ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি হলো নামাজ। নামাজকে বলা হয় বেহেন্তের চাবি। দিনে পাাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ তথা বধ্যতামূলক করা হয়েছে। নামাজ আদায়ের পূর্বে অবশ্যই পবিত্রতা অর্জণ করতে হবে। এই জন্য প্রথমে ওযু করতে হবে। আমাদের অনেকেই ওযুর নিয়ম ও দোয়া জানেন না । নামাজের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নত সঠিক ভাবে জানেন না। আশাকরি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে উপকৃত হবেন।
ওযুর নিয়ম ও দোয়া
অজুতে ৪ ফরজ
০১। সমস্ত মুখমণ্ডল উত্তমরূপে ধৌত করা
০২। দুই হাতের কনুই পর্যন্ত উত্তমরূপে ধৌত করা
০৩। মাথা মাছেহ করা
০৪।দুই পায়ের টাখনুসহ উত্তমরূপে ধৌত করা
সূরা মায়িদা
তায়াম্মুমের ফরজ কয়টি
০১। নিয়ত করা
০২। সমস্ত মুখমণ্ডল একবার মাছেহ্ করা
০৩। দুই হাতের কনুইসহ একবার মাছেহ্ করা
সূরা নিসা
নামাজের ফরজ কয়টি
নামাজের বাহিরে ও ভিতরে ১৩ ফরজ
নামাজের বাহিরে ৭ ফরজ
০১। শরীর পাক, ০২। কাপড় পাক ০৩। নামাজের জায়গা পাক, ০৪। ছতর ঢাকা
০৫। কেবলামুখী হওয়া, ০৬। ওয়াক্ত মত নামাজ পড়া
০৭। নামাজের নিয়ত করা
নামাজের ভিতরে ৬ ফরজ
০১। তাকবীর তাহ্রীমা বলা,
০২। দাঁড়াইয়া নামাজ পড়া
০৩। কেরাত পড়া,
০৪। রুকু করা
০৫। দুই সেজদা করা,
০৬। আখেরী বৈঠক
সূরা মায়িদা, বাকারা, নিসা ও বুখারী
গোসলের ৩ ফরজ
০১। কুলি করা, ০২। নাকে পানি দেওয়া
০৩। সমস্ত শরীর উত্তমরূপে ধৌত করা
সূরা মায়িদা
আরও পড়তে পারেন–তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত, সময়, দোয়ার গুরুত্ব ও ফজিলত
নামাজের ফরজ ওয়াজিব কয়টি
নামাজের ওয়াজিব ১৪টি
মাসআলাহ্ ঃ নামাজে ভূলবশতঃ কোন ওয়াজিব ছুটিয়া গেলে
নামাজ শেষে সিজদায়ে সাহু করিলে নামাজ হইয়া যায়। তবে ইচ্ছাকৃত ওয়াজিব তরক করিলে নামাজ পুনরায় পড়িতে হবে।
০১। আলহামদু শরীফ পুরাটা পড়া
০২। আলহামদুর সঙ্গে সূরা মিলানো,
০৩। রুকু সেজদায় দেরি করা
০৪। রুকু হইতে সোজা হইয়া খাড়া হইয়া দেরি করা
০৫। দুই সেজদার মাঝখানে সোজা হইয়া বসিয়া দেরি করা
০৬। দরমিয়ানি বৈঠক,
০৭। উভয় বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়া
০৮। ইমামের জন্য কেরাত আস্তে এবং জোরে পড়া
০৯। বিতরের নামাজে দু’আ কুনূত পড়া
১০। দুই ঈদের নামাজে ছয় ছয় বার তাকবীর বলা
১১। প্রত্যেক ফরজ নামাজের প্রথম দুই রাকাতকে কেরাতের জন্য নির্ধারিত করা
১২। প্রত্যেক রাকাতের ফরজগুলি তারতীব ঠিক রাখা
১৩। প্রত্যেক রাকাতের ওয়াজিবগুলির তারতীব ঠিক রাখা
১৪। আস্সালামু আলাইকুম বলিয়া নামাজ শেষ করা বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ
নামাজে সুন্নতে মুআক্কাদাহ ১২টি
০১। দুই হাত উঠান, ০২। দুই হাত বাঁধন, ০৩। সানা পড়া
০৪। আউযুবিল্লাহ্ পড়া, ০৫। বিসমিল্লাহ্ পড়া,
০৬। আলহামদুর পর আমীন বলা
০৭। প্রত্যেক উঠা বসায় আল্লাহু আকবর বলা
০৮। রুকুর তাসবীহ্ বলা
০৯। রুকু হইতে উঠিবার সময় সামিআল্লাহুলিমান হামিদা রব্বানা লাকাল হামদু বলা,
১০। সেজদার তাসবীহ্ বলা,
১১। দরূদ শরীফ পড়া, ১২। দু’আয়ে মাছুরা পড়া
ওজু ভঙ্গের কারণ ৭টি
০১। পায়খান/প্রসাবের রাস্তা দিয়ে কোন কিছু বাহির হওয়া
০২। মুখ ভরিয়া বমি হওয়া
০৩। শরীরের কোন জায়গা হইতে রক্ত, পুঁজ, পানি বাহির
হইয়া গড়াইয়া পড়া
০৪। থুথুর সঙ্গে রক্তের ভাগ সমান বা বেশি হওয়া
০৫। চিত বা কাত হইয়া হেলান দিয়ে ঘুম যাওয়া
০৬। পাগলা, মাতাল ও অচেতন হইলে
০৭। নামাযে উচ্চস্বরে হাসিলে
নামাজ ভঙ্গের কারণ ১৯টি
০১। নামাজে অশুদ্ধ পড়া, ০২। নামাজের ভিতর কথা বলা
০৩। কোন লোককে সালম দেওয়া
০৪। সালামের উত্তর দেওয়া, ০৫। উহ! আহ্ শব্দ করা
০৬। বিনা অজরে কাঁশি দেওয়া, ০৭। আমলে কাছীর করা ০৮। বিপদে কি বেদনায় শব্দ করিয়া কাঁদা
০৯। তিন তাসবীহ্ পরিমাণ ছতর খুলিয়া থাকা ১০। মুক্তাদী ব্যতিত অপর ব্যক্তির লোকমা নেওয়া
১১। সুসংবাদ ও দুঃসংবাদে উত্তর দেওয়া
১২। নাপাক জায়গায় সেজদা করা, ১৩। হাঁচির উত্তর দেওয়া
১৪। কেবলার দিক হইতে সিনা ঘুরিয়া যাওয়া
১৫। নামাজে কোরআন শরীফ দেখিয়া পড়া
১৬। নামাজে শব্দ করিয়া হাসা, ১৭। নামাজে খাওয়া ও পান করা
১৮। নামাজে দাঁড়াইয়া কোন বিষয় প্রার্থনা করা
১৯। ইমামের আগে মুক্তাদী লোকমা বা কোন কাজ করা
আরও পড়ুন–হজ্জের ফরজ, ওয়াজিব, দোয়া সহ হজ্জ গাইড-পর্ব-০২
ওযুর নিয়ম ও দোয়া
(১) ওযু ফরয কয়টি ও কি কি?
(২) ওযু করার সুন্নতী পদ্ধতি
(৩) ওযু সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়
(৪) ওযু নষ্ট হওয়ার কারণগুলো কি কি?
____________________________________
ওযু ফরয কয়টি ও কি কি
শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ওযুর ফরয হচ্ছে ছয়টিঃ
(১) কুলি করা, নাকে পানি দেয়া ও নাক ঝাড়াসহ সমস্ত মুখমন্ডল ভালোভাবে ধৌত করা।
(২) কনুইসহ দুইহাত ধৌত করা।
(৩) ভেজা হাতে কানসহ মাথা মাসাহ করা।
(৪) টাখনুসহ দুই পা ধৌত করা।
(৫) যে তারতীব বা ধারা্বাহিক নিয়ম বর্ণনা করা হলো (মুখ, হাত, পা, মাথা মাসাহ) এইভাবে করা, আগে বা পরে না করা।
(৬) এগুলো পরপর করা, অর্থাৎ একটা কাজের পরে অন্য আরেকটা কাজ করতে এমন বিরতি না দেয়া যে আগের ধৌত করা অংগ শুকিয়ে যায়।
অনেক প্রশ্ন করেন, এতোদিন শুনে আসলাম ওযুর ফরজ চারটি, আর আজকে আপনি বলছেন ওযুর ফরজ হচ্ছে ছয়টি? আপনার নতুন দুইটা কোথা থেকে বানাইলেন?
ওযুর ফরজ ছয়টি কারণ আল্লাহ বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নামাযের জন্য প্রস্তুত হও, তখন তোমাদের মুখমন্ডল ও দুইহাত কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং তোমাদের মাথা মাসাহ করা ও দুইপা টাখনু পর্যন্ত ধৌত কর।” সুরা আল-মায়িদাঃ ৬।
এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে আমাদের দেশের প্রচলিত হানাফী মাযহাবের অনুসারীরা আলেমরা ওযুর ফরজ চারটি মনে করেন, যা আমাদের এখানে বর্ণিত প্রথম চারটির অনুরূপ। বাকি যে দুইটা ফরয এখানে লিখা হয়েছে, আপনি যদি আয়াতের দিকে একটু লক্ষ্য করেন তাহলে, সেই দুইটা ফরজ বুঝতে পারবেন। আমি ইন শাল্লাহ একটু ব্যখ্যা করছি।
পাচ নাম্বার ফরয হচ্ছে “যে তারতীব বা ধারা্বাহিক নিয়ম বর্ণনা করা হলো (মুখ, হাত, পা, মাথা মাসাহ) এইভাবে করা, আগে বা পরে না করা”। আপনি চিন্তা করে দেখুন, আমাদের নামাযে প্রথমে কিয়াম, এর পরে কিরাত, এরপরে রুকু এরপরে সিজদা। কেউ যদি আগে পরে করে, ধরুন রুকুর আগে সিজদা করে এরপরে রুকু করে, তাহলে কি তার নামায হবে? না হবেনা। অনুরূপভাবে আল্লাহ সুরা মায়িদাহর ৬ নাম্বার আয়াতে প্রথমে মুখমন্ডল, এরপরে হাত, এরপর মাথা মাসাহ, এরপরে পা ধুইতে বলেছেন। নামাযে যেমন ফরয হচ্ছে আগে রুকু করে পরে সিজদাহ করা, একই যুক্তি বা দলীলে, ওযুর জন্যে ফরয হচ্ছে আগে মুখ ধোয়া এরপরে হাত, আগে পরে করলে হবেনা। আর নবী (সাঃ) জীবনে কোন একদিন, এই ধারাবাহিক ভাবে অযুর বিপরীত করেছেন, যেমন হাতের পূর্বে পা ধুয়েছেন, এমন প্রমান নেই। এথেকে অনেক ইমাম ও আলেম, ওযুতে তারতীব বা ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ফরয বলে ফতোয়া দেন।
আর ষষ্ঠ ফরয হচ্ছে, “এগুলো পরপর করা, অর্থাৎ একটা কাজের পরে অন্য আরেকটা কাজ করতে এমন বিরতি না দেয়া যে আগের ধৌত করা অংগ শুকিয়ে যায়”। এটা হছে ধরুন, আপনি সিজদাহ দিলেন, সিজদাহ দিয়ে বসে থাকলেন ৫-১০ মিনিট, এরপর পরের রাকাতের জন্যে দাড়ালেন। এই বিরতির কারণে কি তার নামায হবে? না হবেনা। অনুরূপভাবে আল্লাহ সুরা মায়িদাহর ৬ নাম্বার আয়াতে প্রথমে মুখমন্ডল, এরপরে হাত, এরপর মাথা মাসাহ, এরপরে পা ধুইতে বলেছেন। এইগুলো পরপর করতে বলেছেন, এমন না যে আপনি এখন হাত ধুয়ে এখে কোন কাজে চলে গেলেন আর ৫-১০ মিনিট পরে বাকি অংগগুলো ধুইলেন, এতে ওযু হবেনা, কারণ কুরাতের আয়াতে অংগগুলো পরপর ধুইতে বলা হয়েছে। এই যুক্তিতে অনেক আলেম এই ফতোয়া দিয়েছেন যে, “ওযুর অঙ্গগুলো পর ধৌত করা ফরয”। এব্যপারে আল্লাহ ভালো জানেন।
উল্লেখ্য, উপরে বর্ণিত আয়াতের কাজগুলো ছাড়া ওযুর মাঝে বাকি সবগুলো কাজ সুন্নত।
____________________________________
ওযু করার সুন্নতী পদ্ধতি
(১) প্রথমে পবিত্রতা অর্জনের জন্য অন্তরে নিয়ত করতে হবে। এরজন্য কোনো দুয়া পড়তে হবেনা বা, মুখে কোনো কিছু বলতে হবেনা। নিয়ত অর্থ হচ্ছে কোন কাজ করতে ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা। “আমি পবিত্রতা অর্জন করার জন্য ওযু করছি”, অন্তরে শুধুমাত্র এই ধারণাটুকু বা ইচ্ছা থাকলেই নিয়ত করা হয়ে যাবে। প্রত্যেক কাজের শুরুতে নিয়ত করা “ফরয”। সহীহ বুখারীঃ ১। নিয়তের জন্য নাওয়াইতু…মুখে উচ্চারণ করে এমন দুয়া পড়া বেদাত, সুতরাং সেটা করা যাবেনা।
ওযুর নিয়ম ও দোয়া
(২) অতঃপর “বিসমিল্লাহ” বলে ওযু করা শুরু করতে হবে। ওযু বা গোসলের পূর্বে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা কিছু আলেমের মতে সুন্নত, অনেক আলেমের মতে ফরয। তাই সবসময় চেষ্টা করতে অবশ্যই শুরুতে বিসমিল্লাহ বলেই ওযু/গোসল শুরু করার জন্য। আর বাথরুমে ওযু করলেও বিসমিল্লাহ বলবে। আবু দাউদঃ ১০১, তিরমিযীঃ ২৫। উল্লেখ্য, শুধু “বিসমিল্লাহ” বলাই সুন্নত, বিসমিল্লাহ-হির রাহমানীর রাহীম – পুরোটা নয়।
(৩) ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করতে হবে। এসময় হাতের আংগুলগুলো খিলাল করতে হবে। আবু দাউদ, মিশকাতঃ ৪০১, নাসায়ী মিশকাতঃ ৪০৫।
এসময় হাতে আংটি থাকলে রাসুল (সাঃ) সেটা নাড়িয়ে ধৌত করতেন। ফিকহুস সুন্নাহঃ ১/৬১। উল্লেখ্য, হাত কব্জি পর্যন্ত না ধোয়া পর্যন্ত ওযুর পানিতে হাত দেয়া যাবেনা। কারণ ঘুমের সময় তার হাত কোথায় ছিলো, কেউ জানেনা। অথবা, হাতে কোনো নাপাকী থাকলে ওযুর পানিও নাপাক হয়ে যাবে। এইজন্য, কব্জি পর্যন্ত হাত না ধোয়া পর্যন্ত ওযুর পানিতে হাত দেয়া নিষিদ্ধ। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউ নিদ্রা থেকে জাগ্রত হলে, সে যেন তার হাত তিনবার না ধোয়া পর্যন্ত পানিতে না ঢোকায়। কেননা তোমাদের কারো জানা নেই যে, তার হাত রাতে কোথায় পৌঁছেছিল। সুনানে নাসাঈ।
নামাজের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নত
(৪) ডান হাতে এক আজলা পরিমান পানি নিয়ে অর্ধেক পানি দিয়ে কুলি করবে আর বাকি অর্ধেক পানি নাকে দিয়ে নাক পরিষ্কার করবে ও বাম হাতে নাক ঝাড়বে। এসময় ভালো করে কুলি করে মুখের সব অংশে এবং নাকের উপরের নরম অংশ পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে হবে। অধিকাংশ মানুষ আগে কুলি করে পরে নাকে পানি দেয়, এটা ঠিকনা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ডান হাতে পানি নিয়ে অর্ধেক পানি দিয়ে কুলি আর বাকি অর্ধেক পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করতেন, অর্থাৎ কুলি করা ও নাক ধোয়া একই সাথে করতেন। আবু দাউদঃ ২৩৬৬, তিরমিযীঃ ৭৮৮। ওযুর নিয়ম ও দোয়া
(৫) কপালের গোড়া থেকে দুই কানের লতি পর্যন্ত ও থুতনীর নিচ পর্যন্ত সমস্ত মুখমন্ডল ধৌত করবে। বুখারী ও মুসলিম। যাদের দাড়ি ঘন, তাদের ভেজা হাতে দাড়ি খিলাল করলেই হবে। আর যাদের দাড়ি হালকা বা মুখের সাদা চামড়া দেখা গেলে পানি পৌছানো ওয়াজিব। আর নারীরা এক অঞ্জলি পানি থুতনীর নিচে দিবে, সেটাও মুখের অন্তর্ভুক্ত, তবে গলা ধৌত করবে না।
(৬) প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত কনুইসহ ধৌত করবে। হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগ থেকে অন্তত কনুই পর্যন্ত ধোয়া ওয়াজিব। ওযুর নিয়ম ও দোয়া
নামাজের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নত
(৭) মাথা মাসাহ করা সঠিক নিয়মঃ ইমানের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো “সালাত” বা নামায। অথচ, আমাদের ব্যক্তিগত উদাসীনতা, স্বল্পশিক্ষিত হুজুরের কাছে থেকে শিখা অথবা “নূরানী নামায শিক্ষা” নামক বইয়ের ভুল শিক্ষার কারণে আমাদের সালাতের মাঝে কত যে ভুল ঢুকে আছে। মাথা মাসাহ করা নিয়ে আমাদের মাঝে যে ভুল গুলো প্রচলিত সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো। প্রথম কথা হচ্ছে, মাথা মাসাহ করতে হবে একবার, তিনবার নয়। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ওযুর অংগসমূহ কখনো একবার, কখনো দুইবার আবার কখনও তিনবারও ধৌত করতেন। কিন্তু মাথা মাসাহ করতেন একবার। মিশকাতঃ ৩৯৩-৩৯৪।
দ্বিতীয়ত, মাথা মাসাহ করার সময় ঘাড় মাসাহ করা বেদাত। ইমাম আন-নববী (রহঃ) বলেন, “এ ব্যপারে হাদীস জাল ও এটা করা সুন্নত নয় বেদাত। ইমাম শওকানী নায়লুল আওতারঃ ১/১৬৩, মাজমু ফাতওয়া ১/৫৬, ইমাম ইবনে কাইয়িম যাদুল মায়া’দঃ ১/১৮৭। রাসুল (সাঃ) কখনোই ঘাড় মাসাহ করতেন না, তাই ঘাড় মাসাহ করা নবীর আদর্শ বিরোধী, যা নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য।
তৃতীয় ভুলঃ নূরানী নামায শিক্ষা, মকসুদুল মুমিনীনসহ কিছু বইয়ে লেখা রয়েছে, মাথার চার ভাগের এক ভাগ বা তিন ভাগের এক ভাগ মাসাহ করা ফরয। এই কথার কোনো ভিত্তি নেই, বরং, রাসুল (সাঃ) সমস্ত মাথাই মাসাহ করতেন। সুতরাং সমস্ত মাথা মাসাহ করাই ফরয।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যেভাবে মাথা মাসাহ করতেনঃ তিনি (সাঃ) দুই হাতের ভেজা আংগুল দিয়ে মাথার সামনে হতে পেছনে ও পুনরায় পেছন থেকে সামনে বুলিয়ে পুরো মাথা একবার মাসাহ করতেন। একই সাথে ভেজা শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে কানের ভেতর অংশ এবং বুড়ো আংগুল দিয়ে কানের বাইরের অংশ মাসাহ করতেন। মাথায় পাগড়ি/স্কার্ফ থাকলে পাগড়ির উপরে ভেজা হাত দিয়ে সমস্ত মাথা মাসাহ করে নিতে হবে।
নামাজের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নত
(৮) এরপর প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা টাখনুসহ ভালোভাবে ধৌত করতে হবে। বাম হাতের আংগুলগুলো দিয়ে পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করতে হবে। এসময় খেয়াল রাখতে হবে, পুরো পা যেনো ভালোভাবে ধৌত করা হয়, অনেকের পায়ের গিটের নিচে পুরো অংশ পানি দিয়ে ধৌত করা হয়না। এরকম করলে জাহান্নামে যেতে হবে, কারণ একারণে তার ওযু হয়না।
(৯) শীতকালে বা সফরে ওযু থাকা অবস্থায় মোজা পড়লে মোজা খুলে পা ধৌত করতে হবেনা, মোজার উপরে একবার মাসাহ করলেই হবে। আর চামড়া বা কাপড় যেকোনো মোজাতেই মাসাহ করা যাবে। তিরমিযী।
মোজ়ার উপরে পা মাসাহ করার নিয়মঃ দুই হাতে ভেজা আঙ্গুল পায়ের পাতা হতে টাখনু পর্যন্ত টেনে এনে একবার মাসাহ করতে হবে। মুসলিম, মিশকাতঃ ৫১৮। ডান হাত দিয়ে ডান পা ও বাম হাত দিয়ে বাম পা মাসাহ করতে হবে। ওযু এখানেই সমাপ্ত। ওযুর পরে সুন্নত হচ্ছেঃ
(১) রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ওযু শেষে একটু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ও তার আশেপাশের কাপড়ে হালকা পানি ছিটিয়ে দিতেন। আবু দাউদ, নাসায়ী, মিশকাত ৩৬১, সহীহঃ আলবানী।
কারণ, শয়তান মানুষকে ওয়াসওয়াসা দেয় যে, তোমার পেশাবের ফোঁটা বের হয়েছে। এই কাজ করলে এই ওয়াসওয়াসা দূর হবে। ওযুর নিয়ম ও দোয়া
(২) ওযু শেষে তিনটি সহীহ দুয়া রয়েছে। সেই দুয়াগুলো “দুয়া” অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
নামাজের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নত
(৩) ওযুর পরে ২ রাকাত নামায পড়া। এই নামায নফল, তবে এর অনেক মর্যাদা রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার দেখানো এই পদ্ধতিতে ওযু করে মনের মধ্যে অন্য কোনো চিন্তা করা ছাড়া ২ রাকাত নামায পড়ে, ঐ ব্যক্তির আগের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। বুখারীঃ ১৫৯।
মুসলিম অন্য হাদীসে বর্ণনা করেছেনঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। মুসলিমঃ ২২৬।
উল্লেখ্যঃ এইখানে সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে ও জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে এর জন্য শর্ত হলো নামাযে নামায ছাড়া অন্য কোনো কিছু চিন্তা করা যাবেনা। তাই এই নামাযের পূর্ণ ফযীলত পেতে হলে সেইদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
____________________________________
ওযু সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়
(১) ওযুর অংগগুলো একবার, দুই বার বা তিনবার ধৌত করতে হবে। একবার ধৌত করা ফরয, সর্বোচ্চ তিনবার করা উত্তম। তবে মাথা মাসাহ বা পায়ে মোজা থাকলে পা মাসাহ একবারই করতে হবে। ওযুর অংগ তিনবারের বেশি ধৌত করা বাড়াবাড়ি, হাদীসে এই কাজের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত ৩৯৫- ৩৯৭।
(২) পানি অপচয় করা যাবেনা। টেপ ছেড়ে ওযু করা পানি অপচয়ের মধ্যে পড়বে। উচিত হচ্ছে মগে বা কোনো পাত্রে পানি নিয়ে ওযু করা। আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ওযু করতেন এক মুদ বা ৬২৫ গ্রাম পানি দিয়ে (প্রায় পৌনে এক লিটার)। বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত ৪৩৯।
(৩) ওযু শেষে ভেজা অংগগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলা জায়েজ রয়েছে। ইবনে মাজাহ ৪৬৫।
(৪) এক ওযু দিয়ে দুই ওয়াক্তের নামায পড়া জায়েজ, তবে নবী (সাঃ) সবসময় নতুন করে ওযু করে নিতেন। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি একবার এক ওযু দিয়ে দুই ওয়াক্তের নামায পড়েছিলেন।
(৫) কাপড়ের মোজার উপরে মাসাহ করা জায়েজ। তিরমিযীতে এর পক্ষে সহীহ হাদীস রয়েছে। যারা বলে শুধু চামড়ার মোজার উপরে মাসাহ করা যাবে, কাপড়ের মোজ়ার উপরে করা যাবেনা, তাদের ফতোয়া সঠিক নয়। ওযুর নিয়ম ও দোয়া
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামগণ (রাঃ) খুফ (চামড়ার মোজা) ও জাওরাবের (সুতী বা পশমী মোটা মোজার) উপরে মাসাহ করতেন। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, মিশকাত ৫৩-৫৪।
মুকীম বা গৃহে অবস্থান করলে একদিন একরাত (২৪ঘন্টা) সফরে তিনিদিন ও তিনরাতে পর্যন্ত একবার মোজা পড়ে মাসাহ করে যাবে, এর পরে ওযু করলে মোজা খুলে ধৌত করতে হবে।
এমন জুতা, যা টাখনু ঢাকে সেটা যদি পাক থাকে আর ওযু করা অবস্থায় পড়া হয়, তাহলে তার উপরেও মাসাহ করা জায়েজ। আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাতঃ ৫২৩।
জুতার নিচে নাপাকী থাকলে তা মাটিতে ভালোভাবে ঘষে নিলে পাক হয়ে যাবে এবং ঐ জুতার উপরে মাসাহ করা চলবে। আবু দাউদ, মিশকাত ৫০৩।
(৬) শরীরে কোনো জখম বা ব্যান্ডেজ থাকলে ঐ অংশটুকুর উপরে ভেজা হাতে একবার মাসাহ করলেই হবে, ধৌত করতে হবেনা সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ১/১৬১।
(৭) ওযুর শুরুতে প্রয়োজনীয় কথা বলতে ও সালাম দিতে বা নিতে হাদীসে কোনো নিষেধ নেই।
(৮) প্রত্যেক অংগ ধোঁয়ার সময় আলাদা আলাদ দুয়া বলতে কিছু নেই, এইগুলো বেদাত। এইগুলো না রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পড়েছেন, না সাহাবার করেছেন না চার ইমাম থেকে কোনো বক্তব্য আছে। যাদুল মায়া’দঃ ১/৮৮।
(৯) শরীরের যেকোনো স্থান থেকে কম হোক আর বেশি হোক রক্ত বের হলে ওযু নষ্ট হবেনা। বুখারী, ২৯ পৃষ্ঠা।
(১০) কাপড় পরিবর্তন করলে বা হাটুর উপরে কাপড় উঠে গেলে ওযু ভেঙ্গে যায়না।
(১১) বমি হলে, নামাযের ভেতরে বা বাইরে উচ্চস্বরে হাসলে, মৃত ব্যক্তিকে গোসল দিলে বা বহন করলে ওযু ভেঙ্গে যায়না।
____________________________________
ট্যাগ: নামাজের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নত