You are currently viewing মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা কোন নীতিতে অবস্থান নিয়ে কাজ করেছিল
মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- পিনাকী ভট্টাচার্য

মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা কোন নীতিতে অবস্থান নিয়ে কাজ করেছিল

এটা ২৫ মার্চের গণহত্যার পর তিন সপ্তাহ পার হয়েছে, এই অবস্থায় কিসিঞ্জারের ড্রাফট করতে বসা এক দলিল। অর্থাৎ গণহত্যার পর এ নিয়ে আমেরিকান সরকারের প্রতিক্রিয়া কী তা এখান থেকে আমরা পরোক্ষে হলেও জানতে পারব। ১৯৭১-এর ২৮ এপ্রিল মার্কিন বৈদেশিক সম্পর্কবিভাগ পাকিস্তানের সঙ্গে কোন পলিসি অনুসারে আমেরিকার চলা উচিত সেই নিয়ে একটি দীর্ঘপ্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদনে সিচুয়েশন অ্যানালাইসিসের পরে তিনটা সম্ভাব্য পলিসি অপশন নিক্সনের বিবেচনার জন্য পেশ করে সেখানে তাঁর নির্দেশনা চাওয়া হয়। প্রত্যেকটা অপশনের সাব-হেডিং-এ সেই অপশন গ্রহণ করলে ইকোনোমিক সহায়তা কী হবে, খাদ্য সহায়তা কী হবে আর মিলিটারি সহায়তা কী হবে সেটার একটা আউটলাইন দেয়া ছিল। আসুন, দেখি অপশনগুলো কী ছিল? মুক্তিযুদ্ধ

অপশন ১: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্বপাকিস্তানকে বশে আনার জন্য যা যা রাজনৈতিক ও মিলিটারি প্রোগ্রাম নেন সেটায় সমর্থন দেয়া।

অর্থনৈতিক সহায়তা: আমরা ঋণ মওকুফ সহায়তা দেব এবং পূর্ণ মাত্রায় উন্নয়ন সহায়তা দেব যখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের নিশ্চিত করবে এই সহায়তা যুদ্ধ অর্থায়নে ব্যবহৃত হবে না। যদিও আমরা জানি, এই সহায়তা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানেই ব্যবহৃত হবে; তবুও সেটা নিয়ে আমরা উচ্চবাচ্য করব না।

খাদ্য সহায়তা: পূর্ণ মাত্রায় খাদ্য সহায়তা দেব, এ বিষয়ে যা যা অনুরোধ আছে সব চালান জাহাজে করে পাঠিয়ে দেব। পূর্বপাকিস্তানে কীভাবে সেই খাদ্য বিতরিত হবে বা খাদ্যসাহায্য দেয়া থেকে বিরত থাকবে সে বিষয়ে কোনো শর্ত আরোপ করব না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

মিলিটারি সহায়তা: গোলা-গুলি ছাড়া সকল মিলিটারি সাপ্লাই পাঠিয়ে দেব। গুলি এবং গোলা পাঠানোর ক্ষেত্রে আমরা কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না নিয়েই বিলম্বিত করব।

অপশন ২: আমরা সত্যিকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখব।

অর্থনৈতিক সহায়তা: আমরা সকল সহায়তা বিলম্বিত করব যতক্ষণ পর্যন্ত আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয় যে, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কর্মসূচি পুনর্গঠিত করা হয়েছে যাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সমতাভিত্তিক বিতরণ করা হবে বিবেচনা নেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

খাদ্য সহায়তা: পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকে বিতরণে বাধা না দিয়ে আমরা খাদ্যসাহায্য পাঠানো আবার শুরু করার আগে তাদের চাপ দেব যেন খাদ্যসাহায্য সারা পাকিস্তানে সমতার সঙ্গে বিতরণ করা হয়, সেটা নিশ্চিত করতে। বিশেষ করে সাইক্লোনদুর্গত এলাকায়, গ্রাম এলাকায় ও আর্মিনিয়ন্ত্রিত এলাকায় যেন বিতরণ করা হয়।

মিলিটারি সহায়তা: গুলি এবং গোলাসহ সকল মিলিটারি সাপ্লাই এবং মৃত্যু হয় এমন মারণাস্ত্র, সেগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ পাঠানো বন্ধ করব। তবে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্রের ও খুচরা যন্ত্রাংশের চালান পাঠানো যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা

অপশন ৩: যুদ্ধ বন্ধে ইয়াহিয়াকে সিরিয়াসলি সাহায্য করা যেন ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এই বিবেচনা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, যদি এই রাজনৈতিক প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায় তবে আমেরিকান সাহায্য কমিয়ে ফেলতে হবে কারণ আমরা পূর্বপাকিস্তানে কাজ চালাতে পারব না। কিন্তু এই আপদকালীন সময়ের জন্য আমাদের পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য জরুরী সাহায্য চালিয়ে যেতে হবে যেন তাদের উন্নয়ন কর্মসূচিকে যখন পূর্ব ও পশ্চিমে পুনর্গঠন করা হবে তখন এই ঝাঞ্ঝাকে সে পেরিয়ে যেতে পারে। আমরা কোনো সাহায্য পাঠানোকে চাপ দেয়ার অজুহাতে থামিয়ে রাখব না। সাহায্য বন্ধের অপশন আমরা তখনই আনব যখন পশ্চিম পাকিস্তানকে নেগোশিয়েট করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ দেয়া হবে এবং তারা যদি এত সুযোগ পেয়েও তা ব্যবহার না করে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়

অর্থনৈতিক সাহায্য: একটি কার্যকর মীমাংসা ও ফয়সালা করার পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্যোগের ভিত্তিতেও আমরা আমাদের এই প্রস্তাব রাখব। আমাদের এইটা বলতে হবে যে এটা আমেরিকা, বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফের আর্থিক সামর্থ্যের নাগালের বাইরে চলে যাবে যদি এই অচলাবস্থা চলতে থাকে এবং পাকিস্তান তার আর্থিক অবস্থাকে আরো নাজুক করে ফেলে। আমাদের এটাও বলতে হবে যে, যদি এই সাহায্যকে যুদ্ধ অর্থায়নে ব্যবহার করা হয় তবে অর্থনৈতিক সাহায্য কমে যেতে পারে। আমরা বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফকে স্বল্পমেয়াদী জরুরী সাহায্য প্রদানে এমনভাবে সমর্থন করব যেন সেই সময়ে পাকিস্তান উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য মূলনীতি সাজিয়ে নিতে পারে-এটা করা হবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির জন্য সাহায্য কমিয়ে দেয়ার অজুহাত হিসেবে নয়। এই পদক্ষেপ যে ন্যায়সঙ্গত হয়েছে সেটা প্রতীয়মান করার জন্য ইয়াহিয়াকে পূর্বপাকিস্তানে এমন প্রশাসন দিতে হবে যারা পর্যাপ্ত বাঙালি সমর্থন পায় এবং অত্যাবশ্যকীয় সেবাসমূহকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় এবং আবারো সাংবিধানিক সংকট তৈরি না হয় এবং এই সময়কালে আমরা যেসব জায়গায় উন্নয়ন কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হয়নি সেখানে নতুন ঋণ দেয়ার জন্য নতুন ঋণ প্রস্তাব প্রক্রিয়া করব। খাদ্য সহায়তা: আমাদের খাদ্যসাহায্য খালাস হয়ে গন্তব্যে পৌছা শুরু

করা মাত্রই আবারো খাদ্যসাহায্য পাঠানো শুরু করব। আমরা কোথায় কতটুকু খাদ্য যাবে তা স্থির করে দেব না, তবে সাইক্লোনে আক্রান এলাকায় যতটুকু যাবে বলে আমাদের করা প্রতিশ্রুতি আছে তা রক্ষা করতে হবে। এই নীতি আমাদের সামগ্রিক অ্যাপ্রোচের মধ্যে নিহিত থাকবে যেন অত্যাবশ্যকীয় সেবা আবার চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যত ব্যাপকভিত্তিক বিতরণ করা যায়।

সামরিক সহায়তা: আমরা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য যে লাইন নিয়েছি সেইরকম লাইন নেব। বাস্তবিকই আমরা প্রাণঘাতী নয় এমন সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ অব্যাহত রাখব যেন ইয়াহিয়া এই ধারণা না করতে পারে যে আমরা সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দিচ্ছি। তবে বিতর্কিত আইটেমগুলোর সরবরাহ বন্ধ রাখব যেন কংগ্রেস সব সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব না তোলে। এরপরে প্রত্যেক অপশনের সুবিধা-অসুবিধা ব্যাখ্যা করা হয়েছে :

অপশন ১: এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কঠিক রাখা সহজ হবে। তবে অসুবিধা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্তমান কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেয়া হবে। ফলে আমাদের ও পাকিস্তানিদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বেড়ে যাবে।

অপশন ২: এর ফলে এমন একটা পজিশন নেয়া সম্ভব হবে যা প্রকাশ্যে বলা সম্ভব এবং ডিফেন্ড করা যাবে। অসুবিধা হচ্ছে, অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যকে কমিয়ে দিলে বা বন্ধ করে দিলে তা পূর্বপাকিস্তানকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করবে। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলব কিন্তু এত কিছুর পরেও পূর্ব পাকিস্তানে একটা রাজনৈতিক সমাধানে আসার জন্য যথেষ্ট সাহায্য করতে পারব না। অপশন ৩: আমরা এই প্রস্তাবের সুবিধার মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে ইয়াহিয়ার সম্পর্কের সুযোগে এমন একটা সমাধানে পৌছার চেষ্টা করতে পারব যা আমাদের ও পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে কম ক্ষতিকর। অসুবিধা হচ্ছে, যদি রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় এবং পাকিস্ত নিকে কোনো ছাড় দিতে সম্মত করতে না পারে তবে আমরা ৬০ কোটি জনগোষ্ঠীর ভারত আর পূর্বপাকিস্তানের জনগণ থেকে আমেরিকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলব। রিপোর্টের শেষে এক কথায় তিনটা অপশন দেয়া ছিল, এভাবে :

অপশন ১: পশ্চিম পাকিস্তানকে নিঃশর্ত সমর্থন। মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ

অপশন ২: নিরপেক্ষতা, যা আসলে পূর্বপাকিস্তানকে সাহায্য করবে।

অপশন ৩: ইয়াহিয়াকে একটি রাজনৈতিক ফয়সালার জন্য সাহায্য করা।

আমরা প্রচলিত সব বয়ানে জানি, আমেরিকা পাকিস্তানকে নিঃশর্ত সমর্থনের কৌশল নিয়েছিল। মানে এক নম্বর অপশন কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আমেরিকান এই ডকুমেন্ট সাক্ষ্য দিচ্ছে, আমেরিকা তিন নম্বর অপশন গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ ইয়াহিয়াকে একটি রাজনৈতিক ফয়সালার জন্য সাহায্য করা। নিক্সন তিন নম্বর অপশন অনুমোদন দেয়ার সময় লিখেছিলেন : To all hands. Don’t squeeze Yahya at this time.’

সবাইকে বলছি, ইয়াহিয়াকে এই মুহর্তে বেশি চাপ দিও না।

সূত্র :

Foreign Relations of the United States, 1969-1976, Volume XI,

South Asia Crisis, 1971, No. 36.

পিনাকী ভট্টাচার্য
পিনাকী ভট্টাচার্য

‘৯০-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঠ থেকে উঠে আসা যে কয়জন রাজনৈতিক কর্মী সমসাময়িক বাংলাদেশে আলােচিত লেখক হয়েছেন, পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দিশা খুঁজে ফেরা পিনাকীর রয়েছে বিচিত্র সব রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। লেখালেখির বিষয় বহুবর্ণ ও বিচিত্র। দর্শন, ইতিহাস আর রাজনীতি পিনাকীর লেখালেখির প্রিয় বিষয়। সফল কর্পোরেট চিফ এক্সিকিউটিভ থেকে এখন লেখালেখি ছাড়াও নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় দেন। একাদেমিয়া নামের একটি নিয়মিত পাঠচক্রের সভাপতি। বাংলাদেশের ফেইসবুকের লেখালেখির জগতে পিনাকী ভট্টাচার্য ইতিমধ্যেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলতে ভালােবাসেন তিনি। নানা বিষয়ে বিস্ফোরক প্রশ্ন তুলে অনেক প্রচলিত বয়ানকে নড়বড়ে করে দেয়ার মতাে বিস্ময়কর দক্ষতা আছে পিনাকীর।

Leave a Reply