যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি সম্পদকে পবিত্র করে এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে। যাকাত শব্দের অর্থ কি, যাকাতের হিসাব , কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ , কত ভরি স্বর্ণ থাকলে যাকাত দিতে হয় , যাকাতের খাত , বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়, যাকাত দেওয়ার নিয়ম , ১ লাখ টাকায় যাকাত কত , যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি , যাকাত কাদের উপর ফরজ, যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ইত্যাদি সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়া হলো।
যাকাত শব্দের অর্থ কি
আরবি শব্দ “যাকাত” (زكاة) এর আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্রতা, বৃদ্ধি, পরিশুদ্ধি ও উন্নতি। ইসলামী পরিভাষায়, যাকাত হলো আল্লাহর নির্দেশিত একটি আর্থিক ইবাদত, যা সম্পদশালী মুসলিমদের উপর ফরজ করা হয়েছে। এটি সম্পদকে পবিত্র করে এবং গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
যাকাতের হিসাব
যাকাত প্রদানের জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার উপর যাকাত দিতে হয়। নিম্নে যাকাতের হিসাব দেওয়া হলো:
১. নিসাব পরিমাণ সম্পদ:
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নিসাব (নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ) পূরণ করতে হবে। নিসাবের পরিমাণ হলো:
- স্বর্ণ: ৭.৫ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম)।
- রৌপ্য: ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম)।
- নগদ টাকা বা ব্যবসায়িক পণ্য: স্বর্ণ বা রৌপ্যের বর্তমান বাজারমূল্যের সমপরিমাণ টাকা বা সম্পদ।
২. যাকাতের হার:
যাকাতের হার হলো সম্পদের ২.৫% (এক চল্লিশ ভাগের এক ভাগ)।
৩. হিসাবের পদ্ধতি:
- সম্পদের মোট পরিমাণ নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করলে এবং এক বছর (হিজরি বছর) সম্পদ আপনার মালিকানায় থাকলে তার উপর যাকাত দিতে হবে।
- যাকাতের পরিমাণ = (মোট সম্পদ × ২.৫%) বা (মোট সম্পদ ÷ ৪০)।
উদাহরণ:
যদি কারো কাছে ১,০০,০০০ টাকা নগদ থাকে এবং এটি নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করে, তবে যাকাতের পরিমাণ হবে:
১,০০,০০০×২.৫%=২,৫০০ টাকা১,০০,০০০×২.৫%=২,৫০০ টাকা
অথবা,
১,০০,০০০÷৪০=২,৫০০ টাকা১,০০,০০০÷৪০=২,৫০০ টাকা
আরো পড়তে পারেন– সূরা বাকারা সম্পর্কে ২০টি কুইজ প্রশ্ন এবং MCQ সহ বিস্তারিত
কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু সম্পদ শর্ত পূরণ করতে হয়। নিম্নে যেসব সম্পদের উপর যাকাত ফরজ তা উল্লেখ করা হলো:
১. নগদ টাকা ও ব্যাংক ব্যালেন্স:
- নগদ টাকা, ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ, ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয় ইত্যাদির উপর যাকাত ফরজ।
- শর্ত হলো, এই অর্থ নিসাব পরিমাণ (স্বর্ণ বা রৌপ্যের সমমূল্যের) অতিক্রম করলে এবং এক বছর পূর্ণ হলে তার উপর যাকাত দিতে হবে।
২. স্বর্ণ ও রৌপ্য:
- স্বর্ণ: ৭.৫ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম) বা তার বেশি থাকলে যাকাত ফরজ।
- রৌপ্য: ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম) বা তার বেশি থাকলে যাকাত ফরজ।
- গহনা, বার, বা অন্য কোনো রূপে স্বর্ণ ও রৌপ্য থাকলেও যাকাত দিতে হবে (মাজহাবভেদে গহনার যাকাত নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে)।
৩. ব্যবসায়িক পণ্য:
- ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পণ্য বা মালামালের উপর যাকাত ফরজ।
- পণ্যের বাজারমূল্য নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করলে এবং এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিতে হবে।
৪. কৃষি উৎপাদন (উশর):
- কৃষিজাত ফসলের উপর যাকাত ফরজ, যা “উশর” নামে পরিচিত।
- সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের ৫% এবং বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত ফসলের ১০% উশর হিসেবে দিতে হবে।
- নিসাব পরিমাণ হলো ৫ ওয়াস্ক (প্রায় ৬৫৩ কেজি)।
৫. পশুসম্পদ:
- নির্দিষ্ট সংখ্যক গবাদি পশু (গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, উট ইত্যাদি) থাকলে যাকাত ফরজ।
- উদাহরণস্বরূপ:
- উট: ৫টি উট থাকলে ১টি ভেড়া যাকাত দিতে হবে।
- গরু/মহিষ: ৩০টি গরু থাকলে ১টি এক বছর বয়সী বাছুর যাকাত দিতে হবে।
- ভেড়া/ছাগল: ৪০টি ভেড়া বা ছাগল থাকলে ১টি যাকাত দিতে হবে।
৬. বিনিয়োগ ও শেয়ার:
- শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকৃত অর্থ, স্টক, বা মিউচুয়াল ফান্ডের উপর যাকাত ফরজ।
- বিনিয়োগের মূল্য নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করলে এবং এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিতে হবে।
৭. প্রাপ্য ঋণ:
- যদি কারো কাছে প্রাপ্য ঋণ বা দেনাদার থেকে ফেরত পাওয়ার আশা থাকে, তবে সেই ঋণের টাকার উপরও যাকাত ফরজ।
- তবে ঋণ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকলে যাকাত দিতে হবে না।
যেসব সম্পদের উপর যাকাত ফরজ নয়:
১. ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র (যেমন: গাড়ি, জমি, বাড়ি, পোশাক ইত্যাদি)।
২. প্রফেশনাল সরঞ্জাম (যেমন: ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের যন্ত্রপাতি)।
৩. প্রাথমিক প্রয়োজনীয় সম্পদ (যেমন: বসবাসের বাড়ি, প্রয়োজনীয় গাড়ি)।
৪. যেসব সম্পদ বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে নয় (যেমন: উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ)।
আরও পড়ুন– ঈদুল ফিতরের দিন করণীয় ও বর্জনীয়
কত ভরি স্বর্ণ থাকলে যাকাত দিতে হয়
স্বর্ণের উপর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ (নিসাব) অতিক্রম করতে হয়। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী:
স্বর্ণের নিসাব পরিমাণ:
- ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা তার বেশি থাকলে যাকাত ফরজ হয়।
- গ্রামে হিসাব করলে: ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ।
যাকাতের হার:
স্বর্ণের মোট পরিমাণ নিসাব অতিক্রম করলে এবং এক বছর (হিজরি বছর) সম্পদ আপনার মালিকানায় থাকলে তার উপর ২.৫% যাকাত দিতে হবে।
হিসাবের পদ্ধতি:
১. স্বর্ণের মোট পরিমাণ নিসাব (৭.৫ তোলা বা ৮৭.৪৮ গ্রাম) অতিক্রম করলে যাকাত দিতে হবে।
২. যাকাতের পরিমাণ = (মোট স্বর্ণের পরিমাণ × ২.৫%) বা (মোট স্বর্ণের পরিমাণ ÷ ৪০)।
উদাহরণ:
যদি কারো কাছে ১০ তোলা স্বর্ণ থাকে, তবে যাকাতের হিসাব হবে:
- ১০ তোলা = ১১৬.৬৪ গ্রাম (প্রায়)।
- যাকাতের পরিমাণ = ১০×২.৫%=০.২৫১০×২.৫%=০.২৫ তোলা।
অথবা,
১০÷৪০=০.২৫১০÷৪০=০.২৫ তোলা।
গ্রামে হিসাব করলে:
১১৬.৬৪×২.৫%=২.৯১৬১১৬.৬৪×২.৫%=২.৯১৬ গ্রাম।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- শুধু স্বর্ণের গহনা নয়, বার, কয়েন বা অন্য কোনো রূপে স্বর্ণ থাকলেও যাকাত দিতে হবে।
- মাজহাবভেদে গহনার যাকাত নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, গহনার উপরও যাকাত ফরজ। তবে অন্যান্য মাজহাবে শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রাখা স্বর্ণের উপর যাকাত ফরজ বলে বিবেচিত হয়।
আও পড়ুন– বাংলা সাহিত্যে ঈদ ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের অন্তরায়
যাকাতের খাত
যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত, যা নির্দিষ্ট খাতেই ব্যয় করতে হয়। কুরআন ও হাদীসে যাকাত বণ্টনের ৮টি খাত উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো:
কুরআনে উল্লিখিত যাকাতের খাত:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
“যাকাত তো শুধুমাত্র ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী কর্মচারী, যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ, আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬০)
যাকাতের ৮টি খাত:
১. ফকীর (গরীব):
- যাদের আয় আছে কিন্তু তা প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
- তারা যাকাত গ্রহণ করতে পারে তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য।
২. মিসকীন (অতি দরিদ্র):
- যাদের কোনো আয় নেই বা খুবই সামান্য আয় আছে।
- তারা যাকাত গ্রহণ করে তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।
৩. আমিলীন (যাকাত আদায়কারী কর্মচারী):
- যারা যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্বে নিয়োজিত।
- তাদের বেতন বা পারিশ্রমিক যাকাত থেকে দেওয়া হয়।
৪. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব (যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন):
- নতুন মুসলিম বা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তি।
- তাদের সাহায্য করা হয় যাতে তারা ইসলামের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয়।
৫. রিকাব (দাসমুক্তি):
- দাস বা বন্দীদের মুক্ত করার জন্য যাকাত ব্যয় করা হয়।
- বর্তমানে এই খাতের প্রয়োগ সীমিত।
৬. গারিমীন (ঋণগ্রস্ত):
- যারা ঋণে জর্জরিত এবং তা পরিশোধ করতে অক্ষম।
- তাদের ঋণ পরিশোধে সাহায্য করা হয়।
৭. ফী সাবীলিল্লাহ (আল্লাহর পথে):
- ইসলামের প্রচার, জিহাদ বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
- এতে মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলামিক শিক্ষা ও গবেষণা অন্তর্ভুক্ত।
৮. ইবনুস সাবীল (মুসাফির):
- যাত্রী বা মুসাফির যারা পথিমধ্যে অর্থাভাবে পড়েছেন।
- তাদের সাহায্য করা হয় যাতে তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন।
মনে রাখবেন:
- যাকাত শুধুমাত্র উপরোক্ত ৮টি খাতেই ব্যয় করা যায়।
- যাকাতের টাকা পরিবারের সদস্য (যেমন: পিতা-মাতা, সন্তান, স্ত্রী) বা ধনী ব্যক্তিদের দেওয়া যাবে না।
- যাকাত দেওয়ার সময় নিয়ত (ইচ্ছা) বিশুদ্ধ রাখা জরুরি।
যাকাত ইসলামের একটি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করে এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়
বর্তমানে যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিসাব (নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ) নির্ধারণ করা হয় স্বর্ণ বা রৌপ্যের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে। যাকাতের নিসাব হলো ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য। এই পরিমাণের সমমূল্যের টাকা বা সম্পদ থাকলে যাকাত ফরজ হয়।
নিসাবের হিসাব:
১. স্বর্ণের নিসাব:
- ৭.৫ তোলা = ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণ।
- বর্তমানে (২০২৩ সালের হিসাবে) স্বর্ণের বাজারমূল্য প্রতি গ্রাম প্রায় ৭,০০০ টাকা (স্থান ও সময়ভেদে পরিবর্তনশীল)।
- তাহলে, ৮৭.৪৮ গ্রাম স্বর্ণের মূল্য = ৮৭.৪৮×৭,০০০=৬,১২,৩৬০৮৭.৪৮×৭,০০০=৬,১২,৩৬০ টাকা (প্রায়)।
২. রৌপ্যের নিসাব:
- ৫২.৫ তোলা = ৬১২.৩৬ গ্রাম রৌপ্য।
- বর্তমানে রৌপ্যের বাজারমূল্য প্রতি গ্রাম প্রায় ৮০ টাকা (স্থান ও সময়ভেদে পরিবর্তনশীল)।
- তাহলে, ৬১২.৩৬ গ্রাম রৌপ্যের মূল্য = ৬১২.৩৬×৮০=৪৮,৯৮৯৬১২.৩৬×৮০=৪৮,৯৮৯ টাকা (প্রায়)।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত:
১. নিসাব পরিমাণ সম্পদ (স্বর্ণ বা রৌপ্যের সমমূল্যের টাকা বা সম্পদ) থাকতে হবে।
২. এই সম্পদ এক বছর (হিজরি বছর) আপনার মালিকানায় থাকতে হবে।
৩. সম্পদ প্রয়োজনাতিরিক্ত (বাড়তি) হতে হবে, যেমন: নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস (বাসস্থান, গাড়ি, পোশাক ইত্যাদি) যাকাতের নিসাবে গণ্য হয় না।
বর্তমানে যাকাতের নিসাব (২০২৩ সালের হিসাবে):
- স্বর্ণের ভিত্তিতে: প্রায় ৬,১২,৩৬০ টাকা।
- রৌপ্যের ভিত্তিতে: প্রায় ৪৮,৯৮৯ টাকা।
মনে রাখবেন:
- যাকাতের নিসাব হিসাব করার সময় স্বর্ণ বা রৌপ্যের যে কোনো একটির মূল্য বিবেচনা করা যায়। সাধারণত রৌপ্যের মূল্য বিবেচনা করা হয়, কারণ এটি গরীবদের জন্য সহজ।
- স্থান ও সময়ভেদে স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্য পরিবর্তন হয়, তাই যাকাতের নিসাবও পরিবর্তনশীল।
উদাহরণ:
যদি কারো কাছে ৫,০০,০০০ টাকা নগদ থাকে এবং এটি এক বছর তার মালিকানায় থাকে, তবে যাকাত ফরজ হবে। যাকাতের পরিমাণ হবে:
৫,০০,০০০×২.৫%=১২,৫০০ টাকা৫,০০,০০০×২.৫%=১২,৫০০ টাকা
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- যাকাত শুধুমাত্র নগদ টাকার উপর নয়, স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্যবসায়িক পণ্য, বিনিয়োগ ইত্যাদির উপরও ফরজ।
- যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা সম্পদকে পবিত্র করে এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
যাকাত কাকে বলে,
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি একটি আর্থিক ইবাদত, যা সম্পদশালী মুসলিমদের উপর ফরজ (বাধ্যতামূলক) করা হয়েছে। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদকে পবিত্র করা হয় এবং গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করা হয়, যা সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
যাকাতের সংজ্ঞা:
- আরবি অর্থ: “যাকাত” (زكاة) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্রতা, বৃদ্ধি, পরিশুদ্ধি ও উন্নতি।
- ইসলামী পরিভাষায়: যাকাত হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ (নিসাব) থাকলে এবং তা এক বছর মালিকানায় থাকলে তার একটি অংশ (২.৫%) গরীব-দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করা।
যাকাতের উদ্দেশ্য:
১. সম্পদকে পবিত্র করা।
২. গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করা।
৩. সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
৪. আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত:
১. মুসলিম হওয়া।
২. বালিগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়া।
৩. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া।
৪. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা (স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ টাকা, ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদি)।
৫. সম্পদ এক বছর (হিজরি বছর) মালিকানায় থাকা।
৬. সম্পদ প্রয়োজনাতিরিক্ত (বাড়তি) হওয়া।
যাকাতের নিসাব:
- স্বর্ণ: ৭.৫ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম)।
- রৌপ্য: ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম)।
- নগদ টাকা বা ব্যবসায়িক পণ্য: স্বর্ণ বা রৌপ্যের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ টাকা বা সম্পদ।
যাকাতের হার:
যাকাতের হার হলো সম্পদের ২.৫% (এক চল্লিশ ভাগের এক ভাগ)।
যাকাত কাদের উপর ফরজ
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। তবে যাকাত সবার উপর ফরজ নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণকারী মুসলিমদের উপর যাকাত ফরজ হয়। নিম্নে যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলি উল্লেখ করা হলো:
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত:
১. মুসলিম হওয়া:
- যাকাত শুধুমাত্র মুসলিমদের উপর ফরজ। অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরজ নয়।
২. বালিগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়া:
- নাবালক (অপ্রাপ্তবয়স্ক) শিশুর উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া:
- পাগল বা মানসিকভাবে অস্থির ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়। যাকাতের হিসাব
৪. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা:
- নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ (নিসাব) থাকলে যাকাত ফরজ হয়।
- নিসাব হলো:
- স্বর্ণ: ৭.৫ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম)।
- রৌপ্য: ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম)।
- নগদ টাকা বা ব্যবসায়িক পণ্য: স্বর্ণ বা রৌপ্যের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ টাকা বা সম্পদ।
৫. সম্পদ এক বছর মালিকানায় থাকা:
- সম্পদ নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করলে এবং তা এক বছর (হিজরি বছর) আপনার মালিকানায় থাকলে যাকাত দিতে হবে।
৬. সম্পদ প্রয়োজনাতিরিক্ত (বাড়তি) হওয়া:
- নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস (যেমন: বাসস্থান, গাড়ি, পোশাক ইত্যাদি) যাকাতের নিসাবে গণ্য হয় না।
- শুধুমাত্র প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদের উপর যাকাত ফরজ।
যাদের উপর যাকাত ফরজ:
১. স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক:
- ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য বা তার বেশি থাকলে যাকাত ফরজ।
২. নগদ টাকার মালিক:
- নগদ টাকা, ব্যাংক ব্যালেন্স, সঞ্চয় ইত্যাদি নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করলে যাকাত ফরজ। যাকাতের হিসাব
৩. ব্যবসায়িক পণ্যের মালিক:
- ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পণ্য বা মালামালের মূল্য নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করলে যাকাত ফরজ।
৪. কৃষি উৎপাদনের মালিক:
- কৃষিজাত ফসলের পরিমাণ ৫ ওয়াস্ক (প্রায় ৬৫৩ কেজি) অতিক্রম করলে উশর (কৃষি যাকাত) ফরজ।
৫. পশুসম্পদের মালিক:
- নির্দিষ্ট সংখ্যক গবাদি পশু (গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, উট ইত্যাদি) থাকলে যাকাত ফরজ।
৬. বিনিয়োগ ও শেয়ারের মালিক:
- শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকৃত অর্থ, স্টক, বা মিউচুয়াল ফান্ডের মূল্য নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করলে যাকাত ফরজ।
যাদের উপর যাকাত ফরজ নয়:
১. নাবালক (অপ্রাপ্তবয়স্ক) শিশু:
- নাবালক শিশুর সম্পদের উপর যাকাত ফরজ নয়।
২. পাগল বা মানসিকভাবে অস্থির ব্যক্তি:
- তাদের সম্পদের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩. যাদের সম্পদ নিসাব পরিমাণ অতিক্রম করে না:
- সম্পদ নিসাব পরিমাণ অতিক্রম না করলে যাকাত ফরজ নয়।
৪. নিত্যপ্রয়োজনীয় সম্পদের মালিক:
- বাসস্থান, গাড়ি, পোশাক ইত্যাদি প্রয়োজনাতিরিক্ত না হলে যাকাত ফরজ নয়। যাকাতের হিসাব
যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শুধুমাত্র একটি আর্থিক কর্তব্য নয়, বরং এটি ইসলামী সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। নিম্নে যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
যাকাতের গুরুত্ব:
১. ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি:
- যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ। এটি ঈমান, নামাজ, রোজা ও হজ্জের পাশাপাশি একটি ফরজ ইবাদত।
২. আল্লাহর নির্দেশ:
- কুরআন ও হাদীসে বারবার যাকাতের গুরুত্ব ও ফরজিয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো এবং যাকাত দাও।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১১০)
৩. সম্পদকে পবিত্র করে:
- যাকাত সম্পদকে পবিত্র করে এবং এর মধ্যে বরকত দান করে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করো, যাতে তুমি তা দ্বারা তাদের পবিত্র করতে পারো।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৩)
৪. সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা:
- যাকাতের মাধ্যমে ধনী ও গরীবের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন হয়, যা সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমায়।
৫. আত্মার পরিশুদ্ধি:
- যাকাত প্রদানকারীর আত্মা কৃপণতা ও লোভ থেকে মুক্ত হয় এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা বৃদ্ধি পায়।
যাকাতের তাৎপর্য: যাকাতের হিসাব
১. গরীব-দুঃখীদের সাহায্য:
- যাকাতের মাধ্যমে গরীব, অভাবগ্রস্ত ও দুঃখী মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হয়। এটি তাদের জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে।
২. সমাজের সংহতি বৃদ্ধি:
- যাকাত ধনী ও গরীবের মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করে এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করে। এটি সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে।
৩. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি:
- যাকাতের টাকা গরীবদের হাতে পৌঁছলে তা বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
৪. আল্লাহর নৈকট্য অর্জন:
- যাকাত প্রদানকারী আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে এবং আখিরাতে এর জন্য পুরস্কার পাবে।
৫. সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ:
- যাকাতের মাধ্যমে বান্দা এই শিক্ষা পায় যে, সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। মানুষ শুধুমাত্র আমানতদার।
কুরআন ও হাদীসে যাকাতের গুরুত্ব:
১. কুরআনে যাকাত:
- কুরআনে ৩২ বার নামাজের সাথে যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা যাকাতের গুরুত্বকে তুলে ধরে।
- আল্লাহ তাআলা বলেন:
“যারা সদকা (যাকাত) দেয়, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ১৮)
২. হাদীসে যাকাত:
- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি সম্পদের যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার সম্পদ একটি বিষধর সাপের রূপ ধারণ করবে এবং তাকে কামড়াবে।” (সহীহ বুখারী)
যাকাতের সামাজিক প্রভাব: যাকাতের হিসাব
১. দারিদ্র্য বিমোচন:
- যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয় এবং গরীবদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
২. অপরাধ হ্রাস:
- যাকাতের মাধ্যমে গরীবদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করলে সমাজে চুরি, ডাকাতি ও অন্যান্য অপরাধ হ্রাস পায়।
৩. মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা:
- যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি মানবিক মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়।
মনে রাখবেন:
যাকাত শুধুমাত্র একটি আর্থিক কর্তব্য নয়, বরং এটি ইসলামী সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারি।