শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ওবায়েদ স্যারের ছিমছাম অফিস থেকে বের হবার সময় এমনটি ভাবেনি। বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী এম রহমান স্যারের আলোচনাটা মাথায় শুধু ঘুরপাক খাবার দরুন সময়ের চলমানতার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ক্ষুদ্র পরিসরের আয়োজনে এম.রহমান স্যারই ছিলেন আলোচনার মধ্যমণি। নির্দেশক, সঞ্চালক সবই। বেশ উপভোগ্য কটা মুহূর্ত।
নতুন একটি উপলব্ধি, কাল্পনিক কিছু ছবি বুকের দেরাজে ঢুকিয়ে যখন রাস্তায় পা বাড়ালাম, তখন হাতে আর মাত্র পঁচিশ মিনিট বাকি। সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জ গামী এগারোসিন্ধুর গোধূলী ট্রেনটা ধরার জন্যে মনে মনে স্থির করি দুপুরের পর থেকে। তার পূর্ব পর্যন্ত ছিলো নরসিংদী ফিরবো মহানগর এক্সপ্রেসেই। মহানগরের টিকিট ৪দিন ধরে মানি ব্যাগে সময় যাপন করছে।
সময়ের কাটা শেষতক খুব দ্রুতই মাঠঘাট পাড়ি দিতে লাগলো। সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ প্রগাঢ়ভাবে নেমেছে শহর ও শহরের বাইরে। বসুন্ধরার নিয়ন বাতি সেই অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
রাস্তায় নেমেই উপলব্ধি করলাম- জীবনটা ধরাবাঁধা ছকে সব সময় চলে না। মাঝে মাঝে ছন্দপতন ঘটে। আজ বোধহয় আমার তেমনই একটি দিন।বসুন্ধরা বারিধারার পথঘাট আমার মতো ভিটেমাটি ছাড়া মানুষের জন্যে নয়-তাও টের পেলাম। গরীবের শখের পরিবহন রিক্সার দেখা পাওয়াই ভার। আমি রাস্তার অপর পাশে রিক্সার জন্যে অপেক্ষায় থাকলাম। প্রিয়জন শিল্পী টি.হোসেন খান ভাই ক্ষতিগ্রস্ত পা টা টানতে টানতে ওপারে অন্ধকারে মিলে গেলেন।
বসুন্ধরার এফ ব্লকের মাথায় পনের মিনিট কেটে গেলো,কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বাহন রিক্সা পেলাম না। ওখানে দাঁড়ানোর অবসরে বারবার আমার আত্মজা সাবিত হাসান বেলালের ফোলা ফোলা চোখদুটো আমার মনের চোখে বারবার বিচিত্রভাবে ভেসে উঠতে থাকে। আমি কদিন ধরে ওকে নিয়ে কিছুটা হতবিহ্বল,চিন্তিত। ওর আচরণের পরিবর্তনটা আমার কাছে অস্বাভাবিক ঠেকছে।
বালিসে মুখ লুকিয়ে বা হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিরব শুয়ে থাকছে। আমি কিছু বললেই বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। আমি সাবিতের অভিব্যক্তিটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তার প্রশ্নগুলোর সব ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারছি না।
সাবিতের বয়স গত পাঁচ সেপ্টেম্বর সাত বছর পূর্ণ হলো। মাত্র ১ম শ্রেণিতে পড়ে সে। কদিন ধরে বারবার আমি অবাকই হচ্ছি- ওর প্রশ্নে। এবছরের স্মরণকালের বন্যা, বানভাসী মানুষের হাহাকার, তার রেশ কাটতে না কাটতেই রোহিঙ্গা নিধনের নিষ্ঠুরতা, রক্তাক্ত ফুটেজ, আগুনের লেলিহান শিখা, পশুর মতো কুঠার দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয় মানুষমারার দৃশ্যগুলো ওর মনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে-তা আমি বুঝতে পারি। ওর প্রশ্ন :
: বাচ্চাটাকে এমনভাবে কেন মারছে? ওর আব্বু আম্মু
কই?
: ওরা মুসলমান বলে বৌদ্ধরা ওদের মারছে।
: আমাদেরও কী মেরে ফেলবে? বৌদ্ধরা কী ঢাকায়ও
আছে? ওরা সাকিব ভাইয়াকে, সামিনকেও মারবে?
: আহা তুমি এতো চিন্তা করছো কেন আব্বু?
ততোক্ষণে চোয়াল বেয়ে ওর শ্রাবণ ধারা নামতে শুরু করেছে। বুকে টেনে নিতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সাবিত। বলে:
: বৌদ্ধরা কী নরসিংদীও আসবে? আমাদেরও জবাই করবে?
: না না। ওরা বাংলাদেশে আসতে পারবে না। তোমার এতো ভয় করতে হবে না।
একসময় তার কান্নাটা থেমে যায়। কিন্তু ফোপাতে থাকে। আবারও প্রশ্ন করে:
: রোহিঙ্গাদের বাচ্চারা আমাদের বাসায় আসবে? ওরা ভালো না আব্বু!
: ওরা ভালো। কিন্তু বলোতো- যদি রোহিঙ্গাদের বাচ্চারা আমাদের বাসায় আসে তখন তুমি কী করবে?
: ওদেরকে নিয়ে খেলবো।রোবট বানাবো সবাই মিলে। একসাথে বসে কার্টুন দেখবো। নাস্তা করবো।গোসল করবো। আমার ড্রেস ওদেরকে দেবো। একসাথে গোসল করবো, স্কুলে নিয়ে যাবো।।
: তুমি ঠিক বলছে। তুমি এমনটি করলে আল্লাহ তোমাকে অনেক সওয়াব দেবেন। তুমি জান্নাতে যেতে পারবে।
: জান্নাতে গেলে আমি কী করবো জানো? আল্লাহর কাছে একটা বাসা চাবো। আর বলবো: আল্লাহ তুমি আব্বুকে,আম্মুকে, সাকিব ভাইয়াকে, সামিনকেও জান্নাতে দাও। আমরা এক সাথে জান্নাতে থাকতে পারবো না আব্বু?
: কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। তবে সবাইকে ভালো কাজ করতে হবে। নামাজ পড়তে হবে।
ততোক্ষণে ওর কান্নাটা থেমে যায়। চোখে মুখে তবু কেন জানি অজানা উদ্বেগ ও শঙ্কা ভর করে আছে সাবিতের।
এসব কথাগুলো গল্প নয়। বাস্তব। আমার চোখটাও এখন ঝাপসা হয়ে আসছে। চশমাটাও বারবার মুছতে হচ্ছে।
আরেকটা বিষয় আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবিয়ে তুলছে।কদিন ধরে সাবিত ঘুমের মাঝে বেশ শব্দ করে হঠাৎ কান্না করে ওঠে। তার একটা কথাই বারবার শুনছি-
: আব্বু আব্বু আমাকে ধরো, আমাকে বাঁচাও।
ঘুমের মধ্যে প্রবল বেগে কান্না করছে, হাত-পা ছুঁড়ছে। বিছানা ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে কোথাও। প্রায় দশ মিনিটের মতো কান্না করে আস্তে আস্তে থেমে যায়। শত ডাকাডাকি করলেও সে কোন কথার জবাব দেয় না, চোখ মেলে তাকায়ও না।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতে পারে না সাবিত। গত রাতেও এমন কান্না করেছে সে। সকালে কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে: খেলার সময় বড় একটা পাথর দিয়ে কে যেন মারতে
এসেছিলো।
আরো পড়ুন-- পিতা মাতা কেন বৃদ্ধাশ্রমে--
আমার বুঝতে বাকি থাকলো না -রোহিঙ্গা নিধনের ছবিগুলো তার মনের মধ্যে কতোটা রেখাপাত করেছে। এই মুহূর্তে নিজকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে- শিল্পী লেলিনের গাওয়া আমার রোহিঙ্গা বিষয়ক প্রথম গানের চিত্রায়নগুলো ওকে দেখানো মোটেও ঠিক হয় নি। বড়দের কেউ কেউ ঐ ফুটেজ গুলো দেখার শক্তি পাচ্ছেন না। মায়ানমারের সামরিক জান্তাদের এমন অমানবিক পোড়ামাটির নীতির কথা ভাবতেই শিউরে ওঠে পুরো বুকটা। হায়রে মানুষ হায়রে মানবতা। না না আর ভাবতে পারছি না।
ঘড়ির কাটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষার পর একটা সি.এন.জিতে চেপে বসলাম। মাত্র দুমিনিটের জন্যে এগারসিন্ধুর গোধূলী ট্রেনটা মিস করলাম। সেই আড়াইঘণ্টা পর মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনটা আসবে। বেশি তাড়াছিলো তাড়াতাড়ি যাবার, সেখানে বিলম্বের আর বিকল্প নেই।
সামনে ৪নং লাইনে দিনাজপুর থেকে ছেড়ে আসা দ্রুতযান এক্সপ্রেসটি এসে দাঁড়ালো। দেরি না করে দ্রুতযানেই উঠে গেলাম। নরসিংদীর দিকে না যেয়ে ট্রেনজার্নিটা দীর্ঘ করার জন্যে উল্টো পথে কমলাপুরের দিকে যাবার নিয়াত করলাম। বিমান বন্দর থেকে ট্রেনে ওঠা এমনিতেই বেশ কষ্টকর। আড়াইঘণ্টা অপেক্ষা করাও অনেক কঠিন। ওর চেয়ে কমলাপুর যাওয়াই আমি ভালো মনে করলাম।
ট্রেন চলেছে কমলাপুরের দিকে। আমার স্মৃতি পেছনে টানছে বারবার। সারাদিন কেটে গেছে ভিন্ন রকম এক ব্যস্ততায়। প্রিয় শিল্পী এ.হাবিব ভায়ের বাসায় অঘোষিত গানের আড্ডা জমে ছিলো। আল্লাহ আমার রব, এই রবই আমার সব-অমর গানের স্রষ্টা শিল্পী টি, হোসেন খান, সুর সম্রাট এম. আর.লিটন, জাত শিল্পী এ. হাবিব ভাই-এর মাঝে আমি নগন্য সঙ্গীত প্রেমী!
আমার রোহিঙ্গা বিষয়ক দুটো গানের সুর ফাইনাল হলো। টি. হোসেন ভায়ের দুটো গানেরও সুর চূড়ান্ত হলো। আল্লাহ তৌফিক দিলে কালই রেকর্ড হবে। দুপুরে এ.হাবিব ভাবীর পাকা হাতের রান্না রোগব্যাধির কথা অনায়াসে ভুলিয়ে দিলো। চারিদিকে এতো অস্থিরতা বিভীষিকার মাঝেও এমন পরিবেশ, এমন অাতিথেয়তার মধ্যে সময় পার করতে পারা একমাত্র তার রহমেই সম্ভব হলো। আবার কোন একদিন নতুন গান নিয়ে বসবো আমরা এমন প্রত্যয় নিয়ে গানের আড্ডা ভেঙে দিয়েছিলাম বিকেল নাগাদ। তারপর শিশু বিশেষজ্ঞ ওবায়েদ স্যারের ডেরায় নতুন আরেকটি পর্ব।
অনাগত শিশুদের জন্যে আমাদের পৃথিবীটা কতোটা বাসযোগ্য করা য়ায়, তাদের জন্যে কী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ করা যায়- তারই একটি নকশা নিয়ে কাজ করার দিক নির্দেশনা চূড়ান্ত করার জন্যে বৈকালিক এই আয়োজন।
সঙ্গীতজ্ঞ তাফাজ্জল খান ভাই,নাট্যব্যক্তিত্ব নূর ভাই,মুকুল ভাই, চিত্রশিল্পী ই.মন্ডল ভাই, সাংস্কৃতিক সংগঠক জাকি ভাই সবার চোখেমুখে নতুন প্রত্যাশার ঝিলিক। মাঝেমাঝে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে মুখটা কারো কারো ভার হয়ে যাচ্ছে। শঙ্কা ও ঘৃণা ফুটে উঠছে। পরক্ষণেই আবারও নতুন প্রতীজ্ঞা ও নতুন উদ্দীপনায় সবাই একাত্ম হচ্ছে। জানি না- আগামী দিনগুলো সত্যি কেমন হবে? গল্প বিবর্তন-কবি আবু তাহের বেলাল, গল্প বিবর্তন-কবি আবু তাহের বেলাল, গল্প বিবর্তন-কবি আবু তাহের বেলাল, বিবর্তন , বিবর্তন, বিবর্তন , গল্প বিবর্তন, বিবর্তন
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
১৬/৯/২০১৭
মহানগর এক্সপ্রেস
নরসিংদীর পথে।