You are currently viewing একটি শিক্ষনীয় গল্প । রাণী- ফাতেমা জাহান লুবনা
একটি শিক্ষনীয় গল্প । রাণী- ফাতেমা জাহান লুবনা

একটি শিক্ষনীয় গল্প । রাণী- ফাতেমা জাহান লুবনা

রাণী

ফাতেমা জাহান লুবনা

পরপর দুটি কন্যা শিশুর জন্মের পরে এবারও এক কন্যা শিশু হবে স্ক্যান করার পর জিজ্ঞেস করায় ডাক্তার জানালেন। এমতাবস্থায় কি করবে কাকলি ভেবে পাচ্ছিল না। তার স্বামী এবার সন্তান নিতে একেবারেই রাজি ছিলেন না কারণ তিনি অনুমান করেছিলেন কাকলির এবারও কন্যা সন্তানই হবে আর সেরকম কিছু ঘটলে তার শাশুড়ি কাকলিকে কিছু উত্তম মধ্যম কথা শুনাবেন এটা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি।

এখন কাকলি তার সাড়ে চার মাসের কন্যা শিশুকে কি গর্ভপাত করবে নাকি গর্ভের মাঝে বাড়তে দিয়ে এই সমাজে হাজারো কথার কাঁটা শুনতে শুনতে হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত হতে দিবে? কাকলির জীবনটা ধূসর মরুভূমির মতো মনে হতে থাকে। আল্লাহ্ কি তাকে এতটাই অপছন্দ করেন যে পরপর তিনবারই তার কন্যা শিশুই হবে? -এ কথাটা ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এমন সময় তার এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ে যে নার্সিং পেশায় নিয়োজিত ছিল একটি সরকারি হাসপাতালে।

কাকলি ভাবল তাহলে পুষ্পকে দিয়েই গর্ভপাতটা করানো যাবে। এতে লোক জানাজানি হবে না আর হলেই বা কি? গর্ভপাতের ঘটনা তো এখন অহরহ ঘটছেই। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এটা কোন আহামরি ঘটনা তো নয়। তার স্বামীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনিও তেমন কোন আপত্তি করেননি। শুধু বললেন,

“দেখ , তোমার যেটা ভালো মনে হয় কর। আমি কি আর বলব? আমি তো তোমাকে আগেই বারণ করেছিলাম।”

কাকলির স্বামী অল্প বেতনের চাকরিজীবী। ঢাকার একটি প্রাইভেট ফার্মে দৈনিক নয়-দশ ঘন্টা কাজ করে যে মাইনে পান তা দিয়ে দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন। গ্রামে বাবামায়ের খরচের জন্যও কিছু টাকা পাঠাতে হয় তাই সংসার টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই অতিক্রম হতে থাকে।

কনকনে শীতের কুয়াশা কেটে সূর্য্যিমামার খানিক সাক্ষাৎ লাভের পর পরই সকাল বেলায় মেয়েদের স্কুলে আর স্বামীকে কাজে পাঠানো হলে কাকলি বাসে চড়ে আর কিছুদূর পায়ে হেঁটে পৌঁছে হাসপাতালের দ্বারে। বহুদিন পরে দুই বান্ধবী আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে। কুশল বিনিময় পর্ব শেষে কাকলি তার মনোবাঞ্ছার কথা প্রকাশ করে পুষ্পর কাছে। পুষ্প কাকলির কথা শুনে কিছুটা হতবাক হয়ে যায়। সে বলে-

‘ কাকলি ! ছেলে হলে তো সংসারের টানাপোড়েনেও গর্ভপাতের চিন্তা ভাবনা করতি না। মেয়ে হচ্ছে বলে এত দুশ্চিন্তা করছিস কেন? দ্যাখ আমিও তো মেয়ে। আমার বাবার মৃত্যুর পর থেকে ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, মায়ের খরচসহ সবকিছু আমিই চালাচ্ছি। আমি তো কারো বোঝা নই। আমার স্বামী আর আমি একই হাসপাতালে কাজ করছি আবার একত্রে আমাদের এক ছেলের যত্ন নেওয়াসহ সংসারের কাজকর্মও করে থাকি। আর তাছাড়া গর্ভপাত সম্পর্কে কোরআনে কি লেখা আছে জানিস? সূরা বনী ঈসরাইলে লেখা আছে –

” দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি । নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ।”‘

কাকলি জিজ্ঞাসা করে –

“তাহলে কি ইসলামে গর্ভপাত করা সম্পূর্ণভাবেই নিষিদ্ধ?”

পুষ্প উত্তর দেয় ,” হুমম…তবে যদি সন্তানের কারণে মায়ের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ায় তখন মায়ের জীবন রক্ষার্থে গর্ভপাত করা যেতে পারে এটা আমি একটি ইসলামিক বইতে পড়েছি। অনেক সময় রাত জেগে ডিউটিতে থাকতে হয় ….রোগী কল করলে তার কাছে যেতে হয়। তেমন ইমার্জেন্সি না থাকলে কিছু সময় ইসলামিক বই পড়ি…সময়টা বেশ ভালো কাটে আর এতে আলহামদুলিল্লাহ আমি ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেও পেরেছি যেটা আগে জানতাম না।”

দ্বিধান্বিত হয়ে কাকলি তার বান্ধবীকে বলে –

“কিন্তু এই সন্তান প্রতিপালন করতে গিয়ে আমাকে আমার শ্বশুরবাড়ির অনেক কথা সহ্য করতে হবে রে। আমি যে এখন কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।”

পুষ্পের হঠাৎ মনে পড়ল তার এক খালাতো বোনের কথা যার বিয়ের বয়স তেরো বছর পার হলেও এখনও বাচ্চা হয়নি বিধায় সে একটি সন্তানের জন্য উদগ্রীব ছিল। তাই সে কাকলিকে পরামর্শ দিল বাচ্চাটা হলে তার সেই খালাতো বোনকে দিয়ে দিতে। কাকলি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে মানসিক ভারমুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল।

পুষ্পের খালাতো বোন রিনা এবং তার স্বামী শিশুটিকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। তার স্বামী সরকারী চাকুরীজীবী। সেই সুবাদে তারা বিভিন্ন সরকারী কোয়াটারে কয়েক বছর পর পর বদলি হয়ে যেতেন।

সরকারি হাসপাতালের বেডে সারারাত জ্বরে কাতরিয়েছে কাকলির স্বামী। হঠাৎ করে এত জ্বরের প্রকোপ দেখে কাকলি রিকশায় করে তার স্বামীকে নিয়ে আসে হাসপাতালে। মেয়েদের দু’জনের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর বাড়িতে সুখেই আছে তারা। খবর পেয়ে তারাও ছুটে আসে অসুস্থ বৃদ্ধ পিতাকে দেখার জন্য। অল্প বয়সী একটি ডাক্তার হাসিমুখে প্রবেশ করে তাদের রুমে। নাম তার রাণী। দেখতে শ্যাম বর্ণের আর সুঠাম। তবে তার কথাতে কেমন যেন মায়া জড়িয়ে আছে …মায়া জড়িয়ে আছে তার চেহারাতেও। রোগীরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে।

সিনিয়র জুনিয়র সব ডাক্তার , নার্স, স্টাফদের কাছেও রাণী বেশ জনপ্রিয়। ডাক্তার বলে কোন অহংকার নেই রাণীর মাঝে। সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে সে। মার্জিত আর রুচিশীল পোশাক পরিহিতা রাণী নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে বেশ সচেতন। চিকিৎসকের পথ্য লিখন নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে যে বিভ্রান্তি আর জটিলতা সৃষ্টি হয় আর সে কারণে দেশে ভুল ঔষধ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনাও যে অহরহ ঘটছে তা তার লিখিত পথ্যের বেলায় মোটেও প্রযোজ্য নয়। সে স্বচ্ছ করে কেবল পথ্য লিখেই ক্ষান্ত হয়না বরং কিভাবে ঔষধ সেবন করতে হবে এরবাইরেও কি কি করতে হবে সবকিছু ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিত। তাই রোগীরা প্রায়ই রাণীকে বলত-

” আপনাকে দেখলে রোগ অর্ধেক সেরে যায় । ”

সে শুধু মুচকি হেসে ছোট্ট করে উত্তর দিত – “আলহামদুলিল্লাহ। ”

আরও পড়ুন – গল্প নীরব দহন- নারগিস নাহার রুনু

এক বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্না বিনয়ী নারী রাণী। যার মতো মেয়ে পাওয়া প্রতিটি পিতামাতার আকাঙ্ক্ষা থাকে…. যার মতো বোন পাওয়া প্রতিটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে ….যার মতো ডাক্তার পাওয়া প্রতিটি রোগীর আকাঙ্ক্ষা থাকে ….যে হতে পারে একজন ভালো স্ত্রী, একজন ভালো মাতা…দেশের একজন সুনাগরিক ….একজন আলোকিত মানবী।

যাহোক রাণী রুমে ঢুকে প্রথমে কাকলির স্বামীর কুশল জিজ্ঞেস করার পর তার ব্লাডপ্রেসার ইত্যাদি অবস্থা জানতে ফাইল হাতে নিয়ে বসে পাশের সিটে। এরইমধ্যে এক নার্স রুমের ভেতর এসে বলে –

“রাণী মেডাম! আপনাকে বড় ডাক্তার ডাকছেন।”

কাকলিকে তার স্বামীর ব্যপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে রাণী রুম থেকে বের হয়ে যায়। সুস্থ হয়ে কাকলি তার স্বামীকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে।

কয়েক দিন পরে পুষ্পের ফোন আসে কাকলির কাছে।

: আমার মেয়েটা এখন কোথায় আছে রে পুষ্প? অনেক দিন হল ওর কোন খোঁজ পাইনি।

:আরে সেটা জানানোর জন্যই তো তোকে ফোন করলাম। আলহামদুলিল্লাহ তোর মেয়ে এখন ডাক্তার হয়েছে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদান করেছে রাণী ।

: কি বলিস ? ডাক্তার রাণী আমার মেয়ে!

আমি ভাবতেই পারছি না আমার মেয়েটা ডাক্তার হয়েছে!

(কথাগুলো বলতে বলতে চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কাকলির।)

: শুধু কি তাই? তোর মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী আর বিচক্ষণও। আমার বোন দুলাভাই ওকে ইসলামিক ভাবেই গড়ে তুলেছেন। আমরা ওকে কিছুদিন আগে তোদের কথা বলেছি। ও তোদের সাথে দেখা করতে চেয়েছে। আমরা সবাই রাণীকে নিয়ে আগামী শুক্রবার তোদের বাসায় আসছি।

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ আনন্দে অশ্রু বিসর্জন করল কাকলি। এরপরে পরম করুণাময় আল্লাহ্ র দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে মোনাজাতে বলল –

“হে আল্লাহ ! আমার মেয়েটিকে তুমি অনেক বড় মাপের আর ভালো একজন ডাক্তার বানাইও যেন ওকে দেখে মানুষ মেয়েশিশু জন্মগ্রহণ করলে আর কখনও হতাশ না হয় আর সমাজও যেন কোনদিন নারীদের অবমাননা করতে না পারে। আমাদের রাণীকে তুমি আদর্শ নারী করে দিও। আমীন।”

শিক্ষনীয় গল্প শিক্ষনীয় গল্প শিক্ষনীয় গল্প ইসলামিক শিক্ষনীয় গল্প অসাধারন শিক্ষনীয় গল্প

Leave a Reply