You are currently viewing আমেরিকা একতরফা সেনা প্রত্যাহারে পাকিস্তানকে চাপ দেয়
মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- পিনাকী ভট্টাচার্য

আমেরিকা একতরফা সেনা প্রত্যাহারে পাকিস্তানকে চাপ দেয়

৪ নভেম্বর ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকা সফর করেন। এই সফরের পটভূমিতেই এই টেলিগ্রাম। এই সফরে শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো আপোস-মীমাংসার কথা এগিয়ে দেয়া যায় কিনা সেই চেষ্টা ছিল নিক্সন প্রশাসনের। সেই লক্ষ্যেই নিক্সন সরাসরি ইয়াহিয়াকে একটা চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের হাত মারফত সম্ভবত ৩০ অক্টোবর ইয়াহিয়ার কাছে পৌছানো হয়।

ইয়াহিয়ার কাছে নিক্সনের চিঠিতে যা লেখা ছিল সেটার বাইরেও ফারল্যান্ডকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা দীর্ঘলিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে ফারল্যান্ড কোনো কোনো পয়েন্ট নিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা করবেন, তার অনুপুঙ্খ নির্দেশনা দেয়া হয়। ফারল্যান্ডকে লেখা স্টেট ডিপার্টমেন্টের সেই নির্দেশনামূলক চিঠিটা একটা শিক্ষণীয় ম্যানেজমেন্ট পাঠ্য হতে পারে। নির্দেশনা এত নিখুঁত হতে পারে তা ওই চিঠির পুরোটা না পড়লে বুঝতে পারা মুশকিল। চিঠিতে আলোচনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়ে প্রথম পয়েন্টেই লেখা হয় :

‘প্রেসিডেন্টের চিঠি হস্তান্তরের জন্য আপনি সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে ইয়াহিয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেবেন এবং নিচের বক্তব্যের বিষয়ে ইয়াহিয়ার বক্তব্য বের করে আনবেন, যেন মিসেস গান্ধীর৪ নভেম্বরের সফরের আগেই আমাদের হাতে তাঁকে বলবার মতো প্রস্তাব হাতে এসে পৌছায়। আপনার আলোচনার সামগ্রিক লক্ষ্য হবে, পাকিস্তানিরা সর্বোচ্চ কী কী ছাড় দিতে প্রস্তুত সেটা জেনে নেয়া যাতে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার সময়ে ভারতের তরফে পাল্টা উত্তেজনা প্রশমন করে এমন সব পদক্ষেপের বিষয়ে আহ্বান জানানো যায়।’

স্পষ্ট দুটি বিষয়ে ইয়াহিয়ার মতামত জানতে চাওয়া হবে :

১. একতরফা সেনা প্রত্যাহার

২. রাজনৈতিক সমাধান

আরও পড়ুন–বঙ্গবন্ধুর প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমেরিকার রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন

রাজনৈতিক সমাধান কীভাবে ইয়াহিয়া করবেন সেটা তাঁর ওপরেই ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়। সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে আমেরিকা জানায়, তাদের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স থেকে তারা জানতে পেরেছে, পাকিস্তানই প্রথম সীমান্তের দিকে সেনা সঞ্চালন করে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খারিয়ান ক্যান্টনমেন্ট থেকে দুই ডিভিশন সেনা শিয়ালকোট সীমান্তে স্থিত করে। এরপরে অক্টোবরের প্রথম দিকে কয়েক ডিভিশন ভারতীয় সেনা শিয়ালকোটের পাকিস্তানের অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নেয়। আপনি মনে রাখবেন, সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে ইয়াহিয়া জাতিসংঘের (তৎকালীন) মহাসচিব উ থান্টের কাছে ইতিবাচক মত দেন।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের চিঠিতে ইয়াহিয়ার শেখ মুজিবকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ব্যবহারের ইচ্ছের কথা উল্লেখ আছে। সে বিষয়ে আমেরিকা জানায়, এই ব্যাপারটা তারা এখন ইয়াহিয়ার বিবেচনার উপরে ছেড়ে দিচ্ছে। আমরা ঠিক আগের ডকুমেন্টের কথা জানি, যেখানে শেখ মুজিবের ওপরে সব দায় চাপিয়ে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে দেয়ার মতলব ইয়াহিয়া এঁটেছিলেন। ইয়াহিয়ার সেই ইচ্ছাটাকেই সম্ভবত এখানে ট্রাম্প কার্ডহিসেবে বলা হচ্ছে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ তাঁর বই ম্যাসাকারে লেখেন, জুলাইয়ে ইয়াহিয়া তাঁর জেনারেলদের বরাতে বলেন, জেনারেলরা তার ওপরে চাপ দিচ্ছে যেন মুজিবের সামরিক ট্রাইবুন্যালে বিচার হয় এবং ফাঁসি দিয়ে দেয়া হয়। ইয়াহিয়া বলেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হয়েছি এবং বিচার শিগগিরই শুরু হবে। আগস্টের ২ তারিখে একটি প্রেসনোটে বলা হয়, মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তাই মিলিটারি কোর্টেতার বিচার হবে।১ সেদিনই ইয়াহিয়া একটি মিলিটারি কোর্টগঠন করেন। ৩ তারিখে একটি টেলিভিশন ভাষণে ইয়াহিয়া বলেন মুজিবের বিচার হবে। ১১ আগস্ট থেকে বিচার শুরু হয় এবং ৪ ডিসেম্বর মিলিটারি কোর্টশেখ মুজিবের ফাঁসির আদেশ দেয়।২

এই চিঠিতেই আমেরিকা উল্লেখ করে, ইয়াহিয়াযেন তাঁর মতলব অনুসারে মিলিটারি কোর্টের প্রসিডিংস প্রকাশ না করে; এটা করা হলে বাঙালিদের মনের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দেবে এবং পূর্বপাকিস্তানে বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমেরিকা বলছে, শেখ মুজিব এখন একটা প্রধান প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আমেরিকা চায় যেন এই বিচারকাজ স্বচ্ছ হয় এবং আপীলের সুযোগকে ব্যবহার করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সামলানো সহজ হবে। এই দলিলগুলোর প্রতিটা পরতে পরতে তা পরামর্শ বা নির্দেশ যা-ই হোক-আমেরিকার দিক থেকে খুবই সতর্কথাকতে দেখা গিয়েছে যে, তারা কোনো মধ্যস্থতাকারী অথবা ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতা-এমন যেন মনে না হয়। এমন ভূমিকা না নেয়া বা এভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ যেন না থাকে সে ব্যাপারেও সতর্কথেকেছে। তবে অনেক জায়গায় পাকিস্তানের কাছে বড়জোর কী কী অপশন আছে বা হতে পারে তার সবগুলো তুলে ধরা হয়েছে। তবে আমেরিকা সতর্কথেকেছে যেন আমেরিকার ককোনো অপশন পছন্দের এমন কোনো ঝোঁক বা ধারণা না দেয়া হয়। বরং পাকিস্তানের কাছে পরিষ্কার থাকার চেষ্টা করেছে যে সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকেই একা নিতে হবে। একটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্য আছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্মরণ সিংকে উদ্ধৃত করে, স্মরণ সিং ৮ অক্টোবরে (১৯৭১) সিমলায় বলেন, ‘ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকার ও তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তানের যেকোনো সমঝোতা মেনে নেবে এমনকি সেটা যদি পাকিস্তানের (সাংবিধানিক) কাঠামোর মধ্যেও হয়।’৩

সূত্র

  1. Massacre: The Tragedy at Bangla Desh and the Phenome-

non of Mass Slaughter Throughout History- February, 1973: by

Robert Payne (Author).

  1. Losers saw him as Trumpcard; Shakhwat Liton, The Daily

Star, January 10, 2016,

  1. National Archives, RG59, Central Files 1970-73, POL IN-

DIA-PAK. Secret; Immediate; Exdis. Drafted by Laingen and

Constable on October 29; cleared by Schneider, Van Hollen,

Sisco, and Saunders; and approved by Irwin. Repeated to Lon-

don, Moscow, New Delhi, Paris, Tehran, USUN, Calcutta, and

Dacca. A note for the record, attached by Saunders on October

29 to a draft of the telegram, indicates that Kissinger revised and

cleared it. (Ibid., Nixon Presidential Materials, NSC Files, Box

626, Country Files, Middle East, Pakistan, Vol. VII, Sep-Oct

1971).

পিনাকী ভট্টাচার্য
পিনাকী ভট্টাচার্য

‘৯০-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঠ থেকে উঠে আসা যে কয়জন রাজনৈতিক কর্মী সমসাময়িক বাংলাদেশে আলােচিত লেখক হয়েছেন, পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দিশা খুঁজে ফেরা পিনাকীর রয়েছে বিচিত্র সব রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। লেখালেখির বিষয় বহুবর্ণ ও বিচিত্র। দর্শন, ইতিহাস আর রাজনীতি পিনাকীর লেখালেখির প্রিয় বিষয়। সফল কর্পোরেট চিফ এক্সিকিউটিভ থেকে এখন লেখালেখি ছাড়াও নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় দেন। একাদেমিয়া নামের একটি নিয়মিত পাঠচক্রের সভাপতি। বাংলাদেশের ফেইসবুকের লেখালেখির জগতে পিনাকী ভট্টাচার্য ইতিমধ্যেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলতে ভালােবাসেন তিনি। নানা বিষয়ে বিস্ফোরক প্রশ্ন তুলে অনেক প্রচলিত বয়ানকে নড়বড়ে করে দেয়ার মতাে বিস্ময়কর দক্ষতা আছে পিনাকীর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা, মুক্তিযুদ্ধ রচনা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কোথায় অবস্থিত, মুক্তিযুদ্ধের ছবি, মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-৭১

Leave a Reply