সূরা হুজুরাত এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়, শানেনুযূল, সূরাটির গুরুত্বপূর্ণ দিক, সূরাটির শিক্ষা সূরাটির মূল বিষয়বস্তু, সূরাটির ফযিলত, এবং সূরাটির আলোকে ৫টি বিষয়ভিত্তিক আয়াত অর্থসহ প্রতিটি বিষয় আলোচনা এবং সূরা হুজুরাত সম্পর্কে ২০টি শর্ট প্রশ্ন ও উত্তর এবং ২৫টি MCQ দেয়া হলো।
সূরা হুজুরাত
সূরা আল-হুজুরাত সম্পর্কে ২০টি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর
সাধারণ তথ্য:
- সূরা আল-হুজুরাত কত নং সূরা?
→ ৪৯ নং সূরা। - এটি মাক্কী না মাদানী সূরা?
→ মাদানী সূরা। - সূরাটিতে কয়টি আয়াত আছে?
→ ১৮টি আয়াত। - সূরার মূল বিষয় কী?
→ ইসলামী সমাজের নৈতিকতা ও শিষ্টাচার।
শানে নুযুল (অবতীর্ণের কারণ):
- কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরার প্রথম আয়াতগুলো নাযিল হয়?
→ কিছু বেদুইন নবীজি (ﷺ)-কে উচ্চস্বরে ও অভদ্রভাবে ডাকত, তাই শিষ্টাচার শেখাতে এ আয়াত নাযিল হয়। - গীবত সম্পর্কিত আয়াত কেন নাযিল হয়?
→ কারণ কিছু লোক পরনিন্দা (গীবত) করত, তাই আল্লাহ এটিকে নিষিদ্ধ করেন। - সূরা হুজুরাতে ভ্রাতৃত্ববোধের নির্দেশ কেন দেওয়া হয়?
→ কারণ মদীনায় আওস-খাজরাজ গোত্রের মধ্যে বিবাদ হতো, তাই তাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য।
মূল শিক্ষা ও বিধান:
- নবীজি (ﷺ)-এর সামনে কীভাবে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে?
→ উচ্চস্বরে বা রূঢ়ভাবে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। - গীবতকে কীসের সাথে তুলনা করা হয়েছে?
→ মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। - মুমিনদের মধ্যে বিবাদ হলে কী করতে বলা হয়েছে?
→ মধ্যস্থতা করে শান্তি স্থাপন করতে বলা হয়েছে। - আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি কী?
→ তাকওয়া (আল্লাহভীতি)। - জাতি-গোত্রের ভিত্তিতে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে কি?
→ না, এটি নিষিদ্ধ। - ইমানের প্রকৃত অর্থ কী?
→ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। - অনুমান বা সন্দেহ থেকে দূরে থাকতে কী বলা হয়েছে?
→ হ্যাঁ, কারণ অনেক সন্দেহই গুনাহ। - নবীজির ঘরে প্রবেশের আগে কী করতে বলা হয়েছে?
→ অনুমতি নিতে এবং ভদ্রভাবে অপেক্ষা করতে।
ব্যবহারিক শিক্ষা:
- সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সূরা হুজুরাত কী শিক্ষা দেয়?
→ পরনিন্দা, সন্দেহ ও বিবাদ এড়িয়ে চলতে বলে। - মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?
→ ভাইয়ের মতো স্নেহ ও সম্মানপূর্ণ। - কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যাবে কি?
→ না, এটি ইসলামে নিষিদ্ধ। - সত্যিকার মুমিনের বৈশিষ্ট্য কী?
→ যে আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ মেনে চলে। - সূরা হুজুরাতের মূল বার্তা কী?
→ “মুমিনদের মধ্যে শিষ্টাচার, ঐক্য ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখো।”
সূরা আল-হুজুরাত সম্পর্কে ২৫টি MCQ (বহুনির্বাচনী প্রশ্ন)
- সূরা আল-হুজুরাত কত নং সূরা?
a) ৪৮
b) ৪৯
c) ৫০
d) ৫১ - এটি কোন ধরনের সূরা?
a) মাক্কী
b) মাদানী
c) মিশ্র
d) কোনোটিই নয় - সূরাটিতে কয়টি আয়াত আছে?
a) ১৫
b) ১৮
c) ২০
d) ২২ - নবীজি (ﷺ)-কে কিভাবে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে?
a) নিচুস্বরে
b) উচ্চস্বরে
c) মধ্যস্বরে
d) কানেক্ষরে - গীবতকে কীসের সাথে তুলনা করা হয়েছে?
a) সোনা চুরির মতো
b) মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো
c) আগুনে পোড়ানোর মতো
d) সাপের কামড়ের মতো - মুমিনদের মধ্যে বিবাদ হলে কী করতে বলা হয়েছে?
a) লড়াই করতে
b) মধ্যস্থতা করতে
c) উপেক্ষা করতে
d) প্রতিশোধ নিতে - আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি কী?
a) সম্পদ
b) বংশ
c) তাকওয়া
d) শক্তি - “মুমিনরা পরস্পর ___।” শূন্যস্থান পূরণ করুন।
a) শত্রু
b) প্রতিদ্বন্দ্বী
c) ভাই ভাই
d) নিরপেক্ষ - সূরা হুজুরাতে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বকে কী বলা হয়েছে?
a) জরুরি
b) বৈধ
c) নিষিদ্ধ
d) প্রশংসনীয় - নবীজির ঘরে প্রবেশের আগে কী করতে হবে?
a) দরজা ভেঙে ঢুকতে
b) অনুমতি নিতে
c) জোরে চিৎকার করতে
d) সরাসরি ঢুকে পড়তে - কোন আয়াতে গীবত নিষিদ্ধ করা হয়েছে?
a) আয়াত ৫
b) আয়াত ১০
c) আয়াত ১২
d) আয়াত ১৫ - সন্দেহ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ কোন আয়াতে আছে?
a) আয়াত ৬
b) আয়াত ১২
c) আয়াত ১৬
d) আয়াত ১৮ - “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ___ আগে বাড়ো না।” শূন্যস্থান পূরণ করুন।
a) ইচ্ছার
b) কথার
c) আদেশের
d) সামনে - কোন গোত্রের মধ্যে বিবাদের কথা সূরায় উল্লেখ আছে?
a) কুরাইশ-মাখজুম
b) আওস-খাজরাজ
c) বনু উমাইয়া-বনু হাশিম
d) বনু নাদির-বনু কুরাইজা - ইমানের প্রকৃত অর্থ কী?
a) নামাজ পড়া
b) আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আত্মসমর্পণ
c) হজ করা
d) রোজা রাখা - সূরা হুজুরাতের মূল বার্তা কী?
a) যুদ্ধের নির্দেশ
b) অর্থনৈতিক নীতি
c) নৈতিকতা ও শিষ্টাচার
d) কিয়ামতের আলোচনা - কোনটি সূরার আলোচ্য বিষয় নয়?
a) গীবত
b) সন্দেহ
c) জিহাদ
d) ভ্রাতৃত্ব - “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে ___।” শূন্যস্থান পূরণ করুন।
a) ধনী
b) শক্তিশালী
c) তাকওয়াশীল
d) সুন্দর - সূরাটি কোন যুগের সমাজ সংস্কার নিয়ে আলোচনা করে?
a) প্রাক-ইসলামী যুগ
b) মাদানী যুগ
c) উমাইয়া যুগ
d) আব্বাসীয় যুগ - কোন আয়াতে নবীজির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে?
a) আয়াত ১-৫
b) আয়াত ৬-৮
c) আয়াত ১০-১২
d) আয়াত ১৫-১৮ - মুমিনদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার নির্দেশ কোথায় দেওয়া হয়েছে?
a) আয়াত ৯-১০
b) আয়াত ১২-১৩
c) আয়াত ১৫-১৬
d) আয়াত ১৭-১৮ - “তোমরা একে অপরের গীবত করো না” — এটি কোন সূরার আয়াত?
a) সূরা বাকারা
b) সূরা নিসা
c) সূরা হুজুরাত
d) সূরা আনফাল - সূরাটি কিসের উপর জোর দেয়?
a) ব্যক্তিগত ইবাদত
b) সামাজিক শিষ্টাচার
c) রাজনৈতিক নীতি
d) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা - নবীজিকে সম্মান করার অর্থ কী?
a) শুধু সালাত পড়া
b) তাঁর সুন্নত অনুসরণ করা
c) শুধু নামে ডাকা
d) তাঁর কবর জিয়ারত করা - সূরা হুজুরাতের শিক্ষা কোনটি?
a) শুধু ব্যক্তিগত পবিত্রতা
b) সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা
c) শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন
d) শুধু রাজনৈতিক ঐক্য
এই প্রশ্নোত্তর ও MCQ গুলো সূরা আল-হুজুরাতের বিষয়বস্তু ও শিক্ষা বুঝতে সহায়ক হবে।
সূরা আল হুজুরাতের বিষয়বস্তু
সূরা আল-হুজুরাত (৪৯ নং সূরা)
মাদানী সূরা, আয়াত সংখ্যা: ১৮
এই সূরার মূল বিষয়বস্তু হলো আখলাক (নৈতিকতা) ও সমাজ সংস্কার। এটি মুমিনদের আচরণ, সামাজিক শিষ্টাচার, ঐক্য ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়। নিচে মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো:
১. নবী (ﷺ)-এর সাথে শিষ্টাচার
আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর সামনে ভদ্রভাবে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন:
- নবীর সামনে উচ্চস্বরে কথা না বলা (আয়াত ২-৩)।
- নবীর ডাকে সাড়া দেওয়া এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা (আয়াত ১)।
২. গীবত ও অপবাদ থেকে বিরত থাকা
- কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ চর্চা (গীবত) করা নিষিদ্ধ। গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে (আয়াত ১২)।
- অহেতুক সন্দেহ ও অনুসন্ধান থেকে বিরত থাকা (আয়াত ১২)।
৩. মুমিনদের মধ্যে বিবাদ নিষ্পত্তি
- যদি মুমিনদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে তাদের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দেওয়া (আয়াত ৯-১০)।
- সমস্ত মুমিন পরস্পর ভাই ভাই, তাই তাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি (আয়াত ১০)।
৪. জাতিগত অহংকার ও বর্ণবাদ প্রত্যাখ্যান
- মানুষকে জাতি, গোত্র বা বর্ণের ভিত্তিতে হেয় প্রতিপন্ন করা নিষিদ্ধ। আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া (আয়াত ১৩)।
৫. বাহ্যিক ইসলাম বনাম প্রকৃত ঈমান
- কিছু লোক মুখে ইসলামের দাবি করে, কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস রাখে না। আল্লাহ তাদের অন্তর জ্ঞাত (আয়াত ১৪)।
- প্রকৃত ঈমান হলো আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ (আয়াত ১৫)।
৬. আল্লাহর অনুগ্রহের স্বীকৃতি
- ঈমান ও সৎকর্ম আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি অনুগ্রহ। তিনি চাইলে সব মানুষকে হিদায়াত দিতে পারতেন (আয়াত ১৭-১৮)।
সূরাটির শিক্ষা:
সূরা আল-হুজুরাত মুসলিম সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা। এটি মুমিনদেরকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও আল্লাহভীতির শিক্ষা দেয়।
এ সূরার বার্তা হলো: “মানুষের মধ্যে শান্তি বজায় রাখো, অহংকার ত্যাগ করো এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলো।”
সূরা আল হুজুরাতের চারটি সামাজিক বিধান
সূরা আল-হুজুরাতের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিধান:
সূরা আল-হুজুরাত (৪৯তম সূরা) মূলত ইসলামী সমাজের নৈতিক ও সামাজিক আচরণবিধি নিয়ে আলোচনা করে। এখানে উল্লেখযোগ্য চারটি সামাজিক বিধান হলো:
১. নেতা ও আলিমদের সম্মান ও শিষ্টাচার
- আয়াত ১-৫: নবী (ﷺ) ও ধর্মীয় নেতাদের সামনে ভদ্রভাবে কথা বলা, উচ্চস্বরে বা রূঢ়ভাবে কথা না বলা।
- শিক্ষা: সমাজে নেতৃত্ব ও জ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান।
২. গীবত (পরনিন্দা) ও সন্দেহ পরিহার
- আয়াত ১২:
- গীবত নিষিদ্ধ: কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ চর্চা করা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো জঘন্য।
- অনুযায়ী সন্দেহ থেকে বিরত থাকা: অহেতুক সন্দেহ ও গোপনীয়তা সন্ধান করা হারাম।
- শিক্ষা: সামাজিক শান্তির জন্য পরনিন্দা ও সন্দেহমূলক আচরণ ত্যাগ করতে হবে।
৩. বিবাদ মীমাংসা ও মুমিনদের ভ্রাতৃত্ব
- আয়াত ৯-১০:
- যদি দুটি মুমিন গোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তবে অন্য মুমিনদের দায়িত্ব হলো তাদের মধ্যে সন্ধি করানো।
- “মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই”—এই নীতিতে ঐক্য বজায় রাখা।
- শিক্ষা: সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব।
৪. জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বর্ণবাদ বর্জন
- আয়াত ১৩:
- “মানুষকে বিভিন্ন গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে শুধু পরিচয়ের জন্য, মর্যাদার জন্য নয়।”
- আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া (আল্লাহভীতি)।
- শিক্ষা: বর্ণ, গোত্র বা বংশগত অহংকার ইসলামে নিষিদ্ধ। সকল মানুষ সমান, পার্থক্য কেবল তাকওয়ায়।
সারসংক্ষেপ:
সূরা আল-হুজুরাত মুসলিম সমাজকে শিষ্টাচার, শান্তি, ন্যায়পরায়ণতা ও সাম্যবোধের শিক্ষা দেয়। উপরোক্ত ৪টি বিধান পালন করলে সমাজে ঐক্য, শান্তি ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
Key Message:
“ইসলামী সমাজ গঠনে শ্রদ্ধা, নিন্দা থেকে বিরত থাকা, বিবাদ মীমাংসা এবং জাতিগত বিভেদ দূর করা অপরিহার্য।”
সূরা আল হুজুরাত এর শানে নুযুল
সূরা আল-হুজুরাতের শানে নুযুল (প্রেক্ষাপট ও অবতীর্ণের কারণ)
সূরা আল-হুজুরাত একটি মাদানী সূরা এবং এটি হিজরি ৯ম বছরের দিকে নাযিল হয়েছিল। এই সূরার আয়াতগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে। নিম্নে এর শানে নুযুল (অবতীর্ণের কারণ) সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হলো:
১. নবী (ﷺ)-এর সাথে শিষ্টাচার সম্পর্কিত আয়াত (আয়াত ১-৫)
প্রেক্ষাপট:
- কিছু বেদুইন সাহাবী নবীজি (ﷺ)-এর সামনে অত্যন্ত উচ্চস্বরে এবং অভদ্রভাবে কথা বলতেন।
- কখনো তারা ঘরের বাইরে থেকে চিৎকার করে ডাকত, যেমন: “ইয়া মুহাম্মাদ! (ﷺ) আমাদের কাছে বেরিয়ে আসুন!”
- এমনকি কেউ কেউ নবীজির ঘরে অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করার চেষ্টা করত।
আয়াত নাযিলের ঘটনা:
এমন অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রেক্ষাপটে আয়াত ১-৫ নাযিল হয়, যেখানে আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে নবীজির সামনে নম্রভাবে কথা বলতে এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে নির্দেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট আয়াত:
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে আগে বাড়ো না… এবং তোমরা রাসূলকে এমনভাবে ডেকো না, যেমন তোমরা একে অপরকে ডাকো…” (সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:১-৫)
২. গীবত (পরনিন্দা) ও সন্দেহ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ (আয়াত ১২)
প্রেক্ষাপট:
- মদীনার কিছু মুসলিম অন্যের দোষ চর্চা (গীবত) এবং অনুপস্থিতিতে সমালোচনা করতে অভ্যস্ত ছিল।
- কিছু লোক অহেতুক সন্দেহ পোষণ করত এবং গোপন তথ্য খুঁজতে চাইত।
আয়াত নাযিলের ঘটনা:
এমন অসামাজিক আচরণের কারণে আয়াত ১২ নাযিল হয়, যেখানে গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো জঘন্য বলা হয় এবং সন্দেহ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট আয়াত:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাকো… আর তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে?” (সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:১২)
৩. মুমিনদের মধ্যে বিবাদ মীমাংসা (আয়াত ৯-১০)
প্রেক্ষাপট:
- মদীনায় আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে প্রাক-ইসলামী যুগের শত্রুতা কখনো কখনো প্রকাশ পেত।
- কিছু ক্ষেত্রে মুসলিমদের দুটি দল বিবাদে জড়িয়ে পড়ত।
আয়াত নাযিলের ঘটনা:
এমন পরিস্থিতিতে আয়াত ৯-১০ নাযিল হয়, যাতে মুমিনদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে শান্তি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং বলা হয়, “মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।”
সংশ্লিষ্ট আয়াত:
“যদি মুমিনদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করিয়ে দাও…” (সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:৯-১০)
৪. জাতিগত অহংকার ও বর্ণবাদ প্রত্যাখ্যান (আয়াত ১৩)
প্রেক্ষাপট:
- আরব সমাজে কৌলিন্য, বংশগত অহংকার ও গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্বের প্রচলন ছিল।
- কিছু লোক অন্যের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত, বিশেষত অনারব দাসদের প্রতি।
আয়াত নাযিলের ঘটনা:
এমন সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে আয়াত ১৩ নাযিল হয়, যেখানে আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ, যে সর্বাধিক তাকওয়াশীল।”
সংশ্লিষ্ট আয়াত:
“হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি… নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে সর্বাধিক তাকওয়াশীল।” (সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:১৩)
সারসংক্ষেপ:
সূরা আল-হুজুরাতের শানে নুযুল থেকে বোঝা যায় যে, এটি মদীনার সমাজ সংস্কার ও মুসলিম উম্মাহর নৈতিক উন্নয়নের জন্য নাযিল হয়েছিল। এই সূরার মূল বার্তা হলো:
নেতৃত্ব ও জ্ঞানীদের সম্মান করা
গীবত ও সন্দেহ ত্যাগ করা
বিবাদে মধ্যস্থতা করে শান্তি স্থাপন
জাতি-গোত্রের অহংকার বর্জন করে তাকওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া
এই শিক্ষাগুলো আজও মুসলিম সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
সূরাটির আলোকে ৫টি বিষয়ভিত্তিক আয়াত অর্থসহ প্রতিটি বিষয় বিস্তারিত চাই
সূরা আল-হুজুরাত থেকে ৫টি বিষয়ভিত্তিক আয়াতের ব্যাখ্যা ও শিক্ষা
১. নবী (ﷺ)-এর প্রতি শিষ্টাচার
আয়াত (৪৯:১-২):
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ. يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
অর্থ:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রগামী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তাঁর সাথে উচ্চস্বরে কথা বলো না, যেমন তোমরা একে অপরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলো; অন্যথায় তোমাদের আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।”
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা:
- নবীজি (ﷺ)-এর সামনে নম্র ও সম্মানজনক আচরণ করা ঈমানের অংশ।
- তাঁর কথার ওপরে কথা বলা বা উচ্চস্বরে ডাকা নিষিদ্ধ, কারণ এটি অসম্মানের শামিল।
- শিক্ষা: ইসলামী সমাজে নেতৃত্ব ও জ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ জরুরি।
২. গীবত (পরনিন্দা) নিষিদ্ধকরণ
আয়াত (৪৯:১২):
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ
অর্থ:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনেক ধরণের সন্দেহ থেকে দূরে থাকো, নিশ্চয় কিছু সন্দেহ পাপ। আর তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না এবং গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।”
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা:
- গীবত (কোনো মানুষের অনুপস্থিতিতে তার দোষ বলা) নিষিদ্ধ এবং এটিকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো জঘন্য বলা হয়েছে।
- অনুযায়ী সন্দেহ ও গোপন ত্রুটি খোঁজা থেকেও বিরত থাকতে হবে।
- শিক্ষা: সামাজিক শান্তির জন্য পরনিন্দা ও সন্দেহ পরিহার করা আবশ্যক।
৩. মুমিনদের মধ্যে বিবাদ নিষ্পত্তি
আয়াত (৪৯:৯-১০):
وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ. إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থ:
“যদি মুমিনদের দুটি দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করিয়ে দাও। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর জুলুম করে, তবে জালিম দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে মীমাংসা করবে এবং ইনসাফ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন। মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।”
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা:
- মুমিনদের মধ্যে বিবাদ হলে মধ্যস্থতা করতে হবে।
- জালিম পক্ষকে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনা ঈমানী দায়িত্ব।
- শিক্ষা: মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বজায় রাখা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা।
৪. জাতিগত অহংকারের নিন্দা
আয়াত (৪৯:১৩):
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থ:
“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে সর্বাধিক তাকওয়াশীল। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।”
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা:
- সব মানুষ আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান—জাতি বা বর্ণের শ্রেষ্ঠত্ব ইসলামে নিষিদ্ধ।
- মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া (আল্লাহভীতি), বংশ বা সম্পদ নয়।
- শিক্ষা: বর্ণবাদ, গোত্রপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করা।
৫. প্রকৃত ঈমানের শর্ত
আয়াত (৪৯:১৫):
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ
অর্থ:
“মুমিন তো তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, অতঃপর সন্দেহে পতিত হয় না এবং আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করে। এরাই সত্যবাদী।”
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা:
- প্রকৃত মুমিনের লক্ষণ:
- আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি অটুট বিশ্বাস (সন্দেহমুক্ত)।
- আল্লাহর পথে ত্যাগ স্বীকার (সময়, সম্পদ, শ্রম দিয়ে)।
- শিক্ষা: ঈমান শুধু মুখের দাবি নয়, বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন জরুরি।
সারসংক্ষেপ:
সূরা আল-হুজুরাতের এই ৫টি বিষয় ইসলামী সমাজ গঠনের মূলভিত্তি:
- নেতৃত্বের প্রতি সম্মান
- গীবত ও সন্দেহ ত্যাগ
- বিবাদে মধ্যস্থতা
- জাতিগত বিভেদ বর্জন
- ঈমানের দাবি পূরণ
প্রয়োগ: এই শিক্ষাগুলো ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বাস্তবায়ন করলে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
সূরা হুজুরাত আয়াত ১১, ১২ , ১-১৩, ১০ আয়াত অর্থসহ ব্যাখ্যা
সূরা আল-হুজুরাতের নির্বাচিত আয়াতসমূহের অর্থ ও ব্যাখ্যা
আয়াত ১-৫: নবী (ﷺ)-এর প্রতি শিষ্টাচার
আয়াত ১-২:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ. يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
অর্থ:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রগামী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তাঁর সাথে উচ্চস্বরে কথা বলো না, যেমন তোমরা একে অপরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলো; অন্যথায় তোমাদের আমল নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।”
ব্যাখ্যা:
- আল্লাহ ও রাসূলের সিদ্ধান্তের আগে নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ।
- নবীজির সামনে নম্রভাবে কথা বলতে হবে, উচ্চস্বরে নয়।
- শিক্ষা: ইসলামী সমাজে নেতৃত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ঈমানের অংশ।
আয়াত ১০: মুমিনদের ভ্রাতৃত্ব
আয়াত ১০:
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থ:
“মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।”
ব্যাখ্যা:
- সব মুমিন পরস্পর আধ্যাত্মিক ভাই।
- বিবাদে মধ্যস্থতা করা ঈমানী দায়িত্ব।
- শিক্ষা: মুসলিম ঐক্য বজায় রাখা এবং পারস্পরিক কল্যাণকামিতা।
আয়াত ১১: অহংকার ও বিদ্রূপ নিষিদ্ধ
আয়াত ১১:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَىٰ أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَىٰ أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
অর্থ:
“হে ঈমানদারগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে বিদ্রূপ না করে, কেননা সে তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। আর কোনো নারীও অপর নারীকে বিদ্রূপ না করুক, কেননা সে তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের দোষারোপ করো না এবং মন্দ নামে ডেকো না। ঈমানের পর ফাসেকি নাম খুবই নিকৃষ্ট। আর যারা তাওবা না করে, তারাই জালিম।”
ব্যাখ্যা:
- বিদ্রূপ, তিরস্কার ও মন্দ ডাকনাম নিষিদ্ধ।
- কেউ কারও চেয়ে কম নয়—মর্যাদা আল্লাহই দেন।
- শিক্ষা: সামাজিক সম্মান বজায় রাখা এবং অহংকার ত্যাগ করা।
আয়াত ১২: গীবত ও সন্দেহ থেকে বিরত থাকা
আয়াত ১২:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ
অর্থ:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনেক ধরণের সন্দেহ থেকে দূরে থাকো, নিশ্চয় কিছু সন্দেহ পাপ। আর তোমরা একে অপরের গোপনীয়তা অনুসন্ধান করো না এবং গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।”
ব্যাখ্যা:
- গীবত (পরনিন্দা): কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ বলা—এটি মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো নিকৃষ্ট।
- অনুযায়ী সন্দেহ ও গোপন ত্রুটি খোঁজা হারাম।
- শিক্ষা: সামাজিক শান্তির জন্য গীবত ও সন্দেহ পরিহার করা।
আয়াত ১৩: মানবীয় সমতা ও তাকওয়া
আয়াত ১৩:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থ:
“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে সর্বাধিক তাকওয়াশীল। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।”
ব্যাখ্যা:
- সব মানুষ আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান—জাতি, বর্ণ বা গোত্রে শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
- মর্যাদার মাপকাঠি একমাত্র তাকওয়া (আল্লাহভীতি)।
- শিক্ষা: বর্ণবাদ, গোত্রপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করা।
সারসংক্ষেপ: এই আয়াতগুলোর মূল শিক্ষা
আয়াত | প্রধান বিষয় | শিক্ষা |
১-৫ | নবীজির প্রতি শিষ্টাচার | নেতৃত্বের সম্মান ও নম্রতা |
১০ | মুমিনদের ভ্রাতৃত্ব | বিবাদে মধ্যস্থতা ও ঐক্য |
১১ | অহংকার নিষিদ্ধ | বিদ্রূপ ও মন্দ নাম থেকে বিরত থাকা |
১২ | গীবত ও সন্দেহ নিষিদ্ধ | সামাজিক শান্তি রক্ষা |
১৩ | মানবীয় সমতা | তাকওয়াই একমাত্র মর্যাদার মানদণ্ড |
প্রয়োগ: এই আয়াতগুলো মুসলিম সমাজকে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও ভ্রাতৃত্ববোধে ঐক্যবদ্ধ হতে নির্দেশ দেয়।