You are currently viewing বাংলা সাহিত্যে ঈদ ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের অন্তরায়-হিমাদ্রি হাবীব
বাংলা সাহিত্যে ঈদ

বাংলা সাহিত্যে ঈদ ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের অন্তরায়-হিমাদ্রি হাবীব

বাংলা সাহিত্যে ঈদ ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের অন্তরায়

–হিমাদ্রি হাবীব

স্বভাবতই বলা হয়ে থাকে ‘ঈদ মানে আনন্দ’। কিন্তু বাক্যটির মাধ্যমে দিন দিন বিস্তৃত অর্থের, ব্যাখ্যামূলক একটি শব্দকে সংকীর্ণ এবং সেই মানসিকতায় ব্যবহৃত একটি উৎসবে পরিণত করা হচ্ছে। কেউ যদি মুখে ‘হি হি’ উচ্চরোলে অট্টহাসি দেয়, তবে তা যে আনন্দই হবে এমন ধারণা অবান্তর। আনন্দের প্রকাশ বেদনার বহিঃপ্রকাশের দ্বারাও হতে পারে।

আমার ধারণামতে আনন্দ শব্দটির অর্থ ‘পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত একটি পুলক’। মুখে হাসি; অন্তরে ক্ষোভ কখনো আনন্দ প্রকাশের প্রকৃত ও সুষ্ঠু মাধ্যম হতে পারে না। অনেক ইন্দ্রিয়র সংমিশ্রণে যেমন প্রকৃত আনন্দকে চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখা যায়, ঈদও ঠিক তেমনই একটি বিষয়।

মুসলিম কিংবা ধনী ঈদের আনন্দে আত্মহারা; পাশের ঘরের হিন্দু কিংবা দরিদ্র শিশুটি শুধু বসে অন্যের এই আনন্দ দেখছে- তাতে আনন্দ আনন্দের চেয়ে নিরানন্দময়। মানবিকতা ও মনুষ্যত্ব এখানে ভূলুণ্ঠিত, জাগ্রত পুলক এখানে শিকলে বন্দী, ঈদ এখানে একটি সংকীর্ণ মেলবন্ধন।

বাংলা সাহিত্যে ঈদ বিষয়ক কালজয়ী লেখাগুলোও অবশ্য এসবের ইঙ্গিত করেছে।

১৯০৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৮০-১৯৫৬)’র সম্পাদিত ‘নবনূর’ পত্রিকা। সম্ভবত এই পত্রিকাটিই সর্বপ্রথম ঈদ-সংখ্যা প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যে। সৈয়দ এমদাদ আলী উক্ত সংখ্যায় ‘ঈদ’ শিরোনামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঈদ-বিষয়ক লেখা বলে গবেষকরা ধারণা করেন। উক্ত পত্রিকায় সৈয়দ এমদাদ আলী সহ কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১), আর, এস হোসেন তথা বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) সহ অনেকেই ঈদ বিষয়ক কবিতা বা গদ্য লিখেছেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত (১৮৬৯-১৯২৭) লিখেছিলেন ‘ঈদজ্জোহা’ কবিতা, জীবেন্দু কুমার দত্তের ‘ঈদ সম্মিলন’ কবিতা এবং মিসেস আর,এস,হোসেন তথা বেগম রোকেয়ার ‘ঈদ সম্মিলন’ গদ্যপ্রবন্ধ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এটিও লক্ষ্যণীয় যে, হিন্দু লেখকরাও ঈদের আনন্দে উজ্জীবিত হয়ে লিখতেন। এখানে তাঁরা সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে ঠাঁই দেন নি এক বিন্দুও।

নিজের স্মৃতিগুলোও মনে পড়ে গেছে এই মূহুর্তে। আমরা তখন কৈশোরে। বন্ধুরা মিলে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলেছিলাম ঈদ-উৎসব উদযাপনে। গ্রামের বেশ দীর্ঘ পথ, পায়ে হেঁটে ঈদের দিনে বেড়াতে গিয়েছি, পূজোর দিনে বেড়াতে গিয়েছি হিন্দু বন্ধুর বাড়ি। সেখানের নারিকেলের নাড়ুর পরিবেশনটা খুব মজার ছিল। একবার আমাদের প্রত্যেককে ‘ঈদ-উপহার কার্ড’ও দিয়েছিল একজন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য মানসিকতা সেখানে দেখে এসেছি। ওরাও আসতো আমাদের মুসলমানের বাড়িতে। ব্যাপারটা খুব গভীর, সুন্দর মানসিকতার। ‘মুসলমানের ঈদের দিন’-এও তারা খাবারের আয়োজন করে, আনন্দ করে, যত্ন করে তুলে রাখা পোশাক বের করে পরে।

সামাজিক দিক দিয়ে অনেকের কাছে এটি দৃষ্টিকটু হতেও পারে। কিন্তু এটি কোনো দোষের কি? বাংলা সাহিত্যের আলোকে একটু যাচাই করা যাক-

‘নবনূর’ পত্রিকায় রোকেয়া সাখাওয়াত তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন,

“এমন শুভদিনে আমরা আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃবৃন্দকে ভুলিয়া থাকি কেন? ঈদের দিন হিন্দু ভাতৃগণ আমাদের সহিত সম্মিলিত হইবেন, এরূপ আশা কি দুরাশা? সমুদয় বঙ্গবাসী একই বঙ্গের সন্তান নহেন কি? অন্ধকার অমানিশার অবসানে যেমন তরুণ অরুণ আইসে, অদ্রুপ আমাদের অভিশাপের পর এমন আশীর্বাদ আসুক, ভাতৃবিরোধের স্থানে এখন পবিত্র একথা বিদ্যমান থাকুক। আমিন।”

‘ঈদ আবাহন’ কবিতায় কায়কোবাদ লিখেছিলেন,

“এই ঈদ বিধাতার কিসে শুভ উদ্দেশ্য মহান,

হয় সিদ্ধ,বুঝে না তা স্বার্থপর মানব সন্তান।

এ নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধূলো খেলা,

এ শুধু জাতীয় পূণ্য মিলনের এক মহা মেলা।”

এখানে কবি উল্লেখ করেছেন ‘জাতীয় পূণ্য মিলনের এক মহা মেলা’ বলে। একটি জাতিতে অনেক সম্প্রদায়ের বসবাস। একটি জাতির মহা মিলন ঘটাতে হলে সকল সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা ব্যতিরেকে কল্পনা করা বাতুলতার সমান।

এছাড়াও মোজাম্মেল হক, শেখ ফজলল করীম সহ প্রমুখ সাহিত্যিক সেসময়ে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য ভুলে ঈদের আহবানে কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন।

শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩) ‘ঈদুল ফিতর’ কবিতায় লিখেছেন,

“কোথা মক্কা-মোয়াজ্জেমা মদিনা কোথায়

প্রাণকেন্দ্র এ মহাসাম্যের

কোথা আমি ভারতের প্রান্ততটে ক্ষুদ্র ঈদগাহে।

সিন্দু-মরু-গিরি-দরী-কান্তার-তটিনী

রচিয়াছে ব্যবধান দুর্জয় বিপুল

তবু শুনি বায়ুস্তরে তরঙ্গদোলায়

ভেসে আসে সে উদাত্ত মন্দ্রিত নির্ঘোষ।

সাম্যের দিশারী আমি-আমি মুসলমান

দেশ-কাল-পাত্র মোর সর্ব একাকার-

বহুত্বে একক আমি

আত্মার আত্মীয় মোর দুনিয়া-জাহান।”

কবিতাটিতে সাম্যের দিশারী এবং দেশ-কাল-পাত্র একাকারের, বহুত্বের একক, সারা দুনিয়ার আত্মার আত্মীয় হিসেবে এই ঈদগাহে অবস্থানরত মুসলিমকে উল্লেখ করা হয়েছে- যাঁর সাথে মক্কা ও কা’বার দূরত্ব অসংখ্য সিন্দু-মরু-গিরি-দরী-কান্তার-তটিনী দ্বারা, তবুও তাঁর মন মক্কাতেই গিয়ে যেমন মেশে, ঠিক তেমনই দেশ,কাল,সম্প্রদায়, শ্রেণি নানান গণ্ডিও অতিক্রম করে মানবাত্মা একে অপরের সাথে বন্ধন তৈরি করবে।

গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) ‘ঈদ-উৎসব’ কবিতাটিতে (প্রথম প্রকাশ: ‘সওগাত’, ভাদ্র ১৩২৬, রক্তরাগ) লিখেছেন,

“সকল ধরা-মাঝে বিরাট মানবতা সুরভি লভিয়াছে হর্ষে

আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়াছে, রাখিতে হবে সারা বর্ষে,

এ ঈদ হোক আজি সফল ধন্য

নিখিল-মানবের মিলন জন্য,

শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশিস স্পর্শে।”

অর্থাৎ, এই ঈদ তখনই সফল হবে, যখন তা নিখিল-মানবের মিলনের জন্য হবে। ‘নিখিল-মানব’ শব্দটির দ্বারা সমস্ত মানবকে একত্রিত করে তোলা হয়েছে। শুধু তাই নয়; এই ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে সারাবছর জুড়ে এই মেলবন্ধনের প্রচলন বাজায় রাখতে হবে।

তিনি আরো লিখেছেন,

“কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম-বাণী, বক্ষে ভরা তার শান্তি,

চক্ষে করুণার স্নিগ্ধজ্যোতি ভার,

বিশ্ব বিমোহন কান্তি।

প্রীতি ও মিলনের মধুর দৃশ্যে,

এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে,

দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার,

বিয়োগ বেদনার শ্রান্তি।”

এসব লেখাগুলোতে কেবল ধনী,গরীব, ফকির, মিসকিন তথা শ্রেণিবৈষম্যর মিলনের কথা বলা হয় নি; হয়েছে তা দেশ, সমাজ, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম সকল কিছুকে উতরিয়ে।

উপরের উদ্ধৃতিগুলো বাংলা সাহিত্যে ঈদ বনাম ‘ধর্ম ও শ্রেণিবৈষম্য’র প্রাথমিক পর্যায়ের বলা যেতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলামের হাতে এসে এই ‘দিয়াশলাই কাঠির বারুদ’ প্রদীপে রূপ নিয়েছে। সেটার ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য দিবালোকের ন্যায় জ্বলজ্বলে। স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে ঈদে ‘আনন্দ বনাম বৈষম্যে’র ভেদাভেদ ভোলার কথাও।

নজরুল ইসলামের ঈদ শীর্ষক উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো নিয়ে সুসাহিত্যিক আব্দুল মান্নান সৈয়দের করা একটি তালিকা নিচে তুলে ধরছি-

ঈদের কবিতা

১।। কৃষকের ঈদ। সাপ্তাহিক ‘কৃষক’, ঈদ-সংখ্যা ১৯৪১।

২।। ঈদ মোবারক। রচনা: কলিকাতা, ১৯ চৈত্র ১৩৩৩। জিঞ্জির।

৩।। জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ।

৪।। ঈদের চাঁদ।

৫।। সর্বহারা।

৬।। বকরীদ।

৭।। কোরবানি। ‘মোসলেম ভারত’, ভাদ্র ১৩২৭। অগ্নি-বীণা।

৮।। শহীদী ঈদ। সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’। ভাঙার গান।

৯।।আজাদ। দৈনিক ‘আজাদ’, ঈদ-সংখ্যা, ১৩৪৭।

ঈদের গান::

১০।। নতুন ঈদের চাঁদ (ওরে ও নতুন ঈদের চাঁদ)।

১১।। খুশির ঈদ (ওমন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ)।

১২।। চলো ঈদগাহে (এলো আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ)।

১৩।। ঈদুল-ফিতর (ঈদুল ফেতর এলো ঈদ ঈদ ঈদ)।

১৪।। ঈদ মোবারক (ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক)

১৫।। ঈদ ঈদ ঈদ (আজি ঈদ ঈদ ঈদ খুশির ঈদ এলো ঈদ)।

১৬।। আল্লাহ আমার মাথার মুকুট (নাই হলো মা জেওর লেবাস)।

১৭।। নতুন চাঁদের তকবির (নতুন চাঁদের তকবির শোনো)।

১৮।। ঈদুজ্জোহার চাঁদ (ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ)।

১৯।। ঈদুজ্জোহার তকবির শোনো (ঈদুজ্জোহার তকবির শোনো ঈদগাহে)।

২০।। ঈদ মোবারক হো (ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, ঈদ)।

২১।। দে জাকাত দে জাকাত, দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত)।

ঈদের নাটিকা::

২২।। ঈদ (বেতার নাটিকা)। দৈনিক ‘ইত্তেফাক’, ঈদসংখ্যা ৭ বৈশাখ ১৩৬৫।

২৩।। ঈদুল ফেতর (রেকর্ড-নাটিকা)।

ঈদের অভিভাষণ::

২৪।। স্বাধীন-চিত্ততার জাগরণ (১৩৪৭ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির এক অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণ)।

এসব লক্ষ্য করে ঈদ বিষয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘রচনাসম্ভার’ বলা যেতে পারে। আমার শিরোনাম শীর্ষক আলোচনাটিতে তাঁর লেখা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলেও কয়েকটি বই করতে হবে। তবে দু’একটা কথা একেবারে না বলেই পারছি না।

ঈদ মানেই নতুন জামাকাপড়, একটা ফ্যাশনদুরস্ত, প্রথাগত, ব্যয়বহুল উৎসব নয়। কাজী নজরুল ইসলাম দেখুন কীভাবে বলেছেন,

শুধু সালোয়ার পরিও না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো।” (বকরীদ)

আবার বলেছেন-

জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধনীরা এসেছে সেথা,

এই ঈদগাহে তুমি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা ?”

‘কৃষকের ইদ’ কবিতায় ইমামকে বিদ্রুপ করে লিখেছেন কথাটি। এমন করে তুলে ধরেছেন প্রকৃতপক্ষে ঈদের দিনে ভেদাভেদ ভুলে, নীচু জাতী হিসেবে ঘৃণা ভুলে যাঁদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই সারিতে নামাজ ও কোলাকুলি করতে হবে, সেসব অবহেলিত, নিষ্পেষিত, গরীবের কথাও। ঈদ তো প্রকৃত তাঁদের জন্যই।

প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে আজীবন উপবাসী,

তাহাদেরই তরে এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি।”

(ঈদের চাঁদ)

কাজী সাহেব ধনীর ঈদের আনন্দ নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন-

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ

মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

(কৃষকের ঈদ)

একই ধারার দুটি আলাদা লেখা, বিষয়বস্তু থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট। গরীব,অসহায়দের রোজা আজীবন। আজ ধনীদের ঘরে ঈদের খুশির বন্যা, কিন্তু ধনীর খুশিই কেবল ঈদ নয়, ঈদে ধনীরই এত খুশি হওয়ার দরকারও নেই; গরীবের ঘরে কি এই খুশি আদৌ এসেছে? আসে, ধনীরা নিয়ে আসলেই তবে আসে। যদি ধনীরা গরীবের ঘরেও ঈদ নিসে আসে, তখনই তা ঈদ।

‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,

“ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,

সুখ-দুখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,

নাই অধিকার সঞ্চয়ের!

কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?

দু’জনার হবে বুলন্দ-নসীব, লাখে লাঝে হবে বদ-নসীব?

এ নহে বিধান ইসলামের।।

ঈদ-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,

ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,

ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!

ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,

তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও-পেয়ালাতে,

দিয়া ভোগ কর, বীর দেদার।।

বুক খালি ক’রে আপনারে আজ দাও জাকাত,

করো না হিসাবী আজি হিসাবের অঙ্কপাত!

একদিন করো ভুল হিসাব।

দিলে দিলে আজ খুনসুড়ি করে দিললগী,

আজিকে ছায়েলা-লায়েলা-চুমায় লাল যোগী!

জামশেদ বেঁচে চায় শরাব।।

পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু, ঈদ মোবারক! আসসালাম!

ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম!

বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ!”

এছাড়াও ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় বলেছেন-

“দীন কাঙ্গালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাগিদ

কোথা সে মহা- সাধক আনিবে যে পুন ঈদ?

ছিনিয়া আনিবে আসমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি,

ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি।

সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?

রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।”

‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায় কত বড় শক্ত কথা বলে অধিকার আদায়ের ঈঙ্গিত করেছেন কবি! গরীবের অধিকার যে বুঝিয়ে দিবে না, তাকে ঈদগাহে যেতে দেওয়া হবে না। এত বড় শক্ত সমর্থন করেছেন প্রকৃত ঈদ-আনন্দের পক্ষেই।

“সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ চাষা মজুর ও বিড়ি- ওয়ালা,

মোদের হিসসা আদায় করিতে ঈদে

দিল হুকুম আল্লাতা’লা।

দ্বার খোলো সাততলা- বাড়ি- ওয়ালা, দেখ কারা দান চাহে,

মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেবো ঈদগাহে।”

ঈদ মানে আনন্দ; কিন্তু এই আনন্দ তখনই আসবে, যখন সবার প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়া হবে। তেমনি ঈদের নামাজের ইমামকে নিয়ে কবি বলেছেন-

“আপনি শক্তি লভে নি যে জন, হায় সে শক্তিহীন,

হয়েছে ইমাম, তাহারি খোতবা শুনিতেছি নিশিদিন ।”

এখানে সমাজের আরেকটা বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক ইমাম রয়েছেন, যাঁরা টাকা-পয়সাওয়ালা কিংবা সমাজের উচ্চশ্রেণির অথবা এ সংক্রান্ত পরিচালানা পরিষদের অধীনস্থ। ফলে ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া’ই কাজ কিংবা সত্য কথা কড়া করে বলতে ভয় পায় এরা। কিন্তু ইমাম অর্থ নেতা, সে-ই অনুসারীর অধিকার আদায় করে দেবে; অথচ অনেক ইমাম নামাজের বেলায়, খোতবা পাঠের বেলায় কেবল নেতা; অন্য সময়ে চাকরের মতো বশীভূত হয়! শুধু তাই নয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞাও সামাজিক মর্যাদায় অনেক ইমামের প্রাপ্তি হচ্ছে। ফলে ইমাম শব্দের অর্থে তা বিপরীতার্থক, তাই যে ইমাম আজ সমাজে শক্তিহীন, সে ইদগাহে শক্তিধর নেতা হবে কী করে! এটিও সামাজিক একটি বৈষম্যের ঈঙ্গিত করে।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আসা যাক। নজরুলের লেখার অপব্যাখ্যা, নিজের মতবাদে প্রস্ফুটিত করে তোলা, দলীয়স্বার্থে ব্যবহার, ধর্মান্ধতায় ব্যবহার, কেবল বিদ্রোহী কাজে নজরুলের লেখার ব্যবহার আজকার নতুন নয়। অথচ কাজী নজরুল ছিলেন বরাবরই অসাম্প্রদায়িক এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। আমি বারবারই একটা কথা বলে থাকি, যাঁরা নজরুলের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে খারাপ করে তুলছে, তাঁকে কেবল তারা বিদ্রোহী রূপে চিনেছে, মর্মার্থ না বুঝেই গোঁড়া ধর্মান্ধতার শিকলে আঁকড়ে ফেলতে চাইছে, এরা নজরুলের খুব কম লেখাই পড়েছে। নজরুলকে বেশি পড়লে জ্ঞানস্বল্পতায় হোক বা ভুল বুঝে হোক বা মর্মার্থ না বুঝেই হোক- এরা নজরুলভক্ত হওয়ার বিপরীতে নজরুলবিদ্বেষী হয়ে উঠবে। অথচ এই ‘বিদ্রোহী’ উপাধি নিয়ে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ অভিভাষণে নজরুল স্বয়ং বলেছেন, “আমাকে খামাকা বিদ্রোহী বলে লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ!” ‘ধর্মের নামে ভণ্ডামি’র বিরুদ্ধবাদীতার জন্য নজরুলের আগমন ঘটেছে, তাও তিনি উল্লেখ করেছেন। সরাসরি বক্তব্য ও ব্যঙ্গাত্মক অনেক রচনায়ও তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

আরো একটি বিষয়। আমার নিকটস্থ কয়েকজন নজরুল সাধককের কাছেও একটি ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছিলাম। অনেকেই তাতে একমতও হয়েছেন। প্রশ্ন এবং উত্তর দুটিই স্বয়ং নজরুলের ভাষ্য থেকে বেরিয়ে আসবে দেখুন-

“যেদিন আমি চলে যাবো, সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরুবে হয়তো আমার নামে! দেশপ্রেমী,ত্যাগী,বীর,বিদ্রোহী- বিশেষণের পর বিশেষণ। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে,বক্তার পর বক্তা! এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু, তুমি যেন যেও না। যদি পারো চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা, পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বলো – ‘বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি’।

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবো না,

কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিবো না।

নিশ্চল, নিশ্চুপ;

আপনার মনে পুড়িবো একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।”

যা-ই হোক, যে কথাটি বলতে চাচ্ছিলাম সে কথায় আসা যাক। নজরুলের অনেক লেখার অপব্যাখ্যা কিংবা ভুলবোঝাবুঝির রীতি আজকের নতুন নয়। তেমনই একটা বিষয় তাঁর ‘শহীদি ঈদ’ কবিতায়।

“মনের পশুরে কর জবাই

পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই-

কসাই-এর আবার কোরবানি !!

আমাদের নয়, তাদের ঈদ

বীর-সুত যারা হ’ল শহীদ-

অমর যাদের বীরবাণী।।”

এই লেখাটির মর্মার্থ অনেকেই বুঝতে অক্ষম তা আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। এটির ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে সরল অর্থে; অথচ ব্যাপারটি গুরুগম্ভীর, অনুভবগত অর্থে, ব্যঙ্গাত্মক অর্থে বিশ্লেষণ করা বাঞ্ছনীয়। ‘কসাইয়ের আবার কুরবানী’র ব্যঙ্গাত্মক ভাব কি তা স্পষ্ট করে না? নজরুল কি প্রকৃতপক্ষে পশু জবাইয়ের বিরোধিতা করেছেন এখানে? খুব গভীরভাবে ভেবেও তা আমার একটিবারও মনে হয় নি। আমি বাস্তবতার আলোকে এটিও বুঝি যে, যারা গোঁড়ামি করবে, নিজের মতকেই কেবল বলিষ্ঠ ভাববে, তারা এই যুক্তি মানতে চাইবে না, গভীরভাবে এই লেখাকে উপলব্ধি করবে না। যদি না করে, মতান্ধ থাকে, তবে নজরুলের লেখার আলোকেই সে নজরুলবিরোধী। এমন লোকদের নিয়েই প্রতিবাদ ও ব্যঙ্গাত্মক নজরুলের সেসব লেখা পড়তে আমি মজা পাই খুব বেশি।

দেখুন, রোজার সময় অনেকেই রোজা রাখে; কিন্তু নামাজ পড়ে না বা যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ করে বেড়ায়! এদের রোজা রোজা নয়; উপোস কেবল। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতেও শোনায় এমন কথা যে, ‘তোমার এমন উপোস করে লাভ কী? লাভ আছে রোজা থেকে! ‘ তেমনই নামাজের বেলায়ও তাই। যে নামাজ নামাজের মতো নয়, সে নামাজ আর ‘শুভ্রবেশী বকের মাছ ধরার ঠোক্কর’ সমান সমান। এরকম অর্থেই হয়ত ‘বকধার্মিক’ বাগধারাটির উৎপত্তি বলে মনে করি।

আঞ্চলিক একটি শ্লেষাত্মক প্রবাদ আছে। ‘হুহ, ন্যাংটার আবার ছতর!’

ঠিক তেমনই অন্যান্য জায়গায় ত্যাগ নেই, ঠিকমতো যাকাত দেয় না, গরীবের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে গেলে নিজের ভাগ কমে যাবে ভাবে, ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতি অবিচার করে, অনৈতিক কমর্কাণ্ডে জড়িত থাকে, সমাজের যত অনাচার করে বেড়ায়, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেয় না, অন্যকে ফাঁকি দেয়, কারো উপকার করে না- আবার ঠিকই কুরবানীর ঈদ আসলেই কুরবানী থাকে! এদের কুরবানী কুরবানী নয়, তা কেবল পশুহত্যার সদৃশ। এদের এরূপ পশুহত্যা থেকে বিরত থাকতেই ঈঙ্গিত করেছেন কবি এবং তার আগে এই “মনের পশুরে কর জবাই” বলে মনের পশুত্বকে দূর করে শুদ্ধ হয়ে কুরবানী দেওয়ার ঈঙ্গিত করেছেন।

ডা: লুৎফর রহমানের ‘মহৎ জীবন’ প্রবন্ধগ্রন্থের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ঐ যে সমুদ্রজাহাজে করে এক ইংরেজ দম্পতি যাচ্ছিল, পথিমধ্যে দূর থেকে এক বিপদাপন্ন জাহাজের সাইরেন শুনতে পেলেন কাপ্তান! সেখানে গিয়ে বিপদাপন্ন জাহাজের মরণব্যাধি রোগীদের সেবা করতে গিয়েছিল একটি মাত্র যুবতী। অন্তরে খারাপ লাগলেও মেয়েটির মা-বাবা পরোক্ষণে তাকেই যেতে দিল। পরার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া বা এই কুরবানী যাদের জীবনে নেই, পরের কল্যাণে যারা নেই- ঈদের দিনে তাদের কুরবানিও কুরবানি নয়, তা কেবলই পশুহত্যা। এদের সামাজিক প্রথা, সামাজিক মর্যাদারক্ষার কুরবানির চেয়ে কুরবানি না থাকাই উত্তম।

নজরুল ইসলাম এই ‘শহিদী ঈদ’ কবিতায় তাইতো বলেছেন,

“নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং-

ইহা-উহা পরে সেজেছ সং-

ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম।

কাড়ি কাড়ি টাকা, কর জড়ো-

ত্যাগের বেলাতে জড়সড়ো-

তোর নামাজের কী আছে দাম?”

আবার অনেকেই আছেন, যারা নিজেকে কখনো পরের জন্য উৎসর্গ করেন না; কেবল নাম কামাইয়ে যাকাত-দান প্রদান করেন। এদের জন্যই উক্ত কবিতায় কবি আরো বলেছেন-

“চাহি নাকো গাভি-দুম্বা-উট-

কতটুকু দান? ও দান ঝুট-

চাই কোরবানি; চাই না দান।

রাখিতে ইজ্জত ইসলামের-

শির চাই তোর, তোর ছেলের-

দেবে কি? কে আছ মুসলমান?

………

শুধু আপনারে বাঁচায় যে-

মুসলিম নহে, ভণ্ড সে–

ইসলাম বলে, বাঁচো সবাই-

দাও কোরবানি জান ও মাল-

বেহেশ্‌ত তোমার করো হালাল –

স্বার্থপরের বেহেশ্‌ত নাই।”

সংকীর্ণ মানসিকতায় যারা দায় সারতে কুরবানী করেন, তাদের জন্য ছেলে-কুরবানীই চেয়েছেন কবি। ‘জান এবং মাল’ শব্দদ্বয় কবি এজন্যই উল্লেখ করেছেন।

শুধু তাই নয়। কুরবানী আজ কুরবানী হতে সামাজিক একটি প্রথায় রূপ নিতে চলেছে। প্রতিযোগিতায় আজ দেশ ছেয়ে গেছে, কার পশু কেমন, কার গোস্তের কেজিদর কম পড়বে–এসব নানানদিক প্রকৃত কুরবানীর বিপরীত।

অনেকক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি, মেহমান বাড়িতে এলে পোষা হাঁস-মুরগী জবাই দিতে বলেন গৃহকর্ত্রীরা, কিন্তু অন্তর তাঁর পুড়ে যায়, অনেকেই আড়ালে গিয়ে চোখ মুছে আসেন, কেউ কেউ কষ্ট পেয়ে পোষা সখের প্রাণির গোসই খান না, খেতে গেলে কেঁদেও ফেলেন কেউ!

এটিও প্রকৃত কুরবানী। অন্তর চায় না; কিন্তু দিতে হয়, মায়ামতায় কান্না আসে পশুটির জন্য, নিজস্ব সম্পদ হারানোর মতোই পেরেশানি! এজন্যই হয়ত কুরবানীর ঈদের পশুকে লালন-পালনে গুরুত্ব দিতে বলা হয়ে থাকে।

কিন্তু কুরবানী কুরবানীর মতো না হলে, তা কেবল পশুহত্যা, সামাজিক প্রথা চর্চা। প্রিয়জন্তু হারানোয় ব্যথায় অন্তরে কষ্ট না পেলে তা কেবল ‘সামাজিক মর্যাদা রক্ষার্থেই পশুহত্যা’র সমান। এটিতে ‘কুরবানী বা অন্তরাত্মার ত্যাগ’ আসতে অনেক বেগ রয়েছে। এরকম কুরবানী নামের পশুহত্যার চেয়ে পশুদের বাঁচানো উচিৎ। এসবই বলেছেন কবি।

নজরুল ইসলাম যে ঈদের কুরবানীর ‘পশু জবেহ’কে ‘পশুহত্যা’ বলেছেন, এটির মর্মার্থ আছে, সেটি প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ এবং বিদ্রুপ। মূলত ‘পশু জবেহ’টা কুরবানীর মতোই কুরবানী হতে হবে, মনের পশুরে জবাই দিতে হবে তার আগে। এসবই বলেছেন কবি। অথচ পদ্যের মতো সরল অর্থে সেটির ব্যাখ্যা করলে তা অপপ্রয়োগ বৈ বিশুদ্ধ হবে না। শুধু তাই নয়, নজরুলের উক্তি দিয়েই প্রকৃত কুরবানী করার প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত-

‘কুরবানী’ কবিতায় কবি নজরুল বলেছেন-

“আজ আল্লার নামে জান্ কোরবানে ঈদের পূত বোধন,

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।”

যাইহোক, ‘বাংলা সাহিত্যে ঈদ ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের অন্তরায়’ শীর্ষক এই আলোচনায় আগেও বলেছি কাজী নজরুল ইসলামের ঈদ-বিষয়ক লেখাগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি বই হয়ে যাবে তাতে। সর্বোপরি ঈদের খুশি কেন? ঈদ কী? কাদের এজন্য এই ঈদ? কখন প্রকৃত ঈদ আসবে বা আদায় হবে তা নিয়ে সারসংক্ষেপের গানটি শুনেই না হয় বিদায় হই-

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।।

তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ

দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ।।

তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে

যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।।

আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন হাত মিলাও হাতে,

তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব-নিখিল ইসলামে মুরিদ।।

(দেখুন, বিশ্ব-নিখিলকে তথা প্রত্যেক জাত-সম্প্রদায়-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-শ্রেণি ইত্যাদিকে বৈষম্য ভুলে, সকল মানুষের জন্য ‘প্রেম’ বিতরণের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে বলা হয়েছে, যা ছিল মহানবীর মহানুভবতাও।)

যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত্-উপবাসী

সেই গরিব এতিম মিসকিনে দে যা কিছু মফিদ।।

ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরিতে শিরনি তৌহিদের,

তোর দাওত কবুল করবেন হযরত, হয় মনে উমীদ।।

(নিচের অংশটি আলাদা করে লিখছি। দেখুন কেমন করে সম্প্রীতিকে ইঙ্গিত করেছেন, যা মহানবী(স:) এর আদর্শ ছিল)

তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট-পাথর যারা

সেই পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে প্রেমেরি মসজিদ।।”

পরবর্তীতে বহু কালজয়ী লেখক ঈদ-বিষয়ক লেখা লিখছেন। ততক্ষণে অবশ্য ঈদ-বিষয়ক লেখার বিস্তর সমাহার গড়ে উঠেছে। আগেও বলেছি দিয়াশলাই এবং প্রদীপের কথা। প্রদীপ হলেন এক্ষেত্রে কাজী নজরুল। “একটি আলোর কণা পেলে লক্ষ প্রদীপ জ্বলে।” কথাটি অতি পরিচিত। এভাবেই দারুণ গূঢ়ার্থবহ বাংলা সাহিত্যে ধর্মীয় বৈষম্য এবং শ্রেণিবৈষম্য ভুলেই ঈদের আনন্দের কথা বলা হয়েছে। ঈদ তখনই হবে যখন সেটিকে যথাযথভাবে পালন করা হবে; নয়তো উৎসবের নামে নিজের নতুন পোশাক, দামী খাবার, ব্যয়বহুল সজ্জা, দুরাকা’ত নামাজ, আতর ইত্যাদি মানেই কেবল ঈদ নয়; ওটা একটা প্রথা মাত্র।

ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক

Leave a Reply