মাওলানা মওদূদী(রঃ)-কে নিয়ে বিতর্কের কারণ
আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ( রহঃ) নিয়ে দেওবন্দী কওমি আলেমদের বিষোদগারের কারণ জানতে গিয়ে এ বিষয়ে আমি নিরপেক্ষ গবেষণা ও ব্যাপক স্টাডি করেছি। তাতে আমি যে সত্যের সন্ধান পেয়েছি তা নিচে আমার জ্ঞান পিয়াসি সত্যসন্ধানী পাঠক বন্ধুদের জন্যে লিপিবদ্ধ করলাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ গবেষণা করতে গিয়ে ভাষণের এক জায়গায় আমি একটি ভাষাগত ভুল বাক্য পেয়েছি। সেটি হচ্ছে, ” আর যদি আমার লোকদের ওপর হত্যা করা হয় ” বাস্তবে বাক্যটি হতো > আর যদি আমার লোকদের ওপর গুলি করা হয় <। মুখস্ত বক্তৃতা দিতে গিয়ে এটি বঙ্গবন্ধুর ‘স্লিপ অব টাংগ’ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখন যদি কেউ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই সামান্য ত্রুটিটি দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন রক্তে আগুন ধরা বিপ্লবী অনন্য সুন্দর সমগ্র ভাষণটিকেই গুরুত্বহীন বলে তাকে আমি পাগল, হিংসুক, মিথ্যুক এবং জ্ঞান পাপী ছাড়া আর কিছুই বলতে পারি না।
বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী ভাষণের কেউ বিরুপ মন্তব্য করা মানে হিমালয়ের সমান উঁচু হওয়ার জন্যে কুনো ব্যাঙের লাফালাফির হাস্যকর প্রয়াস বৈ কিছু নয়! যেমন বর্তমান যুগের কিছু ঈর্ষাপরায়ণ, ধর্মান্ধ আলেম ডাঃ জাকির নায়েকের মতো মানুষের সামান্য ভুল ভ্রান্তি দেখিয়ে বর্তমান বিশ্বে তাঁর বিশাল ইসলামি পান্ডিত্বকেও অবমূল্যায়ন করছে। এরাই এক কালে এদের সীমিত জ্ঞানের জন্যে আল্লামা ইকবালকেও কাফের ফতুয়া দিয়েছিল। ঠিক তেমনি মাওলানা মওদূদীর ( ১৯০৩–১৯৭৯) শত সহস্র বইয়ের কোথাও যদি একটু আধটু ভুল থাকেও সেটাকে কেন্দ্র করে মওদূদীর ইকামতে দ্বীনের জন্যে বিশাল খেদমত ও জ্ঞান ভান্ডারকে গুরুত্বহীন মনে করাটাও সেই শ্রেণির জ্ঞান পাপী আলেমদের পাগলামি, ঈর্ষা, মিথ্যাচার ছাড়া কিছু নয়।
যেমন এই শ্রেণির তথাকথিত আলেমরাই এক কালে ” ইসলামে রাজনীতি নেই”, “ইংরেজি পড়লে কাফের হয়ে যাবে”, “চাঁদের দেশে মানুষ গেছে বললে ঈমান চলে যাবে”…ইত্যাদি অসংলগ্ন কথা বলতো। সামান্য জ্ঞান দিয়ে অসামান্য জ্ঞানের কথা বুঝার ক্ষমতা তাদের নেই! তাদের অনেকেই এখনো শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেও জানে না।
এনিওয়ে, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মাওলানা মওদূদী(রঃ) ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার একমাত্র মুখপাত্র মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অতএব, বুঝাই যাচ্ছে দেওবন্দীদের চোখে তিনি কতো যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন।পরবর্তীতে মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ার বিষয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হোসাইন আহমদ মাদানীর সাথে মাওলানা মওদূদীর মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। মাদানী বলেছেন, “হিন্দু মুসলিম নিয়ে ভারত। তাই মুসলিমদের জন্যে আরেকটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরী করা জায়েয হবে না “! আর মাওলানা মওদূদী বলেছেন, ” জায়েয হবে “! এ নিয়ে মওদূদীর সাথে মাদানীর তীব্র মতবিরোধের জের ধরে মাদানী জেদের বশে মাওলানা মওদূদীর ছিদ্রান্বেষন শুরু করেন। পরে মওদূদীর লেখার কিছু তথাকথিত অসংগতি দেখিয়ে একটি বই লিখেন।
এর পর থেকে মওদূদীর বইতে সত্য মিথ্যা না দেখেই মাদানীর বই পড়ে পরবর্তীদের তাদের কেউ কেউ মওদূদীর বইয়ের কিছু ভুল ত্রুটি দেখিয়ে বই লিখেন যা কিনা মওদুদীর বইয়ের লেখার সাথে কোনো মিল ছিল না। ( কিছুটা মিল থাকলেও মওদুদীর ব্যাখ্যায় তারা ভুল বুঝেছে বলেও উল্লেখ আছে)। তবে মওদূদী নিজেই “একমাত্র নবী রাসূল ছাড়া কেউ ভুলের উর্ধে নয়। আমার সব কথা আমার দলকে মানতেই হবে এমন কোনো কথা নেই ” এটাও বলেছেন । তাঁর লেখা এবং কথাগুলোকে কুরআন হাদিসের আলোকে বিচার করে মানতে বলেছেন। এমনকি তাঁর দলের লোকদেরকে তাঁর বই ছাড়াও অন্যান্য বিখ্যাত লেখকদের বই পড়তে বলেছেন।
ক্ষমতালোভী মুসলিম নামধারী কিছু তাগুত এবং ইহুদি, খ্রিস্টান, নাস্তিকরাই তাঁর ইসলামি রাষ্ট্র দর্শনের বিরোধিতা করে থাকে । আমাদের আলেম সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ তাঁর আকিদার বিষয়ে অহরহ বিষোদগার করছে। মজার ব্যাপার যে, সেই ক্ষুদ্র আলেম শ্রেণিসহ বিশ্বের সমগ্র আলেম সমাজ কিন্তু পাকিস্তানের জাতীয় কবি মুসলিম কবি সম্রাট ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালকে ইসলামি দার্শনিক হিসেবে মাথায় তুলে সন্মান করেন। অথচ তারা জানেন না যে, বর্ষীয়ান কবি ইকবাল নিজেই তৎকালীন তরুণ মাওলানা মওদূদীকেই মাথায় তুলে মর্যাদা দিয়েছেন। মওদূদীর তর্জমানুল কুরআন এবং ইসলামি সাহিত্য পড়ে ইকবাল মওদূদীর বড় ভক্ত হয়ে যান।
ইকবাল মওদূদীকে হায়দারাবাদ থেকে পাঞ্জাব নিয়ে আসেন। ইকবালের জমির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মওদূদীকে ইকামতে দ্বীনের কাজে তাঁর দলের জন্যে দিয়ে যান। ইকবালের চোখে একমাত্র মওদূদীই ছিলেন উপমহাদেশে বিংশ শতাব্দির ইসলামি আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র! ইকবাল মৃত্যুর সময়ও মওদূদীকে দেখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মওদূদী ছুটে গিয়ে কবিকে আর জীবিত পাননি। সম্ভবতঃ মাওলানা মওদূদীই এক মাত্র মোফাস্সেরে কুরআন যিনি কুরআনে উল্লেখিত স্থানগুলো বিভিন্ন দেশে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে কুরআনের তাফসির ( তাফহীমূল কুরআন) লিখেছিলেন।
মওদূদীকে নিয়ে পাক ভারত উপমহাদেশের বাইরে কোনো বিতর্ক নেই। তাঁর লেখা বই বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য এবং তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামি স্কলারদের কাছেও নন্দিত। তিনি বিকেলে বাসার পাশে নিজের বাগানে গিয়ে বসতেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আগত জ্ঞান পিয়াসি পন্ডিতদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতেন। তিনি দেখতে লালিমা বর্ণের খুব সুন্দর মানুষ ছিলেন।
আমাদের দেশের তাবলীগ জামায়াতের লোকদেরও মাঝে মধ্যে মওদূদীর সমালোচনা করতে শোনা যায়। অথচ তাদের মুরব্বী পাকিস্তান তাবলীগ জামাতের আমির মাওলানা তারিক জামিল বলেছেন, ” যারা আল্লামা মওদূদীর (রঃ) এঁর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ায় তারা পশু “! মওদূদী (রহঃ) ছিলেন হযরত আলী ফাতেমীয় বংশধারা থেকে আগত তুর্কী রক্ত ধারা হয়ে চিশতিয়া তরিকার আলেম । মাওলানা আব্বাস আলী খান বিরচিত মাওলানা মওদূদীর জীবনী গ্রন্হে আমি পড়েছি, তাঁর জীবনেও ওমর কর্তৃক রাসূল ( সাঃ)-কে মারার জন্যে তলোয়ার নিয়ে ছুটে যাওয়ার মতো একটি ঘটনা ঘটেছিল। জনৈক যুবক কোনো এক আসরে মওদূদী সম্পর্কে সমালোচনা শুনে খোলা তলোয়ার নিয়ে মসজিদের ঢুকে মওদূদী ( রঃ)-কে মারতে গিয়ে মওদূদীর চেহারা দেখে যুবকের কম্পিত হাত থেকে তলোয়ার পড়ে যায়। পরে সেই যুবক মওদূদীর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে যায়।
মওদূদী এক বার পাকিস্তানের এক দলীয় সভা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার সময় মঞ্চের দিকে বিরোধী দলের গুলি আসছিল। তখন মঞ্চে উপবিষ্ট কয়েকজন ব্যাকুল হয়ে মওদূদীকে বলে ওঠেন, ” মুহতারাম মাওলানা ! গুলি আসছে বসে পড়ুন, বসে পড়ুন “! জবাবে মওদূদী বললেন, ” আমিই যদি বসে যাই এই ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?” তিনি বসেননি দাঁড়িয়েই ছিলেন। আল্লাহর কী লীলা তাঁর গায়ে একটা গুলিও লাগেনি! অথচ ইতোমধ্যেই মাহফিলে কয়েকটা লাশ পড়ে আছে কর্মীরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নীরবে সবাই মওদূদীর বক্তব্য শুনে যাচ্ছে!
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মাওলানা মওদূদীর ফাঁসির হুকুম দিলেন । ফাঁসির আগে আইয়ুব খাঁন মওদূদীকে বললেন, ” আপনি আমার কাছে ক্ষমা চাইলে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিতে পারি “! তখন মওদূদী বলেছিলেন, ” আমি কেনো আপনার কাছে ক্ষমা চাইবো? আমি কোনো অন্যায় করিনি! আমি তো দূরের কথা, আমার দলের কোনো কর্মীকেও আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে নিষেধ করবো “!
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তখন চড়া গলায় বলেছিলেন,” তাহলে তো আজ রাতেই আপনার ফাঁসি হয়ে যাবে “! –জবাবে তখন মওদুদী বলেছিলেন,” প্রেসিডেন্ট ছাহেব, মউত কি ফায়সালা জামিনমে নেহি হোতাহে! আসমানমে হোতাহে…………”! ( অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট সাহেব,মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়! যদি আসমানে আমার মৃত্যুর ফায়সালা না হয় তাহলে আপনার মতো পৃথিবীর সব প্রেসিডেন্ট মিলেও আমার মৃত্যু দিতে পারবেন না! আর যদি আসমানে ফায়সালা হয়ে যায় তাহলে আপনার মতো পৃথিবীর সব প্রেসিডেন্ট আমাকে বাঁচাতেও পারবেন না )
সেই রাতেই মাওলানা মওদূদীকে রক্ষার জন্যে পাকিস্তানে রাস্তায় নেমে হাজার হাজার নারী-পুরুষ কান্না বিজড়িত কন্ঠে প্রতিবাদী মিছিল বের করে ! বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে হাজার হাজার টেলিগ্রাম আসতে থাকে এই বলে যে, এমন রত্নকে না মেরে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিন। কী আশ্চর্য! শেষে সত্যিই মাওলানা মওদূদীর আর ফাঁসি হয়নি। তিনি বেঁচে গেলেন!
মাওলানা মওদূদীকে মুসলিম বিশ্বের নোবেল পুরস্কার বলে খ্যাত “বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার” দেয়া হয়। মদীনা শরীফে মাওলানা মওদূদীর নামে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। মাওলানা মওদূদী (রঃ) মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা ভিসি এবং মতান্তরে আজীবন ভিসি ছিলেন। বাদশাহ নাজ্জাশীর পর একমাত্র মাওলানা মওদূদীর মৃত্যুর পরই কাবা শরীফে বিশাল গায়েবানা জানাজা পড়া হয়েছিল। অতঃপর কাবা শরীফের ইমাম মাওলানা মওদূদীর জানাজায় অংশ গ্রহনের জন্যে বিশেষ বিমানে পাকিস্তান ছুটে যান। তবে তিনি গিয়ে জানাজা পেয়েছিলেন কিনা সেটা এখন আমার মনে পড়ছে না! মাওলানা মওদূদী ওপারে চলে গেলেও তাঁর হাতে গড়া দল জামায়াতে ইসলাম এখন বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে! পরপারে আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের চির মেহমান করে রাখুন–আমিন!
আরও পড়তে পরেন–জুন মাস নিয়ে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ছেলের হৃদয় বিদারক স্ট্যাটাস