You are currently viewing শৈশবের রমজান-শুকরান সাবিত
শৈশবের রমজান-শুকরান সাবিত

শৈশবের রমজান-শুকরান সাবিত

শৈশবে রমজান বেশ কয়েকটা কারণে আমাদের কাছে উপভোগ্য ছিল। প্রথমত তারাবি, যদিও তা ছিল নীরস। কিন্তু সামগ্রিকভাবে উৎসব উৎসব একটা আমেজ ছিল। হয়তো আমরা মারামারি করছি, অথবা তারাবি বাদ দিয়ে বাগানে আগুন জ্বালিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। আরেকটা উৎসবের আমেজ পাওয়া যেত ভোর রাতে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ‘ওঠো রোজাদার ওঠো রোজাদার, খেয়ে নাও নিয়ামাত সাহরি খাবার’ কিংবা ‘আবার এলো রমজান, আবার এলো রমজান’।

তখন পরিবারের হালত বলার মতো ছিল না। সেহরিতে ভাত আর আলু ভর্তার অতিরিক্ত খাবার পাইনি অনেক দিন। কিন্তু এই গানটা অন্তরে গেঁথে গেছিল। সেহরি একটা নিয়ামত। আসলে সেহরি উপভোগ করেছি, নাকি গান উপভোগ করেছি এখন বলতে পারি না।

ফজর পড়ে আমরা বাড়ি যেতাম না, হাটতে হাটতে দূর দিগন্তে ঘুরে আসতাম। এভাবে দুপুর গড়ানো, আর আগে ফিরে এলে ক্রিকেট অথবা ফুটবল খেলা। বিকেল গড়িয়ে ইফতারের সময় এলে মেসওয়াক করা। বৈকালিক স্নিগ্ধতা উপভোগ করারও একটি মাধ্যম ছিল এটি।

রমজানের শেষ দশকের আনন্দ-উৎসব মোড় নিত ভিন্ন দিকে। বিজোড় রাত্রিতে রাত জাগার নামে আড্ডাবাজি আর মারামারি করতাম। কারণ বয়স্করা রাত জাগত না। মসজিদ ফাঁকা ছিল আমাদের জন্য।

২৭ রমজানে আমাদের এলাকায় কবর জেয়ারতের রেওয়াজ। নদীর কিনারে সুসজ্জিত সেই গোরস্থান আরেক ঐন্দ্রজালিক অনুভূতির সৃষ্টি করে। জেয়ারত থেকে ফিরেই জামায়াতের সাথে সালাতুত তাসবিহর নামাজ। সিজদায় কখনও ঘুমিয়ে যাওয়া। ২৯ রমজানের পর চাঁদ উঠে গেলে রাতে অথবা না উঠলে পরদিন থেকে শুরু হওয়া পিঠা-পুলি রান্না। মনে পড়ে, স্কুল জীবনে আমরা অনেকেই এ দিনটা রোজা রাখতাম না।

ঈদের দিন সকাল হতেই আবার মসজিদ থেকে তাকবিরের পাশাপাশি ভেসে আসতে থাকে ‘দলবেঁধে সব করছে খেলা, গাইছে হেসে হেসে, বাড়ির পথে হাঁটেন রাসুল ঈদের নামাজ শেষে’। কখনও বন্ধুদের সাথে, কখনও পরিবারের সাথে, আত্মীয়স্বজনের সাথে ঈদ ও ঈদ পরবর্তী দিনগুলো কেটে যেত।

এখন এর সবটাই স্মৃতি। ঈদের দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি গত কয়েক বছর। আমার মনে হয় এ সময়ের অনেকেই এমনটা করেছে এবং করছে। ঈদকে কোন কালচারাল এজেন্সি হিসাবে খুঁজে পাচ্ছি না আমাদের জেনারেশন। কেমন পানসে হয়ে গেছে।

সেহরিতে এখনও ডাক দেয়। গত দুই বছর ভালোভাবে খেয়াল করেছি। গ্রামের মহিলারাই এই ডাক দেওয়ার জন্য মুয়াজ্জিন ও মসজিদ কমিটিকে বলে রাখে। কোন দিন ডাক না দিলে এজন্য জিজ্ঞাসা করতে কিংবা তাগাদা দিতেও দেখেছি। কিন্তু পুরনো গানগুলো এখন কেউ গায় না। রুচি বদলেছে। গত কয়েকবছর সেহরিতে দেখলাম ইসলামী ভোজপুরি কলরব বাজছে।

আহলে হাদিস পাড়া। শবে বরাত-শবে মেরাজের আলাদা কোন গুরুত্ব ছিলোই না কোন কালে। কিন্তু ঈদের আগের দিনটা নীরস ছিল না। পিঠা-পুলি বানানো এবং তা বিতরণ আগের দিনই শুরু হত। এখন নাই। উঠে গেছে। কিভাবে উঠে গেল হিসাব মেলাতে পারি না। লক্ষ্য করেছি, কুরবানি ঈদের বিতরণ প্রবণতাও কমে আসছে। এর নাটের গুরু আমাদের গ্রামের ইমাম পরিবার। এই পরিবারের এক সদস্য আমার সরাসরি দায়িত্বশীল এবং আমার সংগঠনে এগোনোর ক্ষেত্রে উনিই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু উনারা কারো সাথে কুরবানি শেয়ার করেন না। যদিও অন্যান্য সময় দাওয়াত নিতে কোন আপত্তি তাদের নেই। আমি এখনও বিষয়টা বুঝে উঠতে পারি না।

বাইরে থাকতে এই স্মৃতিগুলো পীড়া দেয়। বাড়ি গেলেও দেয়। সংস্কৃতি হারিয়ে ফেললে যেটা থাকে সেটা শরীর মাত্র। সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলা মানে খোলসটা হারিয়ে ফেলা। খোলসটা হারিয়ে গেলে শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাঙালি মুসলমানের জন্য অশনী সংকেত হইতেছে সে তার সংস্কৃতি আস্ত রাখে নাই। হারায়ে ফেলছে। কিভাবে কিভাবে হারাইছে জানি না। কিন্তু এর ফলে তার চার রাকায়াত নামাজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার না হলে তার বাল-বাচ্চার হবে। কিন্তু এই ক্ষতি দীর্ঘ মেয়াদে। চিন্তা করেন তো আপনি পাবলিক প্লেসে ইসলামের কোন নিশান দেখতেছেন না! বাঙালি মুসলমানের এই পরিণতিই আসতেছে সামনে। এই ইসলামটা সেক্যুলার ইসলাম, যেখানে ধর্ম থাকে কেবলই অন্তরে।

রমজানের সময় সূচি 2022 । রমজানের সময় সূচি 2021 । 

Leave a Reply