You are currently viewing ছন্দ শেখার পাঠশালা : স্বরবৃত্ত ছন্দ – কবি আবু তাহের বেলাল
ছন্দ - আবু তাহের বেলাল

ছন্দ শেখার পাঠশালা : স্বরবৃত্ত ছন্দ – কবি আবু তাহের বেলাল

ছড়া কবিতা ও গান লেখা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। অনেকে মনের আনন্দ থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। মনের আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ছন্দ,মাত্রা,উপমা, অলঙ্কার বা প্রকরণের দিকটা মাথায় নেন না, বিবেচনা করেন না। অনেকে শত শত গান কবিতা লিখে খাতা বা ডায়েরিবন্দী করেছেন। কেউ কেউ অসংখ্য বই বা গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে মনের আবেগে ভালো লাগা মন্দ লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে একটার পর একটা লিখেই চলেছেন। নিজের লেখায় নিজে হয়তো রসবোধ খুঁজে পাচ্ছেন, পরিতৃপ্ত হচ্ছেন। আবার তাদের কিছু ভক্ত অনুরক্ত বা শুভাকাঙ্ক্ষীও গড়ে উঠেছেন- তারা ছন্দ মাত্রা বা রস শাস্ত্র সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান রাখেন না। তারা লেখককে বাহবাহ দিয়ে প্রশংসায় গদগদ হয়ে দিনরাত একাকার করে ফেলছেন। এর দ্বারা ঐ লেখকের মনে তার লেখা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি ভাবছেন- তার লেখাতো ঠিকই আছে। স্বরবৃত্ত ছন্দ

সৌভাগ্যবশত কোন কোন পত্রপত্রিকায় এজাতীয় লেখকদের লেখাও মাঝে মাঝে ছাপানো হয়। তখন বিপত্তি আরও বেড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত কোন বোদ্ধা পাঠক বা সমালোচকের হাতে এই জাতীয় লেখকের লেখা পড়লে স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ সমালোচনাই করেন তিনি। তাতে ক্ষুণ্ন হন লেখক। সমালোচককে শত্রুভাবা শুরু করেন। স্বরবৃত্ত ছন্দ

প্রত্যেক জিনিসেরই নিয়ম কানুন কলা কৌশল আছে। সুনির্দিষ্ট রীতি পদ্ধতি আছে। প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু বা জিনিসই নিয়ম মেনে চলে,পদ্ধতিকে অনুসরণ করে। বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারও নিয়মেরই অনুবর্তী। ঘর গৃহস্থালির আটপৌরে কাজকামেও নিয়ম কানুন আছে। আমাদের মা বোনেরা রান্নাবান্না করেন-তারও বিজ্ঞান আছে, নিয়ম আছে। ঘর ঝাড়ুর কাজটাও পদ্ধতি অনুসরণ করেই করতে হয়।

নাপিত আপনার মাথার চুল কাটে, এই চুল কাটারও নিয়ম আছে, যা নাপিতকে রপ্ত করতে হয়,শিখতে হয়। আপনার ছেঁড়া জুতো যে সেলাই করে দেয়, রঙ লাগিয়ে দেয়- তাকেও সুনির্দিষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি অর্জন করতে হয়, নিয়ম রীতি আত্মস্থ করতে হয়। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য আমার অনেক লেখক বন্ধু এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে চান না। লিখতে গেলেও যে লেখার নিয়ম কানুন জানতে হবে, বুঝতে হবে এটাই মানতে চান না।

আমি প্রাচীনযুগ মধ্যযুগের কথা বলবো না। তখন সাহিত্যের সুনির্দিষ্ট ফরমেট গড়ে ওঠেনি। তৎকালীন কবি সাহিত্যিকগণ নিজস্ব একটা স্টাইলকে ধারণ করে তাদের মনোভাবনাকে লিখিত রূপ দিতেন, কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন, পদাবলী লিখতেন। তারা নির্দিষ্ট ফরমেট ও প্রকৃতিগত ধারণা বা অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর কারণে তাদের লেখাগুলোও একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা সেটা নিয়ে এখন নানা মাত্রিক গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছি।

আধুনিক যুগের সাহিত্য মূলত ক্ল্যাসিক সাহিত্য। সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন অনুসরণ করেই সাহিত্য লিখতে হবে। সেজন্যে সাহিত্য সৃষ্টির কলাকৌশল জানতে হবে, শিখতে হবে। পুরাতন নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়মও দাঁড়িয়ে যাবে এর মধ্য দিয়ে। কেউ যদি নিয়ম ভাঙতে চায়, তবে তাকে আগে প্রতিষ্ঠিত নিয়মকে জানতে হবে। নিয়ম জানলেই নিয়ম ভাঙা যাবে, নতুন পথের সন্ধান দেয়া যাবে।

ছন্দ শেখার পাঠশালা নবীন লেখকদের জন্যে ছন্দ শেখার খুব সহজ একটি ছন্দের ক্লাস। আমরা এখানে পুথিগত বিদ্যাকে কপি না করে সহজ সরল কথায়, গল্পের ছলে কথা বলার ভঙ্গিতে ছন্দ সম্পর্কে, ছড়া-গান-কবিতার প্রকরণ সম্পর্কে আলোকপাত করবো।এখান থেকে আড়াই যুগ পূর্বে আমি যখন ছাত্র ছিলাম, সেই ১৯৯০ সালে “ছন্দ শেখার পাঠশাল “ নামে দীর্ঘ একটি কিশোর কবিতা লিখেছিলাম। মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে আমাদের প্রিয় বন্ধুদেরকে সেই যে কিশোর কবিতাটির সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে চাই,তাতে আমাদের ছন্দ শেখার পাঠশালার কাজটা এগিয়ে নেয়া সহজতর হবে।

 

ছন্দ শেখার পাঠশালা

আবু তাহের বেলাল

 

আমার কজন বন্ধু আছে স্বনাম খ্যাত কবি

ছন্দ মাত্রার ধার ধারে না কাব্য করাই হবি।

কান্ধে ছালার ব্যাগ ঝুলিয়ে উদাস বাউল হাঁটে-

আকাশ থেকে মিল খুঁজে নেয় রবির সাথে ছবি।

::::

ভাবটা ধরে মধুসূদন রবীন্দ্র কী নজরুল

অভিধানের শব্দ ঘেঁটে বানান লেখে সব ভুল।

নিজকে ভাবে শক্তি-সুনীল কাব্য লেখে গদ্যে-

কেউ ভাবে না ছন্দ ছাড়া সৃষ্টি যে হয় ভণ্ডুল।

::::

তাদের দলে কেউ ভিড়ো না নতুন যারা লেখ

ছন্দটাকে ভাঙতে হলে ছন্দ আগে শেখো।

ছন্দ লয়ের হিসেব ছাড়া লিখছে যারা লিখুক-

যুগ ডিঙাতে পারবে না কেউ তোমরা সবাই দেখো।

::::

ছন্দ শেখার পাঠশালা তাই খুলতে এলাম আজি

আমার কথায় তোমরা যদি হও সকলে রাজি!

মোটামুটি তিন নিয়মে হয় কবিতা লেখা-

জানবে যখন তোমরা হবে সকল কাজের কাজী।

::::

সবার আগে জানতে যে হয় অক্ষর মাত্রা পর্ব

এজ্ঞান ছাড়া যায় না করা লেখালেখির গর্ব।

অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত-

না জানলে ঐ সুনাম খ্যাতির সবটা হবে খর্ব।

::::

এখন তবে এক এক করে যায় করা যায় শুরু

কী শেখাবো পুঁজি তো নেই বিদ্যে ছাড়াই গুরু।

পড়লে ধরা জুটবে দেদার হাজার বিড়ম্বনা-

ভয়ে ভয়ে বক্ষ আমার কাঁপছে দুরু দুরু।

::::

অক্ষর প্রসঙ্গ:

কাব্যকলায় দুধরনের অক্ষর আছে জানি

মুক্ত এবং বদ্ধ বলে করি টানাটানি।

মুক্তাক্ষরে শ্বাসকে বাড়াও যতো ইচ্ছে কবি-

থমকে গেলে চলার গতি বদ্ধ অক্ষর মানি।

::::

‘বলাকা’তে তিনটি আছে মুক্ত ডানার পাখি

আকাশ পথে যাচ্ছে উড়ে মেঘের আবির মাখি।

এক শিকারী মারতে যে চায় পাষাণ পাথর বড্ড-

অনেক পেলে বদ্ধ-অক্ষর পরাও প্রেমের রাখী।

::::

সকল ছন্দেই মুক্তাক্ষরে একটি মাত্রা মোটে

বদ্ধ-অক্ষর লিখতে যতো আপদ বিপদ জোটে।

আজ চুকিয়ে দিই যদি দিই সেই ঝামেলা ঝক্কি-

ছন্দ দোলায় খই ফোটানো চাই সকলের ঠোঁটে।

মাত্রা প্রসঙ্গ:

মাত্রা হলো অক্ষরগুলোর উচ্চারণের কালটা

সিলেবলের হিসেব শেখার যেমন মেলি জালটা।

কানকে করো সজাগ এবং চোখটা রেখো খোলা-

বিলে ঝিলে জোছনা নীলে মারবে যখন ফালটা।

সঙ্গীতে এই মাত্রাটা যে তাল নামেতেই চেনা

নাচের বেলা মুদ্রা ও লয় যায় না টাকায় কেনা।

একলা বসে মাত্রা কষে খাটাও মাথা কবি-

ভেবেই আকুল পণ্ড যে শ্রম কে শোধে কার দেনা!

পর্ব প্রসঙ্গ:

পর্ব হলো এক চরণের ক্ষুদ্রতম অংশ

তিন প্রকৃতির হতে পারে পর্ব খেলার বংশ।

অতি-পূর্ণ-অপূর্ণ আর ভাঙা মাঝে মধ্যে-

হিসেব ছাড়া মেধা মনন আর করো না ধ্বংস।

অন্ত্যমিল:

অন্ত্য মিলের রহস্যটা এবার দেবো খুলে:

‘চরণ শেষে ধ্বনির মিলন’-কেউ যেয়ো না ভুলে।

যেমন দেখো : মনের ‘ভুলে’ গোলাপ ‘তুল’তুমি-

নিজের হাতে দাও পরিয়ে শ্রাবণ মেঘা ‘চুলে’।

::::

অন্ত্যমিলটা হতেই পারে বিচিত্র এক খেলা

পর চরণের প্যারায় যদি ভাসাও মনের ভেলা

প্রথম-দোসরা,তেসরা-চৌঠার মিলতে পারে ধ্বনি-

প্রথম-তেসরা,দোসরা-চৌঠারয় জমতে পারে মেলা।

::::

চার চরণেও আসতে পারে একই ররম ধ্বনি

প্রথম চৌঠা,দোসরা তেসরায় হয় যে সমাপনী,

প্রথম দোসরা চৌঠা সমিল অমিল শুধু তেসরায়-

এমন করেই মিলের তারায় সুরের আগমনী।

স্বরবৃত্ত ছন্দ:

প্রথম বলি: স্বরবৃত্ত দুলকি চালের ছন্দ

দুয়ে দুয়ে চারের বাঁধন নেইতো দ্বিধা দ্বন্দ্ব।

যুক্ত-বদ্ধ সব অক্ষরে মাত্রা ধরে একটি-

অনায়াসে যাও পেরিয়ে সকল খানা-খন্দ।

::::

আরো আছে স্বরবৃত্তের নিয়ম কিছু বাকি

মাত্রা পর্ব সমান সমান কেউ দিও না ফাঁকি।

ভাবটা রেখে সহজ সরল অন্ত্যমিলও খাসা-

রুমুর ঝুমুর চমক চমক শব্দ এনো ডাকি।

::::

গানের ছন্দ ছড়ার ছন্দ প্রাণের স্বরবৃত্ত

আশিক মাশুক ভক্ত সবাই ভক্ত মনিব ভৃত্য,

জেনে বুঝে ভাঙতে পারো স্বরবৃত্তের চালটা-

তুমি যখন বুঝতে পারো তোমার তাবৎ কৃত্য।

::::

চারের বাঁধন ভেঙে দিয়ে গানের সুরে তালে

গীতল স্বরবৃত্ত নামে বাতাস লাগাই পালে,

ভাঙা গড়ার এমন খেলা নতুন কিছুর ঝোঁকে-

আসছে চলে বোধের স্রোতে সকল কবির কালে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:

এবার বলি অক্ষরবৃত্ত মোটেও কঠিন নয়তো

পয়ার নামে যার পরিচয় ছান্দোসিকী কয়তো।

প্রাচীন-মধ্য-এই আধুনিক সকল যুগে যুগে-

কল্পো লোকের ছন্দগাঁথায় জয় শুধু তার জয়তো।

::::

দুই মাত্রা দাও শব্দ শেষে আসলে বদ্ধ অক্ষর

এই নিয়মের নেই ভেদাভেদ বিশেষ কোন পক্ষর।

‘বন্ধুর’ লিখে একে দুয়ে মাত্রা বসাও তিনটি-

‘বন্’পেলো এক ‘ধুর্’ পেলো দুই নেই ঝামেলা ঝক্কর।

::::

তিন হালাতে ফারাক আছে শঙ্কা যে নেই তাতে

অক্ষর বৃত্তের বদ্ধ-অক্ষর অন্ত্য ছাড়াও যাতে

পাখির কোলায় দোদুল দোলায় আসলে আদি মধ্যে-

হেসে খেলে দুই মাত্রা পায় সকল কবির হাতে।

::::

সমাসব্দ্ধ নির্দেশ বাচক কথ্য ক্রিয়াপদে

যেমন দেখ-‘পালটি’ নায়ের ‘ছিঁড়লে’ সাগর নদে।

‘রাতদিন’ কারো হয় না মালুম মৃত্যু শুধু ডাকে-

ঝড় তুফানে যায় শাসিয়ে কেউ না তারে রদে।

::::

অক্ষর বৃত্তের ভাষা এবং সুরটা হবে গাঢ়

ধীর গতিতে ফেলবে কদম বৈঠা এবং দাঁড়্ও।

পর্ব গোনার হিসেব নিকেশ নেইতো বাঁধা ধরা-

তারপরেও বষ মেনে যায় বনের ক্ষ্যাপা ষাঁঢ়ও।

::::

অক্ষরবৃত্তের বিচিত্ররূপ স্বাধীনতার নামে

লম্বা খাটো চরণ দেখি অক্ষরবৃত্তের খামে,

হিসেব ছাড়া নয় তবু সে মেপে মেপেই চলে

অকবিরা নাচতে থাকে কবির ডানে বামে।

::::

আটে ছয়ে, দশে আটে অক্ষরবৃত্ত হাঁটে

বাইশ ছাব্বিশ তিরিশ চৌত্রিশ হরেক মাত্রা খাটে,

ভাঙা গড়ার অনেক খেলাই খেলছে অনেক কবি-

তারাই সফল ধ্যানী যারা ছন্দ সুরের বাটে।

মাত্রাবৃত্ত:

মুক্তাক্ষরে এক মাত্রা আর বদ্ধাক্ষরে দুটি

নরম কোমল শব্দগুলো বাঁধে ফুলেল জুটি,

আদি মধ্যে এবং অন্ত্যে নেই ব্যবধান মোটে-

ভাবের সাধক প্রেম সাধনায় খাওরে লুটোপুটি।

::::

মাত্রা পর্ব সমান তালে ঠিক রেখে যে চলে

ছন্দ রসিক সবাই তাকে মাত্রাবৃত্ত বলে,

একটু ঢিমে মধ্য লয়ই মাত্রাবৃত্তের গতি-

নিত্য ছড়ায় আলোর জ্যোতি হাজার কথার ছলে।

যাবার বেলা:

বৃত্ত ত্রয়ীর চিত্ত মাঝে বিচিত্র সব রীতি

প্রবোধ নীরেন জামান কাদির সবার একই নীতি।

বাকি টুকু নিজেই শেখ জানার সীমা নেইতো-

আপাতত দিলাম এখন ছন্দ খেলার ইতি।

 

ছড়া কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ

 

ছন্দ ছাড়া ছড়া,কবিতা বা গান লেখার কোন সুযোগ নেই। যারা মনে করেন ছড়া কবিতা লিখতে গেলে কোন নিয়ম কানুন বা পদ্ধতির প্রয়োজন নেই, শুধু মনের আবেগকে ভাব ভাষায় প্রকাশ করলেই হলো।তাদের ধারনাটা ভুল আর ভুল। অনেকে আবার ছন্দ বলতে অন্ত্যমিলকেই বুঝে থাকেন। সেটাতো আরও বড় ভুল। ছন্দ ও অন্ত্যমিল সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। যদি আমরা লেখালেখিতে ভালো করতে চাই তবে লেখালেখির নিয়মকানুনটা অবগত হতে হবে। বিশেষ করে ছন্দজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।সহজভাবেই আমরা নিম্নে ছন্দ বিষয়ক খুটিনাটি বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

 

ছন্দের সংঙ্গা

প্রত্যেক জিনিসের স্বাভাবিক প্রকৃতিই তার ছন্দ। নদীর স্রোতধারার একটি ছন্দ আছে। বাতাসের স্বাভাবিক যে গতিবেগ তারও একটি ছন্দ আছে। পাখির কলকাকলীর মধ্যেওে ছন্দ আছে। ছন্দ আছে ঘোড়ার চলার গতিতে। হুইসেল বাজিয়ে যে ট্রেন ঢাকা থেকে চট্টলা ছুটছে তারও একটি ছন্দ আছে। এককথায়-প্রকৃতি জগৎ,প্রাণী জগৎ,বস্তু জগৎ – সব কিছুই এক ছন্দায়িত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলছে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে- ছড়া, কবিতা বা গানের ছন্দ কী? সেটাও কী তবে ছড়া, কবিতা চলার স্বাভাবিক গতি? অনেকটা তাই। ছন্দ ছড়া কবিতার একরকম সুর তরঙ্গ, এমন শৃঙ্খলিত বিন্যাস কাঠামো- যার মাধ্যমে লেখকের মনের কথা রসবোধ সম্পন্ন হয়ে অন্য মানুষের হৃদয় মনেও রোমাঞ্চ জাগাতে পারে, সুর তুলতে পারে ছন্দ সাধাররণত তিন প্রকার। আভিধানিক অর্থে- ছাঁদ, পদ্যবন্ধ, রচনানুবন্ধ, মাত্রা বা তাল, পদ্যের রচনারীতি (উল্লেখ্য- সব সৃজনশীল লেখার মধ্যেই ছন্দ আছে। গল্প লেখার ছন্দ আছে, প্রবন্ধ লেখার ছন্দ আছে, উপন্যাস ও নাটকেরও ছন্দ আছে। প্রতিটি লেখার অন্তর্নিহিত যে শক্তি থাকে সেটাই ছন্দ। ছড়া বা কবিতার ছন্দটা প্রত্যক্ষ; তাই আমরা ছন্দ বলতে মূলত পদ্যরচনারীতিকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকি।

আরও পড়ুন — ইসলামী গান : সমস্যা ও সম্ভাবনা

 

ছন্দের প্রকারভেদ

ছন্দ সাধারণত তিন প্রকার্

ক। স্বরবৃত্ত ছন্দ;স্বরবৃত্ত ছন্দ সাধারণত দ্রুত লয়ের ছন্দ।

খ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ;মাত্রাবৃত্ত ছন্দ মধ্য লয়ের ছন্দ।

গ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ;অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বিলম্বিত বা ধীর লয়ের ছন্দ।

ছন্দ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে সংক্রান্ত আরও কিছু বিষয় সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারনা নিতে হবে। যেমন:

১। অক্ষর কাকে বলে? অক্ষর কতপ্রকার ও কী কী?

২। মাত্রা কী? কোন অক্ষরে মাত্রা কীভাবে গণনা করবো?

৩। অন্ত্যমিল কাকে বলে? কিভাবে অন্ত্যমিল দেবো?

৪। স্তবক কী?

৫। পর্ব কী? পর্ব কতপ্রকার ও কী কী?

 

প্রথমে জেনে নেবো-

অক্ষর কাকে বলে?

অক্ষরমূলত এক প্রয়াসে উচ্চারিত শব্দাংশ। অর্থাৎ ছড়া কবিতা বা গানে ব্যবহৃত শব্দকে আমরা একসাথে উচ্চারণ করি না। বরং ভেঙে ভেঙে কেটে কেটে উচ্চারণ করি। বাংলা বর্ণমালার বর্ণের সাথে অক্ষরকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বর্ণের সাথে যখন কারচিহ্ন যুক্ত হয়ে ধ্বনির সৃষ্টি করে তখনই অক্ষরের সৃষ্টি হয়।

সেক্ষেত্রে একাধিক বর্ণ মিলেও কিন্তু একটি অক্ষর পাই।

যেমন দেখুন:

ক- এই ব্যঞ্জন বর্ণটি গঠিত হয়েছে- ক+অ এর মাধ্যমে।

ধ্বনির লিখিত রূপ হিসেবে ‘ক’ একটি বর্ণ। আবার শব্দের সাথে যখন ব্যবহার হচ্ছে তখন নাম হয়ে যাচ্ছে অক্ষর।

সহজ হবে আরেকটা উদাহরণ দেখলে। যেমন- কনকনে শব্দটি দেখুন। বর্ণহিসেবে এই শব্দটির মধ্যে ৪টি বর্ণ আছে ( ক+ন+ক+ন, এই চারটি বর্ণের সাথে অ ধ্বনি এবং এ-কার ধ্বনিও যুক্ত হয়েছে।)। কিন্তু উচ্চারণের অবস্থা অনুযায়ী পাচ্ছি তিনটি অক্ষর (কন্ একটি কনে দুটি)।

 

অক্ষর বনাম Syllable

অক্ষরের ধারণাটা পরিস্কারের জন্যে আমরা ইংরেজি সিলেবলের (Syllable) সহায়তা নিতে পারি। (Syllable) কী তবে? (Syllable) হচ্ছে: এক প্রয়াসে উচ্চারিত শব্দাংশ। যেমন: Phone এই শব্দের ভেতর পাঁচটি letter আছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে (Syllable) আছে মাত্র একটি। আবার দেখুন Telephone শব্দটি উচ্চারণ করছি Te+Le+Phone (বাংলায় লিখলে: টেলিফোন- টে+লি+ফোন) ইংরেজিতে বললে তিনটি (Syllable) আর বাংলায় বললে তিনটি অক্ষর রয়েছে টেলিফোন শব্দটির মধ্যে।

আবার দেখুন টেলিফোন(Telephone) বাংলায় লিখলে কারচিহ্ন ছাড়াই চারটি বর্ণ আছে, আর ইংরেজিতে Letter আছে নয়টি। যখন এটাকে অক্ষর বা Syllable হিসেব করবো তখন পাবো মাত্র তিনটি অক্ষর/ Syllable.

ইংরেজিতে যেমন Syllable দুপ্রকার:

ক। Open Syllable &

খ। Closed Syllable),

তেমনি বাংলাতে অক্ষর দুপ্রকার:

ক। মুক্তাক্ষর এবং

খ। বদ্ধাক্ষর

 

যিনি ইংরেজি Syllable বুঝবেন তিনি বাংলার অক্ষরও বুঝবেন। তাই Syllable এর পাঠটা আগে ঝালিয়ে নিই।

Syllable এর সংঙ্গা আগে আমরা দেখেছি।

বাকি আছে Open Syllable এবং Closed Syllable কাকে বলে সেটা জেনে নেয়া।

যে Syllable উচ্চারণের সময় বাতাস কোথাও বাঁধাপ্রাপ্ত হয় না এবং ধ্বনিকে ইচ্ছেমতো প্রলম্বিত করা যায়-সেই Syllable কে Open Syllable বা মুক্ত Syllable বলে। Open Syllable ই মুক্তাক্ষর। যেমন: টেলিফোন ( Telephone) শব্দের মধ্যে টে+লি ( Te+le) দুটো Open Syllable / মুক্তাক্ষরকে পাঠক ইচ্ছেমতো টেনে টেনে পড়তে পারবেন।

অপরদিকে Closed Syllable সেই Syllable কে বলে-যা উচ্চারণের সময় বাতাস বাঁধাপ্রাপ্ত হয়,অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেমে যেতে হয়, শ্বাসে তালা লাগানো হয়। যেমন- ফোন (Phone) শব্দটি। এখানে বাতাস বা শ্বাসকে কিন্তু ইচ্ছেমতো প্রলম্বিত করা যাচ্ছে না, প্রলম্বিত করা যাচ্ছে না। থামতেই হচ্ছে। তাই ফোন (Phone) Closed Syllable বাংলায় বললে বদ্ধাক্ষর।

বদ্ধাক্ষর বোঝার জন্যে আমরা আরবী ভাষার সহযোগিতা নিতে পারি। যেমন: জবর,জের, পেশ যুক্ত হরফই মুক্তাক্ষর বা Open Syllable অপরদিকে সাকিন বা জযমযুক্ত হরফকে Closed Syllable বা বদ্ধাক্ষর বলতে পারি। যেমন: ফাতিহা- ফা+তি+হা = তিনটি মুক্তাক্ষর এখানে। আবার কিতাব- কি+তাব এখানে কি মুক্তাক্ষর কিন্তু তাব্ বদ্ধাক্ষর।

আরও পড়ুর– বাংলা ছন্দ আনন্দ (পর্ব-০২):: ছন্দ শেখার পাঠশালা-

 

মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরকে চেনার জন্যে আমরা কয়েকটা শব্দ বা আমাদের নামকে ব্যবহার করতে পারি। যেমন:

ক। মালেকা:  মা+লে+কা (১+১+১= ০৩),তিনটি মুক্তাক্ষর।

খ। রাহিমা:  রা+হি+মা (১+১+১= ০৩), তিনটি মুক্তাক্ষর।

গ। পল্লব: পল্ + লোব্ (১+১=০২) দুটি বদ্ধাক্ষর

ঘ। বন্ধন: বন্+ ধোন্ ( ১+১=০২) দুটিই বদ্ধাক্ষর।

ঙ। বুটিক: বু+টিক্ (১+১=০২) বু-মুক্ত ও টিক্ বদ্ধাক্ষর

চ। হিজল: হি+জোল্ (১+১=০২)হি-মুক্ত ও জোল্ বদ্ধাক্ষর

 

দেখুন অনেকে সংযুক্ত ব্যঞ্জন এবং বদ্ধাক্ষরকে এক করে ফেলেন বা গুলিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ সংযুক্ত ব্যঞ্জনকেই বদ্ধাক্ষার মনে করে। কিন্তু এদুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছেন। দুয়ের পরিচয়ই পৃথক পৃথক। বদ্ধাক্ষরের পরিচয় আগে দিয়েছি। এখন সংযুক্ত ব্যঞ্জন টা চেনাবার পালা।

সংযুক্ত ব্যঞ্জন হচ্ছে দুটো ব্যঞ্জন বর্ণ একসাথে যুক্তভাবে ব্যবহৃত হওয়া। যেমন: ক্ত, ম্ন,ম্ল, স্ম, হ্ন,হ্ণ, হ্ব, ব্দ, ন্থ প্রভৃতি।

শব্দের ভেতরে তবে এদের প্রয়োগটা কেমন হচ্ছে? দেখুন:

শক্ত, রক্ত, চিহ্ন, বহ্নি, অপরাহ্ণ, স্মরণ,স্মৃতি।

এসব উদাহরণ থেকে আমরা বদ্ধাক্ষর ও মুক্তাক্ষর বের করে আনতে পারি। যেমন:

শক্ত: শক্ + তো (শক্ বদ্ধাক্ষর এবং তো মুক্তাক্ষর)

রক্ত: রক্ + তো ( রক্ বদ্ধাক্ষর এবং তো মুক্তাক্ষর)

স্মরণ: শ+ রোন্ (শ মুক্তাক্ষর এবং রোন্ বদ্ধাক্ষর)

দেখতে পেলাম যুক্তব্যঞ্জন ভেঙেই বদ্ধাক্ষর গঠিত হচ্ছে।

 

আশা করছি, ছড়া,কবিতা ও গানে ব্যবহৃত মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর সম্পর্কে আর কারো ঝামেলা থাকবে না।

 

ছন্দ ভেদে অক্ষরের মাত্রা প্রয়োগ পদ্ধতি:

এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা সঙ্গত মনে করছি। তা হলো:

ক। মুক্তাক্ষর সব ছন্দেই একমাত্রা বিশিষ্ট হয়।

খ। বদ্ধাক্ষরের মাত্রা গণনায় ছন্দভেদে তারতম্য ঘটে।

যেমন:

০১। স্বরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর সব সময় এক মাত্রা হয়

০২। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর সব সময় দুই মাত্রা হয়

০৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের শেষে বদ্ধাক্ষার দুই মাত্রা হয়

 

একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি খোলাশা করা য়ায়। যেমন: “বন্ধন” শব্দের মাঝে দুটি বদ্ধাক্ষর আছে (বন্+ধন্)।

#স্বরবৃত্ত ছন্দে বন্ধন ০১+০১=০২ মাত্রা পেয়েছে।

#মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বন্ধন ০২+০২=০৪ মাত্রা হয়েছে।

#অক্ষরবৃত্তে বন্ধন ০১+০২= ০৩ মাত্রা লাভ করেছে।

 

উল্লেখ্য: বদ্ধাক্ষর শব্দের শুরুতে এবং মাঝে বসেও তিনটি ক্ষেত্রে দুমাত্রার মর্যাদা লাভ করে। যেমন:

০১। নির্দেশক পদে: লোকটি -২+১=০৩টি মাত্রা

০২। সমাসবদ্ধ পদে: নদনদী-২+১+১=০৪টি মাত্রা

০৩। কথ্য ক্রিয়াপদে: বললাম- ২+২=০৪টি মাত্রা।

আশাকরি অক্ষর চিনতে আর কারও বাকি নেই। কিন্তু মাত্রা বিষয়টা এখনো বলা হয় নি। অথচ অনেক জায়গায় মাত্রা মাত্রা করে যাত্রা ভগ্ন হবার যোগাড় হয়েছে। এবার সংক্ষেপে মাত্রা সম্পর্কে একটু আলোকপাত করি।

 

মাত্রা প্রসঙ্গ

মাত্রা বলতে মাত্রা হচ্ছে যেকোন জিনিসের পরিমাপক। ব্যালেঞ্চ রেখে কথা না বললে আমরা বলি কথার মাত্রা জ্ঞান নেই। কেউ কাজ কর্মে বেয়াড়া আচরণ করলে বলি: মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সতর্ক করার জন্যে আমরা বলি: মাত্রা অতিক্রম করা ভালো নয়। বাচ্চার গায়ে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমরা বলি: মাত্রাতিরিক্ত জ্বর এসেছে। এই মাত্রা কথাটার মধ্যে একটা ব্যালেঞ্চ, ভারসাম্যপূর্ণ রীতিনীতি ও পরিমাপকের কথা বলা হয়ে থাকে।

ছড়া কবিতায় মাত্রা বলতে অক্ষরের ন্যূনতম সময়কালকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ একটি অক্ষর বা Syllable ন্যূনতম যে সময়টুকু প্রয়োজন হয়- সেটাই মাত্রা। যেমন: বালিকা – এখানে তিনটি মুক্তাক্ষর আছে। প্রতিটি অক্ষরই একমাত্রা বিশিষ্ট হয়েছে।

মাত্রা হিসেব করার জন্যে নিম্নের পন্থা আমরা অনুসরণ করতে পারি।

ক। মুক্তাক্ষারের মাত্রা গণনায় শুধু অক্ষরের ওপরে একটা করে খাড়া দাগ (আলিফ বা One-1 এর মতো) দিতে পারি। ওপরের দৃষ্টান্ত আবারও দিচ্ছি:

বালিকা: 1 1 1

বা লি কা= ০৩ মাত্রা হলো।

আবার বদ্ধাক্ষর বোঝাতে বদ্ধাক্ষরের ওপর বর্ণের পূর্ণ মাত্রার মতো আড়াআড়ি করে দাগ টেনে দিতে হবে এবং সেই দাগের ওপরে মাত্রার সংখ্যা বসাতে হবে। যেমন:

বন্ধন: 1 11

বন্ ধোন্ = ০৩ মাত্রা হলো।

ছড়া কবিতায় যাকে আমরা মাত্রা বলে চিহ্নিত করি (সময়কাল), গানের ক্ষেত্রে তাকে লয় বলা হয়ে থাকে। আবার নাচের সময়কালকে মাত্রাকে মুদ্রা বলে।

 

অন্ত্যমিল প্রসঙ্গ

অন্ত্যমিল ছড়া,কবিতা ও গানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। অধিকাংশ পাঠক অন্ত্যমিলকে ছন্দজ্ঞান করে বড্ড গরমিল করে ফেলে ছড়া কবিতার আলোচনায়। ছন্দ আর অন্ত্যমিল কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো বিষয়। ছন্দ হচ্ছে লেখার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, বিন্যাস বা বাঁধন। ছন্দ ছাড়া কোন ছড়া, কবিতা বা গান লেখা সম্ভব নয়। ছন্দ অপরিহার্য একটি বিষয়। অনেকে আধুনিক কবিতা মুক্ত ছন্দে লেখার কথা বলেন, বলেন গদ্য ছন্দ বা গদ্য কবিতার কথাও। সাধারণভাবে এজাতীয় লেখায় কোন ছন্দ নেই বলে কেউ কেউ মনে করলেও-তা কিন্তু ঠিক নয়। আধুনিক কবিতা হোক, গদ্য কবিতা হোক, মুক্ত ছন্দের কবিতা হোক- ছন্দ তাতে থাকবেই কবির হাতেই যদি তা লিখিত হয়ে থাকে। অকবিদের কষ্টকাব্যের কথা এখানে আর নাইবা বলি।

অপর দিকে অন্ত্যমিল হচ্ছে চরণের শেষ শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্য। যা কবিতার জন্য অপরিহার্য বিষয় নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অন্ত্যমিল ছাড়াও কবিতা লেখা যায়, কিন্তু ছন্দ ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি কবি জসীম উদদীনের কবর কবিতা থেকে:

এইখানে তোর/ দাদির কবর/ ডালিম গাছের/তলে

তিরিশ বছর/ ভিজায়ে রেখেছি/ দুই নয়নের / জলে।…

এইদুটো চরণের শেষ শব্দের ধ্বনি সাদৃশ্য দেখেন- তলে এবং জলে। কী সুন্দর ধ্বনিগত সাদৃশ্য।মনে রাখার মতো মিল। এই মিলটা অন্ত্য বা শেষে হবার কারণে তার নামটাও দেয়া হয়েছে-অন্ত্যমিল।

অন্যদিকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতাটি দেখুন:

এসেছে নতুন শিশু

তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ মৃত আর ধ্বংস স্তূপ পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের;

চলে যাবো ,তবু আজ যতোক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল।

সুকান্তের এই বহুল পঠিত ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতাটিতে অন্ত্যমিল নেই, কিন্তু ছন্দ আছে।

 

অন্ত্যমিলের প্রকারভেদ

একজন সফল ছড়াকার, কবি বা গীতিকার তার ইচ্ছে মতোন অবশ্যই অন্ত্যমিল দিতে পারবেন, যদি তিনি প্রতিটি ছন্দের অন্তর্গত প্রাণশক্তি ধারণ করতে পারেন, কানকে সজাগ রেখে চরণের গতিকে ধরে রাখতে সক্ষম হন। গানে উনিশ বিশ কী নিরানব্বিই একশত এই তারতম্য টুকুনও কেমন জানি লেখকের ব্যর্থতা ও দৈন্যকে প্রকট করে তোলে। প্রচলিত অন্তমিলের কয়েকটি ধারণাকে (চার চরণ বিশিষ্ট স্তবকের অন্ত্যমিল) নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ

খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ

গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ

ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি)

ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ

চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি)

 

এর বাইরেও বিচিত্র অন্ত্যমিল দেয়া যেতে পারে। তবে একটি গানের মধ্যে এক এক প্যারায় এক এক রকম না করে প্রথম থেকে শেষ পর অবধি একই রকম অন্ত্যমিল ও মাত্রা বিন্যাসকেই আমরা আদর্শ বলতে পারি।নিরীক্ষার নামে যাতে কোন বিশৃঙ্খলার সুযোগ তৈরি না হয়, তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। প্রচলিত কয়েকটি অন্ত্যমিলের দৃষ্টান্ত নিচে উল্লেখ করা হলো:

ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ

সকল জীবের তুমি খালিক

তুমি অশেষ একক অসীম,

দোজাহানের তুমি মালিক

তুমি গাফুর মহা মহীম।।

 

খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ)

মল বাজিয়ে মেঘের খামে

সারা দিনই বৃষ্টি নামে,

বৃষ্টি নামে ফোটায় ফোটায়

কদম কেয়া ফুলের বোটায়।

 

গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ

সোনার দেশে সোনার মানুষ কই

যেদিক তাকাই ডাকাত এবং চোর

গুমের ভয়ে আটকে রাখি দোর

আমরা তবু চুপটি করে রই।

 

ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি)

অলসতা কেউ করি না

উঠি সকাল বেলা,

ভালো করে মুখ ধুয়ে নিই

কেউ করি না হেলা।

 

ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ

স্বপ্ন আমার সবুজ শীতলপাটি

জোয়ার ভাটার নিরেট পলিমাটি

স্বপ্ন বোনার স্বপ্নে বিভোর হাঁটি

স্বপ্ন তবু হয় না পরিপাটি।

 

চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি)

পায়ের নিচে সবুজ শ্যামল ভূমি

জোছনা নেমে যায় যেন তার চুমি

ফারাক্কার ঐ মরণ বাঁধের ফলে-

বাঁচা মরার সংগ্রামে আজ তুমি!

 

স্তবক প্রসঙ্গ

ছড়া বা কবিতা শুধু নয়, যে কোন লিখিত বিষয়ে স্তবক বা প্যারা পরিভাষাটি বেশ পরিচিত। স্তবক বা প্যারা একটি লেখার ভাব ও বিষয়বস্তু অনুসারে বিভক্ত হয়ে থাকে। অর্থ প্রকাশে ও রস আস্বাদনে যা বিশেষ ভূমিকা রাখা। ছড়া কবিতায় সাধারণত চারটি চরণের সমন্বয়ে এক একটি স্তবক বা প্যারা গঠিত হয়। চরণের সংখ্যা কম বেশিও হতে পারে। সনেটে আমরা দেখি-আট চরণের এবং ছয় চরণের প্যারা। স্বরবৃত্ত,অক্ষরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দের অন্ত্যমিল প্রধান ছড়া কবিতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে চার চরণের পর্বই আমরা পাবো। তবে মুক্ত ছন্দ বা গদ্য ছন্দে লিখিত আধুনিক কবিতায় স্তবকের চরণসংখ্যা কম বেশি প্রায় লক্ষ্য করা যায়। “ছন্দ শেখার পাঠশালা” কিশোর কবিতার একটা স্তবক বা প্যারা নিম্নে উল্লেখ করলাম:

অন্ত্যমিলটা হতেই পারে বিচিত্র এক খেলা

পর চরণের প্যারায় যদি ভাসাও মনের ভেলা

প্রথম-দোসরা,তেসরা-চৌঠার মিলতে পারে ধ্বনি-

প্রথম-তেসরা,দোসরা-চৌঠারয় জমতে পারে মেলা।

 

পর্ব প্রসঙ্গ

পর্ব শব্দটি আমাদের আটপৌরে জীবনে বিভিন্ন ভাবে পরিচিত। বিয়ে শাদিতে বলি গায়ে হলুদ পর্ব। বৌভাত পর্ব। একটা বড় জিনিসের ক্ষুদ্রতম পার্ট বা অংশকেই আমরা সাধারণত পর্ব বলি। ছড়া কবিতায় একটি চরণের ক্ষুদ্রতম অংশ, পাঠ বা আবৃত্তির সময় যা অদৃশ্যমান ছেদ বা বিরাম চিহ্নের মতো কাজ করে, ইচ্ছে করলেই পাঠক বা আবৃত্তিকার যেখানে দম নিতে পারে। যেমন দেখুন:

পর্ব হলো/ এক চরণের/ ক্ষুদ্রতম/ অংশ

তিন প্রকৃতির/ হতে পারে/ পর্ব খেলার/ বংশ।

অতি-পূর্ণ-/অপূর্ণ আর/ভাঙা মাঝে/ মধ্যে-

হিসেব ছাড়া/ মেধা মনন/ আর করো না/ ধ্বংস।

উপরের উদাহরণে প্রতিটি চরণকে চারটি করে অংশে ভাগ করা হয়েছে। যে ভাগগুলোতে বিরাম চিহ্ন না থাকলেও শ্বাস বা দম নেবার একটু বিরতি নেবার যেন প্রচ্ছন্ন সুযোগ রয়েছে।

 

আশাকরি পর্ব চেনা আর ঝামেলা থাকবে না। তবে পর্বের শ্রেণিবিভাগটাও জেনে নেয়া দরকার। পর্ব মূলত তিন প্রকার। যথা:

০১। পূর্ণ পর্ব।

০২। অপূর্ণ পর্ব বা ভাঙা পর্ব

০৩। অতি পর্ব।

 

পূর্ণ পর্ব বলতে বেশি এবং সমান মাত্রা বিশিষ্ট পর্বকেই বোঝানো হয়। উপরের উদারণে প্রতিটি চরণে তিনটি করে পূর্ণ পর্বের দৃষ্টান্ত রয়েছে (পর্ব হলো/ এক চরণের/ ক্ষুদ্রতম/ অংশ)।

এবার অপূর্ণ পর্বে কথায় আসি। অপূর্ণ পর্ব যা পূর্ণপর্বের তুলনায় কমসংখ্যক মাত্রা বিশিষ্ট হয় এবং চরণের শেষাংশে ব্যবহৃত হয়। সব কবিতায় কিন্তু অপূর্ণ পর্ব ব্যবহৃত হয় না। যেমন: ‘পর্ব হলো/ এক চরণের/ ক্ষুদ্রতম/ অংশ’-এই চরণের শেষ শব্দ ‘অংশটাই হচ্ছে অপূর্ণ পর্বের উদাহরণ। অনুরূপভাবে ওপরের কবিতাংশে বর্ণিত চরণগুলোর শেষ শব্দ ‘বংশ’, ‘মধ্যে’, ‘ধ্বংস, শব্দ তিনটিও অপূর্ণ পর্ব বা ভাঙা পর্বের উদাহরণ।

অতিপর্ব হলো চরণের মূল মাত্রা বা পর্বের অতিরিক্ত ব্যবহৃত শব্দ যা সাধারণত চরণের শুরুতে পৃথকভাবে ব্যবহৃত হয়। অতিপর্বের ব্যবহার খুবই কম।কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতায় আমরা অতি পর্বের বেশ প্রয়োহ লক্ষ্য করি। যেমন।

আমি চিরদুর্দম,দুর্বিনীত,নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন/ আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়,আমি অভিশাপ পৃথ্বীর।

এই চরণ তিনটিতে প্রথমে ব্যবহৃত শব্দগুলি অতিপর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

পর্বের এই আইডিয়ার পাশাপাশি মধ্যখণ্ডন সম্পর্কে একটু বলে রাখি। মধ্য খন্ডণ হচ্ছে একটি শব্দকে ভেঙে ফেলে, দুভাগ করে ফেলা। মূলত পূর্ণ পর্বের মাত্রা মেলানোর জন্যে পরবর্তী শব্দকে দু অংশকে বিভক্ত করাকে মধ্যখণ্ডন বলা হয়ে থাকে। যেমন: ‘গানের ছন্দ/ প্রাণের ছন্দ/ প্রিয় স্বর/বৃত্ত’ এখানে স্বরবৃত্ত শব্দটিকে দুভাগ করে ফেলা হয়েছে প্রিয় শব্দের সাথে মিলিয়ে পূর্ণ পর্বের হিসাব মিলানোর জন্যে। এজাতীয় পরিস্থিতি মাঝে মাঝে আমরা লক্ষ্য করতে পারবো।

 

স্বরবৃত্ত ছন্দ প্রসঙ্গ

বাংলা কবিতার প্রচলিত তিন প্রকার ছন্দের মধ্যে স্বরবৃত্ত ছন্দটাই আটপৌরে এবং প্রাকৃত ছন্দ। সবচে সহজবোধ্য ছন্দ। নবীন লেখকদের জন্যে আদর্শ ছন্দ হচ্ছে এই স্বরবৃত্তছন্দ। গানের ছন্দ, ছড়ার ছন্দ-এই স্বরবৃত্ত ছন্দ। খুব সহজেই স্বরবৃত্তে ছন্দে খুব সহজে মনের ভাবকে প্রকাশ করা যায়। এই ছন্দকে কেউ কেউ শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। চিত্রা নামেও ডেকেছেন কেউ কেউ। দ্বিজেন্দ্রনাল রায় নাম দিয়েছেনমাত্রিক ছন্দ, প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছেন দলবৃত্ত ছন্দ এবং অমূল্যধন এই ছন্দের নাম দিয়েছেন দ্রুতলয় বা শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন বাংলা প্রাকৃত ছন্দ। নাম কিন্তু মৌলিক কোন বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে স্ববৃত্তের বিশেষ সুর ঝংকার ও রিদমটাই।

যে ছন্দে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর সব সময়ই এক মাত্রা বিষিষ্ট হয়-সেই ছন্দকে সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দ বলে। অন্যভাবে বললে স্বর বা শ্বাসঘাত প্রধান ছন্দই স্বরবৃত্ত ছন্দ। এই ছন্দে সাধারণত ছড়া, কিশোর কবিতা ও গান লেখা হয়ে থাকে। দ্রুতলয়ের এই ছন্দে কখনো কখনো ভাবগম্ভীর বিষয়ও প্রকাশ করা হয়ে থাকে।

 

স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য

১। স্বরবৃত্ত ছন্দে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর সব সময় এক মাত্রা বিশিষ্ট হয়।

২। এই ছন্দের পূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যা সাধারণত চারটি হয়। অর্থাৎ চার

মাত্রার চালই স্বরবৃত্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৩। স্বরবৃত্ত ছন্দ দ্রুতলয়ের ছন্দ।

৪। এর ভাব ভাষা হয় সহজ সরল, সাবলীল।

৫। সাধারণত পর্ব ও মাত্রা সংখ্যা সমান থাকে।

৬। স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতা অন্ত্যমিল প্রধান হয়ে থাকে।

৭। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও পীড়নের চিত্র কম দেখা যায়।

 

স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতার একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে:

প্রথম বলি:/ স্বরবৃত্ত /দুলকি চালের/ ছন্দ

দুয়ে দুয়ে/ চারের বাঁধন/ নেইতো দ্বিধা/ দ্বন্দ্ব।

যুক্ত-বদ্ধ / সব অক্ষরে / মাত্রা ধরে/ একটি-

অনায়াসে/ যাও পেরিয়ে/ সকল খানা/ খন্দ।

::::

আরো আছে/ স্বরবৃত্তের/ নিয়ম কিছু /বাকি

মাত্রা-পর্ব/ সমান সমান/ কেউ দিও না/ ফাঁকি।

ভাবটা রেখে/ সহজ সরল/ অন্ত্যমিলও/ খাসা-

রুমুর ঝুমুর/ চমক চমক/ শব্দ এনো/ ডাকি।

 

স্বরবৃত্ত ছন্দের শব্দ প্রয়োগের কৌশল

স্বরবৃত্ত ছন্দ চার মাত্রার পূর্ণ পর্বের চাল হওয়ায় দুমাত্রা বিশিষ্ট শব্দ পাশাপাশি ব্যবহারে সচেষ্ট হতে হবে। তবে আর আঙুল টিপে টিপে মাত্রার হিসেব করতে হবে না। যেমন: প্রথম বলি:/ স্বরবৃত্ত /দুলকি চালের/ ছন্দ । দু মাত্রার শব্দ সব সময় দিতে পারবেন তা কিন্তু নয়। বিষয় ও ভাবের অপরির্হাযতায় কখনো কখনো ব্যতিক্রমও

ঘটতে পারে। যেমন এক মাত্রা বিশিষ্ট শব্দ সামনে আসতে পারে, তিন মাত্রা বিশিষ্ট শব্দ আসতে পারে। এক্ষেত্রে করনীয়:

ক। এক মাত্রার শব্দ আগে আসলে পারে তিন মাত্রার শব্দ দিতে সচেষ্ট হবেন।

খ। প্রথমে তিন মাত্রার শব্দ এলে পরে এক মাত্রার শব্দ বসাবেন।

ঘ। প্রথমে এক মাত্রা হলে তার পরে দুই মাত্রার একটি এবং এক মাত্রার একটি শব্দ দিয়ে পূর্ণ পর্বের ঝামেলা সারতে পারবেন।

একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিস্কার করা যেতে পারে।

দুই মাত্রা দাও শব্দ শেষে আসলে বদ্ধ অক্ষর

এই নিয়মের নেই ভেদাভেদ বিশেষ কোন পক্ষর।

‘বন্ধুর’ লিখে একে দুয়ে মাত্রা বসাও তিনটি-

‘বন্’পেলো এক ‘ধুর্’ পেলো দুই নেই ঝামেলা ঝক্কর।

দুই মাত্রা দাও, এই নিয়মের; এখানে 1+2+1/ 1+3 মাত্রা গণনা করা হয়েছে। এভাবেই সচেতন ভাবে আমাদের শব্দ প্রয়োগ করতে হবে।

 

স্বরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা গণনায় দুটি আপত্তি:

ক। কেউ কেউ কথ্য পদের (মাড়িয়ে, দাঁড়িয়ে, বাড়িয়ে, তাড়িয়ে, চড়িয়ে, গড়িয়ে, মাজিয়ে ইত্যাদি) তিন মাত্রা বিশিষ্ট শব্দ পর্বের শুরুতে আসলে দুই মাত্রা ধরে হিসেব করার কথা বলেন। তারা অনেক অগ্রজ কবির ছড়া কবিতা থেকে দৃষ্টান্ত দেবারও চেষ্টা করেন। যেমন :

 

কেয়া পাতার/ নৌকা গড়ে/ সাজিয়ে দেবো/ ফুলে

তালদীঘিতে/ ভাসিয়ে দেবো/ চলবে দুলে/ দুলে।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 

বলবো আমি / আলসে মেয়ে/ ঘুমিয়ে তুমি/ থাকো

হয়নি সকাল/ তাই বলে কি/ সকাল হবে /নাকো?

(কাজী নজরুল ইসলাম)

 

আমার কেবল/ ইচ্ছে করে/ নদীর ধারে/ থাকতে

বকুল ডালে/ লুকিয়ে থেকে/ পাখির মতো /ডাকতে।

(আল মাহমুদ)

 

অনুরূপভাবে কবি জসীম উদদীনসহ আরো অগ্রজ অনেক কবির কবিতায় হঠাৎ করে এমন ছন্দ পতন চোখে পড়ে। হয়তো কবি খেয়াল করেন নি। শ্রুতি মাধুযৃ নষ্ট না হওয়ায় চালিয়ে দিয়েছেন। প্রকাশ্য তিনটি মুক্তাক্ষরযুক্ত শব্দকে অগ্রজ কবিরা লিখেছেন বলে দুই মাত্রা মেনে নেয়া মোটেও যৌক্তিক নয়। এই অন্ধ শ্রদ্ধা সাহিত্যের কোন উপকার করে নি, বরং ক্ষতিই করেছে। যারা তিন মাত্রাকে দুই মাত্রা বলে চালিয়ে দিতে চান, তারা আবার একই শব্দ পর্বের শেষাংশে বসলে আবার তিন মাত্রাই গণনা করছেন খোড়া যুক্তি দিয়ে। একই শব্দের দু রকম মাত্রা গণনার কোন যুক্তি নেই। তিন মাত্রাকে দুমাত্রার বিশ্লেষণ সাহিত্যকে ত্রুটিযুক্ত পথেই ধাবিত করবে। মনে রাখতে হবে: লেখককে দেখে নয়, লেখা দেখেই মূল্যায়ন করতে হবে। অগ্রজ রা মানুষ ছিলেন, মানুষ ছিলেন বলেই তারা কেউ সমালেঅচনা বা ত্রুটির উর্দ্ধে নন।

 

খ। আরেকটি হাস্যকর যুক্তির সাথে পরিচয় করে দিচ্ছি। কেউ কেউ মনে করেন: পাশাপাশি দুটো বদ্ধাক্ষর বসলে সেখানে স্বরবৃত্তের মাত্রা হিসেবে এক মাত্রা না ধরে দেড় মাত্রা ধরে হিসেব কষে থাকেন। কী অদ্ভুত যুক্তিরে বাবা! যেমন:

সূর্যিমামা/ জাগার আগে/ উঠবো আমি/ জেগে

হয় নি সকাল/ ঘুমো এখন/ মা বলবেন / রেগে।

(খোকার সাধ- কাজী নজরুল ইসলাম)

 

এখানে ‘মা বলবেন’- মোট তিনমাত্রা হয়। তারা কবির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ১+১.৫+১.৫= ৪ মাত্রা বলতে চান। আহারে বন্ধু, এখানে একমাত্রা শর্ট পড়েছে কথাটা বললে কী খোকার সাধ খুকীর ইচ্ছেতে পরিণত হতো।

মনে রাখতে হবে: এসব আপোষকামীতার মনোভাব ভালো নয়। স্বরবৃত্তে মুক্তাক্ষর বদ্ধাক্ষর সব জায়গাতেই এক মাত্রা বিশিষ্ট হবে, জোড়াতালি বা যোগ বিয়োগের কোন প্রয়োজন নেই।

 

গীতল স্বরবৃত্ত: স্বরবৃত্তীও নতুন ভাবনা

ছড়ার ছন্দ, গানের ছন্দ স্বরবৃত্ত ছন্দ। স্বরবৃত্ত মানেই দ্রুত গতির ছন্দ। গানে সব সময় দ্রুত রয়টা ভালো লাগে না। স্বরবৃত্তের চারমাত্রার পূর্ণ পর্বের বাঁধন টা ভেঙে পাঁচ বা ছয় মাত্রার পর্ব বিন্যাস করে গানে নতুনত্ব আনা যাবে, নতুন আবেদন সৃষ্টি করা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই কেবল গানের ক্ষেত্রে স্বরবৃত্তের নতুন পর্ব বিন্যাস সাধন করে এই ছন্দটাকে নিয়ে খেলা করা যায়। সেক্ষেত্রে আমি এর নাম দিয়েছি ‘গীতল স্বরবৃত্ত’।এই গীতল স্বরবৃত্ত আবার ছড়া কবিতায় ব্যবহার করা ঠিক হবে না। আমার নিরীক্ষাধর্মী অনেক গান আছে গীতল স্বরবৃত্তে। যেমন:

হাজার গানের মাঝে/ একটি গানও যদি

আল্লাহর কাছে ওগো/ প্রিয় হয়

সেইতো খুশীর কথা/ সেইতো সফলতা

চাওয়া পাওয়া আমার/ আর কিছু নয়।।

 

আমার এই গীতল স্বরবৃত্ত নাম টা অনেকের কাছে আপত্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু এই ভাবেই নতুন পথের আবিষ্কার হবে । সাহিত্য সাংস্কৃতিক ভাবনা কখনো অকাট্য বা অপরিবর্তনীয় নয়। বিষয়টি আশা করি ছন্দবোদ্ধারা বিবেচনায় নেবেন। স্বরবৃত্ত ছন্দ

সব শেষে বলবো : নবীন বন্ধুদের জন্যে স্বরবৃত্ত ছন্দটি আদর্শ ছন্দ। এর ভাঙা গড়া চলবে। চলনে বলনে আসবে বৈচিত্র্য।সে ক্ষেত্রে সবাইকে আগে স্বরবৃত্তের মূল কাঠামো বা বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করতে হবে,জানতে হবে। ছন্দ ভাঙতে হলে, আগে ছন্দকে জানতে হবে, ছন্দের ওপর লাঠি ঘোরানোর শক্তি অর্জন করতে হবে।

স্বরবৃত্ত ছন্দ

নরসিংদী স্বরবৃত্ত ছন্দ

০৯ অক্টোবর-২০১৭

 

Leave a Reply