You are currently viewing বাংলা ছন্দ আনন্দ (পর্ব-০২):: ছন্দ শেখার পাঠশালা-অধ্যাপক কবি আবু তাহের বেলাল

বাংলা ছন্দ আনন্দ (পর্ব-০২):: ছন্দ শেখার পাঠশালা-অধ্যাপক কবি আবু তাহের বেলাল

ছন্দ বলতে আমরা কী বুঝবো?

আজ আমরা ছন্দ বলতে কী বুঝি বা ছন্দ কাকে বলে- এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো। আগে অভিধানের পাতায় চোখ রাখা যাক: বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে:

ছন্দ- পদ্যবন্ধ, রচনানুবন্ধ, মাত্রা বা তাল, পদ্যের রচনারীতি।
ছন্দের পরিচয় জানতে আমরা কয়েকজন সাহিত্য সমালোচকের কথাকে স্মরণ করতে পারি। যেমন:

ক। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়: “পদ বিন্যাস করিলে বাক্য শ্রুতিমধুর হয়
এবং মনে রসের সঞ্চার হয়, তাহাকে ছন্দ বলে।”

খ। ড.সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়:“বাক্যস্থিত পদগুলোকে যেভাবে সাজাইলে
বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে ভাবগত ও ধ্বনিগত সুষমা
উপলব্ধি হয়, পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিকে ছন্দ বলে।”

গ। তারাপদ ভট্টা…..য :“ভাষার অন্তর্গত প্রবহমান ধ্বনি সৌন্দর্যই ছন্দ।

ঘ। প্রবোধচন্দ্র সেন:“শিল্পীত বাকরীতির নামই ছন্দ।”

খ্যাতিমান পণ্ডিতবৃন্দের মন্তব্যসমূহ বিশ্লেষণ করলে পদ বিন্যাসে একটি সুষম শৃঙ্খলার নামই ছন্দ, যার সাহায্যে ভাব ও অর্থ প্রকাশ যথাযথ হয়। বাক্যের মাধুর্য বিকশিত হয়।

একটু অন্যভাবে আমরা ছন্দ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারি।

ছন্দকে আমরা ইংরেজি Nature শব্দের সাথে তুলনা করে বুঝতে পারি। Nature শব্দকে আমরা প্রকৃতি, স্বভাব বা স্বাভাবিক প্রবণতা, মূল ধরণ বা বৈশিষ্ট্য বলে বুঝতে পারি। Naturally বললে আমরা যেন আমাদের কাঙ্ক্ষিত ছন্দের আবহটা খুঁজে পাবো।

অভিধানে Naturally এর অর্থ করা হয়েছে:

স্বাভাবিকভাবে, স্বভাবত, প্রকৃতিগতভাবে, অবশ্যই, নিশ্চয়ই,আপনা থেকে ,ছলচাতুরী বা কৃত্রিমতা ছাড়া, অকৃত্রিমভাবে।

এই অর্থগুলোর মধ্য থেকে ছন্দের জ্ঞাতিভাই হিসেবে স্বাভাবিকতাকে বিবেচনায় আনতে পারি। পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের স্বাভাবিক কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।

যেমন: আগুনের কাজ দাহ করা, উষ্ণতা প্রদান করা,

পানির কাজ সিক্ত করা, ভিজিয়ে দেয়া, নিচের দিকে প্রবাহিত হওয়া।

আবার এ ছন্দকে প্রতিটি জিনিসের স্বাভাবিক গতির সাথে ভাবা যেতে পারে।

যেমন: রেলগাড়ি চলার একটি স্বাভাবিক গতি আছে, রিদম বা ঝংকার আছে, বাতাসের চলার স্বাভাবিক গতি আছে, নদীর বয়ে চলার মধ্যে একটি স্বাভাবিক গতি আছে, ঘোড়ার চলার স্বাভাবিক একটি গতি আছে। প্রত্যেক জিনিসের চলার যে স্বাভাবিক গতি- মূলত তাই ঐ জিনিসের ছন্দ।

আমরা যে স্থান কাল পাত্র্র ভেদে আমাদের কণ্ঠকে বিচিত্র ভাবে খেলিয়ে মনের আনন্দ,বিষাদ,ক্ষোভ,ঘৃণা,বিস্ময়, ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকি- সেটা্ও আমাদের কথার রিদম, লয় বা ছন্দ।ছড়া,গান,কবিতারও একটা চলন আছে, গতি আছে, গতির স্বাভাবিক রকমফেরও আছে। গদ্যেরও কিন্তু একটা তাল আছে, চলার একটা ঝংকার আছে। তাই গদ্যেরও ছন্দ আছে,প্রকৃতি আছে।

এককথায় পৃথিবীর চলমান বা স্থির প্রতিটি জিনিস (প্র্রাণিবাচক, অপ্রাণিবাচক) ই তার প্রকৃতি অনুযায়ী ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। প্রত্যেকের মধ্যেই ছন্দ আছে। মানব জীবনেরও নানামাত্রিক ছন্দ আছে। শৈশবের ছন্দ, কৈশোরের ছন্দ, তারুণ্যের ছন্দ, যৌবনের ছন্দ, প্রৌঢ়ত্বের, বার্ধক্যের ছন্দ।

জীবনের প্রত্যেক স্তরেই কিন্তু স্বাতন্ত্র্য চাওয়া পাওয়া,বৈশিষ্ট্য বা প্রবণতাও আছে।শৈশবে তারুণ্যের প্রতীক অপ্রত্যাশিত, তারুণ্যে আবার বার্ধক্যের বৈশিষ্ট্য অনাকাঙ্ক্ষিত। জীবনের প্রতিটি স্তরের সাধারণ ধর্ম ও প্রবণতাই জীবনের নানামাত্রিক ছন্দ।

এককথায় পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস, বস্তুর বা প্রাণীর মতোই ছড়া বা গান কবিতার স্বাভাবিক চলার গতিই হচ্ছে। পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে ছন্দ বিরাজ করলেও ক্ষুদ্রার্থে আমরা শুধু ছড়া কবিতার গতি বা ছন্দকে ছন্দ বলে চিনে থাকি। অন্যান্য বিষয়ের ছন্দকে পৃথক পৃথক নামেই জেনে থাকি।

বিষয়টা আরেরকটু খোলাসা করি। যেমন-চরিত্র শব্দটি। মানুষের আচরণই চরিত্র। কারও আচরণ ভালো, গ্রহণযোগ্য। আবার কারও আচরণ মন্দ, অগ্রহণযোগ্য। যার আচরণ ভালো, আমরা তাকে বলি চরিত্রবান। আর যার চরিত্র বা আচরণ মন্দ- তাকে বলি চরিত্রহীন। সমাজে বহুল প্রচলিত ভুল এটি। কোন মানুষই চরিত্রহীন নয় (চরিত্র ছাড়া)। হয়তো সৎ চরিত্রের, নয়তো দুশ্চরিত্রের হবেন। তাহলে বোঝা গেলো- সবারই চরিত্র আছে,কিন্তু ভালো চরিত্রটাকেই কেবল আমরা চরিত্র বলছি।

অনুরূপ ভাবে গদ্য পদ্য, নাটক, উপন্যাস সব কিছুর মধ্যেই ছন্দ থাকলেও আমরা কেবল গান ছড়া কবিতার ছন্দকেই ছন্দ বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।আমার বিশ্বাস: এতোক্ষণে আমরা সবাই ছন্দের ধারণাটা লাভ করতে পেরেছি।

বাংলা ছন্দের প্রকারভেদ:

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সূচনা লগ্ন থেকে অদ্যাবধি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ছন্দ হিসেবে মূলত তিন প্রকার ছন্দের অস্তিত্ব আমরা পাই। বাকী ছন্দ বা ছন্দ প্রকরণ সমূহ এই তিন ছন্দেরই বিবর্তিত রূপ। যা খুব ক্ষুদ্র পরিসরে প্রয়োগ হয়ে থাকে।বিদেশি ভাষা থেকেও কিছু কিছু ছন্দ বা ছন্দরীতি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে।

সাধারণভাবে সর্বাধিক প্রচলিত তিন প্রকার ছন্দ হচ্ছে:
ক। স্বরবৃত্ত ছন্দ
খ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
গ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।

এর বাইরে কমবেশি প্রচলিত যে ছন্দগুলো বাংলা সাহিত্যে প্রয়োগ হয়ে থাকে তার আলোচনা আমরা শেষে দিকে উপস্থাপনে সচেষ্ট হবো।

বহুল প্রচলিত তিন প্রকার বাংলা ছন্দে রচিত ছড়া কবিতার গতি সাধারণত বা চলার স্টাইল সম্পর্কে বলি:
ক। স্বরবৃত্ত ছন্দ সাধারণত দ্রুত লয়ের ছন্দ।
খ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ মধ্য লয়ের ছন্দ।
গ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বিলম্বিত বা ধীর লয়ের ছন্দ।

যে কোন ছড়া কবিতা আবৃত্তি করার সময়, যেকোন গীতি কবিতায় সুরারোপের সময় অতি অবশ্যই লেখাটি কোন ছন্দে লেখা হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে নিতে হবে। নয়তো তা পথ হারাবে বলে আমি মনে করি।লেখার ছন্দটা না ধরতে পারলে আবৃত্তি বা গানের সুর যথাযথ হয় না, সুন্দর হয় না।

এই সহজ কথাটা কিন্তু সহজে কোন আবৃত্তিকারকে, কোন সুরকারকে বুঝানো যাবে না। আবৃত্তিকারকে চেষ্টা করে কিছুটা বুঝানো সম্ভব হলেও সুরকার দেখাবেন তার তাল ও রাগ। বলবেন- সুর করতে আবার ছন্দ মাত্রার হিসাব কী? আমাকে এসব বুঝাতে এসো না। তুমি আমার সুর সাধনায় বিঘ্ন ঘটাবে না মোটেও।

এসব পাগলকে বুঝানোর দায়িত্ব নিয়ে পারা যাবে না। বাংলাভাষা প্রেমিক অনেক পাগল আছেন যারা একবারই ছন্দ মাত্রার হিসাব করতেই চান না। স্বাধীন ভাবে ছড়া কবিতা লিখতে চান, গদ্য কবিতার কথা বলতে চান, মিশ্র ছন্দ বা আধুনিক কবিতার ছন্দহীনতার কথা বলতে চান।

যদিও প্রকৃত আধুনিক কবিদের গদ্য কবিতার ভেতরে ছন্দ আছে যা নির্বোধ গদ্য কবি(!) ধরতে পারেন না। এই ধরতে না পারার অক্ষমতাই তাকে বিভ্রান্ত করেছে। আবার কেউ কেউ ছন্দ মাত্রার মধ্যে থেকে বিধিনিষেধ মেনে ছড়া কবিতা লিখতে পারেন না, কলম ভেঙে যাবার ভয়ে, তারাই ছন্দহীনতার অন্ধকার পথে পা বাড়িয়ে বাংলা কবিতার মসৃণ সুন্দর পথকে পঙ্কিলতায় ভরে দিচ্ছে। এসমস্ত হাতুড়ি ডাক্তারদের হাত থেকে মুক্তি চাই মনে প্রাণে।

বাংলা ছন্দের বিভিন্ন নামকরণ:

বাংলা ভাষার প্রধান তিন প্রকার ছন্দকে(স্বরবৃত্ত ছন্দ,মাত্রাবৃত্ত ছন্দ,অক্ষরবৃত্ত ছন্দ) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছন্দবিশারদগণ ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত করেছেন।অনেকে এই নামের ভিন্নতার কারণে ছন্দ নিয়ে গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে যায়। সেই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার জন্যে প্রধান তিন প্রকার ছন্দকে কে কি নামে অভিহিত করেছেন, তার একটা বিববরণ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। যেমন:

  • প্রথমত স্বরবৃত্ত ছন্দ:
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলা প্রাকৃত ছন্দ
    সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত : চিত্রা ছন্দ
    দ্বিজেন্দ্রলাল রায় : মাত্রিক ছন্দ
    প্রবোধচন্দ্র সেন : দলবৃত্ত ছন্দ
    অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় : দ্রুতলয় বা শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ
  • দ্বিতীয়ত মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সাধু, নূতন ছন্দ
    সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। : হৃদ্যা ছন্দ
    দ্বিজেন্দ্রলাল রায় : মিতাক্ষর,নূতন ছন্দ
    প্রবোধচন্দ্র সেন। : কলাবৃত্ত ছন্দ
    অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়: বিলম্বিতলয় বা ধ্বনিপ্রধান ছন্দ
  • তৃতীয়ত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : সাধু,পুরাতন ছন্দ
    সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত : আদ্যা ছন্দ
    দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: মিতাক্ষর,পুরাতন ছন্দ
    প্রবোধচন্দ্র সেন : মিশ্রবৃত্ত ছন্দ
    অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় : ধীরলয়ের বা তালপ্রধান ছন্দ।

ছন্দ বোঝার জন্যে প্রাথমিক উপাদান।

তিন প্রকার ছন্দ বোঝার জন্যে বা চিহ্নিত করার জন্যে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি উপাদানের সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। অর্থাৎ ছন্দজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠকে আগে আত্মস্থ করতে হবে। তা হলে:
● অক্ষর
● মাত্রা
● পর্ব
● যতি
● অন্ত্যমিল

ক। প্রথম আলোচনায় আসি

অক্ষর বলতে কী বুঝি?

স্বাভাবিকভাবে অক্ষর আর বর্ণ এক মনে হলেও ছড়া,কবিতা,গান লেখার ছন্দ মাত্রার হিসেবে কিন্তু এক নয়।ধ্বনির লিখিত রূপকে মূলত বর্ণ বলা হয়।কয়েকটি বর্ণ মিলে এবং তার সাথে কার-চিহ্ন সহযোগে সাধারণত একটি শব্দ গঠিত হয়।আর এক প্রয়াসে একটা শব্দের যতোটুকু করা যায়,সেই শব্দাংশকেই অক্ষর বলে।

আরেকটি ঘুরিয়ে বলি: অক্ষর মূলত এক প্রয়াসে উচ্চারিত শব্দাংশ। অর্থাৎ ছড়া কবিতা বা গানে ব্যবহৃত শব্দকে আমরা একসাথে উচ্চারণ করি না। বরং ভেঙে ভেঙে কেটে কেটে উচ্চারণ করি। বাংলা বর্ণমালার বর্ণের সাথে অক্ষরকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বর্ণের সাথে যখন কারচিহ্ন যুক্ত হয়ে ধ্বনির সৃষ্টি করে তখনই অক্ষরের সৃষ্টি হয়। সেক্ষেত্রে একাধিক বর্ণ মিলেও কিন্তু একটি অক্ষর পাই। বর্ণকে আমরা letter বলতে পারি এবং অক্ষরকে Syllable বলতে পারি।

এবার বর্ণ ও অক্ষরকে উদাহরণের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করবো। যেমন দেখুন:
ক- এই ব্যঞ্জন বর্ণটি গঠিত হয়েছে- ক+অ এর মাধ্যমে। ধ্বনির লিখিত রূপ হিসেবে ‘ক’ একটি বর্ণ। আবার শব্দের সাথে যখন ব্যবহার হচ্ছে তখন নাম হয়ে যাচ্ছে অক্ষর।

সহজ হবে আরেকটা উদাহরণ দেখলে। যেমন- কনকনে শব্দটি দেখুন। বর্ণহিসেবে এই শব্দটির মধ্যে ৪টি বর্ণ আছে (ক+ন+ক+ন: এই চারটি বর্ণের সাথে অ ধ্বনি এবং এ-কার ধ্বনিও যুক্ত হয়েছে।)।কিন্তু উচ্চারণের অবস্থা অনুযায়ী পাচ্ছি তিনটি অক্ষর (কন্ একটি কনে দুটি) বা Syllable ।

এতোক্ষণে বোঝার কথা: অক্ষরের ধারণাটা পরিস্কারের জন্যে আমরা ইংরেজি Syllable এর সহায়তা নিতে পারি। Syllable কী তবে? Syllable হচ্ছে: এক প্রয়াসে উচ্চারিত শব্দাংশ,যা আমরা অক্ষরের সংজ্ঞাতেও বলেছি। যেমন: Phone এই শব্দের ভেতর পাঁচটি letter আছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে Syllable আছে মাত্র একটি ।

আবার দেখুন Telephone শব্দটি উচ্চারণ করছি Te+Le+Phone (বাংলায় লিখলে: টেলিফোন- টে+লি+ফোন) ইংরেজিতে বললে তিনটি Syllable আর বাংলায় বললে তিনটি অক্ষর রয়েছে টেলিফোন শব্দটির মধ্যে।

আবার দেখুন টেলিফোন (Telephone) বাংলায় লিখলে কারচিহ্ন ছাড়াই চারটি বর্ণ আছে,আর ইংরেজিতে Letter আছে নয়টি।যখন এটাকে অক্ষর বা Syllable হিসেব করবো তখন পাবো মাত্র তিনটি Syllable/ অক্ষর।

অক্ষর এর প্রকার ভেদ:

ইংরেজিতে যেমন Syllableসাধারণত দুপ্রকার:

ক। Open Syllable &
খ। Closed Syllable,

তেমনই বাংলাতেও অক্ষর দুপ্রকার:

ক। মুক্তাক্ষর (Open Syllable)
খ। বদ্ধাক্ষর (Closed Syllable)।

যিনি Syllable বুঝবেন তিনি বাংলার অক্ষরও বুঝবেন। তাই Syllable এর পাঠটা আগে ঝালিয়ে নিই।
Syllable এর সংজ্ঞা আগে আমরা দেখেছি। বাকি আছে Open Syllable এবং Closed Syllable কাকে বলে সেটা জেনে নেয়া।

যে Syllable উচ্চারণের সময় বাতাস কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয় না এবং ধ্বনিকে ইচ্ছেমতো প্রলম্বিত করা যায়-সেই Syllable কে Open Syllable বা মুক্ত Syllable বলে। Open Syllable ই মুক্তাক্ষর। যেমন: Telephone) শব্দের মধ্যে টে+লি ( Te+le) দুটো Open Syllable /মুক্তাক্ষরকে পাঠক ইচ্ছেমতো টেনে টেনে পড়তে পারবেন।

অপরদিকে Closed Syllable সেই Syllable কে বলে-যা উচ্চারণের সময় বাতাস বাধাপ্রাপ্ত হয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেমে যেতে হয়, শ্বাসে তালা লাগানো হয়। যেমন- ফোন (Phone) শব্দটি। এখানে বাতাস বা শ্বাসকে কিন্তু ইচ্ছেমতো প্রলম্বিত করা যাচ্ছে না, প্রলম্বিত করা যাচ্ছে না। থামতেই হচ্ছে : অর্থাৎ ফোন্ বলতে হচ্ছে।তাই ফোন্(Phone) Closed Syllable, বাংলায় বললে বদ্ধাক্ষর।

বদ্ধাক্ষর বোঝার জন্যে আমরা আরবী ভাষার সহযোগিতা নিতে পারি। যেমন: জবর,জের, পেশ যুক্ত হরফই মুক্তাক্ষর বা Open Syllable অপরদিকে সাকিন বা জযমযুক্ত হরফকে Closed Syllable বা বদ্ধাক্ষর বলতে পারি। যেমন: ফাতিহা- ফা+তি+হা = তিনটি মুক্তাক্ষর এখানে। আবার কিতাব- কি+তাব এখানে কি মুক্তাক্ষর কিন্তু তাব্ বদ্ধাক্ষর।

মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরকে চেনার জন্যে আমরা কয়েকটা শব্দ বা আমাদের নামকে ব্যবহার করতে পারি। যেমন:
ক। মালেকা:মা+লে+কা(১+১+১= ০৩),তিনটি মুক্তাক্ষর।
খ। রাহিমা: রা+হি+মা (১+১+১= ০৩), তিনটি মুক্তাক্ষর।
গ। পল্লব: পল্ + লোব্ (১+১=০২) দুটি বদ্ধাক্ষর
ঘ। বন্ধন: বন্+ ধোন্ ( ১+১=০২) দুটিই বদ্ধাক্ষর।
ঙ। বুটিক: বু+টিক্ (১+১=০২) বু-মুক্ত ও টিক্ বদ্ধাক্ষর
চ। হিজল:হি+জোল্ (১+১=০২)হি-মুক্ত ও জোল্ বদ্ধাক্ষর

দেখুন অনেকে সংযুক্ত ব্যঞ্জন এবং বদ্ধাক্ষরকে এক করে ফেলেন বা গুলিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ সংযুক্ত ব্যঞ্জনকেই বদ্ধাক্ষার মনে করে। কিন্তু এদুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছেন। দুয়ের পরিচয়ই পৃথক পৃথক। বদ্ধাক্ষরের পরিচয় আগে দিয়েছি। এখন সংযুক্ত ব্যঞ্জন টা চেনাবার পালা।

সংযুক্ত ব্যঞ্জন হচ্ছে দুটো ব্যঞ্জন বর্ণ একসাথে যুক্তভাবে ব্যবহৃত হওয়া। যেমন: ক্ত, ম্ন,ম্ল, স্ম, হ্ন,হ্ণ, হ্ব, ব্দ, ন্থ প্রভৃতি। শব্দের ভেতরে তবে এদের প্রয়োগটা কেমন হচ্ছে? দেখুন:
শক্ত, রক্ত,চিহ্ন, বহ্নি, অপরাহ্ণ, স্মরণ,স্মৃতি।

এসব উদাহরণ থেকে আমরা বদ্ধাক্ষর ও মুক্তাক্ষর বের করে আনতে পারি। যেমন:
শক্ত: শক্ + তো (শক্ বদ্ধাক্ষর এবং তো মুক্তাক্ষর)
রক্ত: রক্ + তো ( রক্ বদ্ধাক্ষর এবং তো মুক্তাক্ষর)
স্মরণ: শ+ রোন্ (শ মুক্তাক্ষর এবং রোন্ বদ্ধাক্ষর)

দেখতে পেলাম যুক্তব্যঞ্জন ভেঙেই বদ্ধাক্ষর গঠিত হচ্ছে।
আশা করছি, ছড়া,কবিতা ও গানে ব্যবহৃত মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর সম্পর্কে আর কারো ঝামেলা থাকবে না।

এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা সঙ্গত মনে করছি। তা হলো:
ক। মুক্তাক্ষর সব ছন্দেই একমাত্রা বিশিষ্ট হয়।
খ। বদ্ধাক্ষরের মাত্রা গণনায় ছন্দভেদে তারতম্য ঘটে।
যেমন:
০১। স্বরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর সব সময় এক মাত্রা হয়।
০২। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর সব সময় দুই মাত্রা হয়।
০৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের শেষে বদ্ধাক্ষার দুই মাত্রা
হয়।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি খোলাশা করা য়ায়। যেমন: “বন্ধন” শব্দের মাঝে দুটি বদ্ধাক্ষর আছে (বন্+ধন্)।
স্বরবৃত্ত ছন্দে বন্ধন ০১+০১=০২ মাত্রা পেয়েছে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বন্ধন ০২+০২=০৪ মাত্রা হয়েছে।
অক্ষরবৃত্তে বন্ধন ০১+০২= ০৩ মাত্রা পেয়েছে।

উল্লেখ্য: বদ্ধাক্ষর শব্দের শুরুতে এবং মাঝে বসেও তিনটি ক্ষেত্রে দুমাত্রার মর্যাদা লাভ করে। যেমন:
০১। নির্দেশক পদে: লোকটি -২+১=০৩টি মাত্রা
০২। সমাসবদ্ধ পদে: নদনদী-২+১+১=০৪টি মাত্রা
০৩। কথ্য ক্রিয়াপদে: বললাম- ২+২=০৪টি মাত্রা।

নির্দেশক পদ বলতে আমরা সেই পদকে বুঝি যার দ্বারা ব্যক্তি,বস্তু বা কোন জিনিসের নির্দিষ্টতা করণ করা হয়ে থাকে। যেমন ; মানুষটি, হাঁসটি। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একাধিক পদ এক পদে পরিণত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করলে এবং নতুন অর্থ প্রদান করলে আমরা তাকে সমাস বলে চিহ্নিত করে থাকি। যেমন: সিংহ চিহ্নিত যে আসন = সিংহাসন। এই “সিংহাসন” বাংলা শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দ, যার অর্থ সিংহের সাথে নয়, সম্পর্ক রাজা বাদশার সাথে। যারা ক্ষমতার মসনদে আসীন।

বদ্ধাক্ষরযুক্ত সমাসবদ্ধ পদের উদাহরণ: কীটপতঙ্গ (কীট ও পতঙ্গ), দাসদাসী (দাস ও দাসী)। কথ্য ক্রিয়াপদ বলতে কথ্যরীতিতে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদকে বুঝানো হয়। যেমন: করলাম, চললাম। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলোচনায় আমরা এবিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত তুলে ধরবো।

এবার ছন্দে ছন্দে অক্ষরকে আমরা চিনে নিতে পারি:

কাব্যকলায় দুধরণের অক্ষর আছে জানি
মুক্ত এবং বদ্ধ বলে করি টানাটানি।
মুক্তাক্ষরে শ্বাসকে বাড়াও যতো ইচ্ছে কবি-
থমকে গেলে চলার গতি বদ্ধ অক্ষর মানি।

‘বলাকা’তে তিনটি আছে মুক্ত ডানার পাখি
আকাশ পথে যাচ্ছে উড়ে মেঘের আবির মাখি।
এক শিকারী মারতে যে চায় পাষাণ পাথর বড্ড-
অনেক পেলে বদ্ধ-অক্ষর পরাও প্রেমের রাখী।
:
সকল ছন্দেই মুক্তাক্ষরে একটি মাত্রা মোটে
বদ্ধ-অক্ষর লিখতে যতো আপদ বিপদ জোটে।
আজ চুকিয়ে দিই যদি দিই সেই ঝামেলা ঝক্কি-
ছন্দ দোলায় খই ফোটানো চাই সকলের ঠোঁটে।

ছড়া কবিতার অঙ্গনে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরকে আবার কেউ কেউ অন্যভাবে নামকরণ করেছেন: তাদের মতে বাংলা অক্ষর দুধরণের-
স্বরান্ত ও ব্যঞ্জনান্ত বা হসন্ত বা হলন্ত ।

স্বরান্ত হলো মুক্তাক্তর বা Open Syllable এবং ব্যঞ্জনান্ত হলো বদদ্ধাক্ষর বা Closed Syllable হিসেবে পরিগণিত। (চলবে)

 

Leave a Reply