You are currently viewing আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি আমেরিকার কাছে পাকিস্তানের সঙ্গে মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে যান জুলাইয়ে
মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- পিনাকী ভট্টাচার্য

আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি আমেরিকার কাছে পাকিস্তানের সঙ্গে মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে যান জুলাইয়ে

১ জুলাই ১৯৭১, আওয়ামী লীগ গণপরিষদ সদস্য কাজী জহিরুল কাইয়ুম কলকাতায় মার্কিন কূটনীতিকদের জানান, আওয়ামী লীগের নেতারা ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় আসতে আগ্রহী। কেনো ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধ বেঁধে গেলে এবং বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে উগ্রপন্থীরা তা দখল করে নেবে। এমনকি এজন্য আওয়ামী লীগ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী থেকেও সরে আসতে প্রস্তুত। কাজী জহিরুল কাইয়ুম ছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য এবং বাংলাদেশের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের চাচা। এই রাজনৈতিক সমাধানের জন্য কাইয়ুম প্রস্তাব দেন একটি চতুর্পক্ষীয় সভার যেখানে আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান, আমেরিকা এবং ভারত থাকবে। কিন্তু তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের এই সভায় অংশ নেয়াটা আবশ্যিক।

কাজী জহিরুল কাইয়ুম নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি এবং তিনি প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বার্তা নিয়ে এসেছেন বলে আমেরিকান কূটনীতিকদের জানান। কাজী জহিরুল কাইয়ুমের নামের উল্লেখ সেই সময়ের ৮টি আমেরিকান ডকুমেন্টে আছে। এ থেকেই বোঝা যায়, কাজী কাইয়ুমের প্রস্তাবগুলোকে আমেরিকা গুরুত্ব দিয়েছে, নিছক মোশতাকের কোনো ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দেয়নি। কারণ তার সকল প্রস্তাব ও আলোচনা যুক্তিপূর্ণ বলে আমেরিকানদের কাছে মনে হয়েছে। আমেরিকান কূটনীতিকরা নানাভাবেই তার বক্তব্যকে পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং তাঁর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা চালিয়ে গেছেন।

কাজী কাইয়ুম আমেরিকার কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে আসেন ৭ আগস্ট এবং দেখা করে পলিটিক্যাল অফিসারের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, আমেরিকাই একমাত্র দেশ যারা এই অবস্থার একটা সফল নিষ্পত্তি করে দিতে পারে, কিন্তু এই নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় অংশ হতে হবে শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি আরো বলেন, যদি মুজিবুর রহমানকে বিচার করে ফাঁসি দেয়া হয় তবে সমঝোতার সম্ভাবনা হয়ে যাবে ‘শূন্য’। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের এমনকি বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই তারা কোনো সমঝোতায় পৌছানোর ক্ষমতা রাখে না। অন্যদিকে যদি এই সমঝোতা শেখ মুজিবের মাধ্যমে হয় তাহলে জনগণ এটা মেনে নেবে; এমনকি ঠিক আগের অবস্থাতে ফিরে যাওয়া হলেও সেটাও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এর পরে কাজী কাইয়ুম বলছেন, আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে এবং এই উপমহাদেশের সবার জন্য তা বিরাট বিপর্যয় হবে। কাইয়ুম বলেন, গুজব শানা যাচ্ছে যে ভারত বাংলাদেশ সরকারকে কিছুদিনের মধ্যেই স্বীকৃতি দিতে পারে; এবং এর ফলে তিনি মনে করেন, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব তাতে আরো গভীর হবে, রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা সংকুচিত হবে এবং পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হবে। যদি যুদ্ধ শুরু হয় তবে আমেরিকার চেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিস্থিতির ওপরে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে এবং এটা আওয়ামী লীগের জন্য অসুবিধাজনক হবে।

জহিরুল কাইয়ুমের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বক্তব্য পাকিস্তানি সরকারের কাছে পৌছানোর অনুমতি আমেরিকানদের কাজী কাইয়ুম দেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে নিজে পাকিস্তানে আলোচনা শুরুর জন্য যেতে ইচ্ছুক এবং খন্দকার মোশতাকও যেতে পারেন যদি নিরাপদ আচরণের নিশ্চয়তা দেয়া হয়।

খুব অবাক বিষয় যে, কাজী কাইয়ুম আরো বলছেন, দিনে দিনে সামরিক শক্তি হিসেবে মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, তারা এক্ষেত্রে দুই ধারী’ কৌশল নিয়েছেন। (কিনভেনশনাল আর্মির যুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ) দুই ডিভিশনের কনভেনশনাল ফোর্স, যা এখন আছে একটি ডিভিশন যাতে আছে দশটি ব্যাটেলিয়ন এবং একেকটি ব্যাটেলিয়নে আছে ১২০০ সেনা। যখন দ্বিতীয় ডিভিশনটি তৈরি হওয়া সম্পন্ন হবে তখন পূর্বপাকিস্তান দখল করে তাকে রক্ষা করা হবে। আর এই সময়ের মধ্যে পাশাপাশি গেরিলা মুক্তিবাহিনী পূর্বপাকিস্তানের সকল অংশে গেরিলা তৎপরতা চালাবে।

তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগ নিঃসংশয় যে, সামরিক বিজয় তারা অর্জন করতে পারবে। এমনকি কাইয়ুমের বক্তব্যে এটাও এসেছে যে, যুদ্ধের পরে বিপুল পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে এবং এই কাজে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে। ঠিক একই কথা যুদ্ধ শুরুর আগে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে।

এই ডকুমেন্টের কমেন্টে বলা আছে, মিলিটারি স্ট্যান্ড পয়েন্টে মুক্তিবাহিনীর সামরিক বিজয় বিষয়ে তাঁকে (কাজী জহিরুল কাইয়ুম) আরো বেশি দ্বিধাহীন মনে হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তিনি সমভাবে প্রণোদিত বলে মনে হয়েছে। এই অবস্থানটা কাউকে বিহ্বল করে তুলতে পারে। যিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন মুক্তিবাহিনী শেষ বিচারে বিজয়ী হয়ে যাবে, তবুও ছাড় দিয়ে একটা রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা কেন চলছে? শুধু সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি পেয়ে আওয়ামী লীগের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করবে, সেটাই কি একমাত্র কারণ? কাইয়ুমের উদ্যোগটাকে মোশতাকের উদ্যোগ মনে করা যেতে পারে। আমেরিকান কূটনীতিকদের কাছেও তাই মনে হয়েছে। তবে এটা যে কাইয়ুমের দিক থেকে ঘটনা পরিস্থিতিকে বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রস্তুতি বিষয়টা বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বলা বক্তব্য সন্দেহ নেই, আর সেটা স্বাভাবিকও। তবে মোশতাকের দিক থেকে বললে, তিনি হয়তো বলতেন, মুজিব যেন পাকিস্তানিদের হাতে মারা না যান, তাকে যেন বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারেন এবং সর্বোপরি তাজউদ্দীন গংদের হাত ও প্রভাব থেকে পরিস্থিতিকে মুজিবের হাতে ন্যস্ত করতে পারেন-সেজন্যই তিনি এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলেন। বিশেষ করে তার বিশেষ শর্ত, কিন্তু এই নিস্পত্তির প্রক্রিয়ায় অংশ হতে হবে শেখ মুজিবুর রহমানকে কেবল একথা বলার জন্যই তাঁকে কোন ষড়যন্ত্রকারী মনে করা কঠিন। আবার মোশতাকের এমন স্ট্রাটেজি নেয়া খুবই যুক্তিসিদ্ধ মনে করা যেতে পারে। তবে এমন ব্যাখ্যায় আস্থা রাখা না রাখা অথবা এমন পাঠে এগিয়ে আসা না আসা একেবারেই পাঠকের নিজস্ব বিবেচনার ওপর ছেড়ে রাখলাম।

সূত্র :

National Archives, RG59, Central Files 1970-73, POL23-9

PAK. Secret; Immediate; Exdis. Also sent to New Delhi.

পিনাকী ভট্টাচার্য
পিনাকী ভট্টাচার্য

‘৯০-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঠ থেকে উঠে আসা যে কয়জন রাজনৈতিক কর্মী সমসাময়িক বাংলাদেশে আলােচিত লেখক হয়েছেন, পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দিশা খুঁজে ফেরা পিনাকীর রয়েছে বিচিত্র সব রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। লেখালেখির বিষয় বহুবর্ণ ও বিচিত্র। দর্শন, ইতিহাস আর রাজনীতি পিনাকীর লেখালেখির প্রিয় বিষয়। সফল কর্পোরেট চিফ এক্সিকিউটিভ থেকে এখন লেখালেখি ছাড়াও নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় দেন। একাদেমিয়া নামের একটি নিয়মিত পাঠচক্রের সভাপতি। বাংলাদেশের ফেইসবুকের লেখালেখির জগতে পিনাকী ভট্টাচার্য ইতিমধ্যেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলতে ভালােবাসেন তিনি। নানা বিষয়ে বিস্ফোরক প্রশ্ন তুলে অনেক প্রচলিত বয়ানকে নড়বড়ে করে দেয়ার মতাে বিস্ময়কর দক্ষতা আছে পিনাকীর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা, মুক্তিযুদ্ধ রচনা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কোথায় অবস্থিত, মুক্তিযুদ্ধের ছবি

Leave a Reply