You are currently viewing হজ্জ , হজ্জের ফরজ কয়টি , হজ্জের নিয়ম পর্ব-০১
হজ্জ

হজ্জ , হজ্জের ফরজ কয়টি , হজ্জের নিয়ম পর্ব-০১

হজ্জ পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ । আর্থিক সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হজ্জ পালন করা ফরজ। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে কয়েক লক্ষ মুসলমান হজ্জ করতে যেয়ে থাকেন । আপনি যদি তাদের একজন হয়ে থাকেন তাহলে এই আর্টিকেল আপনাকে একটি পরিপূর্ণ গাইডলাইন দিবে। তাছাড়া প্রতিটি মুসলমানের জানা উচিত হজ্জের নিয়ম, হজ্জের ফরজ, ওয়াজিব, সন্নাত সম্পর্কে। পঠকের সুবিধার্থে  এই আর্টিকেল তিনটি পর্বে পোস্ট করা হয়েছে । হজ্জ বিষয়ে এ টু জেড বর্ণনা করা হয়েছে।

হজ্জ-এর সংজ্ঞা

হজ্জ এর আভিধানিক অর্থ : সংকল্প করা । পারিভাষিক অর্থ : নির্দিষ্ট দিনে শরীয়তের বিধান অনুসারে বায়তুল্লাহ্ শরীফে গিয়ে সুনির্দিষ্ট স্থানসমূহের যিয়ারত করাকে হজ্জ বলে ।

হজ্জ ও উমরাহ্-এর সময়কাল

হজ্জ-এর জন্য নির্দিষ্ট সময়কাল হল শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত । এ মাসগুলির মধ্যেই যে কোন সময় হজ্জ এর  ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ্ শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হয়।

৯ই যিলহজ্জ তারিখে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হতে হয়। পক্ষান্তরে, উমরাহ্ করা সুন্নত এবং বছরের যে কোন সময় তা করা যায় । – সায়্যিদ সাবিক্ক, ফিকহুস সুন্নাহ (কায়রো, দারুল — ফাতহ লিল-ইলমিল আরাবী, সংস্করণ, ৫ম ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ১/৪৬২, ৫৪০

হজ্জ কবুলের শর্ত

যে কোন আমলে সালেহ বা নেক আমল আল্লাহ্ তা’আলার নিকট কবূল হওয়ার জন্য প্রধানত দু’টি শর্ত রয়েছে–

১. আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালীন মুক্তির স্বার্থে খালেস অন্তরে আমল করা ।

২. রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করে আমল করা ।

হজ্জ-এর জন্য উল্লিখিত দু’টি শর্তের সাথে আরও ১টি শর্ত হচ্ছে–

মাল বা অর্থ হালাল ও বৈধ হওয়া । কারণ, হারাম মাল দিয়ে ইবাদত করলে আল্লাহ্র নিকট তা গ্রহণযোগ্য হবে না। হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ । তাই যারা হজ্জ করতে যাবেন তাদের উদ্দেশ্য ও নিয়ত যেন একমাত্র আল্লাহকে খুশী করা ও তার নৈকট্য লাভ করার জন্য হয় ।

তাহলে তিনি নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় হজ্জ থেকে ফিরে আসবেন এবং তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে । কিন্তু নিয়ত ঠিক না হলে তার হজ্জ ও উমরাহ্ আদায়ের কোন সওয়াব হবে না; বরং এর জন্য তাকে গুনাগার হতে হবে ।

নবী করীম (সাঃ) যেভাবে হজ্জ ও উমরাহ্ আদায় করতে বলেছেন, সেভাবে আমাদেরকেও আদায় করতে হবে, কম-বেশী করা যাবে না, তার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করতে হবে। তাই নবী করীম (সাঃ) বলেছেন ঃ

“তোমরা আমার কাছ থেকে হজ্জ সম্পর্কে জেনে নাও ।”–বায়হাকী, হা/৯৩০৭, সহীহুল জামে’, হা/৭৮৮২

আরও পড়তে পারেন– রোজার নিয়ত, ইফতারের নিয়ত, রোজা ভঙ্গের কারণ, রোজার গান, কবিতা

অনেক হজ্জ আদায়কারী নবী করীম (সাঃ)-এর দেয়া হজ্জ-এর নিয়মের বিপরীত আমল করে থাকেন । যেমন- ৯ম তারিখে আরাফাতের ময়দানে তাবুতে যোহর-আসর এর নামায কসর ও জমা’ করেন না । অনুরূপভাবে, মীনায় যোহর, আসর ও এশার ফরয নামাযগুলো কসর করেন। না এবং সন্দেহ করে হজ্জ-এর শেষে কাফফারা আদায় করেন ইত্যাদি ।

নবী করীম (সাঃ)-এর নিয়মের বিপরীত কোন আমলই আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না । নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেন :

مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدُّ

“যে ব্যক্তি এমন আমল করল যা তাকে আদেশ করা হয় নি, সে আমল প্রত্যাখ্যাত ।”

–বুখারী ও মুসলিম

আরও পড়ুন–তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত, সময়, দোয়ার গুরুত্ব ও ফজিলত

হজ্জ , হজ্জের ফরজ কয়টি , হজ্জের নিয়ম পর্ব-০১

হজ্জ-এর গুরুত্ব ও হুকুম

নিরাপদ ও সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মু’মিনের জন্য জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন –

وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً

“মানুষের উপর আল্লাহ্র জন্য এ ঘরের হজ্জ করা ফরয, যার সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রয়েছে ।”

–সূরা আলে-ইমরান-৯৭

তিনি আরও বলেন ঃ

وَأَتِمُّواْ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ

“আর তোমরা পূর্ণ কর হজ্জ ও উমরাহ্ আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে ।”–সূরা বাক্বারাহ-১৯৬

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন :

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ فَرَضَ عَلَيْكُمُ الْحَجَّ فَحَجُّوا

“হে মানবমন্ডলী ! আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের উপর হজ্জ ফরয করে দিয়েছেন । অতএব তোমরা

হজ্জ পালন কর ।”–মুসলিম

যার উপর হজ্জ ফরয তার উপর উমরাহ্ ওয়াজিব । –বায়হাকী, ৪/৩৫০, বুখারী ফতহুল বারীসহ,

একাধিকবার হজ্জ বা উমরাহ্ করা নফল বা ইচ্ছাধীন তথা অতিরিক্ত বিষয় । –আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্, মিশকাত, হা/২৫২০

৯ম অথবা ১০ম হিজরীতে হজ্জ ফরয হয় । ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) এ মতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন । তবে জমহুর আলেমগণের মতে ৬ষ্ঠ হিজরীতে হজ্জ-এর হুকুম নাযিল হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ১০ম হিজরীতে জীবনে একবারই স্বপরিবারে হজ্জ আদায় করেন ।

–ফিক্‌হুস সুন্নাহ্, ১ম খ-, পৃঃ ৪৪৪

আর তিনি জীবনে মোট ৪ বার উমরাহ্ পালন করেন ।–বুখারী ফতহুল বারীসহ, হা/১৭৭৫-৭৮

আদায় করা হয় । এছাড়াও, হজ্জ থেকে ফিরে আসার পরে আমল-আখলাক পূর্বের চেয়ে উত্তম হওয়া এবং পূর্বের গুনাহে পুনরায় লিপ্ত না হওয়া ইত্যাদি কবূল হজ্জ-এর বাহ্যিক নিদর্শন ।

৩। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এরশাদ করেন, “ইসলাম, হিজরত ও হজ্জ ব্যক্তির বিগত দিনের সকল গুনাহ্ শেষ করে দেয়।” –মুসলিম, মিশকাত, হা/২৮

৪। তিনি আরও বলেন, “তোমরা হজ্জ ও উমরার মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখ (অর্থাৎ সাথে সাথে কর) । কেননা, এ দু’টি মু’মিনের অভাব ও গুনাহ্সমূহ দূর করে, যেমন স্বর্ণকারের আগুনের হাপর লোহা, ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে দেয় ।” স্বর্ণ –সুনানে নাসায়ী, হা/২৪৬৮, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, মিশকাত, হা/২৫২৪

৫। তিনি আরও বলেন, “তিনটি সম্প্রদায়

আল্লাহর মেহমান :

(১) আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধকারী,

(২) হজ্জ আদায়কারী ও

(৩) উমরাহ্ পালনকারী ।” –নাসায়ী, মিশকাত, হা/২৫৩৭

৬। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “শ্রেষ্ঠ দু’আ হল আরাফার দিনের দু’আ।”–তিরমিযী, মুআত্তা, সিলসিলাহ্ সহীহাহ্, হা/১৫০৩ ৭ ।

তিনি আরও বলেন, “আরাফাতের দিন ব্যতীত অন্য কোন দিন আল্লাহ্ তা’আলা এত অধিক পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন না । ঐ দিন আল্লাহ্ তা’আলা তাদের অধিক নিকটবর্তী হন । অতঃপর আরাফাতের ময়দানের হাজীদের নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন ও বলেন–দেখ, তারা কী চায় ?” (তারা যা চায়, আমি তাদেরকে তা-ই দেব।) –মুসলিম, মিশকাত, হা/২৫৯৪

৮। অন্য বর্ণনায় রাসূল (সাঃ) বলেন, “ওরা আল্লাহ্র মেহমান। তিনি তাদের ডেকেছেন, তাই তারা এসেছেন । এখন তারা যা প্রার্থনা করবেন আল্লাহ্ তা’আলা তা-ই দিয়ে দিবেন –ইবনে মাজাহ্, হা/২৩৩৯, সিলসিলাহ সহীহাহ্, হা/১৮২০

৯। রাসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করবে, তার সমস্ত গুনাহ্ ঝরে পড়বে।” –সহীহ ইবনে খুযায়মা, হা/২৭২৯, নাসায়ী, হা/২৭৩২

১০। তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ্ শরীফের সাতটি তাওয়াফ করবে ও শেষে দু’রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে যেন একটি গোলাম আযাদ করল । এ সময় প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে একটি করে গুনাহ্ ঝরে পড়ে ও একটি নেকী লেখা হয় ।”

–তিরমিযী, মিশকাত, হা/২৫৮০

১১ । তিনি আরও বলেন, “তাওয়াফ হল সালাতের ন্যায়। এ সময় কোন কথা বলা যাবে না, নেকীর কথা ব্যতীত ।” –তিরমিযী, নাসায়ী, মিশকাত, হা/২৫৭৬ ও হা/১১০২

হজ্জ না করার পরিণতি

হযরত আবু উমামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি কঠিন অপারগতা বা অত্যাচারী শাসক বা অসুস্থতা অন্তরায় না হওয়া সত্ত্বেও হজ্জ না করে মৃত্যুবরণ করল, সে চাই ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করুক বা খ্রীস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক ।”–দারেমী

আল্লাহ্ মাফ করুন, কত কঠিন হুমকি! বুঝা গেল, যাদের উপর হজ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও শরীয়ত স্বীকৃত কোন ওযর ছাড়া হজ্জ ত্যাগ করে, তাদের ঈমানহারা হয়ে মৃত্যুবরণ করার আশঙ্কা রয়েছে ।

কা’বা শরীফে নামাযের ফযীলত

عَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَلف صَلاةٍ فِيْمَا سِوَاهُ إِلا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ، وَصَلَاةٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلاةٍ فيمَا سِوَاهُ أحمد وابن ماجة

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এরশাদ করেন, “অন্যত্র নামায আদায়ের চেয়ে আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) নামায আদায় করা এক হাজার গুণ উত্তম এবং মসজিদুল হারামে (কা’বা শরীফে) নামায আদায় করা অন্যত্র নামায আদায়ের চেয়ে এক লক্ষ গুণ উত্তম।”

–আমাদ, ইবনে মাজাহ্, ইরওয়াউল গালীল, হা/১১২৯

হজ্জ-এর প্রকারভেদ

হজ্জ তিন প্রকার ; যথা — ;

১. ইফরাদ,

২. তামাত্তু’ ও

৩. কিরান ।

হজ্জে ইফরাদ ঃ হজ্জ-এর সময় মীক্বাত থেকে শুধু হজ্জ-এর ইহ্রাম বেঁধে হজ্জ করাকে হজ্জে ইফরাদ বলে ।

হজ্জে তামাত্তু’ : হজ্জ-এর মৌসুমে মীক্বাত থেকে শুধু উমরাহ্-এর জন্য ইহ্রাম বেঁধে উমরাহ্ পালন করে হালাল হওয়ার পর হজ্জ-এর সময় পুনরায় হজ্জ-এর উদ্দেশ্যে ইহরাম বেঁধে হজ্জ আদায় করাকে হজ্জে তামাত্তু’ বলে ।

হজ্জে ক্বিরান : মীক্বাত থেকে হজ্জ ও উমরাহ্ এর জন্য একত্রে ইরাম বেঁধে প্রথমে উমরাহ্ পালন করে হালাল না হয়ে ঐ ইরাম দ্বারাই পুনরায় হজ্জ আদায় করাকে হজ্জে কিরান বলে ।

বাংলাদেশীদের জন্য কোন হজ্জ উত্তম

বাংলাদেশীদের জন্য তামাত্তু’ হজ্জ পালন করাই উত্তম । কারণ–

১. এমতাবস্থায় উমরাহ্ ও হজ্জ দু’টোই পালিত হয় ।

২. আদায় করার ক্ষেত্রে এটি সহজ। কারণ, মক্কা শরীফ পৌঁছে উমরাহ্ আদায় করে ইহ্রাম খুলে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা যায়। অতঃপর যথাসময়ে আবার ইহ্রাম বাঁধতে হয় । ৩. ইহ্রাম অবস্থায় হজ্জে কিরানের তুলনায় অল্প সময় থাকতে হয় বিধায় ইহ্রাম সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতির সম্ভাবনা কম থাকে ।

তবে ইহরামের সময়সীমা যদি সংক্ষিপ্ত হয়, যেমন কেউ যদি যিলহজ্জ মাসে মক্কা শরীফে যান, তাহলে সেক্ষেত্রে তার জন্য ক্বিরান হজ্জ আদায় করাই উত্তম ।

আর যারা বদলী হজ্জ করবেন, তারা হজ্জে তামাত্তু’ আদায় করতে পারবেন না । এমন কি, যিনি হজ্জ করাচ্ছেন, তার অনুমতি ব্যতীত হজ্জে কিরানও করতে পারবেন না । শুধু ইফরাদ হজ্জ আদায় করতে পারবেন । বদলী হজ্জ আদায়কারী যদি হজ্জে তামাত্তু’ করেন, তবে যিনি হজ্জ করাচ্ছেন, তার অনুমতি থাকলেও তার হজ্জ আদায় হবে না

হজ্জের ফরজ কয়টি

১) ইহরাম বাঁধা। ২) উকুফে আরাফা (বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা)। ৩) তাওয়াফে জিয়ারত বা কাবাঘর তাওয়াফ।

হজ্জ-এর আরকান (ফরযসমূহ)

হজ্জ-এর আরকান (ফরয) তিনটি; যথা–

১ইহরাম.  বাঁধা । হজ্জ-এর নিয়তে ইরামের দু’টি কাপড় পরিধান করে তাবিয়াহ্ পাঠ করা ।

২. উকূফে আরাফাহ্ তথা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা (অর্থাৎ, ৯ই যিলহজ্জ দুপুরে সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে ১০ই যিলহজ্জ সুহে সাদিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সামান্য সময়ের জন্য হলেও) ।

৩. তাওয়াফে ইফাযাহ্ (তাওয়াফে যিয়ারত) করা, অর্থাৎ, ১০ই যিলহজ্জ পবিত্র কা’বা ঘর তাওয়াফ করা ।

হজ্জ-এর এই তিনটি ফরযের কোন একটিও যদি আদায় না করা হয়, তবে হজ্জ আদায় হবে না । দম বা কুরবানী দ্বারাও এর ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয় । পুনরায় আদায় করতে হবে ।

হজ্জ-এর ওয়াজিবসমূহ

হজ্জ-এর ওয়াজিব ৭টি; যথা–

১. মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধা ।

২. আরাফাহ্ থেকে ফেরার পথে রাতে মুয্দালিফায় অবস্থান করা এবং মাগরিব ও এশা একসঙ্গে আদায় করা ।

৩. সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ৭ (সাত) বার সা‘য়ী করা (দৌড়ানো) ।

৪. মীনায় নির্দিষ্ট স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করা (১০ থেকে ১৩ ই যিলহজ্জ পর্যন্ত) ।

৫. মাথার চুল মুন্ডানো অথবা খাটো করা (মেয়েদের চুলের অগ্রভাগ কাটা) ।

৬. বিদায়ী তাওয়াফ করা (যারা মক্কাবাসী নন) ।

৭. তামাত্তু’ ও ক্বিরান হজ্জ আদায়কারীগণের জন্য কুরবানী করা ।

হজ্জের ওয়াজিবসমূহের কোনটি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা ভুলবশত ছুটে যায় তবে হজ্জ আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু এর জন্য ক্ষতিপূরণ (দম) ওয়াজিব হবে । তবে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ওয়াজিব আদায় না করা অন্যায় । অবশ্য কোন কাজ যদি গ্রহণযোগ্য কোন ওযরবশত বাদ পড়ে থাকে, তাহলে ক্ষতিপূরণ ওয়াজিব হবে না ।

হজ্জ-এর সুন্নতসমূহ

হজ্জ-এর অনেকগুলি সুন্নত রয়েছে। নিম্নে এর কয়েকটি বর্ণনা করা হলো :

১. মীক্বাত (মক্কা)-এর বাহির থেকে আগত হজ্জে ইফ্রাদ ও হজ্জে ক্বিরান আদায়কারীগণের তাওয়াফে কুদূম করা ।

২. তাওয়াফে কুদূমে রমল ও ইযতিবা’ করা । (যদি তাওয়াফে কুদূমের পর সা’য়ী করা হয় ।)

৩. ৮ই যিলহজ্জ সকালে মীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ও রাত যাপন করা ।

৪.৯ই যিলহজ্জ সূর্যোদয়ের পর মীনা থেকে আরাফার ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া ।

৫. আরাফাতের ময়দান থেকে (৯ই যিলহজ্জ) সূর্যাস্তের পর হজ্জের ইমামের রওয়ানা হওয়ার পর রওয়ানা হওয়া ।

৭. মীনায় অবস্থানের দিনসমূহে (১০, ১১ ও ১২ই যিলহজ্জ) মীনায় রাত যাপন করা ।

৮. মীনা থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ‘মুহাসাব’ নামক স্থানে অতি অল্প সময়ের জন্য হলেও যাত্রা বিরতি করা ।

হজ্জের এ সুন্নতসমূহ আদায় করলে অনেক সওয়াব পাওয়া যায় তবে ছেড়ে দিলে দম (কুরবানী) ওয়াজিব হয় না ।

মীক্বাত সর্বমোট পাঁচটি । যথা– ১. মদীনাবাসীদের জন্য ‘যুলহুলাইফাহ্’, ২. নাজদবাসীদের জন্য ‘করনুল মানাযিল’, ৩. সিরিয়াবাসীদের জন্য ‘জুহফা’, ৪. ইরাকবাসীদের জন্য যাতু ‘ইরক’ ও

৫. বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ইয়েমেন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও চীন প্রভৃতি দেশসমূহের মীক্বাত হল ‘ইয়ালামলাম’ পাহাড়। বাংলাদেশসহ ৫ নম্বরে বর্ণিত সব দেশের হজ্জ ও উমরাহ্ পালনকারীগণকে জেদ্দা বন্দর থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত এ পাহাড় অতিক্রম করার পূর্বেই ইহ্রাম বাঁধতে হবে ।

নৌযানে হজ্জ ও উমরাহ্ পালনকারীগণকে ঐ স্থানে পৌছার পূর্বেই সংকেত দেয়া হয়। বিমানেও অনেক সময় বলে দেয়া হয় । তবে বিমানযাত্রীদের জন্য ইরামের সর্বশেষ স্থান নির্ধারণ করা দুষ্কর, তদুপরি সময়ও সংক্ষিপ্ত, এজন্য বিমানে আরোহণের পূর্বেই ইহরাম বাঁধা তাদের জন্য আবশ্যক। জেদ্দায় অবতরণের পরে ইহ্রাম বাঁধলে গোনাহগার হতে হবে এবং কাফফারাস্বরূপ একটি ‘দম’-ও দিতে হবে । ২৯

যেহেতু মদীনা শরীফের দিক থেকে আগত হজ্জ এবং উমরাহ্ পালনকারীগণের মীক্বাত হল ‘যুলহুলাইফাহ্’, সেহেতু হজ্জের আগে বা পরে যদি কেউ মদীনা শরীফ গিয়ে আবার মক্কা শরীফ এসে হজ্জ বা উমরাহ্ করতে চান, তাকে মদীনা শরীফ থেকে ৬ মাইল দূরবর্তী ‘যুল্হুলাইফাহ্ নামক স্থানে অবশ্যই ইহ্রাম বাঁধতে হবে । সেখানে বিশাল আকারের এক মনোরম মসজিদ আছে, যেখানে অযূ-গোসলসহ ইহ্রাম সংক্রান্ত কার্যাদি সমাধার যাবতীয় সুব্যবস্থা আছে ।

ইহ্রাম ব্যতীত যদি কেউ মীক্বাত অতিক্রম করেন, তবে তিনি গুনাগার হবেন এবং তার ওপর দম (কুরবানী) ওয়াজিব হবে ।

ইহরাম কী

ইহ্রাম হল হজ্জ অথবা উমরাহ্ কিংবা উভয়টির জন্য নিয়ত করা । কোন ব্যক্তি ইহরাম সংক্রান্ত কার্যাবলী আরম্ভ করলে (ইরামকারী) বলে গণ্য হবেন । তিনি মুহরিম

ইহরাম বাঁধার নিয়ম

১। ইহরাম বাঁধার পূর্বে নখ কাটা, গোঁফ কাটা বগলের লোম, নাভীর নীচের লোম পরিষ্কার করা, ওজু বা গোসল করা, তবে গোসল করাই উত্তম । মহিলাগণ নাপাক (হায়েয-নেফাস) অবস্থাতেও গোসল করে

ইহ্রাম বাঁধতে পারবেন ।

২। পুরুষগণ সাদা সেলাইবিহীন লুঙ্গী ও চাদর পরিধান করবেন । কিন্তু মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন পোশাক নেই । যে কোন ধরনের শালীন ও মার্জিত পোশাক পরিধান করবেন। তারা সেলাইকৃত কাপড়ও পরতে পারবেন ।

৩। সুগন্ধি ব্যবহার করা। ইরামের সংকল্প করার পূর্বে পুরুষগণ সুগন্ধি ব্যবহার করবেন। কিন্ত মহিলাদের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার নিষেধ । যে কোন ফরয বা নফল নামাযের পরে ইহরাম বাঁধতে পারেন । তবে ইহ্রাম বাঁধার জন্য নামায পড়া কোন শর্ত নয় । নির্দিষ্ট মীক্বাত থেকে ইহ্রাম বাঁধা সম্ভব না হলে বাড়ী থেকে বা বিমানে উঠার পরও ইহ্রাম বাঁধতে পারেন ।

ইহরাম-এর তাৎপর্য

সেলাইবিহীন লুঙ্গী ও চাদর পরিধানের মাধ্যমে ইহ্রাম বাঁধার তাৎপর্য এই যে, এতকাল আপনি যাই ছিলেন না কেন, এখন আপনাকে ফকিরের বেশে আল্লাহ্ তা’আলার সামনে হাযির হতে হবে । রঙিন কিংবা জাঁকজমকপূর্ণ সকল পোশাক খুলে রেখে সাদা পোশাক পরিধান, মোজা ছাড়া কেবল জুতা পরা, কোন ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার না করা, চুল না কাটা, যৌন উত্তেজক কাজ ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা, শিকার না করা বা শিকার কার্যে সাহায্য না করা ইত্যাদির মাধ্যমে কেবল

বাহ্যিক ফকির-ই নয়; অন্তরেও তাকওয়া ও ফকির

হওয়ার সবক নিতে হবে । বস্তুত সারা দুনিয়ার সকল মানুষ এ জাতীয় সাধারণ পোশাক পরিধান করে এ বিশ্ব সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ভাষা, জাতি, দেশ, বংশ ও গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য চূর্ণ করার এক মহান শিক্ষা লাভ করেন । গর্ব-অহংকারের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করার এ এক বিরাট হাতিয়ার ।

 ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ

ইহ্রাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক । ইহ্রাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ নিম্নরূপ ঃ

১. ঝগড়া-ফাসাদ, মারামারি বা গালাগালি করা । ২. পুরুষের জন্য সেলাইযুক্ত কাপড় পরিধান করা । (তবে মহিলারা অন্যান্য সময়ের মত সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করতে পারবেন ।)

৩. নখ কাঁটা, চুল কাঁটা ও পশম উপড়ানো (তা শরীরের যে কোন স্থানের হোক না কেন)।

৪. শরীরে বা কাপড়ে যে কোন ধরনের সুগন্ধি লাগানো বা ব্যবহার করা অথবা এমন রঙ করা কাপড় পরিধান করা, যে রঙের সুগন্ধি আছে ।

৫. সহবাস করা বা সহবাসের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, এমন কোন কাজ করা বা কথা বলা ।

৬. বিয়ে করা ।

৭. স্থলচর প্রাণী বা পশু-পাখি ইত্যাদি হত্যা করা বা তাতে সহযোগিতা করা ।

৮. মুর্রিম ব্যক্তির জন্য নিজের শিকারকৃত (নিজে শিকার করুক বা তার সহযোগিতায় শিকার করা হোক) প্রাণীর গোশ্ত আহার করা ।

৯. পুরুষদের জন্য মাথা পুরোপুরি বা আংশিক ঢেকে ফেলা (পাগড়ি বা টুপি দিয়ে হলেও) । মহিলাদের জন্য মাথা ঢেকে রাখা নিষিদ্ধ নয়; বরং তাদেরকে মাথা ঢেকে রাখতে হবে । তারা ইহরাম অবস্থায় মুখমন্ডল খোলা রাখবেন, তবে পর পুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব।

১০. মোজা পরিধান করা ।

–বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ ও অন্যান্য মুরিমের জন্য ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে শুধু স্ত্রী সহবাস করলেই ইহ্রাম বাতিল বলে গণ্য হবে । অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজগুলোর কোন একটি কাজ যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে করে ফেলে, তাহলে তার ইহ্রাম বাতিল হবে না; ফিদ্‌ইয়া বা ক্ষতিপূরণ দিলেই চলবে । ফিদ্‌ইয়া হচ্ছে-একটি বক্রী বা দুম্বা কুরবানী করা অথবা ছয়জন মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা তিন দিন রোযা

রাখা । যেমন আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন– فَفِدْيَةٌ مِّن صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكِ

“তার ফিদ্‌ইয়া বা কাফফারা হচ্ছে, সে রোযা রাখবে কিংবা সদকাহ্ করবে কিংবা কুরবানী

করবে ।–সূরা বাক্বারাহ-১৯৬

ইাম-এর অন্যান্য মাসায়েল

১. নিয়ত ও তাবিয়াহ্ পাঠের পূর্বে গোসল করে দু’রাক্‘আত নামায পড়া সুন্নত । তবে গোসল ও দু’রাআত নামায আদায় ছাড়াও ইহ্রাম বাঁধা যায় ।

২. ইহ্রাম অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে তাতে ইরামের কোন ক্ষতি হয় না। কাপড় ও শরীর ধুয়ে গোসল করে নিতে হবে। ইরামের চাদর পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে অন্য চাদর পরিধান করে নিতে হবে ।

৩. ইহ্রাম অবস্থায় ইনজেকশন ও টীকা নেয়া জায়েয ।

৪. ইহ্রাম অবস্থায় আয়নায় চেহারা দেখা জায়েয ।

৫. ইহ্রাম অবস্থায় মেওয়াক করা অন্যান্য সময়ের ন্যায় সুন্নত ।

৬. ইহ্রাম অবস্থায় সাপ, বিচ্ছু, ছারপোকা, মশা, ভিমরুলের মত ক্ষতিকর প্রাণী মেরে ফেলা জায়েয ।

৭. ইহ্রাম অবস্থায় গোসল করা বৈধ তবে শরীরের ময়লা দূর করা ও খুশু-সাবান ব্যবহার করা যাবে না ।

তাবিয়াহ্

لَبَّيْكَ اللهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لا شَرِيكَ لَكَ উচ্চারণঃ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক । লাব্বাইকা লা-শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক । লা-শারীকা লাক । অর্থ : হে আল্লাহ্! আমি তোমার ডাকে হাযির, আমি তোমার দরবারে উপস্থিত। আমি তোমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি, তোমার কোন অংশীদার নেই । আমি তোমার দরবারে হাযির । নিঃসন্দেহে সকল প্রশংসা ও অনুগ্রহ তোমার, সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র আধিপত্য তোমার । তোমার নেই কোন অংশীদার ।

–বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা/২৫৪১ হাদীস শরীফে উল্লিখিত তাবিয়ার অনেক ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে । তাই হজ্জের যাবতীয় কাজ আদায় অবস্থায় এ তাবিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে

বেশী বেশী পড়ার চেষ্টা করবেন। উল্লেখ্য যে, পুরুষগণ এ তাবিয়াহ্ স্বশব্দে আর মহিলাগণ নিঃশব্দে পড়বেন ।

ব্যাংকিং বিষয়ে জানতে এখানে ক্লিক করুন