You are currently viewing ভ্রান্তির বেড়াজালে হাজার বছরের ইহুদী মুসলিম সম্পর্ক
ভ্রান্তির বেড়াজালে ইহুদী মুসলিম সম্পর্ক

ভ্রান্তির বেড়াজালে হাজার বছরের ইহুদী মুসলিম সম্পর্ক

“ভ্রান্তির বেড়াজালে হাজার বছরের ইহুদী মুসলিম সম্পর্ক”
সম্প্রতি ক্রুসেড নিয়ে একটা ভিডিও দেখলাম ইউটিউবে৷ সেখানে বলা বর্ণনা দেয়া হয়েছে ক্রুসেডের সময় ইহুদীরা মুসলিমদের ভেতরে ঢুকে মুসলিম ইমাম সেজে কীভাবে মুসলমানদের ঈমান আকীদা ধ্বংসের চেষ্টা করছে! শুধু এই ভিডিও না, এমন অসংখ্য বই, গল্প, কাহিনী পড়তে পড়তে আমরা বড় হয়েছি৷ যেগুলোতে বলা হয়েছে ইহুদীরা সব কিছুর জন্য দায়ী৷ আসলে কী তাই? আসুন সত্যটা ক্রসচেক করে নিই৷
ক্রুসেড যুদ্ধটা শুরু হয়েছিলো ১০৯৫ সালে৷ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত জেরুজালেম শহর ও পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দেস মুসলিমদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য এই যুদ্ধ ঘোষণা করে ইউরোপের খ্রিস্টানরা৷ গোটা খ্রিস্টানজগত তখন ধর্মতাত্ত্বিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত৷ ইতালীর রোম কেন্দ্রীক ক্যথলিক খ্রিস্টান এবং বাইজেন্টাইন কেন্দ্রীক অর্থোডক্স খ্রিস্টান৷ তখনো প্রটেস্টান্ট খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়নি৷ এই দুই খ্রিস্টান গোত্র ইউরোপের দুই প্রান্তে প্রভাবশালী ছিলো৷ পশ্চিম ইউরোপে ছিলো ক্যাথলিকদের প্রাধান্য৷ আর পূর্ব ইউরোপে ছিলো অর্থোডক্সদের প্রাধান্য৷ তো ক্রুসেড ঘোষণা করেছিলো রোমের ক্যাথলিক চার্চের পোপ৷ যদিও যুদ্ধের মূল নেতৃত্বে ছিলো অর্থোডক্স বাইজেন্টাইের সম্রাট৷ কিন্তু ক্রুসেডে অর্থোডক্স চার্চের কোনো ভূমিকা ছিলো না৷ এই ক্রুডেস চলমান ছিলো বরাবর দুইশত বছর৷ ১২৯৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রুসেড যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলো ইউরোপের খ্রিস্টান নেতারা৷ অবশ্য এর পরেও ক্রুসেডের নামে বহু যুদ্ধ হয়েছে খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে৷ মূল ক্রুসেডের এই দুইশত বছরের মাঝে একাধিকবার খ্রিস্টান ও মুসলমানরা জিতেছে ও হেরেছে৷ শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টানরা হেরেছে এবং মুসলমানরা জিতেছে৷ এই হলো ক্রুসেডের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস৷
এখন প্রশ্ন হলো ক্রুসেডে ইহুদীদের ভূমিকা কী ছিলো? শুনলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন, ক্রুসেড নয় শুধু, ক্রুসেডের আগে পরে প্রায় হাজার বছরের বেশি সময় ইহুদীরা মুসলমানদের পক্ষে ছিলো৷ এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় ছিলো৷ যেটা খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মাঝে ছিলো না৷ পুরো ইউরোপ জুড়ে হাজার বছর ধরে ইহুদীরা খ্রিস্টানদের হাতে নির্যাতিত হয়ে এসেছে৷ আর তাদের আশ্রয়স্থল ছিলো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা৷ স্পেন কেন্দ্রীক মুসলিম সাম্রাজ্য ও কনস্টাটিনোপল কেন্দ্রীক ওসমানিয় সাম্রাজ্য গঠিত হলে ইউরোপের এই দুই অঞ্চলে ইহুদীরা মোটামুটি নিরাপত্তা পায় ও স্বস্তিতে থাকতে পারে৷ মধ্যপ্রাচ্যে ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলিমদের নিকট খ্রিস্টানরা হারলে ইউরোপে গিয়ে ক্রুসেডাররা ইহুদীদের মধ্যে যাদেরকে হাতের কাছে পেতো আচ্ছামতো পিটাতো৷ আর মধ্যপ্রাচ্যে যদি খ্রিস্টানরা জিততো তবে সেখানে মুসলিমদের সাথে ইহুদীদেরকেও পিটাতো৷ অর্থাৎ মুসলিমরা একবার মার খেলে ইহুদিরা খেতো দুইবার৷ এই ছিলো তখনকার চিত্র৷ কোনো ইহুদী কি খ্রিস্টানদের পক্ষে থাকতে পারে না? পার, তবে সেটা সংখ্যায় একেবারেই নগন্য৷ ক্রুসেডে ইহুদীদের চাইতে মুসলিমরা অনেক বেশি খ্রিস্টানদের পক্ষে ছিলো৷ কথাটি শুনতে বেখাপ্পা লাগছে, তাই না? কিন্তু এটাই সত্য৷ মুসলমানদের কিছু গোত্র খ্রিস্টান ক্রুসেডারদেরকে সহযোগিতা করেছে জ্ঞাতিভাই অন্য মুসলিমদেরই বিপক্ষে৷ সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে মুসলিমদের পারস্পরিক রাজনৈতিক বিরোধের ফলেই এমনটা হয়েছিলো৷ জেরুজালেম তখন মিশর কেন্দ্রীক ফাতেমীয়দের দখলে ছিলো৷ সে জন্য সেলজুক তুর্কিদের একাংশ ইউরোপিয় ক্রুসেডারদেরকে তাদের রাজ্যের মধ্য দিয়ে যেতে দিয়েছে, রসদ দিয়েছে, বিশ্রামের জন্য আশ্রয় দিয়েছে৷ কিন্তু অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে এই ক্রুসেডাররা জেরুজালেমের পাশাপাশি সেলজুকদের কতিপয় এলাকাও দখল করে নেয়৷
প্রসঙ্গক্রমে চলুন আরেকটু অতীতে যাই৷ সম্রাট কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট যিনি প্রথম কন্সট্যান্টাইন বা সেইন্ট কন্সট্যান্টাইন নামেও পরিচিত, ৩০৭ হতে ৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে রোমান সম্রাট ছিলেন৷ রোমান সম্রাটদের মাঝে তিনি প্রথম খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করেন এবং এর পর তিন মহাদেশ জুড়ে বিশাল রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে৷ এই সময় থেকে শুরু হয় ইহুদীদের ভাগ্যের চরম অবনতি৷ মুসলমানদের সাথে ইহুদীদের সমস্যা হয়নি? মদীনা কেন্দ্রীক মোহাম্মদ স. এর সাথে ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জার কিছু ঝামেলা হয়েছিলো৷ কিন্তু হাজার বছরের ইহুদী-খ্রিস্টান সংঘাতের তুলনায় তা কিছুই না৷ মূলত খ্রিস্টানদের ধর্মাবতার যিশুকে শূলে চড়িয়ে হত্যার জন্য কতিপয় ইহুদীকে দায়ী করা হয়৷ সেই থেকে ইহুদী খ্রিস্টান বিরোধের শুরু৷ খ্রিস্টানরা যখন যেখানে ইহুদী পেয়েছে অমানবিক নির্যাতন করেছে হাজার বছর ধরে৷ আর ইহুদীরা আশ্রয় নিয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়৷ শুধু আশ্রয় নেয়নি, বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদেও তারা আসীন ছিলো৷
অনেকে হযরত ওমর রাঃ এর জেরুজালেম দখলের ঘটনাটা সামনে আনেন৷ ওমর এর খেলাফত কালে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম মুসলিমদের অধীনে আসে৷ তখন জেরুজালেম ছিলো খ্রিস্টান অধ্যুষিত৷ বাইজেন্টাইন সম্রাটের অধীনে ছিলো এলাকাটি৷ হযরত মুহাম্মদ স. এর আগেই ব্যাবিলন, গ্রিক, রোমান, পারস্যরা বহুবার জেরুজালেম দখল করে৷ সর্বশেষ ওমর যখন জেরুজালেম হস্তগত করেন তখন সেখানে খুব অল্প সংখ্যক ইহুদী ছিলো৷ খ্রিস্টান ও প্যাগানরা সংখ্যায় বেশি ছিলো৷ সুতরাং মুসলিমদের সাথে জেরুজালেম কেন্দ্রীক ইহুদীদের কোনো সংঘাত ছিলো না৷ আরব শাসকদের অধীনে থাকা অবস্থায় জেরুজালেম তিন ধর্মের তীর্থস্থানে পরিণত হয়৷ খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া, আব্বাসীয় এই আমলে তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায়নি৷ ঝামেলাটা শুরু হয় আব্বাসীয়দের ক্ষয়ের কালে৷ আব্বাসীয়রা যত দুর্বল হতে থাকে মুসলিম সাম্রাজ্য তত খণ্ড বিখণ্ড হতে থাকে৷ ঠিক এই ধারাবাহিকতায় উত্তর আফ্রিকাতে ফাতেমীয় সাম্রাজ্য নামে একটি মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয় ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে৷ ফাতেমীয়রা ৯৬৯ সালে মিশর দখলে নিলে তাদের সাম্রাজ্য বিশাল আকার ধারণ করে৷ এরপর জেরুজালেমসহ আরবের একটা এলাকা তাদের দখলে চলে যায়৷ ফাতেমীয়দের শুরুর দিকে জেরুজালেমে তেমন কোনো ঝামেলা হয়নি, তিন ধর্মের মানুষই সহাবস্থানে ছিলো৷ ঝামেলাটা শুরু হয় ১০৫০ সালের পর৷ এ সময় ফাতেমীয়রা জেরুজালেমের ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে বিরূপ আচরণ করে৷ যিশু খ্রিস্টের সমাধি ভেঙ্গে ফেলে৷ ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্য স্থান থেকে তীর্থ যাত্রায় খ্রিস্টানদেরকে জেরুজালেমে প্রবেশে বাধা দিতে থাকে৷ এখান থেকে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়৷ কিন্তু ইহুদীরা জেরুজালেমে নিরাপদেই থাকে মুসলিমদের সাথে৷ ক্রুসেডের কথা ত এই আর্টিক্যালের শুরুর দিকে বলেছি৷
জেরুজালেমসহ আরবের অধিকাংশ এলাকা অটোমানদের অধীনে আসে ১৫২০ সালের দিকে৷ তখন আবার তিন ধর্মের লোকদের সহাবস্থান নিশ্চিত হয়৷ এই ধারাবাহিকতা চলে অন্তত ১৯০০ সাল পর্যন্ত৷ তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে ১৮৩০ সালে এসে৷ ইউরোপে ফরাসী বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, বিজ্ঞান বিপ্লব- এই তিন বিপ্লবের ঢেউ এসে লাগে তুর্কি অধীন পূর্ব ইউরোপে৷ এই তিনটা বিপ্লব সাধিত হয় ১৭৬০ থেকে ১৮৫০ এর মধ্যে৷ এসব বিপ্লব পুরো ইউরোপের রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মের চেহারা পাল্টে দেয়৷ সেই পরিবর্তনের সাথে খাপ খেতে পারে না অটোমানরা৷ এদিকে বিশাল রুশ সাম্রাজ্য অটোমানদেরকে অনবরত আক্রমন ও পর্যুদস্ত করতে করতে থাকে৷ এই সময়ে পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, আরব, উত্তর আফ্রিকায় অটোমান বিরোধী বিদ্রোহ জোরদার হতে থাকে৷ ঠিক এই সময়ে ইহুদীরা নতুন চিন্তা নিয়ে সংঘঠিত হতে শুরু করে৷ সময়টা ১৮৫০ সালের পর৷ ইহুদী ধনকুবে রথচাইল্ড পরিবারের সহায়তায় শুরু হয় ইহুদীবাদী আন্দোলন৷ কিন্তু শুরুর দিকে সেই আন্দোলনটা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ছিলো না৷ সংগত কারণে সেগুলো ছিলো ইউরোপিয় খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে৷ তাহলে আমরা এখন যে পরিস্থিতি দেখছি তা কীভাবে হলো? এখানেই আমাদের ভ্রান্তি! পুরো ঘটনাপ্রবাহটা উল্টে দিয়েছে ইউরোপিয় খ্রিস্টান শাসকরা৷
অটোমনরা রাষ্ট্রীয় সংস্কারের অংশ হিসেবে ১৮৫০ এর দিকে ভূমি আইন সংশোধন করে অমুসলিমদের ভুমি কেনার বিধান করে৷ এই সুযোগে ইহুদী ধনীরা জেরুজালেম কেন্দ্রীক ব্যাপক হারে জমি কিনতে থাকে৷ আরব কৃষকরা অটোমানদেরকে খাজনা দিতে রাজি ছিলো না৷ কিন্তু নতুন অভিবাসী ইহুদীরা উচ্চ হারে খাজনা দিতো৷ আর্থিক সংকটে পড়া, যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপের রুগ্ন দেশ অটোমানদের জন্য ইহুদীদের এই রাজস্ব ক্ষুধার্ত মানুষের সম্মুখে দেয়া মুখরোচক খাবারের ন্যায় ছিলো৷ অটোমানরা আরো বেশি পরিমাণে ইহুদীকে আরব ভূখণ্ডে স্বাগত জানালো৷ ফিলিস্তিনি কৃষকরাও কচকচে নগদ টাকা পেয়ে বেজায় খুশি৷ এভাবে চলতে থাকলো ১৯১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ষাট দশক৷ এর মাঝে রাশিয়া ও জার্মান কেন্দ্রীক ইহুদী নেতারা পৃথিবীতে ইহুদীদের জন্য একটা নতুন রাষ্ট্রের দাবী জানালো৷ জার্মান ও অটোমান মিলে সিদ্ধান্ত দিলো আফ্রিকার উগাণ্ডাতে হবে নতুন ইহুদী রাষ্ট্র৷ ইহুদী নেতারা তা মেনেও নিলো৷ সে লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছিলো৷ কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়৷ সেই সময় পর্যন্ত অটোমানদের প্রধান শক্রু ছিলো রাশিয়া৷ আর প্রধান বন্ধু ছিলো ব্রিটিশ ও ফরাসী জোট৷ আবার ব্রিটিশদের সাথে বিরোধ ছিলো জার্মান ও অস্ট্রো হাঙ্গেরীর৷ ব্রিটিশরা তখন পৃথিবী ব্যাপি তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলেছে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা গেলো জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরী জোটে৷ আর রাশিয়া গেলো ব্রিটিশ জোটে৷ অটোমানদের সাথে ব্রিটিশ ও ফরাসীদের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব ছুটে গেলো মুহুর্তেই৷ রাশিয়া ত আগে থেকেই অটোমানদের বিরুদ্ধে এক পায়ে খাড়া ছিলো৷ এবার রাশিয়ার শক্তি বেড়ে গেলো৷ ইহুদী নেতারা দুই জোটের সাথেই সম্পর্ক রাখলো৷ তারা গোপনে ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি করলো৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীরা ব্রিটিশদেরকে যুদ্ধের খরচ যোগাবে৷ বিনিময়ে ব্রিটিশ জোট জিতলে জেরুজালেম কেন্দ্রীক একটি ইহুদী রাষ্ট্র গঠন করে দেবে৷ অর্থাৎ জার্মান জোট জিতলে ইহুদী রাষ্ট্র হবে আফ্রিকার উগাণ্ডায়৷ আর ব্রিটিশ জোট জিতলে ইহুদী রাষ্ট্র হবে আরবের জেরুজালেমে৷
অপরিণামদর্শী আরবরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের পক্ষে অস্ত্র ধারণ করলো৷ ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই গোটা আরব অঞ্চল অটোমানদের হাতছাড়া হয়৷ আরবরা যদি অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করতো তবে বিশ্বযুদ্ধে জার্মান-অটোমান জোট হারলেও জেরুজালেমে ইহুদী রাষ্ট্র গঠন কঠিন হতো৷ অরবরা ইহুদীদের এই কাজটা এগিয়ে দিলো৷ যুদ্ধে জার্মান জোট হারলো আর গোটা আরব অঞ্চল দখলে নিলো ব্রিটিশ ও ফরাসীরা৷ এভাবে দাবার গুটি উল্টে যায়৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৭ সালে ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃক ইহুদী রাষ্ট্র গঠন সংক্রান্ত ‘বেলফোর’ ঘোষণা আসে৷ সেই থেকে ইহুদীরা খ্রিস্টানদের বন্ধু, আর মুসলমানরা ইহুদীদের চরম শক্রু বলে বিবেচিত হতে থাকে৷ ইহুদীরা মুহুর্তেই চোখ উল্টে ফেললো৷ হাজার বছরের আশ্রয় দাতাদের সাথে বেইমানী করলো৷ পরের ইতিহাস ত সবার জানা৷ প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি৷
আমরা বরাবরই বর্তমানের চোখে অতীত ও ভবিষ্যতকে দেখার চেষ্টা করি৷ ইহুদীদের বর্তমান আচরন দেখেই অতীতকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে৷ এ জন্য ছোটোকাল থেকে এসব ইহুদী বিরোধী গল্প-কাহিনী পড়ে পড়ে বড় হয়েছি৷ এই মিথ্যার তলে চাপা পড়ে গেছে সঠিক ইতিহাস৷ এ জন্য আমাদের গল্প কাহিনীতে সর্বত্র ভিলেন ইহুদীরা৷ পশ্চিমা কালপিটগুলোকে আমরা রীতিমতো পুজা করে চলছি! কিন্তু শক্রু মিত্র চিহ্নিত করতে না পারলে আপনি লড়াই করবেন কীভাবে৷ কে বড় শক্রু আর কে ছোটো শক্রু সেটাও আপনাকে বুঝতে হবে৷ ফিলিস্তিন সংকটের জন্য প্রধানত দায়ী ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র৷ এই সংকট তারাই তৈরি করেছে এবং তারা এর সমাধান চায় না৷ অথচ তারা চাইলে এই সমস্যার সমাধান মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাপার৷ গোটা মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও খনিজ সম্পদ দখলের জন্য ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদীদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা অব্যহত রাখা খুবই প্রয়োজন৷ তাদের অস্ত্রে ব্যবসার জন্য শত বছর ধরে এই সংকট জিইয়ে রাখা দরকার৷ পানামা, কিউবা, হাইতি, পূর্বতিমুর এসব সংকট তারা রাতারাতি সমাধান করেছে৷ কিন্তু ফিলিস্তিন সংকট একশত বছরেও সমাধান হয়নি৷ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ প্রজেক্ট লাগবেই৷ সেখা আফগানে হোক, ইরাকে হোক, ভিয়েতনামে হোক কিংবা ইউক্রেনে হোক৷ তারা বিশ্বব্যাপি গণতন্ত্রের সবক দেবে৷ কিন্তু আরবরা যখন তাদের হাতে তেল তুলে দেবে তখন আর সেখানে গণতন্ত্র না থাকলেও সমস্যা নাই৷ তারা বিশ্বব্যাপি মানবতাবাদের কথা বলবে৷ কিন্তু ইসরায়েলিরা অন্যের ভিটা দখল করলে, নিরীহ মানুষ মারলে সেখানে তারা চুপ৷ পশ্চিমাদের পুঁজিবাদী প্রজেক্ট, সাম্রাজ্যবাদী প্রজেক্ট সম্পর্কে আমরা কত জনে জানি? কতটুকু ধারণা রাখি? আদৌ কিছু জানি? তারা আমাদেরকে তাদেরই বানানো ইতিহাস পড়াচ্ছে৷ তারা বলছে তারা সভ্য, আমরা অসভ্য৷ আজকের স্বঘোষিত সভ্য ও মানবতার ভেকধারীদের অতীত খুবই কলুষিত৷ তাদের হাত কোটি মানুষের রক্তে রঞ্জিত৷ পৃথিবীর এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে তারা গণহত্যা চালায়নি৷ এমন কোনো দেশ নেই যেখান থেকে তারা সম্পদ লুণ্ঠন করেনি৷ মানব সভ্যতার পিঠে ইউরোপিয়ানদের কশাঘাতের দাগ এখনো চকচক করছে৷ আমাদের প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস চর্চা করা এবং শত্রু মিত্র চেনা৷
তথ্যসূত্রঃ
(১) হিব্রু থেকে ইহুদী – খন্দকার মাহমুদুল হাসান।
(২) ইহুদী জাতির ইতিহাস – আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ।
(৩) জেরুজালেম – সাইমন সেবাগ মন্টেফিউরি।
(৪) জেরুজালেম- ক্যারেন আর্মস্ট্রং
(৫) ফিলিস্তিন: ইতিহাসের চার হাজার বছর- নূর মাসালেহ, অনুবাদ- সাঈদ ইসলাম।
(৬) ইতিহাসের পাঠশালায় (মধ্যযুগ)- আসিফ আযহার।
(৭) আধুনিক ইউরোপ; আদি পর্বের রূপান্তর- সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
(৮) ক্রুসেডের ইতিহাস – ড. রাগিব সারজানি।
(৯) ক্রুসেড; দ্য ফ্লেইম অব ইসলাম – হ্যারল্ড ল্যাম্ব।
(১০) দি অটোমান সেঞ্চুরিস – লর্ড কিনরস।
(১১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ- সাহাদত হোসেন খান৷
(১২) গল্পে গল্পে বিংশ শতাব্দী- আমিনুল ইসলাম৷
(এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন লেখকের ‘পৃথিবীটা কীভাবে জলদস্যুদের হলো’ বইটি৷)