সারাটি জীবন সংসার এবং সন্তানদের পিছনে খেটেখুটে আর সমাজ সেবামূলক কাজ করার পরেও বাবামাকে কেন বাধ্য হতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে যেতে? এমন প্রশ্নে আজ আর অবাক হবার মতো কিছু নেই ।সমাজের অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা । প্রবীণদের দুঃখ দুর্দশার কাহিনী দিন দিন আরও মর্মান্তিক হচ্ছে ।
বৃদ্ধাশ্রমে না গেলেও বৃদ্ধ বয়সে সন্তান থেকেও সঙ্গহীন জীবন যাপনে বাধ্য হতে হয় অনেক পিতামাতাকেই।দশ মাস যুদ্ধ করে যে মা তার সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখায় আর বাবা বটবৃক্ষের মতো সারাজীবন আগলে রাখে জীবনের সন্ধ্যায় তাদের ভাগ্যে জুটে অনাদর আর অবহেলা ।তাদের কথাও যেন শুনার মতো ধৈর্য হারিয়ে ফেলে তাদের আদরের সোনামানিকরা।কিন্তু কি কারণে ঘটছে এমন ঘটনা আর এ থেকে উত্তরণের পথ কি আসুন সে নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক।
- প্রথমত:
ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব:
সন্তান প্রতিপালনের সময় পিতামাতা বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের বাইরে ধর্মীয় মূল্যবোধের জাগরণে প্রয়াস কম থাকলে এই সমস্যা প্রকটতর হতে দেখা যায় ।বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমকে সন্তানের আত্মস্থ করণে পিতামাতার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা পরিলিক্ষত হয়।ইংরেজি,গণিত,বিজ্ঞান এর বাইরেও তারা নাজ-গান ইত্যাদির শিক্ষক রাখলেও ধর্মীয় শিক্ষাকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় না।আর সন্তান কোন রকমে কোরআন দেখে পড়তে পারলেই পিতামাতা মনে করে থাকেন তাদের ধর্মীয় শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে গেছে ।কিন্তু আসলে শুধু কোরআন দেখে দেখে পড়তে পারাটাই যথেষ্ট নয় ;এর অর্থ বুঝতে হবে । পবিত্র কোরআনের শিক্ষা যাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে থাকে তারা পিতামাতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।
মহান আল্লাহ কোরআনে এরশাদ করেছেন,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُلْ لَّهُمَا أُفٍّ وَّلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيْماً- وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْراً- رَّبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا فِيْ نُفُوْسِكُمْ إِنْ تَكُوْنُواْ صَالِحِيْنَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلْأَوَّابِيْنَ غَفُوْراً.
‘আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, আর তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভাল করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল’ (বনী ইসরাঈল ২৩- ২৫)।
এ বিষয়ে আল্লাহ আরও বলেন,
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَّفِصَالُهُ فِيْ عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِيْ وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيْرُ.
‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে’ (লোক্বমান ১৪)
সুতরাং ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রতিটি সন্তানের হৃদয়ে বদ্ধমূল করা গেলে পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে জটিলতার অবসান ঘটবে অনেকটাই।
- দ্বিতীয়ত:
মানবিক মূল্যবোধের অভাব:
মানুষ হিসেবে উন্নত মনোবৃত্তির অভাব এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সন্তানকে কেবলই পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হলে সন্তান উন্নত মনোবৃত্তির শিক্ষা লাভ সুসম্পন্ন হয় না। এক্ষেত্রে পিতামাতা তাদের নিজেদের পিতামাতার প্রতি মহব্বত করা এবং সন্তানদের সে বিষয়ে জাগ্রত করা কর্তব্য ।পিতামাতা যদি তাদের বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে সচেতন হোন তবে সন্তান সেটা দেখে উন্নত মনোবৃত্তি অর্জনে সক্ষম হবে ।
- তৃতীয়ত:
আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা
উন্নত কোন বৃদ্ধাশ্রমে পিতামাতাকে পাঠিয়ে খরচ চালনার সঙ্গতি থাকলে অনেক সময় সন্তানেরা পিতামাতার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা করে থাকে ।অনেক সময় পিতামাতাও নিজের সঙ্গতি থাকলে একাই আসতে চায় বৃদ্ধাশ্রমে তাদের সন্তানদের কষ্ট হচ্ছে মনে করে।তবে টাকার চেয়ে পিতামাতার মূল্য অনেকগুণ অধিক এটা যারা জানেন এবং মানেন তারা পিতামাতার জন্য বৃদ্ধাশ্রমে থাকা পছন্দ করতে পারেন না।
- চতুর্থতঃ
সন্তানদের নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকা
যে সন্তানের ভালো চাকরি আর উন্নত জীবন যাপনের জন্য পিতামাতাকে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করতে হয় সেই সন্তান একটা সময় এত বেশি ব্যস্ত হয়ে যায় যে পিতামাতার দেখাশোনা করার মতো সময় তাদের আর হয়ে ওঠে না।অনেক সময় ছেলে -বৌ উভয়েই চাকরিজীবী হওয়ায় পিতামাতাকে একাকী অনেকটা সময় কাটাতে হয় ।তাই তারা বাধ্য হয়ে পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে ।জীবনের ব্যস্ততা বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ।
আরও পড়ুন–চোখ ভালো রাখার উপায়-চোখ ভালো রাখার খাবার- এবং চোখের ব্যায়াম
নোবেল পুরস্কার ১৯০১ থেকে ২০২২ তালিকা
ইসলামে নারীর মর্যাদা ও কুরআনের একটি আয়াতের অপব্যখ্যার জবাব । ফাতেমা জাহান লুবনা
- পঞ্চমত:
সন্তানদের দাম্পত্য কলহ:
অনেক সময় ছেলে- ছেলের স্ত্রীর বা মেয়ে-মেয়ের জামাইয়ের মধ্যে বৃদ্ধ পিতামাতা,শ্বশুর শাশুড়িকে কেন্দ্র করে যে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয় তার পরিসমাপ্তি ঘটে বৃদ্ধাশ্রমের মধ্য দিয়ে ।তাই এক্ষেত্রে ছেলে -মেয়ে বিবাহ দেওয়ার সময় উন্নত মনোবৃত্তি সম্পন্ন পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিহার্য ।
- ষষ্ঠত:
প্রবাসে সন্তানদের অবস্থান করা
সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে অথবা জীবিকার প্রয়োজনে প্রবাসে প্রেরণ করে থাকেন অনেক পিতামাতা।পরবর্তীতে উন্নত জীবন যাপনের মোহে পড়ে আজীবন তারা কাটিয়ে দেয় প্রবাসে।এমতাবস্থায় পিতামাতার দেখাশোনার জন্য পাশে কেউ থাকে না বিধায় তাদের বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হতে হয়। পিতামাতার তাদের সন্তানদের প্রবাসে পাঠানোর পূর্বে এই বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে ।যদি দেশের মাটিতেই তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করা যায় তবে প্রবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত যথোপযুক্ত হয় না।
- সপ্তমত:
সন্তানদের সঠিক সময় দানে ব্যর্থতা
লেখাপড়ার পাশাপাশি সন্তানদের সঠিক মানসিক বিকাশের জন্য পিতামাতার উভয়েরই কর্তব্য পর্যাপ্ত সময় প্রদান করা তাদেরকে যেন তারা পিতামাতার সাথে আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে ।সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় না দিলে তারা পরবর্তীতে বড় হলেও আর পিতামাতার প্রতি মানসিক টান অনুভব করে না।ফলে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে ততটা চিন্তান্বিত হতে হয় না।
- অষ্টমত:
পারিবারিক কালচার থাকা
কোন পরিবারের কালচার যদি এমন থাকে যে বৃদ্ধ হলেই তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয় তাহলে পরিবারের সন্তানরা সেই শিক্ষা নিয়েই বেড়ে ওঠে এবং এটাকে নিতান্তই স্বাভাবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকে। পরবর্তীতে তারাও একইভাবে পিতামাতার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা খুঁজে নিতে দ্বিধা বোধ করে না।তাই নিজেদের পিতামাতার জন্য বৃদ্ধাশ্রমকে পছন্দ করার সময় চিন্তা করা আবশ্যক যে দিন বদলের পালায় এমন সময় তাদের ও আসবে যখন তাদের সন্তানেরা তাদেরকে একই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবে।
- নবমত:
সন্তানদের আর্থিক অসঙ্গতি
পিতামাতার খাওয়া পরার খরচাদি চালাতে অক্ষম হলে সন্তান অনেক সময় পিতামাতাকে বিনামূল্যে স্বেচ্ছাসেবী বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয় বা তারাও আসতে বাধ্য হয়। ধনীদের অর্থ সম্পদে সঠিকভাবে যাকাত প্রদানের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র সমস্যা অনেকখানি দূর করা সম্ভব ।এক্ষেত্রে সরকার,স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলি এবং সমাজের ধনী ব্যক্তিদের সহযোগিতায় পর্যাপ্ত বয়স্ক ভাতা নিশ্চিত করা গেলে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে ।