You are currently viewing ফ্যাসিবাদ কি? এরশাদ কেন স্বৈরাচার, হাসিনা কেন ফ্যাসিস্ট? -কমিউনিস্ট ইউনিয়ন
ফ্যাসিবাদ কি

ফ্যাসিবাদ কি? এরশাদ কেন স্বৈরাচার, হাসিনা কেন ফ্যাসিস্ট? -কমিউনিস্ট ইউনিয়ন

ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ ও মেহনতির সংবিধান প্রতিষ্ঠার দাবি তুলুন-

গণমুক্তি ইউনিয়ন কমিউনিস্ট ইউনিয়ন

ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করে রাখতে গত ১৫ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন এক তরফা তফসিল ঘোষণা করেছে। উদ্দেশ্য এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা। এর আগেও ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে এবং ২০১৮ সালে মধ্যরাতের কারসাজির নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে সরকার। এভাবে জগদ্দল পাথরের মত জাতির ওপর চেপে বসে আছে শেখ হাসিনার সরকার। আর এজন্য জারি রেখেছে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন। শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী যুগ। এই জগদ্দলের নীচে চাপা পড়ে আছে ব্যাপক মেহনতি নিপীড়িত মানুষ এবং শাসকদের ক্ষমতাবঞ্চিত অংশ। দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ ও অতিষ্ঠ। এই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে চাইছে। তারা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন উচ্ছেদের জন্য সন্ধান করছে সঠিক পথ, পাশাপাশি বুঝতে চাইছেন দুঃশাসনের কারণ। আর নির্মাণ করতে চাইছেন সমৃদ্ধ দেশ এবং জনগণের বিশেষত মেহনতি জনগণের রাষ্ট্র ও সরকার। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশে চরমভাবে ঘনীভূত রাজনৈতিক সংকট মূলত শাসনতান্ত্রিক সংকট। মর্মে রয়েছে পুঁজিবাদের সংকট একই সঙ্গে পুঁজিবাদ বিকশিত না হওয়ারও সংকট। স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ এরই ফলশ্রুতি। সামরিক শাসনে সমস্যার ধামাচাপা দেওয়া হয়, কিন্তু সমাধান মেলে না। তাই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নটি রাজনৈতিক বিবেচনায় আনা অতিশয় জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে উচ্ছেদ করাই যখন প্রধান রাজনৈতিক করণীয়, তখন অতীতের অনেক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হচ্ছে। কারণ এর আগেও জনগণের আন্দোলনে বার বার শাসকের পরিবর্তন

ঘটেছে। কিন্তু ক্ষমতা চলে গেছে শাসকদের বঞ্চিত অংশের ঘরে, বিজয়ী থেকেছে একই শোষক লুণ্ঠক শ্রেণি। আর ব্যাপক মেহনতি মানুষের ওপরে আগের মতই বহাল থেকেছে শোষণ লুটপাট আর নিপীড়নের খড়গ। এভাবেই বিজয় বেহাত হয়েছে বার বার। মেহনতি জনতা এই পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চায় না।

এবারও জনগণের অভ্যুত্থানে এই ফ্যাসিবাদী সরকারের যদি পতন ঘটে, সেক্ষেত্রে মেহনতিদের বিজয় আগের মতই বেহাত হবে কিনা- সেটা এখনই প্রশ্ন উঠেছে। মেহনতি জনগণের পক্ষে যারা রাজনীতি করছেন, তারা যদি মেহনতিদের স্বার্থে স্বতন্ত্র কর্মসূচি নিতে ব্যর্থ হন, কিংবা সেই স্বতন্ত্র কর্মসূচি ছাড়াই শাসকদের ক্ষমতাবঞ্চিত অংশের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তোলেন অথবা মৌলবাদ জুজুর ভয়ে নানা টালবাহানায় এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চান কিংবা একই কারণে সরকার উচ্ছেদের রাজনীতি থেকে নিজেদের বিরত রাখেন- সেক্ষেত্রে শতাব্দির পুরানো ভুলের বৃত্তেই ঘুরপাক খেতে থাকবে মেহনতির ভাগ্য। বিপরীতে জনগণের ভাষা বোঝার অক্ষমতা নিয়ে ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে এক পর্যায়ে নিঃশেষ হওয়ার পরিণতির দিকেই ধাবিত হবে ‘প্রগতির শক্তি’। জনগণের বিজয় বেহাত হওয়া না হওয়ার শর্ত এখানেই নিহিত রয়েছে।

মেহনতির স্বার্থে ভ্রুণ আকারে হলেও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে থাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও তা এখনও দৃশ্যমান নয়। আমাদের মতে, মেহনতির রাজনৈতিক করণীয়ের উদ্দেশ্য হওয়া দরকার ফ্যাসিস্ট সরকারের উচ্ছেদের ধারায় ব্যাপক মানুষের স্বার্থের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার রাজনীতি

জোরালোভাবে সামনে আনা। এসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে বা আড়ালে রেখে সবাই মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন উচ্ছেদের রাজনীতি একটি চির পরিচিত পথ। যে পথে এরশাদ স্বৈরাচারকে বিদায় করা গেছে। এতে আপাত স্বস্তি মেলে, এক সরকারের দীর্ঘদিনের পীড়ন থেকে জনগণ আপাত নিষ্কৃতি পায়, শাসকদের এক অংশের বদলে আরেক অংশের ক্ষমতায়ন ঘটে, কিন্তু নিপীড়িত মেহনতি মানুষের মুক্তি মেলে না। তাদের মুক্তি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এভাবে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনকে উচ্ছেদ করা গেলে, উচ্ছেদের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ ও বহাল থাকবে শোষণমূলক, দমন- পীড়নমূলক রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান। যে সংবিধান দেশের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন ও স্বৈরতন্ত্রের জন্মদাতা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালেই বিষয়টি সামনে আনার দরকার ছিল, কিন্তু আনা হয়নি।

পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবারও কি সেই পুরানো ভুল হবে? বার বার কি নিপীড়িত মেহনতি মানুষ একই ভুল করবে? এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই চূড়ান্ত সময়, যে সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন–প্রতিবাদ হিসেবে ‘বয়কট’ কেমন কর্মসূচি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আলাপ

এরশাদ কেন স্বৈরাচার, হাসিনা কেন ফ্যাসিস্ট?

এরশাদ স্বৈরাচার ছিল, কারণ তিনি বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় এসেছিলেন, এটা অপরাধ। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে শোষণ লুণ্ঠন করেছেন। গুটি কয়েক দালাল ও ক্লান্ত-বিপ্লবী ছাড়া ছাত্র, শ্রমিক, গণমাধ্যম ও দেশের মূল ধারার বুদ্ধিজীবী তার পক্ষে ছিল না। নয় বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের তাকে উচ্ছেদ করা গেছে।

আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের এজেন্সি নিয়ে রাজনীতি করছে আওয়ামী লীগ, আর ধর্মের এজেন্সি নিয়ে আছে বিএনপি-জামাতসহ বেশকিছু দল। শত তৎপরতা সত্ত্বেও এই ‘এজেন্সি’র সামান্যই ভাগে পেয়েছিল এরশাদ। তাই জনগণের আবেগ অনুভূতির সঙ্গে প্রতারণা করার আর কোনো বিষয় তিনি আবিষ্কার করতে পারেননি। ফলে প্রতারণা করে, বিভ্রান্ত করে জনগণের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। তা না হলে এরশাদেরও ফ্যাসিজমের ভিত্তি তৈরি হত। অপরদিকে, হাসিনার সরকার একবার ক্ষমতায় এসেছিল বিনা ভোটে, আরেকবার এসেছিল মধ্যরাতের কারসাজিতে, এটা শুধু অপরাধই নয়, এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও শঠতা।

হাসিনার ফ্যাসিস্ট হওয়ার কিছু ভিত্তি

ক. ‘৭৫ এর পর থেকে বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টির টানা দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে জনগণ। সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে বামপন্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুক্তিযুদ্ধের নামে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাদের নীরব ও সরব, কখনো প্রকাশ্য কখনো অপ্রকাশ্য সমর্থন লাভ করে শেখ হাসিনার সরকার। এতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর এই সরকারের একচ্ছত্র ‘মালিকানা’ তৈরি হয়। এই সুযোগে তারা ইচ্ছেমত মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামীকরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তৈরি করেছে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান। তারা এটা বোঝাতে চাইছে, ‘দেশটা আমরা স্বাধীন করেছি, তাই এটা আমাদের বাপ-দাদার তালুক সম্পত্তি।’ এটা ফ্যাসিবাদের ভিত্তি নির্মাণ করছে।

এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য বামপন্থীরা এখনও সরকার উচ্ছেদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে একমত হতে পারছেন না। এদের

একাংশ ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদের জন্য ঝুকে পড়ছেন বিএনপির দিকে, আরেকাংশের এখনও মোহমুক্তি ঘটেনি, তাদের আশঙ্কা সরকার উচ্ছেদে যদি মৌলবাদের ক্ষমতায়ন ঘটে? ব্যাপক মেহনতি জনতাকে রাজনৈতিক আন্দোলনে টেনে আনতে না পারলে সেই বিপদের আশঙ্কা অবশ্যই আছে। কিন্তু সত্যটা হল, এই ব্যাপক মেহনতি জনতাকে রাজনৈতিক আন্দোলনে (এখানে অর্থনৈতিক আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে না) সামিল করতে না পারলে বামপন্থার রাজনীতি দাঁড়াবে না, আর ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ সুদূর পরাহতই থাকবে। ব্যাপক মেহনতি জনতাকে রাজনৈতিক আন্দোলনে টেনে আনার এখনই উর্ধ্বর সময়। কিন্তু সেটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে যারা নিরাপদ আন্দোলনের রুটিন ওয়ার্কে ব্যাপৃত থাকছেন, এভাবে বিএনপি জামাত ঠেকানোর তাদের এই মনোভাব আওয়ামী লীগ সরকার তথা ফ্যাসিবাদের প্রতি মৌন সমর্থন তৈরি করছে। আর এই সমর্থনের কারণে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংখ্যক জনগণের আবেগ অনুভূতি এখনও আওয়ামী লীগের দ্বারা প্রতারিত হতে পারছে। সরকার মুক্তিযুদ্ধকে শাসন- শোষণ-লুণ্ঠন এর কাজে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে। এটা বন্ধ করার একমাত্র গ্যারান্টি হল মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য নির্মাণ করা। মুক্তিযুদ্ধের পতাকা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া। সেই কাজ জরুরি কিন্তু দৃশ্যমান নয়। সেই কাজ করতে পারে দেশের একমাত্র বাম প্রগতিশীল শক্তি।

খ. সামরিক বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও আইন- শৃঙ্খলাবাহিনী হলো রাষ্ট্র, কিন্তু এরা সরকারের সঙ্গে একাকার। একটি উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক কে? থানার দারোগা নাকি কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা? এটা চিনতে মানুষ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে

যায়। রাষ্ট্র, সরকার ও দল এখন একাকার হয়ে আছে। এই সুযোগে আমলারা সরকারের কাছ থেকে আদায় করছে অন্যায় স্বার্থ। আর অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করে পার পেয়ে যাচ্ছে। সরকারও আমলাদের অনিয়ম দুর্নীতির অলিখিত অনুমোদন দিয়ে নির্মমভাবে দমন করছে বিরোধীদের। এই পরিস্থিতি আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশ। এভাবে তারাও সরকারের ফ্যাসিস্ট হওয়ার ভিত্তি তৈরি করছে।

গ. অপরদিকে, সরকারের সমর্থনে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। মাত্র কয়েকটি জায়ান্ট কোম্পানি নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে নিত্যদিন বাড়িয়ে দিচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। সরকার এদের অন্যায়কে সমর্থন দিচ্ছে, বিনিময়ে এরাও সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। আর মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে। মধ্যবিত্ত টিকতে পারছে না, মেহনতিরা দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। কৃষিপণ্যের বাজারও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। এভাবে দেশের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সরকারকে টিকিয়ে রাখছে এবং সরকারের ফ্যাসিস্ট হওয়ার ভিত্তি নির্মাণ করছে।

ঘ. বিএনপি জামাত ধর্ম (ইসলাম) নিয়ে রাজনীতি করে। সেই পতাকা কেড়ে নিতে মরিয়া ছিল আওয়ামী লীগ। সে কাজে সফল। দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া, ৫৬০ টি মডেল মসজিদ নির্মান সহ বহু পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে সরকার। সরকারের পক্ষে আছে হেফাজতে ইসলাম আর বোল-পাল্টানো জামাতিরা। অপরদিকে, ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে অমুসলিমদের সঙ্গে চলছে প্রতারণা। সকল ধর্মীয় শক্তির বড় অংশ এবং তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তির প্রধান অংশ এখন সরকারের পকেটে। এরাও ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। বিনিময়ে তারাও হাতিয়ে নিচ্ছে নানা অবৈধ সুযোগ সুবিধা।

ঙ. সরকারের পক্ষে শক্তভাবে আছে বিরাট সংখ্যক উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী, গণমাধ্যমকর্মী ও টকশোজীবী। প্রকাশ্যে এরা কেউই সরাসরি আওয়ামী লীগ করেন না। এদের কাজ হল মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান তৈরি করা এবং সরকার যা যা করছে তাকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে ভালো বলে উপস্থাপন করা। পাশাপাশি সরকারের ‘বিকল্প নাই’ তত্ত্ব হাজির করা। যা সরকারকে ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী করার মনস্তত্ত্ব তৈরি করে। এদের অধিকাংশই বিপ্লব-ক্লান্ত সাবেক বামপন্থী। অপরদিকে, সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের নামে একাংশ, ধর্মের নামে আরেকাংশ এখনও মানুষকে প্রতারণা করে চলছে। এরা সবাই এখন গণবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই গণবিরোধী শক্তি ধর্মের নামে এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে সরকারকে সমর্থন দিয়ে দেশে যথেচ্ছ লুটপাট করে চলেছে।

এর আগে কখনও রাষ্ট্র-প্রশাসন-সরকারকে একাকার হতে দেখা যায়নি। এভাবে কারো পক্ষেই গণমাধ্যম, ধর্মীয় শক্তি ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং বিপ্লব-ক্লান্ত বিরাট সংখ্যক সাবেক ও বর্তমান বামপন্থীদের নিজের সমর্থনে এক করা সম্ভব হয়নি। এভাবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারের সমর্থনে এক হয়নি। দলের বাইরের এসব মুখোশধারী গণবিরোধী শক্তিই ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। এরা ইতোমধ্যেই গণশত্রু ও জাতীয় শত্রু হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এরা শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য।

বন্ধুগন

সরকারের অবাধ লুটপাট ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। রিজার্ভ কমতে কমতে এখন তলানীতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (আইএমএফের বিপিএম-৬) হিসাবে গত ১৫ নভেম্বর ২০২৩, তারিখে রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন কোনো ক্রমেই তা ১৫ বিলিয়নের নীচে নামানো যাবে না। না হলে অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথা বলেছেন তারা।

অপরদিকে, মূলধন ঘাটতিতে আছে ১৫ ব্যাংক। এর পরিমাণ ৩৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ঋণ রয়েছে জিডিপির ৪০ শতাংশ। এমন পরিস্থিতি দেশে কখনও দেখা যায়নি। দেশের ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৪০টিই নগদ টাকা ধার করে চলছে। মুদ্রা বাজারে তারল্য সংকট চলছে। তারল্য সংকট মেটাতে গত ৬ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে এসব ব্যাংকসহ দুটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক দিনেই সর্বোচ্চ ২৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা ধার নিয়েছে।

ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলা হচ্ছে উন্নয়নের কথা। বড় বড় মেগা প্রকল্পের গল্প শুনিয়ে ক্ষুধার্তকে ঘুম পারাতে চায় সরকার। পরিবেশ ও জনকল্যাণকে বিবেচনায় না আনা এসব উন্নয়ন স্বস্তির বদলে দুর্ভোগ তৈরি করছে। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। অপরদিকে সরকারের আর্শিবাদপুষ্টদের হাজার হাজার কোটি টাকা বসিয়ে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে।

যে কোনো দেশে মার্কিনীরা তাদের একচ্ছত্র স্বার্থ দাবি করে, তার ব্যত্যয় ঘটলে নানা ধরণের মানবিকার ক্ষুণ্ণের অভিযোগ তোলে, এমনকি স্যাংশনও দিয়ে থাকে। কিন্তু সৌদি আরবের মত রাজতন্ত্রে থাকা দেশে তাদের মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয় না, কারণ সেখানে তাদের স্বার্থ শতভাগ অক্ষুণ্ণ রয়েছে। সম্প্রতি এই ফ্যাসিবাদী সরকার পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাসহ নানা স্যাংশনের কবলে। সরকারের উপকারভোগীরা অবাধ লুটতরাজ করে সেই অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্নদেশে পাচার করে রেখেছে। গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। আমেরিকায় পাচার করা সেই অর্থ ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ইঙ্গিত দিয়েছে দেশটি। এতে চোরের ওপর বাটপারির মত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যাবে হোয়াইট হাউজের তহবিলে। এসব কারণে ক্ষমতাবঞ্চিত অংশ খুব উৎফুল্ল হলেও ওই অর্থ বাংলাদেশের জনগনের। আমাদের দাবি, অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের জনগনের সম্পদ লুটের টাকা বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশের জনগনের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে। এই দাবিতে সোচ্চার হওয়া দরকার।

এছাড়া ইতিহাস আমাদের এটাও দেখিয়ে দেয় যে, বাইরের প্রভাবশালী শক্তির হস্তক্ষেপে গণবিরোধী শাসক বিদায় হলে, পরে সেই প্রভাবশালীর প্রভাব এত বেড়ে যায় যে, তার পরিণতি সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে আর কে বেশি জানে। একারণে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে বাঁচাতে ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদের দায় নিতে হবে দেশের জনগনকে, বিশেষত মেহনতি জনগণকে। কারণ মেহনতিরা নিজেকে মুক্ত করতে গিয়ে, নিপীড়িত সকল শ্রেণিকেই মুক্তি দিতে জানে।

প্রিয় ভাই বোনেরা

পরিবর্তনমুখি বাস্তবতায় আমরা মেহনতিদের স্বার্থে সংবিধান সভার নির্বাচনের দাবিতে স্বতন্ত্র কর্মসূচি নিয়ে হাজির হয়েছি। যা ২০১৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বলার চেষ্টা করছি। আমরা সবাই জানি, বর্তমানের সংবিধান প্রণয়ন করেছে যে গণপরিষদের সদস্যরা, তারা ১৯৭০ সালে কুখ্যাত ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার ৫ দফার এলএফও’র শর্তে মোচালেকা দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারা একটা স্বাধীন দেশের উপযোগী সংবিধান প্রণয়নের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না। যার কারণে মূলনীতি, ঘোষণা ও প্রস্তাবনায় ভালো ভালো কথা থাকলেও, ওই সংবিধান মূলত ব্রিটিশের সৃষ্ট ও পাকিস্তানের পরিত্যক্ত একটি ঔপনিবেশিক কাঠামোর রাষ্ট্রকেই অনুমোদন দিয়েছে। এই সংবিধান কেড়ে নিয়েছে ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বার স্বীকৃতি। এই সংবিধান সকল স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা, প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে সীমাহীন ক্ষমতা। সংবিধানে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার করে পার পাওয়া যায়, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের অনুমোদন মেলে। সুতরাং একটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে জনগনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়, এমন একটি সংবিধান প্রয়োজন। সেই নিরিখে আমাদের দাবির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:

১. শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িতকা বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তির তথা ওই আন্দোলকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের দ্বারা একটি বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন

করতে হবে। যে সরকার বর্তমানের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন বাতিল করবে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থক বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। প্রবাসীসহ পেশাজীবীদের নির্বাচিত প্রতিনিধির দিয়ে সংসদের আরেকটি কক্ষ গঠন করবে।

২. বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জনগনের সম্পদ আত্মসাৎকারী, দুর্নীতিবাজ, ভোটাধিকার হরণকারী ও হত্যাকারীদের বিচার কাজ শুরু করবে। তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, ভোটাধিকার বাতিল ও সম্পত্তি

বাজেয়াপ্ত করবে।

৩. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রচারণার ব্যবস্থা করবে এবং ব্যক্তিগত প্রচারণা অতিশয় সীমিত করে দেবে। একজন মজুরের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জামানতের ব্যবস্থা করবে। নির্বাচনে পেশি শক্তি, অর্থ ও ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ ও কঠোরভাবে দমন করা হবে। নির্বাচনী বিধিমালা ভঙ্গকারীর প্রার্থীতা বাতিল করা হবে। প্রবাসীদের অনলাইনে ভোট দানের ব্যবস্থা করবে এবং গণপরিষদে তাদের নির্ধারিত আসন রাখার ব্যবস্থা করবে।

৪. বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মসূচি: (ক) পরিবেশবান্ধব

কলকারখানা গড়ে তোলা, বন্ধ কলকারখানা আধুনিকায়ন করে চালু করা। বৃহৎ কলকারখানা, ভূমি, ব্যাংক, বীমা, বৃহৎ খাদ্য ব্যবসা, বৃহৎ শিক্ষা ব্যবসা, বৃহৎ চিকিৎসা ব্যবসা ও কৃষিজমি (ক্রমন্বয়ে) জাতীয়কারণ করা। ক্ষেতমজুরদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা, সর্বনিম্ন মজুরি ও সর্বোচ্চ বেতন ক্রমান্বয়ে সমান করে আনা। ক্ষেতমজুরসহ সকল খাতের শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দেওয়া। (খ) যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত গোপন চুক্তি জনগনের সামনে প্রকাশ করা এবং অমর্যাদাকর ও গণবিরোধী সকল চুক্তি বাতিল করা, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা আদায় করতে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের শরান্নপন্ন হওয়া, সীমান্ত হত্যা ও চোরাচালান বন্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া। (গ) ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, নারী-পুরুষের সমধিকার ও সকল জাতির ভাষার সমধিকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া। রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠন করে ধর্মীয় অনুদানের অর্থ জমা রাখা, সেই অর্থ সমাজের মূলশ্রোত থেকে বিচ্যুত ও পশ্চাৎপদ অংশের হিতার্থে ব্যয় করা। (ঘ) বিচারবহির্ভূত হত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। সামরিক বাহিনীতে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য হত্যা ও গুমের বিচার করা, উৎপাদনমুখি, গণবান্ধব ও আত্মমর্যাশীল সেনাবাহিনী গঠন। সৌদি যুদ্ধ জোট থেকে

বেরিয়ে আসা।

৫. বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচিতরা একটি গণপরিষদ গঠন করবেন। যে গণপরিষদ মেহনতি নর-নারী, নিপীড়িত নারী সমাজ, ক্ষুদ্র জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করবেন এবং বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদক্ষেপসমুহ এগিয়ে নেবেন। সেই গণপরিষদের অধীনে নিম্নকক্ষে জাতীয় গণসংসদ এবং উচ্চ কক্ষে পেশাজীবী প্রতিনিধিরা নির্বাচন হবেন। নির্বাচিতরা বিনামূল্যে বা নামে মাত্র মূল্যে নাগরিকের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান কাজের অধিকার ও বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। সারাবিশ্বের মেহনতি নর-নারী ও নিপীড়িত জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে সংহতি প্রতিষ্ঠা করবে। আত্মমর্যাদাশীল জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের সহযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানে নেতৃত্ব দেবে। সুখি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে