You are currently viewing মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই আমেরিকানরা বুঝে গিয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে
মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ- পিনাকী ভট্টাচার্য

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই আমেরিকানরা বুঝে গিয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে

১৯৭১ সাল যেমন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণছিল ঠিক তেমনই, তবে ভিন্ন কারণে হবু বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকার কাছে কূটনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণহয়ে উঠেছিল। কারণ পাকিস্তানের মাধ্যমে এই সময়েই চীনের সঙ্গে কিসিঞ্জার এক গোপন বোঝাপড়া করতে যাচ্ছেন, যা দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার স্বার্থকে কয়েক দশকের জন্য সুরক্ষা দেবে। এই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার কৌশলগত সম্পর্ক আর বাংলাদেশের সম্ভাব্য অভ্যুদয়কে নিক্সন প্রশাসন কীভাবে দেখেছে তা একালে বসে আমেরিকান চোখ দিয়েও দেখার প্রয়োজন আছে। মুক্তিযুদ্ধ,  মুক্তিযুদ্ধ

অল্প কিছু ডকুমেন্ট ছাড়া এই সংক্রান্ত সব ডকুমেন্টই আমেরিকা এখন রিলিজ করেছে। ১৯৬৯ থেকে সে সম্পর্কিত ডকুমেন্টের শুরু; তবে ঠিক মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়কালকে ধরার জন্য এখানে ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি থেকে নির্বাচিত অংশগুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। আমেরিকানরা ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতেই বুঝে যায়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হতে যাচ্ছে। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭০- এ হেনরি কিসিঞ্জার নিক্সন কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্যের বিষয়ে আমেরিকান পলিসি কী হবে তা নিয়ে গোপন জাতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণার আদেশ দেন। সেই গোপন চিঠিতে পাকিস্তান প্রসঙ্গে খেয়াল রাখতে বলা হয় সএই বলে, ‘পাকিস্তান এখনো একটি সংবিধান রচনার পর্যায়ে আছে, তাই পাকিস্তান সম্পর্কে এই গবেষণার ফলাফলকে সাময়িক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই সংবিধান রচনার পরে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তার উপরে গবেষণায় সুপারিশ চূড়ান্ত করতে হবে।’১

সংবিধানের এই রেফারেন্সকে ১৯৭২ সালের সংবিধান বলে বোঝা ভুল হবে। এটা আসলে অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য হবু সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে। কারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদ সদস্য হওয়াসহ একই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের জন্য আগে একটা সংবিধান প্রণয়নের কথা ছিল- সম্ভাব্য সেই সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে যা আর কখনোই প্রণীত হয়নি কারণ পরে ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ হেনরি কিসিঞ্জার গবেষক দলকে আরেকটি গোপন চিঠিতে, পূর্বোক্ত গবেষণায় পূর্বপাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আমেরিকা কী পদক্ষেপ নেবে, সেটাও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলে দেন।২

২২ ফেব্রুয়ারি কিসিঞ্জার নিক্সনকে একটা মেমো দেন। এই চিঠিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রিপোর্টপ্রেসিডেন্টের কাছে। এখানে শব্দের মারপ্যঁাচ নেই, সরল ভাষায় পরিস্থিতির ব্রিফিং দিচ্ছেন কিসিঞ্জার নিক্সনকে। কিসিঞ্জার পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সম্ভাব্য পরিণতি আঁচ করেই নিক্সনকে বলছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভবত স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন। তবে কিসিঞ্জার বলেন, ‘স্বাধীনতার এই ঘোষণা একটি কৌশল হতে পারে। কিন্তু প্রদেশে জনগণ যেভাবে জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছে তাতে শেখ মুজিব যা করতে চাইছেন সেটা করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে সংশয় থেকে যায়।’ স্বাধীনতার ঘোষণা একটি কৌশল হিসেবে কেন কিসিঞ্জার মনে করেন তার একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সম্প্রতি আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশের কূটনীতিকদের কাছে বার্তা দিয়েছেন, যদি তিনি তার পরিকল্পনামতো চলতে না পারেন এবং একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন তাহলে যেন তারা (পশ্চিমারা) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে শান্তিরক্ষীর ভূমিকা রাখে।’ কিসিঞ্জার নিক্সনকে আরো জানাচ্ছেন, ‘এই ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমেরিকার নাই, যদিও পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনৈতিক নেতারাই আমেরিকানদের কাছে সমর্থনের জন্য আসছে, এমনকি পাকিস্তানের কিছু কিছু দল থেকে আমেরিকা কর্তৃক পূর্বপাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার জন্য উস্কানি দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। আমেরিকা জোরের সঙ্গে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং এই ঘটনায় নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখছে। ঢাকার কনসাল জেনারেল শেখ মুজিবকে জানিয়েছেন, একটি সাংবিধানিক সমাধান খুঁজে নেয়ার জন্য এবং শেখ মুজিব যদি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান তবে আমেরিকানদের এই সংকটে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তিনি সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন।’ তবে কিসিঞ্জার মনে করছেন ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্ভবত হচ্ছেই। সেক্ষেত্রে শেখ মুজিবের প্রতি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ কারণ কিসিঞ্জার বলছেন, ‘শেখ মুজিব আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন। এবং তিনিই সেদিন আমাদের সহায় হতে পারেন যেদিন সত্যি সত্যিই আমাদের স্বাধীন পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে হবে।’৩

৩১ মার্চে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দুই কর্মকর্তা হ্যারল্ড সান্ডার্স এবং স্যামুয়েল হজকিনসন পাকিস্তানের অবস্থা নিয়ে কিসিঞ্জারকে একটা মেমো লেখেন। সেখানে ভুট্টোকে বাদ রেখে ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে নেগোশিয়েশনের একটি সম্ভাবনার কথা বলা হয়, যা কিনা সিআইএ’রও প্রস্তাব ছিল। আবার ‘এই ধরনের নেগোশিয়েশন পশ্চিম পাকিস্তানে এমনকি আর্মির মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে। স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাব্য জন্মের মুহর্তে দাঁড়িয়ে আমেরিকা এখন কী করবে’ সেই প্রশ্ন তোলা হয়। মেমোটি শেষ হয় যে বাক্য দিয়ে তা হচ্ছে :

‘We are after all witnessing the possible birth of a new nation of over 70 million people in an unstable area of Asia and, while not the controlling factor, we could have something to do with how this comes about – peacefully or by bloody civil war.’

‘আমরা সবাই এশিয়ার এক অস্থির অঞ্চলে সাত কোটি মানুষের একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জন্ম দেখতে যাচ্ছি, যেখানে আমরা নিয়ন্ত্রক নই, এই সম্ভাব্য জন্ম কীভাবে হবে, শান্তিপূর্ণ নাকি রক্তাক্ত পথে, সে বিষয়ে হয়তো আমরা কিছু করতে পারতাম।’৪ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১-এ পাকিস্তান নিয়ে আমেরিকা কী ধরনের গ্যাড়াকলে পড়েছিল সেটা কিসিঞ্জারের সাম্প্রতিক একটা সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে। কিসিঞ্জার বলছেন, ‘চায়নার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের দ্বার খোলে ১৯৬৯-এ। বাংলাদেশে সংকট শুরু হয় ১৯৭১ সালে। এই সময়ের মধ্যেই আমরা চায়নার সঙ্গে একাধিক অতি গোপনীয় আলাপ করি এবং আমরা তখন বিরাট সাফল্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। এই কথোপকথনের মধ্যস্থতাকারী ছিল পাকিস্তান এবং পাকিস্তান বেইজিং ও ওয়াশিংটন উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল। বাংলাদেশ সংকট ছিল পাকিস্তানের বাঙালি অংশের স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা। পাকিস্তান সেটাকে বীভৎস সহিংসতা দিয়ে প্রতিরোধ করতে যায় এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। প্রকাশ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টা নিন্দা করতে গেলে, তা পাকিস্তানি চ্যানেলটা নষ্ট করে দিত; যা চায়নার সঙ্গে সম্পর্ককে পরিপূর্ণভাবে উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে আরো কয়েক মাসের জন্য দরকার ছিল। আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট যারা বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি অবলোকন করছিলেন তারা চায়নার এই বিষয়টা সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। তাদের পাঠানো বর্ণনা হৃদয়বিদারক ও যৌক্তিক। অথচ আমরা প্রকাশ্যে এর নিন্দা করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমরা দুর্গতদের জন্য প্রচুর পরিমাণে খাদ্য-সাহায্য দিয়েছি এবং পরিস্থিতির অবসানের জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে গেছি। পাকিস্তানের মাধ্যমে চায়নার সঙ্গে সম্পর্কপূর্ণভাবে স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই আমেরিকা অব্যাহতভাবে বাংলাদেশকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে চাপ দিতে থাকে। নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, নিক্সনের প্রস্তাব অনুসারে, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিতে রাজী হয়।’৫

সূত্র

১. National Security Study Memorandam 109, December 19, 1970 by Henry Kissinger.

২. National Archives, Nixon Presidential Materials, NSC Files,

Box 365, Subject Files, National Security Study Memorandam,

Nos. 104-206. Secret; Exdis. A copy was sent to the Chairman

of the Joint Chiefs of Staff.

৩. National Archives, Nixon Presidential Materials, NSC Files,

Box 624, Country Files, Middle East, Pakistan, Vol. III, 1Oct

70-28 Feb 71.

৪. National Archives, Nixon Presidential Materials, NSC Files,

Box 625, Country Files, Middle East, Pakistan, Vol. IV, 1 Mar

71-15 May 71. Secret; Sent for information.

৫. World Chaos and World Order: Conversations With Henry

Kissinger.

পিনাকী ভট্টাচার্য
পিনাকী ভট্টাচার্য

‘৯০-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাঠ থেকে উঠে আসা যে কয়জন রাজনৈতিক কর্মী সমসাময়িক বাংলাদেশে আলােচিত লেখক হয়েছেন, পিনাকী ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে দিশা খুঁজে ফেরা পিনাকীর রয়েছে বিচিত্র সব রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। লেখালেখির বিষয় বহুবর্ণ ও বিচিত্র। দর্শন, ইতিহাস আর রাজনীতি পিনাকীর লেখালেখির প্রিয় বিষয়। সফল কর্পোরেট চিফ এক্সিকিউটিভ থেকে এখন লেখালেখি ছাড়াও নিজের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় দেন। একাদেমিয়া নামের একটি নিয়মিত পাঠচক্রের সভাপতি। বাংলাদেশের ফেইসবুকের লেখালেখির জগতে পিনাকী ভট্টাচার্য ইতিমধ্যেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলতে ভালােবাসেন তিনি। নানা বিষয়ে বিস্ফোরক প্রশ্ন তুলে অনেক প্রচলিত বয়ানকে নড়বড়ে করে দেয়ার মতাে বিস্ময়কর দক্ষতা আছে পিনাকীর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় , মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ রচনা, মুক্তিযুদ্ধ রচনা , বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কোথায় অবস্থিত, 

মার্কিন ডকুমেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ পিনাকী ভট্টাচার্য

Leave a Reply