সূরা রুম (আরবি: سورة الروم) হল পবিত্র কুরআনের ৩০তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ৬০টি। এই সূরার নামকরণ হয়েছে প্রথম আয়াতে উল্লিখিত “রূম” (বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বা রোমানরা) শব্দ থেকে, যেখানে পারস্য (ইরান) ও রোমের যুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে। সূরা রুম সম্পর্কে ২০টি শর্ট প্রশ্ন ও উত্তর এবং ২৫টি MCQ সহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো । এই প্রশ্নোত্তর ও MCQ গুলো আপনার জন্য সহায়ক হবে!
সূরা রুম
সম্পর্কে ২০টি শর্ট প্রশ্ন ও উত্তর এবং ২৫টি MCQ
১. সূরা রুম কুরআনের কত নম্বর সূরা?
উত্তর: ৩০ নম্বর সূরা।
২. সূরা রুমের আয়াত সংখ্যা কত?
উত্তর: ৬০টি আয়াত।
৩. সূরা রুম কোন ধরনের সূরা? (মাক্কী না মাদানী)?
উত্তর: মাক্কী সূরা।
৪. সূরা রুমে মূলত কী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে?
উত্তর: রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের যুদ্ধ, আল্লাহর নিদর্শন, কিয়ামত ও পুনরুত্থান।
৫. রোমানরা কোন যুদ্ধে প্রথমে পরাজিত হয়েছিল?
উত্তর: ৬১৪ বা ৬১৫ সালে পারস্যের বিরুদ্ধে।
৬. সূরা রুমে রোমানদের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে কত বছরের মধ্যে?
উত্তর: ৩ থেকে ৯ বছরের মধ্যে (আয়াত ৩-৪)।
৭. রোমানরা কবে পারস্যদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে?
উত্তর: ৬২৪ বা ৬২৫ সালে।
৮. সূরা রুমের প্রথম আয়াতে কী বলা হয়েছে?
উত্তর: “রোমানরা পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী এলাকায়…” (রুম ৩০:১)।
৯. সূরা রুমে আল্লাহর কোন নিদর্শনগুলোর কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: আকাশ-পৃথিবী সৃষ্টি, দিন-রাত্রির পরিবর্তন, বৃষ্টি দ্বারা মৃত ভূমির সঞ্জীবন ইত্যাদি।
১০. সূরা রুমের ২১ নম্বর আয়াতে কী বলা হয়েছে?
উত্তর: “তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে স্ত্রী সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও…” (বিবাহের গুরুত্ব)।
১১. সূরা রুমে শিরকের নিন্দা করে কোন আয়াত আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, যেমন আয়াত ৪২: “বলো, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদের পরিণতি কী হয়েছিল।”
১২. সূরা রুমের শেষ আয়াতে কী বলা হয়েছে?
উত্তর: “অতএব, ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য…” (রুম ৩০:৬০)।
১৩. সূরা রুমে আল্লাহর একত্ববাদের প্রমাণ হিসেবে কী উল্লেখ করা হয়েছে?
উত্তর: প্রকৃতির নিদর্শন, মানুষের সৃষ্টি, বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণের多样性 ইত্যাদি।
১৪. সূরা রুমে কিয়ামতের আলোচনা কোথায় আছে?
উত্তর: আয়াত ১২-১৬, ২৭-২৮, ৪৩-৪৫ ইত্যাদিতে।
১৫. সূরা রুমে দাওয়াতের কী পদ্ধতি বলা হয়েছে?
উত্তর: হিকমত (প্রজ্ঞা) ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে (আয়াত ৪৭)।
১৬. সূরা রুমে আল্লাহর রহমতের আলোচনা কোথায় আছে?
উত্তর: আয়াত ৪৬-৪৯ (বৃষ্টি দ্বারা জীবনের পুনরুজ্জীবন)।
১৭. সূরা রুমে সম্পদ ও সন্তানকে কী বলা হয়েছে?
উত্তর: দুনিয়ার জীবনের শোভা ও পরীক্ষা (আয়াত ৭-৮)।
১৮. সূরা রুমে আল্লাহর কাছে প্রকৃত ইবাদত কী?
উত্তর: একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করা ও শিরক পরিহার করা (আয়াত ৩১-৩২)।
১৯. সূরা রুমে নবীজি (সা.)-কে কীভাবে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে?
উত্তর: ধৈর্য ধারণ করতে বলা হয়েছে, কারণ আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য (আয়াত ৬০)।
২০. সূরা রুমের মূল শিক্ষা কী?
উত্তর: আল্লাহর নিদর্শনসমূহ চিন্তা করা, কিয়ামতে বিশ্বাস করা, শিরক ত্যাগ করা ও ন্যায়পরায়ণ জীবনযাপন করা।
সূরা রুম সম্পর্কে ২৫টি MCQ (বহুনির্বাচনী প্রশ্ন)
১. সূরা রুম কুরআনের কততম সূরা?
- a) ২৯
b) ৩০
c) ৩১
d) ৩২
২. সূরা রুমে কার যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে?
- a) মুসলিম-কাফির
b) রোমান-পারস্য
c) ইহুদি-নাসারা
d) আরব-ইহুদি
৩. সূরা রুমে রোমানদের বিজয় কত বছরের মধ্যে হবে বলে বলা হয়েছে?
- a) ১-৩ বছর
b) ৩-৯ বছর
c) ১০-১৫ বছর
d) ২০ বছর
৪. সূরা রুম কোন ধরনের সূরা?
- a) মাদানী
b) মাক্কী
c) উভয়টিই
d) কোনোটিই নয়
৫. সূরা রুমে আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে কী উল্লেখ করা হয়েছে?
- a) পাহাড়-নদী
b) দিন-রাত্রির পরিবর্তন
c) জান্নাত-জাহান্নাম
d) ফেরেশতাগণ
৬. সূরা রুমের আয়াত সংখ্যা কত?
- a) ৫০
b) ৫৫
c) ৬০
d) ৬৫
৭. সূরা রুমের ২১ নম্বর আয়াত কী সম্পর্কে?
- a) জিহাদ
b) বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন
c) ব্যবসা-বাণিজ্য
d) রোজা
৮. সূরা রুমে শিরকের নিন্দা করে কোন আয়াত?
- a) ১০
b) ৪২
c) ৫০
d) ৬০
৯. রোমানরা পারস্যদের বিরুদ্ধে কবে বিজয়ী হয়?
- a) ৬১০ সালে
b) ৬২৪/৬২৫ সালে
c) ৬৩০ সালে
d) ৬৪০ সালে
১০. সূরা রুমের প্রথম আয়াতে কী বলা হয়েছে?
- a) বিসমিল্লাহ
b) রোমানরা পরাজিত হয়েছে
c) আল্লাহর প্রশংসা
d) কিয়ামতের আলোচনা
১১. সূরা রুমে আল্লাহর একত্ববাদের প্রমাণ কী?
- a) প্রকৃতির নিদর্শন
b) সম্পদ-সন্তান
c) যুদ্ধ-বিগ্রহ
d) রাজা-বাদশাহ
১২. সূরা রুমে দাওয়াতের পদ্ধতি কী?
- a) জোর-জবরদস্তি
b) হিকমত ও উত্তম উপদেশ
c) শাস্তির ভয় দেখানো
d) লোভ দেখানো
১৩. সূরা রুমে সম্পদ ও সন্তানকে কী বলা হয়েছে?
- a) দুনিয়ার শোভা ও পরীক্ষা
b) শাস্তির কারণ
c) অপ্রয়োজনীয়
d) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
১৪. সূরা রুমের শেষ আয়াতে কী বলা হয়েছে?
- a) ধৈর্য ধারণ করো
b) বেশি ইবাদত করো
c) জিহাদ করো
d) দান করো
১৫. সূরা রুমে কিসের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে?
- a) আল্লাহর ইবাদত
b) সম্পদ অর্জন
c) রাজনীতি
d) যুদ্ধ
১৬. সূরা রুমে আল্লাহর রহমতের উদাহরণ কী?
- a) বৃষ্টি দ্বারা মৃত ভূমির সঞ্জীবন
b) সম্পদ বৃদ্ধি
c) বিজয় দান
d) সুস্বাস্থ্য
১৭. সূরা রুমে নবীজি (সা.)-কে কীভাবে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে?
- a) ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে
b) যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে
c) চুপ থাকতে বলা হয়েছে
d) হিজরত করতে বলা হয়েছে
১৮. সূরা রুমে কিয়ামতের আলোচনা কোথায় আছে?
- a) শুরুতে
b) মধ্যে ও শেষে
c) শুধু শেষে
d) নেই
১৯. সূরা রুমের মূল বার্তা কী?
- a) আল্লাহর নিদর্শন চিন্তা করা
b) বেশি দান করা
c) বেশি নামাজ পড়া
d) জিহাদ করা
২০. সূরা রুমে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?
- a) এটি সত্য
b) এটি পরিবর্তনযোগ্য
c) শুধু মুমিনদের জন্য
d) শুধু নবীদের জন্য
২১. সূরা রুমে মানুষের সৃষ্টির কথা কোথায় বলা হয়েছে?
- a) আয়াত ২০
b) আয়াত ২০-২১
c) আয়াত ৩০
d) আয়াত ৪০
২২. সূরা রুমে আল্লাহর নিদর্শন চিন্তা করতে বলা হয়েছে কেন?
- a) জ্ঞান অর্জনের জন্য
b) ধনী হওয়ার জন্য
c) ক্ষমতা পাওয়ার জন্য
d) সুখী হওয়ার জন্য
২৩. সূরা রুমে শিরককারীদের কী বলা হয়েছে?
- a) তাদের পরিণতি ভয়াবহ
b) তারা ক্ষমা পাবে
c) তারা বিজয়ী হবে
d) তারা নিরাপদ
২৪. সূরা রুমে আল্লাহর ইবাদতের সঠিক পদ্ধতি কী?
- a) শুধু নামাজ পড়া
b) একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করা
c) শুধু হজ করা
d) শুধু দান করা
২৫. সূরা রুমে আল্লাহর কসম খাওয়া সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?
- a) এটি হারাম
b) এটি জায়েজ
c) এটি মুস্তাহাব
d) এটি ফরজ
এই প্রশ্নোত্তরগুলো সূরা রুমের মূল বিষয়বস্তু বুঝতে ও পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে।
সূরা রুম এর ফজিলত, সূরা রুম এর শানে নুযুল,
সূরা রুমের ফজিলত, শানে নুযুল ও বিশেষ তাৎপর্য
১. সূরা রুমের ফজিলত (মাহাত্ম্য)
ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা:
- সূরা রুমে রোমানদের পরাজয় ও বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল, যা কুরআনের অলৌকিকতার প্রমাণ।
আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি:
- এই সূরায় প্রকৃতি, মানব সৃষ্টি ও কিয়ামতের আলোচনা রয়েছে, যা ঈমান বৃদ্ধি করে।
ধৈর্য ও আশার বার্তা:
- মুমিনদেরকে ধৈর্য ধারণ করতে বলা হয়েছে, কেননা আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী (আয়াত ৬০)।
দোয়া কবুলের সময়:
- কিছু হাদীসে সূরা রুম তিলাওয়াতকে বিশেষ ইবাদত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ করে ফজরের সময়।
২. সূরা রুমের শানে নুযুল (নাযিলের প্রেক্ষাপট)
ঐতিহাসিক পটভূমি:
- ৬১৪-৬১৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ রোমান (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। এটি ছিল খ্রিস্টান রোমানদের পরাজয়, যা মুশরিক আরবদের আনন্দিত করেছিল (যেহেতু রোমানরা ছিল আহলে কিতাব)।
- মুসলিমরা রোমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, কারণ তারা আহলে কিতাব এবং ইসলামের নিকটবর্তী ধর্মাবলম্বী।
কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী:
- সূরা রুমের প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলেন:
“রোমানরা পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী এলাকায়, কিন্তু তারা এই পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে।” (রুম ৩০:১-৪)
- মুশরিকরা এই ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ৬২৪-৬২৫ সালে রোমানরা পারস্যদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়, যা কুরআনের সত্যতা প্রমাণ করে।
ঈমানদারদের জন্য পরীক্ষা:
- এই ঘটনাটি মুমিনদের জন্য একটি পরীক্ষা ছিল, কারণ তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে অবিচল থাকল এবং শেষ পর্যন্ত তা সত্য প্রমাণিত হলো।
৩. সূরা রুমের বিশেষ তাৎপর্য
আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ:
- রোম-পারস্য যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী কুরআনের অলৌকিকতার অন্যতম নিদর্শন।
প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শন:
- সূরায় দিন-রাত্রির পরিবর্তন, বৃষ্টি, মানব সৃষ্টি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
কিয়ামত ও পুনরুত্থানের বিশ্বাস:
- সূরার শেষের দিকে কিয়ামতের আলোচনা রয়েছে, যা মুমিনদের জন্য সতর্কবাণী।
শিরকের নিন্দা ও তাওহীদের দাওয়াত:
- সূরার মধ্যভাগে শিরককারীদের ভয়াবহ পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
ধৈর্য ও তাওয়াক্কুলের শিক্ষা:
- নবীজি (সা.) ও সাহাবীদেরকে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে, যা যেকোনো মুমিনের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
৪. সূরা রুম থেকে শিক্ষা
আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য – যেমন রোমানদের বিজয় ঘটেছিল।
প্রকৃতির নিদর্শন চিন্তা করা – এটি ঈমান বৃদ্ধি করে।
শিরক পরিহার করা – শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে।
ধৈর্য ধারণ করা – মুমিনদের জন্য আল্লাহর সাহায্য আসবেই।
৫. হাদীসে সূরা রুমের গুরুত্ব
- ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রোমানদের বিজয়ের খবর শুনে আবু বকর (রা.) মুশরিকদের সাথে একটি বাজি ধরেছিলেন, যা পরে সত্য প্রমাণিত হয়। (তাফসীর ইবনে কাসীর)
- রাসূল (সা.) বলেছেন,
“যে ব্যক্তি সূরা রুম তিলাওয়াত করবে, সে কিয়ামতের দিন সেই সব লোকের সাথে থাকবে যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় লাভ করেছিল।” (তাফসীর মাজহারী)
উপসংহার:
সূরা রুম কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা, যা ঐতিহাসিক ভবিষ্যদ্বাণী, আল্লাহর নিদর্শন, ধৈর্য ও তাওহীদের শিক্ষা বহন করে। এটি মুমিনদের জন্য একটি আশার বার্তা যে, আল্লাহর সাহায্য অবশ্যম্ভাবী।
এই সূরার আলোচনা থেকে আমরা শিখতে পারি:
- আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা,
- প্রকৃতির নিদর্শন থেকে শিক্ষা নেওয়া,
- শিরক থেকে দূরে থাকা,
- কিয়ামতের প্রস্তুতি নেওয়া।
আরও পড়ুন: তাফসীর ইবনে কাসীর, তাফসীর তাবারি, তাফসীর জালালাইন।
সূরাটির সংক্ষিপ্ত পরিচয়, সূরাটির গুরুত্বপূর্ণ দিক, সূরাটির শিক্ষা সূরাটির মূল বিষয়বস্তু এবং সূরাটির আলোকে ৫টি বিষয়ভিত্তিক আয়াত অর্থসহ প্রতিটি বিষয় বিস্তারিত চাই
সূরা রুম: সংক্ষিপ্ত পরিচয়, গুরুত্বপূর্ণ দিক, শিক্ষা ও মূল বিষয়বস্তু
১. সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
- নাম: সূরা রুম (আরবি: سورة الروم)
- অবস্থান: কুরআনের ৩০তম সূরা
- আয়াত সংখ্যা: ৬০টি
- নাযিলের সময়: মাক্কী জীবনের মধ্যপর্বে (৬১৫-৬২০ খ্রিস্টাব্দ)
- প্রধান বিষয়: রোমান-পারস্য যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী, আল্লাহর নিদর্শন, কিয়ামত ও তাওহীদের দাওয়াত
২. সূরা রুমের গুরুত্বপূর্ণ দিক:
- ঐতিহাসিক ভবিষ্যদ্বাণী: রোমানদের পরাজয় ও বিজয়ের আলোচনা (আয়াত ১-৬)।
- প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শন: আকাশ-পৃথিবী, বৃষ্টি, মানব সৃষ্টি ইত্যাদি (আয়াত ২০-২৫)।
- শিরকের নিন্দা ও তাওহীদের দাওয়াত (আয়াত ৩১-৩২)।
- কিয়ামত ও পুনরুত্থানের বর্ণনা (আয়াত ১২-১৬, ৫৬-৫৭)।
- ধৈর্য ও তাওয়াক্কুলের শিক্ষা (আয়াত ৬০)।
৩. সূরা রুমের শিক্ষা:
আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য – যেমন রোমানদের বিজয় ঘটেছিল।
প্রকৃতির নিদর্শন নিয়ে চিন্তা করা – এটি ঈমান বৃদ্ধি করে।
শিরক পরিহার করা – একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে।
ধৈর্য ধারণ করা – মুমিনদের জন্য আল্লাহর সাহায্য অবশ্যম্ভাবী।
কিয়ামতের প্রস্তুতি নেওয়া – পার্থিব জীবনের মোহ ত্যাগ করা।
৪. সূরা রুমের মূল বিষয়বস্তু:
ঐতিহাসিক ঘটনা: রোমানদের পরাজয় ও বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী।
তাওহীদ ও শিরকের বিরোধিতা: আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা।
প্রাকৃতিক নিদর্শন: দিন-রাত, বৃষ্টি, মানব সৃষ্টি ইত্যাদি।
আখিরাতের স্মরণ: কিয়ামত, হাশর ও জাহান্নামের বর্ণনা।
দাওয়াতের পদ্ধতি: হিকমত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার।
৫. সূরা রুমের আলোকে ৫টি বিষয়ভিত্তিক আয়াত (অর্থসহ বিস্তারিত বিশ্লেষণ)
১. ঐতিহাসিক ভবিষ্যদ্বাণী (রোমানদের বিজয়)
আয়াত ৩-৪:
“তারা (রোমানরা) কয়েক বছরের মধ্যে বিজয়ী হবে। পূর্ব ও পশ্চিমের সব বিষয় আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণে। সেদিন মুমিনরা আল্লাহর সাহায্যে আনন্দিত হবে।”
বিশ্লেষণ:
- ৬১৪-৬১৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্যরা রোমানদের পরাজিত করলে মুশরিকরা খুশি হয়, কিন্তু কুরআন ভবিষ্যদ্বাণী করে যে ৩-৯ বছরের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী হবে।
- ৬২৪-৬২৫ সালে রোমানরা বিজয়ী হয়, যা কুরআনের সত্যতা প্রমাণ করে।
- শিক্ষা: আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, মুমিনদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
২. প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শন
আয়াত ২০-২১:
“তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি হলো, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন… এবং তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও।”
বিশ্লেষণ:
- মানুষের সৃষ্টি, বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনের শান্তি আল্লাহর অনুগ্রহ।
- প্রকৃতির নিয়ম (দিন-রাত্রি, বৃষ্টি) আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ।
- শিক্ষা: প্রকৃতি নিয়ে গভীর চিন্তা করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়।
৩. শিরকের নিন্দা ও তাওহীদের দাওয়াত
আয়াত ৩১-৩২:
“তোমরা একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে ফিরে যাও… এবং সে সব বিভক্তকারীদের মধ্যে শামিল হয়ো না, যারা নিজেদের ধর্মকে ভাগ করেছে।”
বিশ্লেষণ:
- শিরককারীরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত করে, যা মহাপাপ।
- ইসলামে একত্ববাদের গুরুত্ব ও বিভেদ সৃষ্টিকারীদের সতর্কতা।
- শিক্ষা: শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, গোত্র বা জাতির বিভেদ ত্যাগ করতে হবে।
৪. কিয়ামত ও পুনরুত্থান
আয়াত ৫৬-৫৭:
“যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা বলে, নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুত দিন (কিয়ামত) সত্য… সেদিন অবিশ্বাসীদের জন্য কোনো সুপারিশকারী থাকবে না।”
বিশ্লেষণ:
- কিয়ামতের দিন সবাই হাশরের মাঠে জমা হবে।
- অবিশ্বাসীরা শাস্তি পাবে, আর মুমিনরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
- শিক্ষা: দুনিয়ার জীবনের মোহ ত্যাগ করে আখিরাতের প্রস্তুতি নিতে হবে।
৫. ধৈর্য ও তাওয়াক্কুলের শিক্ষা
আয়াত ৬০:
“অতএব, ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয়, তারা যেন তোমাকে বিচলিত না করে।”
বিশ্লেষণ:
- নবীজি (সা.) ও মুমিনদেরকে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে।
- আল্লাহর সাহায্য আসবেই, তাই হতাশ হওয়া যাবে না।
- শিক্ষা: যেকোনো সংকটে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা।
উপসংহার:
সূরা রুম ঐতিহাসিক সত্যতা, তাওহীদ, প্রকৃতির নিদর্শন, কিয়ামত ও ধৈর্যের শিক্ষা নিয়ে গঠিত। এটি মুমিনদের জন্য একটি আশার বার্তা বহন করে যে, আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবে।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:
- প্রতিদিন সূরা রুম তিলাওয়াত করা – বিশেষ করে ফজরের সময়।
- প্রকৃতির নিদর্শন নিয়ে গভীর চিন্তা করা – ঈমান বৃদ্ধির জন্য।
- শিরক থেকে দূরে থাকা – শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা।
- কিয়ামতের প্রস্তুতি নেওয়া – নেক আমল বাড়ানো।
- ধৈর্য ধারণ করা – আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা।
আরও পড়ুন: তাফসীর ইবনে কাসীর, তাফসীর তাবারি, তাফসীর জালালাইন।
সূরা রুম আয়াত ১৭-১৮, ৩০, ২১ , ৩৯, ২২, ৪১, আয়াত ও অর্থসহ ব্যাখ্যা
সূরা রুমের নির্বাচিত আয়াতসমূহের অর্থ ও ব্যাখ্যা
১. আয়াত ১৭-১৮ (আল্লাহর মহিমা ও প্রশংসা)
আয়াত:
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ
অর্থ:
“অতএব, সন্ধ্যায় ও সকালে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো। আকাশ ও পৃথিবীতে সমস্ত প্রশংসা তাঁরই এবং সন্ধ্যায় ও দুপুরে (তাঁর ইবাদত করো)।”
ব্যাখ্যা:
- এই আয়াতে প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) ও হামদ (আলহামদুলিল্লাহ) পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- সকাল-সন্ধ্যা, দুপুর ও রাতের বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর ইবাদত করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
- শিক্ষা: মুমিনের উচিত দিনের বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর জিকির ও শুকরিয়া আদায় করা।
২. আয়াত ২১ (দাম্পত্য জীবনের শান্তি)
আয়াত:
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থ:
“তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি হলো, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য থেকে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”
ব্যাখ্যা:
- বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত।
- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম, মমতা ও শান্তি আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন।
- শিক্ষা:
- দাম্পত্য জীবনে সহনশীলতা ও ভালোবাসা বজায় রাখা।
- আল্লাহর এই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা।
৩. আয়াত ২২ (ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য)
আয়াত:
وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّلْعَالِمِينَ
অর্থ:
“তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।”
ব্যাখ্যা:
- আকাশ-পৃথিবীর সৃষ্টি, বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণের মানুষ আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ।
- বৈচিত্র্য আল্লাহর ইচ্ছা, কিন্তু সব মানুষ সম্মানিত (সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩)।
- শিক্ষা:
- জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিভেদ না করে সমতা বজায় রাখা।
- আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে গভীর চিন্তা করা।
৪. আয়াত ৩০ (ফিতরাত বা স্বভাবধর্ম)
আয়াত:
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ:
“অতএব, তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে এই দীন (ইসলাম)-এর দিকে স্থির রাখো। এটাই আল্লাহর সৃষ্টি প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।”
ব্যাখ্যা:
- ইসলাম হলো মানুষের স্বভাবধর্ম (ফিতরাত)।
- মানুষ জন্মগতভাবে তাওহীদের প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু পরিবেশ ও কুসংস্কার তাকে বিভ্রান্ত করে।
- শিক্ষা:
- শিরক ও বিদআত থেকে দূরে থাকা।
- সহজ-সরল ইসলামী জীবনযাপন করা।
৫. আয়াত ৩৯ (সুদ ও রিবার নিষেধাজ্ঞা)
আয়াত:
وَمَا آتَيْتُم مِّن رِّبًا لِّيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُو عِندَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُم مِّن زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ
অর্থ:
“তোমরা সুদ দিয়ে মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করলে তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু তোমরা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জাকাত দাও, তবে তারাই (সওয়াবে) বহুগুণ লাভ করবে।”
ব্যাখ্যা:
- সুদ (রিবা) হারাম এবং এটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
- জাকাত ও সদকাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।
- শিক্ষা:
- সুদভিত্তিক লেনদেন পরিহার করা।
- জাকাত ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র করা।
৬. আয়াত ৪১ (প্রকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ)
আয়াত:
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অর্থ:
“মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থল ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, যাতে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে (তাওবার দিকে)।”
ব্যাখ্যা:
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খরা, মহামারী) মানুষের পাপ ও জুলুমের ফল।
- আল্লাহ শাস্তি দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেন, যাতে তারা তাওবা করে।
- শিক্ষা:
- পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা।
- পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা।
উপসংহার:
সূরা রুমের এই আয়াতগুলো থেকে আমরা শিখতে পারি:
- প্রতিদিন আল্লাহর জিকির ও শুকরিয়া আদায় করা।
- দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা ও শান্তি বজায় রাখা।
- বৈচিত্র্যকে সম্মান করা এবং আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা।
- ইসলামের সহজ-সরল পথে অবিচল থাকা।
- সুদ পরিহার করে জাকাত ও দানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র করা।
- প্রকৃতিক বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে তাওবা করা।
তাফসীরের জন্য পড়ুন: ইবনে কাসীর, তাবারি, জালালাইন।