You are currently viewing পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এর ছয়টি কবিতা
পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এর ছয়টি কবিতা

পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এর ছয়টি কবিতা

পল্লী কবি জসিম উদ্দিন এর ছয়টি কবিতা

 

আসমানী

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, কবিতা

রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। কবিতা

বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি,

একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।

একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,

তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।

পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়,

সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।

মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি

থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।

পরণে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,

সোনালী তার গার বরণের করছে উপহাস।

ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,

সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।

বাঁশীর মত সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,

হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।

আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে

ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে।

ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,

সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে।

পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,

বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।

খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে,

কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?

পল্লী কবি জসিম উদ্দিন

মা ও খোকা

মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার মানিক আমার!

উদয়তারা খোকন আমার! ঝিলিক মিলিক সাগর-ফেনার!

ফিনকি হাসি ক্ষণিকজ্বলা বিজলী-মালার খোকন আমার!

খোকন আমার দুলকি হাসি, ফুলকি হাসি জোছনা ধারার।

তোমায় আমি দোলার উপর দুলিয়ে দিয়ে যাই যে দুলে, –

যাই যে দুলে, সকল ভুলে, রাঙা মেঘের পালটি তুলে,

দেই তোমারে দোলায় দুলে। প্রেমের কবিতা

খোকন তখন লাফিয়ে উঠে প্রেমের কবিতা

সাইকেলেতে যায় যে ছুটে, প্রেমের কবিতা

বল খেলিয়ে খেলার মাঠে সবার তারিফ লয় যে লুটে।

মা বলিছে, খোকন আমার! মানিক আমার!

এতটুকুন দস্যি আমার! লক্ষ্মী আমার!

হলদে রঙের পক্ষী আমার! প্রেমের কবিতা

তোমায় আমি পোষ মানাব বুকের খাঁচায় ভরে

তোমায় আমি মিষ্টি দেব, তোমায় আমি লজেন্স দেব,

তোমায় আমি দুধ খাওয়াব সোনার ঝিনুক ভরে!

খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, রান্না ঘরে যায় যে ছুটে,

কলাই ভাজা চিবোয় সে যে পূর্ন দুটি মুঠো।

মা বলিছে, খোকন আমার! যাদু আমার! মানিক আমার!

ঈদের চাঁদের হাসি আমার! কেমন করে রাখি তোরে

বুকের মাঝে ধরে? বিদ্রোহী কবিতা

এতটুকুন আদর আমার! দূর্বা শিষের শিশির আমার!

মেঘের বুকের বিজলী আমার! বিদ্রোহী কবিতা

সকল সময় পরাণ যে মোর হারাই হারাই করে;

এত করে আদর করি ভরসা না পাই

তোরে আমার বুকের মাঝে ধরে। বিদ্রোহী কবিতা

পাল-পাড়াতে কলেরাতে, মরছে লোকে দিনে রাতে,

বোস পাড়াতে বসন্ত আজ দিচ্ছে বড়ই হানা,

আমরা মাথার দিব্যি লাগে ঘরটি ছেড়ে-

যাসনে কোথাও ভুলি মায়ের মানা।

খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ওষুধ লয়ে যায় যে ছুটে,

পাল-পাড়াতে দিনে রাতে রোগীর সেবা করে;

মরণ-মুখো রোগী তখন অবাক হয়ে চেয়ে দেখে

ফেরেস্তা কে বসে আছে তার শিয়রের পরে।

মুখের পানে চাইলে, তাহার রোগের জ্বালা।

যায় যে দূরে সরে। কবর কবিতা

মা বলিছে, খোকন আমার! সোনা আমার!

হীরে-মতির টুকরো আমার! টিয়ে পাখির বাচ্চা আমার!

তোরে লয়ে মন যে আমার এমন ওমন কেমন যেন করে।

পুতুল খেলার পুতুল আমার! বকুল ফুলের মালা আমার!

তোরে আদর করে আমার পরাণ নাহি ভরে।

ও পাড়াতে ওই যে ওধার, ঘরে আগুন লাগছে কাহার,

আজকে ঘরের হোসনেরে বার, কবর কবিতা

আমার মাথায় হাত দিয়ে আজ বল ত শপথ করে।

খোকন তখন লাফিয়ে উঠে, ক্ষিপ্ত হয়ে যায় যে ছুটে,

জ্বলন্ত সেই আগুন পানে সবার সাথে জুটে।

দাউ দাউ দাউ আগুন ছোটে, কুন্ডলী যে পাকিয়ে ওঠে;

ওই যে কুঁড়ে, ঘরের তলে, শিশু মুখের কাঁদন ঝলে,

চীৎকারিয়ে উঠছে মাতা আঁকড়িয়ে তায় ধরে।

জ্বলছে আগুন মাথার পরে কে তাহাদের রক্ষা করে।

মুহূর্তে যে সকল কাঁদন যাবে নীরব হয়ে;

সেই লেলিহা আগুন পরে খোকা মোদের লাফিয়ে পড়ে,

একটু পরে বাইরে আসে তাদের বুকে করে।

মা যে তখন খোকারে তার বুকের মাঝে ধরে,

বলে আমার সোনা মানিক! লক্ষ্মী মানিক!

ঘুমো দেখি আমার বুকের ঘরে। কবর কবিতা

খোকা বলে, মাগো আমার সোনা মানিক।

সকল শ্রানি- জুড়াব আজ তোমার কোলের পরে।

আরও পড়ুন— গল্প– জীবন যখন যেমন

খোসমানী

তেপান্তরের মাঠেরে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে

রে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে ;

দুলছে সদাই ধুলার দোলায় ঘূর্ণি হাওয়ার ভরে।

মাঝখানে তার বট-বিরিক্ষি ঠান্ডা পাতার বায়ে,

বাতাসেরে শীতল করে ছড়ায় মাটির গায়ে।

সেথায় আছে খোসমানী সে সোনার বরণ গা,

বিজলী-বরণ হাত দুখানি আলতা-পরা পা।

সন্ধ্যাবেলা যখন এসে দাঁড়ায় প্রদীপ করে,

হাজার তারা ফুঠে ওঠে নীল আকাশের পরে।

পাকা তেলাকুচের ফলে রাঙাতে ঠোঁট দুটি,

সন্ধ্যা-সকাল রাঙা হয়ে হাসে কুটিকুটি।

রামধনু, তার শাড়ীর পাড়ে দোল খাইবে বলে,

সাতটি রঙের সাতটি হাসি ছড়ায় মেঘের দলে।

সাদা সাদা বকের ছানা নরম পাখা মেলে,

বলে, কন্যা, তোমার শাড়ীর পাড়ে ফিরব খেলে।

মেঘের গায়ে বিজলী মেখে বলে, কন্যা, আয়।

তোরে আজি জড়িয়ে নেব নীলাম্বরীর ছায়।

সে যখনে হাসে তখন হাসে যে ফুলগুলি,

গান গাহিলে বেড়ে তারে নাচে যে বুলবুলি।

সকাল হলে দুর্বাশীষের নীহার-জলে নেয়ে,

আকাশ দিয়ে নেচে বেড়ায় ফুলের রেণু খেয়ে।

এই খুকীটির সঙ্গে তোমার আলাপ যদি থাকে,

ব’লো যেন আসমানীরে বারেক কাছে ডাকে।

 

অনুরোধ

ছিপছিপে তার পাতলা গঠন, রাঙা যে টুকটুক

সোনা রূপায় ঝলমল দেখলে তাহার মুখ।

সেই মেয়েটি বলল মোরে দিয়ে একখান খাতা,

লিখো কবি ইহার মাঝে যখন খুশি যা তা।

উত্তরে তায় কইনু আমি, এই যে রূপের তরী,

বেয়ে তুমি চলছ পথে আহা মরি মরি।

যে পথ দিয়ে যাও সে পথে পথিক জনার বুকে,

ঢেউ ভাঙিয়া এধার ওধার হয় যে কতই সুখে।

রূপের ডালি চলছ বয়ে, শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে,

কুসুম ফুলের মাঠখানি যে কতই রঙে রাজে।

একটুখানি দাঁড়াও মেয়ে, অমন মুখের হাসি,

খানিকটা তার ধরে রাখি দিয়ে কথার ফাঁসি।

চলছ পথে ছড়িয়ে কতই রঙের রঙের ফুল,

কিছুটা তার লই যে এঁকে দিয়ে ভাষার ভুল।

রূপশালী ওই অঙ্গখানি, গয়না শাড়ির ভাঁজে,

আয়না খানা সামনে নিয়ে দেখছ কত সাজে।

সত্যি করে বল কন্যে! সবার যেমন লাগে,

তোমার কাছে লাগে কি তার হাজার ভাগের ভাগে?

নিজের ভোগেই আসে না যা, কেনবা যতন ভরে,

সাবধানেতে রাখছ তাহায় সবার আড়াল করে!

রূপ দেখে যার ভাল লাগে, রূপ যে শুধু তার,

তার হুদয়ে উথলপাথল রূপের মহিমার।

কেন তুমি কৃপণ এত! তোমার যাহা নয়,

পরের ধনে পোদ্দারী কি তোমার শোভা পায়?

সবই ত যায়, কিছুই ভবে রয় না চিরতরে,

বাসর রাতের শেষ না হতে রূপের প্রদীপ ঝরে।

কি করে বা রাখবে তারে? বাহুর বাঁধনখানি,

এতই শিথিল, পারেনা যে রাখতে তারে টানি।

শুধু কথার সরিৎ-সাগর, তাহার নিতল জলে,

রূপের কমল রয় যে ফুটে মেলি হাজার দলে।

কথার খাঁচায় বন্দী হতে এই ভঙ্গুর ধরা,

কত কাল যে করছে সাধন হয়ে স্বয়ম্বরা।

সেই কথাও চিরকালের হয় না চিরদিন,

সেদিন তোমার আর আমারো রইবেনাক চিন।

 

কবিতা

তাহারে কহিনু, সুন্দর মেয়ে! তোমারে কবিতা করি,

যদি কিছু লিখি ভুরু বাঁকাইয়া রবে না ত দোষ ধরি।”

সে কহিল মোরে, “কবিতা লিখিয়া তোমার হইবে নাম,

দেশে দেশে তব হবে সুখ্যাতি, আমি কিবা পাইলাম ?”

স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিনু কি দিব জবাব আর,

সুখ্যাতি তরে যে লেখে কবিতা, কবিতা হয় না তার।

হৃদয়ের ফুল আপনি যে ফোটে কথার কলিকা ভরি,

ইচ্ছা করিলে পারিনে ফোটাতে অনেক চেষ্টা করি।

অনেক ব্যথার অনেক সহার, অতল গভীর হতে,

কবিতার ফুল ভাসিয়া যে ওঠে হৃদয় সাগর স্রোতে।

তারে কহিলাম, তোমার মাঝারে এমন কিছু বা আছে,

যাহার ঝলকে আমার হিয়ার অনাহত সুর বাজে।

তুমিই হয়ত পশিয়া আমার গোপন গহন বনে,

হৃদয়-বীণায় বাজাইয়া সুর কথার কুসুম সনে।

আমি করি শুধু লেখকের কাজ, যে দেয় হৃদয়ে নাড়া,

কবিতা ত তার ; আর যেবা শোনে-কারো নয় এরা ছাড়া।

মানব জীবনে সবচেয়ে যত সুন্দরতম কথা,

কবিকার তারই গড়ন গড়িয়া বিলাইছে যথাতথা।

সেকথা শুনিয়া লাভ লোকসান কি জানি হয় না হয়,

কেহ কেহ করে সমরকন্দ তারি তরে বিনিময়।

 

হেলেনা

নতুন নাতিনী, সুচারু হাসিনী, মধুর ভাষিনী ললনা,

হলুদে চুনেতে মিশাতে কিছুতে হয় না তাহার তুলনা।

তাহার নাসাতে কি যেন ভাষাতে ভোমর গাহিছে গহনা,

যুগল আঁখির কাজল দীঘির নীরে বিজলীর নাহনা।

জোড়া সে ভুরুতে যুগল ধনুতে চাহনী-তীর যে যোজিত,

যাহার উপরে হানিবে সেহরে হইবে জীবনে বষিত।

যুগল মালীকা গেঁথেছে বালিকা যেন বা দুইটি বাহুতে,

হেরি অধরিমা-মুখ-চন্দ্রিমা হয়তো গ্রাসিবে রাহুতে।

চলনে বলনে ছলনে খেলনে ঝলকে পলকে কবিতা,

পাহাড় গলিত নাহার নাচিত যদিবা শুনিত কিছু তা।

যদি সে আকাশে দাঁড়াত সহাসে চাঁদ এসে দশ নখেতে,

দশ গ্রহে তারা আলোকের ধারা ছড়াত মনের সুখেতে।

উড়ুয়া জাহাজে চড়িনা তাই যে গাটের পয়সা ভাঙিয়া,

তাহারে দেখিতে যাই যে চকিতে সুদুর আকাশে উড়িয়া।

সে যাহার গলে ও বহুযুগলে পরাবে প্রণয় মালীকা,

কি তার সাজারে ঘুরিবে বাজারে লইয়া দ্রব্য তালিকা,

হংসগামিনী টলে যে মেদিনী তাহার পায়ের আঘাতে,

যে দেখে তাহারে মরে সে আহারে তাহার রুপের প্রভাতে।

নামেতে হেলেনা কথা যে মেলে না বাখানিতে তার গীতি হে,

কবি হীনমতি মানি অখ্যাতি এখানে লিখিনু ইতি যে।

কবিতা , হেলেনা , অনুরোধ, খোসমানী, মা ও খোকা, আসমানী ।

কবিতা , হেলেনা , অনুরোধ, খোসমানী, মা ও খোকা, আসমানী ।

Leave a Reply