খুব বেশি দূর না। এইতো কিছুদিন আগের কথা।
২০২১ সাল। আমি তখনও মাদ্রাসায় পড়ি। হিফয বিভাগে। পড়ালেখার সাথে ফেসবুক ঘাটাঘাটিও দৈনিক রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। চ্যাটিং, পোস্টিং, নিউজফিড; এরই মাঝে চলছিল দিন। হঠাৎ একদিন এক বোনের পোস্ট দেখে থমকে যাই। যতদূর মনে পড়ে– পোস্ট টা ছিল এরকম, ‘মানুষটি যদি হয় আরিফ আজাদের মত, তাহলে আর কি চাই!’ এটা না হলেও এরকম টাইপের একটা হবে আর কি। তখনও আমি আরিফ ভাইকে চিনি না। ফেইসবুকে কী না পাওয়া যায়? তাই সার্চ দিলাম ‘আরিফ আজাদ’। সিজদায় লুটিয়ে পড়া প্রো–পিক দেওয়া একটি পেজ ভেসে উঠলো। ক্লিক করে ভিতরে ঢুকে একটু উকি দিলাম। তাতে বুঝলাম উনি একজন লেখক। বহুল পরিচিত ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’ সিরিজের লেখক তিনি। আমি এই বইটির নাম কয়েক বছর ধরেই শুনে আসছিলাম। প্রায় ২-৩ বছর ধরে। কিন্তু কখনো কল্পনাও করিনি, এটি একটি ইসলামিক বই। যাই হোক, সাজিদ বইটির pdf পড়তে শুরু করি। কিছুটা পরে খুব ভালো লাগছিল। তারপর ফেইসবুকে জানতে পারলাম তার (আরিফ ভাইয়ের) বর্তমান (২০২১) লিখিত একটি বই প্রচুর বিক্রী হচ্ছে। সাথে এটাও জানতে পারলাম যে, এই বই পড়ে অনেকে ফিরে আসছে দ্বীনের পথে। বইটির নাম ‘বেলা ফুরাবার আগে’! নামের মাঝেই কেমন যেন একটা আকর্ষণ আছে। শুধু কিনতে পারছিলাম না। কারণ গ্রামের লাইব্রেরী গুলোতে এসব বই পাওয়া যায় না।
আরও পড়তে পারেন–বই রিভিউ , নবি জীবনের গল্প । আরিফ আজাদ
একদিন মা বললো, ‘তোর ভাইয়া আসছে শহর থেকে।’ ভাবলাম এই সুযোগ— ভাইয়া কে msg দিলাম, আমার জন্য বেলা ফুরাবার আগে বইটি নিয়ে আসতে! এশার আযান হয়ে গেল, নামাজও শেষ, আমাদের রাতের খাওয়াও শেষ; সবাই এখন ঘুমোতে যাবে। ভাবছিলাম ভাইয়া মনে হয় আসবে না। মা কে বললাম, ভাইয়া কি আজ আসবে না? তিনি বললেন, রওয়ানা হয়েছে। আসতে একটু রাত হবে। আমার আর তর সইছিল না। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে। রাত এগুচ্ছে না। এভাবেই রাত ১০, ১১, ১২, ১ টা বেজে গেল। ভাইয়া আসছেই না। কেমন যেন মন খারাপ। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেলাম। দৌড় দিলাম মেইন গেটের দিকে। দেখি, ভাইয়া এসেছে। ভাইয়া রাগী মানুষ, তাই কিছু বলতে পারছি না। ভিতরে এসে ব্যাগ রেখেই আগে বই বের করতে শুরু করলো। আব্বার জন্য অনেকগুলো বই এনেছে। সাথে আমার বলা বেলা ফুরাবার আগে বইটিও এনেছে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে– আমি যখন বইটি হাতে পেয়েছিলাম, তখন সময় ছিল— রাত ১:২৩ মিনিট। আমি সেটা নোটও করে রেখে দিয়েছিলাম। সেদিন বইটি হাতে পেয়েই পড়তে শুরু করে দিয়েছিলাম। সেদিন রাতেই অনেকখানি পড়ে ফেলেছিলাম। এটাই ছিল আমার বইপ্রেমী হয়ে উঠার যাত্রা। আমার এই সৃতি কখনও ভুলবো না আমি মনে করি, বাকি টা আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছে।
তারপর শুরু হয় নিয়মিত পড়া। খুব বেশি সময় লাগেনি বইটি শেষ করতে। আমি বইটি সম্পর্কে যতটা ভেবেছিলাম, তার থেকেও অনেক বেশি উন্নত ও উত্তম ছিল। বইটি পড়ে আমার এটা মনে হয়েছে যে, কবি হয়তো আমার জীবনের ভুলগুলো অবলোকন করে তারই সমাধান হিসেবে এই বইটি লিখেছেন। সত্যি বলতে, যে-ই বইটি পড়বে; তারই মনে হবে, যেন বইটি শুধু তার জন্যই লেখা। দিন দিন বইটির গভীরে যেতে লাগলাম। আর উদ্ধার করতে লাগলাম অমূল্য বাণীগুলো! আমার জীবন চলার পথের ভুলগুলোর সমাধান খুঁজে পেলাম। পেলাম মুক্তির পথ। যেই অভ্যাসগুলোয় আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না তার ভিতর থেকে; সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসার সুরঙ্গ খুঁজে পেলাম। পরিবর্তন আসলো আমার কথায়, চলায়; নির্বিশেষে আমিও সঠিক পথ চিনতে পেয়েছি।
মানুষ বলে– ‘প্রথম ভালোবাসা নাকি ভোলা যায় না।’ আরে সেটা তো হারাম সম্পর্ক! কিন্তু সত্যি বলতে, জীবনের প্রথম কোনো বই ছিল এটি। আমার মনে হয়— আমার মৃত্যু অবধি যত বই-ই আমি সংগ্রহ করবো, পড়বো, খুঁতিয়ে দেখবো; কিন্তু এই বইয়ের মত কোনো বইকেই ভালোবাসতে পারবো না! বইটি পড়ে ভালোবাসে ফেলেছি লেখককে, ভালোবেসেছি ‘সমকালীন প্রকাশন’কে। আল্লাহ্ পাক বইয়ের সংশ্লিষ্ট সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুক, আমীন!
বইটি আমাকে যা শিখিয়েছে—
১. মন খারাপের দিনে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের শিক্ষা পেয়েছি।
২. শিখিয়েছে, প্রাচুর্যের পিছনে না দৌড়ে, পরকালের সঞ্চয় করতে।
৩. শিখিয়েছে, ক্রাশ নামক চোখের যিনা থেকে নিজেকে সংযত রাখতে।
৪. হারাম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে শিখিয়েছে।
৫. সদকায়ে জারিয়ার বিপরীতে চলমান গোনাহ্ থেকে মুক্তি লাভের রাস্তা দেখিয়েছে।
৬. বেলা ফুরাবার (মৃত্যুর ডাক আসার) আগেই রবের দিকে ফিরতে সাহস যুগিয়েছে।
৭. অসংখ্য গোনাহের মাঝে আমাকে রবের অবিরাম দয়ার বাণী শুনিয়েছে।
৮. সত্যিকারের বসন্ত (দ্বীন) চিনিয়েছে।
৯. শিখিয়েছে, নামাজে মনোযোগী হতে।
১০. ফিৎনার এই জামানায়, আমাকে মসজিদের সাথে সম্পর্ক রাখতে শিখিয়েছে।
১১. মুসলিমের প্রকাশ্য শত্রু শয়তান থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
১২. পরিশেষে আমাকে প্রত্যাবর্তনের দাওয়াত দিয়েছে।
শিখেছি অনেক কিছু। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তুলে ধরেছি। যদি এই সমস্যাগুলো আপনার মাঝে এখনও বাসা বাঁধে। প্রতিরোধ করতে এখনই একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন। আশা করি, বইটি আপনাকে নিরাশ করবে না। আর তাছাড়া এই বইটি সর্বস্তরের নারী–পুরুষেরই পড়া উচিত।
বই– বেলা ফুরাবার আগে
লেখক– আরিফ আজাদ
প্রকাশনা– সমকালীন প্রকাশন
কভার– পেপারব্যাক