You are currently viewing বঙ্গবন্ধুর প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমেরিকার রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন
মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- পিনাকী ভট্টাচার্য

বঙ্গবন্ধুর প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমেরিকার রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন

এই ডকুমেন্টটা ১১ আগস্ট ১৯৭১ সালের। অর্থাৎ এর ঠিক দুদিন আগে ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৫ বছরের প্রতিরক্ষা বিষয়ে বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। এই স্বাক্ষরের খবর আমেরিকানরা জেনে গেছে। কিন্তু তবু তারা নিশ্চিত না, বাংলাদেশের বিষয়ে (স্বাধীন করে ফেলা) ভারতের সিদ্ধান্ত কী হতে যাচ্ছে। যদিও পরবর্তীকালের সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ থেকে আমরা জানি, এই চুক্তি স্বাক্ষরই স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের সামরিক তৎপরতার সিগনাল ছিল। এই দিনে পাকিস্তানের পরিস্থিতি ও সেখানে আমেরিকার করণীয় নিয়ে হোয়াইট হাউজের সিচুয়েশন রুমে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিক্সন, কিসিঞ্জার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সকল উপ ও প্রতিমন্ত্রী, সিআইএ’র উপ-প্রধান এক দীর্ঘ আলোচনা করেন। নিক্সনের আলোচনার মূল বিষয় ছিল, যেন কোনোভাবেই যুদ্ধ লেগে না যায়। এখানে যুদ্ধ বলতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বোঝানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনগুলোকে তারা গেরিলা হামলা বলেই অভিহিত করেছে। নিক্সন বারবার বলছেন, যুদ্ধ লেগে গেলে এই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থদারুণভাবে বিঘ্নিত হবে। নিক্সন বলছেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এবং ভারতে শরণার্থীরা যে দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছে তাতে আমরা অত্যন্ত চিন্তিত। মানবিক সাহায্যের জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানানো উচিত। আর আমাদের মানবিক সাহায্যে সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। এখানে নিক্সন খুব বাজেভাবেই ভারতীয়দের সমালোচনা করেন। তিনি ভারতে কর্মরত আমেরিকান অফিসারদের সম্পর্কেহতাশা প্রকাশ করে বলেন :

‘যে-ই দেখি ভারতে যায় সে-ই ওদের প্রেমে পড়ে যায়, বিষয়টা কী?

পাকিস্তানে গেলেও কারো কারো এমন হয়। তবে ভারতের প্রেমেই পড়ে বেশি, কারণ পাকিস্তানিরা আবার আলাদা জাত। পাকিস্তানিরা সোজাসাপ্টা আর কখনো কখনো চূড়ান্তভাবে গর্দভ। আর ইন্ডিয়ানরা এমন কুটিল আর স্মার্টযে মাঝে মাঝে আমাদের ওদের মতো করে চিন্তা করতে বাধ্য করে।’

এই প্রসঙ্গটা এসেছে যখন নিক্সন আবিষ্কার করেন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট যে সামান্য প্রাণঘাতী নয় এমন যুদ্ধ সরঞ্জামের যে চালান পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল সেটা ডিপ্লোম্যাটরা আটকে দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নিক্সন নির্দেশ দেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টে যে সব ভারতপ্রেমী আমেরিকান অফিসার আছে তাদের ঠান্ডা করতে হবে। নিক্সন আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যদি ভারত পাকিস্তানের ভেতরে গেরিলা পাঠিয়ে সীমান্তের আশেপাশে দৌড়ঝাঁপ করতে থাকে তাহলে সুইসাইডাল হবে সেটা জেনেও পাকিস্তান যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। আমরা জানি, নিক্সনের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। চার মাস পরে পাকিস্তানই প্রথম ভারতের মাটিতে আক্রমণ করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা করে। ঐ সভায় তিনটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল :

১. আমেরিকা শরণার্থী ও পূর্বপাকিস্তানের দুর্গত মানুষদের জন্য সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতা দেবে।

২. কোনোভাবেই যেন যুদ্ধ না লাগে, কারণ যুদ্ধ কাউকেই সাহায্য করবে না।

৩. আমেরিকা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক (সমাধানের অবস্থান নিয়ে কথা বলবে। তবে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবে। সভায় ধারণা করা হয়, সম্ভবত ভারত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং ভারতের লক্ষ্য যাই হোক না কেন, আমেরিকা কেয়ার করে না। আমেরিকা যেটা চায় তা হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যেন শান্তিপূর্ণভাবে হয়। পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ণয়ের

অধিকার ভারতের নেই, ঠিক একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সুযোগ নেই পূর্বপাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের। উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিস্কো এই সময় বলেন, আমাদের রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে, ‘শেখ মুজিবকে যেন ফাঁসি দেয়া না হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, তখন পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা চলছিল। নিক্সন তখন সাজেশন দেন, যেহেতু পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে ইয়াহিয়া এখনো বন্ধু বলে মনে করেন, শেখ মুজিবকে যেন মেরে না ফেলা হয়-সেটা যেন তার মাধ্যমেই ইয়াহিয়াকে জানানো হয়। নিক্সন সভার শেষে আবারও বলেন, প্রকাশ্যে জনগণের কাছে আমরা বলব, আমরা এই সংঘাতের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমরা বলব শেখ মুজিবকে যেন মেরে না ফেলা হয়। নিক্সনের এই কথার মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, আমেরিকা আর নিরপেক্ষ নয়; তারা একটা রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ফেলেছে এবং শেখ মুজিবের জীবন বাঁচানোর জন্য তাদের পদক্ষেপের কারণেই তারা নিজেরাও মনে করছে না তারা আর নিরপেক্ষতা দেখাতে পারছে। এই সভার তিন নম্বর সিদ্ধান্ত তাই ছিল : ‘আমেরিকা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কথা বলবে না। রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবে।’

আমরা এই সভার ডকুমেন্ট থেকেই জানতে পারি, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ইউএন ১৭০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য সংগ্রহ করেছে যার মধ্যে ৭০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য এসেছে খোদ আমেরিকা থেকে।

সূত্র :

National Archives, Nixon Presidential Materials, NSC Files, NSC

Institutional Files (H-Files), Box H-058, SRG Meeting, Paki-

stan/Cyprus, 8/1in1. Secret; Nodis. Prepared by Saunders.

পিনাকী ভট্টাচার্য
পিনাকী ভট্টাচার্য

‘৯০-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঠ থেকে উঠে আসা যে কয়জন রাজনৈতিক কর্মী সমসাময়িক বাংলাদেশে আলােচিত লেখক হয়েছেন, পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দিশা খুঁজে ফেরা পিনাকীর রয়েছে বিচিত্র সব রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। লেখালেখির বিষয় বহুবর্ণ ও বিচিত্র। দর্শন, ইতিহাস আর রাজনীতি পিনাকীর লেখালেখির প্রিয় বিষয়। সফল কর্পোরেট চিফ এক্সিকিউটিভ থেকে এখন লেখালেখি ছাড়াও নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় দেন। একাদেমিয়া নামের একটি নিয়মিত পাঠচক্রের সভাপতি। বাংলাদেশের ফেইসবুকের লেখালেখির জগতে পিনাকী ভট্টাচার্য ইতিমধ্যেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলতে ভালােবাসেন তিনি। নানা বিষয়ে বিস্ফোরক প্রশ্ন তুলে অনেক প্রচলিত বয়ানকে নড়বড়ে করে দেয়ার মতাে বিস্ময়কর দক্ষতা আছে পিনাকীর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা, মুক্তিযুদ্ধ রচনা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কোথায় অবস্থিত, মুক্তিযুদ্ধের ছবি

Leave a Reply