মায়ের স্মৃতি
এক এক করে হারিয়ে গেলো ছয় ছয় ছয়টি বছর। ২০১৭ সালের গতকালটা ছিলো আম্মুর সাথে সর্বশেষ ফোনে কথা বলার মূহুর্ত। প্রায় ১০/১৫ মিনিটের ফোনালাপ। আম্মুর কথার মাঝে ছিলো জীবন চলার শত পাথেয়। স্বপ্নচারীর স্বপ্ন দেখানোর এক অভূতপূর্ব আলাপন। শুধু তাই নয়, কথাচ্ছলে দেখিয়েছিল উন্নত দেশে পাঠিয়ে সন্তানকে উচ্চশিক্ষা নেয়ার স্বপ্ন। দিয়েছিলো অভয়। হয়তো বিদায় নিবে বলেই দিয়ে গিয়েছিল হরেক উপদেশ। জীবন নামক চাকা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থমকে যাবে তা কল্পনার মধ্যবিন্দুতেও ছিলো না। বসন্তের পুষ্প ঝরে পড়বে অনন্তশয়ন হয়ে তা যদি জানা হয়ে যেতো, তাহলে আরো কিছু জীবন চলার পাথেয় কুড়ে নিতাম তোমার কাছ থেকে সেদিন। মায়ের স্মৃতি
ঊষালগ্ন পেরিয়ে যখন বেলা উঁকি দিচ্ছিল এমন সময়ে খবর পেলাম তোমার হঠাৎ পায়ের যন্ত্রণার খবর। চব্বিশঘণ্টার ব্যবধানে এই যন্ত্রণা তোমাকে মৃত্যুর দোয়ারে নিয়ে ঠেকবে তা কল্পরাশিতে কখনো অঙ্কিত হয়নি। জীবনটা এতো দ্রুত ক্ষীণ হয়ে আসবে তা ভাবিনি। বাসা থেকে মেডিকেলে যাওয়ার জন্য যখন বের হয়েছিলে, চাচীর কাছে বলেছিলে, ভাবী আমার দুটি মেয়ে ও ছেলেদের একটু দেখবেন। হয়তো সেই সময়েই তোমার মাঝে জানা হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুদূতের সাক্ষাৎ ঘনিয়ে এসেছে।
হাসপাতালের বেডে এক এক করে জিজ্ঞেস করছিলে, বাবা ভাত খেয়েছিস কিনা। এখনো যখন খেতে বসি তোমার কথা স্মরণ হলে অশ্রুকণা বয়ে যায়। তোমার সুখের নীড়টি এমন ছিলো যে, কোনো সময় শূন্য থাকতো না খাবারের পাত্র। এমন সময় গিয়েছে, দিনে কয়েকবার বাহির থেকে দৌড়ে এসে ভাত খুঁজেছি, আর অমনি তা তুমি রেডি করে দিয়েছ।
তিল তিল করে ঘর্মাক্ত কায়ায় বিসর্জন দেয়া জলরাশি একদিন জমাটবদ্ধ হয়ে তোমার স্বপ্নিল সারথি হবে, সেটার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলে তুমি। মাঝরাতে যখনই ঘুম ভাঙতো দেখতে পেতাম তোমায়- জায়নামাজে অশ্রুসিক্ত নয়নযুগল; মায়ের কোলের শিশুর মতো ক্রন্দন করতে আর বলতে, হে প্রভু, আমার সন্তানদের ইসমাইল (আঃ) এর মতো কবুল করে নিও, তাদেরকে বানাও মুত্তাকীদের ইমাম এবং বাবা-মায়ের চক্ষুশীতলকারী।
আরও পড়তে পারেন–বন্ধু নির্বাচনে ইসলাম কী বলে?
হারিয়ে গেলেই বুঝা যায় হারানোর যন্ত্রণা। তুমি কতো বড় নেয়ামত ছিলে তা তখন ভাবনার মাঝে আসতো না। এখন প্রতিমুহূর্তে ভাবনার জগতে উঁকি দিয়ে যায়। তুমি বলতে প্রায়শই, বাবা হারিয়ে গেলেই বুঝবি। এখন বুঝবি না। মা, সত্যি এখন বুঝি। আজও মাঝরাতে যখনই ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় তোমার সেই ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসছে সুপ্ত সমীরণের মধ্য দিয়ে। এশা শেষে যখন ঘুম পাড়ি দিতাম মাঝেমাঝে, নিশির অর্ধাংশে তুমি জাগিয়ে তুলতে আর কোমল হস্তে মুখে তুলে দিতে খাবার। সন্ধ্যা শেষে লালিমা যখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়তো, বাসায় ফিরতে যখন দেরী হতো তখন তুমি বকা দিয়ে বলতে, “বাবা, পড়াশোনার সময় নষ্ট করতে নেই”।
মা, তুমি সংসারকে এতো সুন্দরভাবে গুছিয়ে তুলছিলে, প্রতিবেশীরা একপর্যায়ে হতবাক হয়ে বলছিলো, এই মেয়ে অসুস্থ শরীরে কীভাবে আটটি সন্তানকে শামলিয়ে নিচ্ছে, যেখানে আমরা ২/৩ জনকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। তোমার সন্তান বেশি ছিলো বলেই মানুষ ঈর্ষা করতো, কারো মুখপ্রান্ত থেকে বের হতো বিভিন্ন অশ্রাব্য শব্দাদি। মা, আজ তোমার সেই কষ্টার্জিত শ্রমে গড়ে তোলা সন্তানদের দেখে ওরাই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর গর্ববোধ করে।
আম্মু, সত্যি আজ তুমি অনেক ভাগ্যবান। তোমার সন্তানদের মধ্যে এমন তো কেউ নেই, যে কোনো প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের সাথে রূঢ় ব্যবহার করেছে। তোমার কাছে এমন কোনো কখনো অভিযোগ আসতে শুনিনি যে তোমার সন্তান কাউকে গালি দিয়েছে। তোমার মৃত্যুর পর চাচাদের কাছে শুনেছি, প্রায় ৩০ বছরের সংসারে তোমাকে অযথা ঘর হতে বের হতে তারা কখনো দেখেনি। দেখেনি কারো বাসায় গিয়ে গল্প আড্ডা জমাতে। মা, তুমি রেখে গেলে এক অনন্ত আদর্শ।
তোমার বাসনা ছিলো সন্তানদের নিয়ে শহরে একসাথে থাকার। সেই বাসনা তুমি যাওয়ার পর পরই মহান মনিব কবুল করে নিয়েছিল। আজ সব আছে, শুধু তুমি নেই। ললাটে চুমু দিয়ে কেউ দোয়া করে দেয় না, পরশ হাতের ছোঁয়া হয়েছে খোয়া।
আম্মু, তুমি একটুও ভেবো না আমাদের নিয়ে। তোমার প্রতিটি সন্তান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজেই তোমার জন্য ফেরদৌসের সর্বোচ্যটুকু কামনা করে। সময়ের পরিক্রমায় তোমার রেখে যাওয়া স্বপ্ন ইনশাআল্লাহ একদিন বাস্তবে পরিণত হবে। কেনো জানি এখনো মনে হয়, কবরে শুয়ে শুয়ে আমাদের জন্য দোয়া করে যাচ্ছ তুমি। তোমার দোয়ার বদৌলতে আমরাও হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছি তোমার ঠিকানায়। আম্মু, দেখা হবে ফেরদৌসের সেই অন্তিম সিঁড়িতে ইনশাআল্লাহ।
“রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি ছাগিরা”