You are currently viewing বাংলা ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার জন্মগত যোগ নেই-নাসীমুল বারী
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

বাংলা ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার জন্মগত যোগ নেই-নাসীমুল বারী

বাংলা ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার জন্মগত যোগ নেই

।। নাসীমুল বারী ।

এক:  আমাদের বাংলা ভাষাতে ইংরেজি, আরবি, পর্তুগীজ, চীনা ইত্যাদি অনেক অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়। তাই বলে কি বাংলা ভাষার সাথে ইংরেজি, আরবি, পর্তুগীজ, চীনার জন্মগত সম্পর্ক খুঁজি? সংস্কৃত কথ্য ভাষা নয়- লিখিত ভাষা। মানুষ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে না, বলেওনি কখনো। শুধু ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থ সংস্কার করার জন্যই এ ভাষার উদ্ভব পাণিনির ব্যাকরণকে মাধ্যম করে। যেহেতু লিখিত ভাষা, নিজস্ব কথ্যতা নেই- তাই এ ভাষার শব্দ বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়ে পড়াটা স্বাভাবিক। বিভিন্ন ভাষায় শব্দ ছড়িয়ে পড়ার মানে এই নয় যে ওইসব ভাষা সংস্কৃত থেকে জন্ম।

খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ সময়ের মধ্যে কোনো এক সময়ে বৈদিক ভাষার জন্ম হয়। মানব সভ্যতায় ভাষার শুদ্ধার জন্যে পাণিনি অষ্টাধ্যয়ী ব্যাকরণ রচনা করেন খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে। পুরাণে নানারীতির ভাষার মিশ্রণ হওয়ায় ভাষার ধর্মীয় ভাবের বিশুদ্ধতা ক্ষুণ্ন হয়। তাই ভাষাকে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যে পরিশুদ্ধ করার জন্য পাণিনির ব্যাকরণকে মাধ্যম করে সংস্কার করা হয়। এই সংস্কার করা ভাষাই ‘সংস্কৃত ভাষা’। এটা শুধু পুরাণের লিখিত ভাষা। এ ভাষার কথ্য কোনো ভাষা নয়। যেটুকু কথ্য হতো- তা শুধু ধর্মীয় পণ্ডিতগণই বলার অধিকার রাখতেন; সাধারণের জন্যে তা নিষিদ্ধ ছিল। তাই খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দেই সংস্কৃত ভাষার জন্ম ও থেমে যাওয়া। এর আর কোনো শাখা প্রশাখা নেই। সে থেকে আজ অবধি সংস্কৃত ভাষা লিখিত ভাষা হিসেবে প্রচলিত। বাংলাভাষার জন্মের সাথে তাই সংস্কৃত ভাষার কোনো যোগ নেই।

নিচে ছবিতে ভাষাবংশের কুলজি দেওয়া হলো। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর করা এ কুলজিটিই ভাষার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। সেখানেই দেখুন সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার অবস্থান।

বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

আরও পড়তে পারেন–রূপতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় – প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-নাসীমুল বারী

দুই:  পাণিনি রচিত অষ্টাধ্যয়ী ব্যাকরণই সভ্যতায় ভাষার প্রাচীনতম ব্যাকরণ। সে ব্যাকরণের সূত্র ধরে ‘বৈদিক ভাষা’ ও ‘প্রাচীন প্রাচ্য ভারতীয় আর্য ভাষার সমন্বয়ে ‘সংস্কৃত ভাষা’র উদ্ভব। সংস্কৃত ভাষার উদ্ভাবনে পাণিনির ব্যাকরণের সংস্কারকৃত একটা ব্যাকরণিক রূপও তৈরি হয়। এটাই ‘সংস্কৃত ব্যাকরণ’। ‘প্রাচীন প্রাচ্য ভারতীয় আর্য’ ভাষা থেকেই পরবর্তীতে অনেক ভাষার জন্ম হয়েছে। তন্মধ্যে আমাদের বাংলা ভাষাও। সংস্কারকৃত ব্যাকরণের কারণে ‘প্রাচীন প্রাচ্য ভারতীয় আর্য’ ভাষার কিছু অংশ সংস্কৃত হওয়ায় এবং নতুন একটি সংস্কৃত ভাষার রূপ তৈরি হওয়ায় পরবর্তী অনেক ভাষাতেই সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলা ভাষাতেও তেমন। এ কারণেই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ভাষা থেকে জন্ম নেওয়া একটি ভাষা বলে ভুল ধারণা প্রচলিত। এমনও বলা বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার দুহিতা বা কন্যা। এসব ধারণার কারণ ওই যে বললাম সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব। এসব ধারণার ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় নি।

বাংলা ভাষার যে ব্যাকরণ আমরা পড়ে আসছি- তা মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণের বাংলা রূপ। বাংলা ভাষার স্বকীয় কোনো ব্যাকরণ নেই। “বিশ শতকের সূচনাকালে বাংলা ভাষার একটি নিজস্ব ব্যাকরণ রচনা এবং এ বিষয়ে গবেষণার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ পণ্ডিত-কবি-সাহিত্যিক। কিন্তু বিশ শতকের শেষ অবধি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা সম্ভব হয়নি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক জনাব শামসুজ্জামান খান ২০০৯ সালের প্রথম দিকে এই অপূর্ণতা নিরসনের লক্ষ্যে ‘বাংলা একাডেমী বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়ন ও প্রকাশনা’ শীর্ষক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের পণ্ডিত-ব্যাকরণবিদদের নিয়ে আলোচনা সভা, কর্মশালা আয়োজন করে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে প্রণীত হয় নয়শত পৃষ্ঠাব্যাপী বৃহৎ ব্যাকরণ গ্রন্থ। এটি দুই খণ্ডে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়।” [সূত্র: বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ গ্রন্থের ‘প্রসঙ্গ-কথা’। পুনমুদ্রণ চৈত্র ১৪২২/মার্চ ২০১৬।]

দুই খণ্ডে প্রকাশিত এটিই ‘বাংলা ভাষার প্রথম স্বকীয় ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’। বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছে বলেই ব্যাকরণ গ্রন্থটির নাম- ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’।

আরও পড়ুন–ঈদ উপহার-তিনে একে এক-ছোটগল্প-নাসীমুল বারী

তিন:   স্বকীয় বাংলা ব্যাকরণ ‘প্রমিত’ ধারার ব্যাকরণ। ‘প্রমিত’ মানে ‘মানসম্মত’ বা ‘একটি নির্দিষ্ট মানে উন্নীত করা হয়েছে এমন কিছু্’। যুগের সাথে সমন্বয় করে ভাষার আধুনিকতায় একটি মানসম্মত নিজস্ব ধারার বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বলেই একে বলা হয় ‘প্রমিত ব্যাকরণ’। ‘প্রমিত ব্যাকরণে’ আগের প্রচলিত অনেক কিছুর সাথেই পার্থক্য দেখা যাবে।

পদনির্মাণ করে অর্থবহ ও সার্থক বাক্য গঠন করতে হলে বাক্যের শব্দগুলোকে শ্রেণিকৃত করে চিহ্নিত করতে হয়। প্রথাগত ব্যাকরণে বা প্রাচীন ধারার ব্যাকরণে শব্দশ্রেণি নির্ধারিত হতো শুধু শব্দের অর্থের ভিত্তিতে। সেটি ছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের ধারা পদ্ধতি। প্রমিত বাংলা ব্যাকরণে বাক্যে শব্দের সম্পর্কগত ভূমিকা অর্থাৎ ব্যাকরণগত ভূমিকার ওপর নির্ভর করে শব্দশ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। যেমন ‘বিশেষ্য’- প্রাচীন ধারায় শুধু অর্থনির্ভর ‘নাম’ বৈশিষ্ট্যের ওপর জোর দেওয়া হতো। অথচ ভূমিকাগত দিক থেকে বিশেষ্য বাক্যের কর্তা ও কর্ম উভয়ই হতে পারে। সম্বন্ধ বিভক্তিও গ্রহণ করতে পারে। নিচের বাক্য দুটি দেখি-

মেহেদী মিরাজ ভালো অলরাউন্ডার।

দর্শকরা মেহেদী মিরাজকে অনেক ভালোবাসে।

১ম বাক্যে ‘মেহেদী মিরাজ’ নাম বিশেষ্য। কিন্তু বাক্যে কর্তা হিসেবেও অবস্থান আছে। ২য় বাক্যে ‘মেহেদী মিরাজ’ নাম বিশেষ্যটি কর্ম হিসেবেও অবস্থান নিয়েছে। আবার ‘কে’ বিভক্তিও যোগ করে ‘মেহেদী মিরাজ+কে’ হয়েছে।

এভাবে শব্দ বাক্যের মধ্যে ভাব প্রকাশে অবস্থা বুঝে ভূমিকা রাখছে। বাক্যে শব্দের ব্যাকরণগত অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সনাক্তকরণ ও বিশ্লেষণে শব্দের শ্রেণিগত ধারা গড়ে উঠেছে। বাক্যের শ্রেণিকৃত শব্দের এমন ধারাই শব্দশ্রেণি।

আরও পড়তে পারেন–সৃজনশীল লেখার নিয়ম-আঙ্গিক ধারা-সাহিত্যের ধারা-প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ

‘প্রমিত ব্যাকরণে’ শব্দশ্রেণি ৮ প্রকার- ১. বিশেষ্য, ২. সর্বনাম, ৩. বিশেষণ, ৪. ক্রিয়া, ৫. ক্রিয়াবিশেষণ, ৬. যোজক, ৭. অনুসর্গ, ৮. আবেগশব্দ। লক্ষ করুন- সংস্কৃত ব্যাকরণের ধারায় আমরা পদ ৫ প্রকার জানতাম। আসলে তা শব্দশ্রেণি। এখন বাংলা ব্যাকরণে যথার্থ রীতি শব্দশ্রেণিই আমরা শিখব। এখানে এসে তা ৮ প্রকার হয়েছে। ঠিক তেমনি বাংলা ব্যাকরণে সমাস ৪ প্রকার। যথা- ১. বন্ধন সমাস, ২. বর্ণন সমাস, ৩. কারকলোপী সমাস, ৪. অন্যার্থক সমাস। প্রত্যয়ও প্রধানত ২ প্রকার- ১. আদ্যপ্রত্যয়, ২. অন্ত্যপ্রত্যয়।

পুরোনো সংস্কৃতজাত বাংলা ব্যাকরণের সাথে স্বকীয়জাত প্রমিত বাংলা ব্যাকরণের পার্থক্যের অল্প কিছু উদাহরণ দিলাম মাত্র।

চার:   ২০২৩ সালে প্রবর্তীত নতুন ধারা শিক্ষা ব্যবস্থায় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির বাংলা মূল বইয়ের পাঠে কিছু কিছু করে প্রমিত বাংলা ব্যাকরণের পাঠ দেওয়া হয়েছে। পাঠের অধিকতর সহযোগিতা নেওয়ার জন্য আমি যথাসম্ভব সহজ ও বিবরণমূলকভাবে ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ নামে স্বকীয় ধারার বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করে বাজারজাত করেছি। চেষ্টা করেছি প্রমিতধারার সহজীকরণভাবে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিবাবক, লেখক কিংবা ব্যাকরণ নিয়ে উৎসাহী যে কারোর জন্য খুবই উপকারী ও গুরুত্বপূর্ণ বই এটি।

২৮০ পৃষ্ঠার এ বইটি সুলভ সংস্করণ হিসেবে হোয়াইটপ্রিন্ট কাগজে (অফসেট নয়) ছাপা হয়েছে। ২৮০ টাকা মলাট মূল্যে বিশেষ ছাড় ৩৫% এবং আরও ২টাকা। এতে মূল্য হয় ১৮০ টাকা, ডেলিভারি ৩কপি পর্যন্ত ৫০ টাকা। 01685303388 এই নাম্বারে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে অর্ডার করতে পারেন। যে কোনো প্রয়োজনে বা তথ্য জানতে ইনবক্সে যোগাযোগ করতে পারেন।

আরও পড়ুন–সংজ্ঞা কি? জেনে নিন ২৬ টি বিষয়ের সংজ্ঞা – নাসীমুল বারী

বইটি পড়লে আরও জানতে পারবেন–

বাংলা ভাষার উৎপত্তি , বাংলা ভাষা কাকে বলে,  বাংলা ভাষার আদি নিদর্শনের নাম কি , বাংলা ভাষার মূল উৎস কি, বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে, বাংলা ভাষায় মৌলিক ধ্বনি কয়টি, কোন ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্মসহ একটি পরিপূর্ণ “প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’