You are currently viewing তাহমিদা জান্নাত এর মৃত্যু ও তার শেষ যবনিকার আর্তনাদ
তাহমিদা জান্নাত এর মৃত্যু

তাহমিদা জান্নাত এর মৃত্যু ও তার শেষ যবনিকার আর্তনাদ

তাহমিদা জান্নাত এর মৃত্যু

-আবদুস সামাদ

তাহমিদা জান্নাত, উঠতি বয়সের এক উদ্দ্যেমী, উৎসাহী তরুনী। মায়াবী চেহারা, ভাল ছাত্রী, বাবা,মা, প্রতিবেশী, স্কুলের স্যার, ম্যাডাম সকলের কাছে প্রিয়। তার মুখে ফুটে থাকতো হাসির ফোয়ারা। না কখনো কাউকে সে কষ্ট দেয়নি। ফেবু’র তালিকায় সে ছিল সবার ভাল বন্ধু, তার লাইক, সুন্দর মন্তব্য ছিল পরামর্শ মুলক। মৃত্যু

শেষ যবনিকার আর্তনাদ

সকলের অগোচরে ফেবু’র এক বন্ধুর শেয়ারে এক মর্মান্তিক ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাহমিদা জান্নাতের হৃদয় বিদারক উপস্থাপনাটি পৃথিবীতে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মানুষের জন্য শিক্ষার দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। নশ্বর, ভঙুর, অস্থায়ী, ক্ষয়প্রাপ্ত মাটির ধরায় লাগামহীন আধুনিক, প্রগতির উপর ভর করে উঠতি বয়সের যুবতী, যুবক, মাঝ বয়সী নারী, পুরুষেরা যে পরিবেশের অবতারনা করছে তা নুতন প্রজন্মদের উৎসাহিত করছে বলেই মনে হয়।

নোংরামী, নষ্টামী যে হারে বেড়ে চলছে বা মানুষেরা জড়িয়ে যাচ্ছে তা দেখে মনে তাতে সীমাহীন ছাওয়াব অর্জনে প্রতিযোগীতা চলছে, অন্যদিকে মনে হয় পৃথিবীর মাটিতে তাদের আগমন ঘটেছে চিরদিনের জন্য। এখান থেকে কাউকে কোনদিন ফিরে যেতে হবেনা। রঙিন পৃথিবীর গোলক ধাঁধাঁয় জীবনের উদ্দ্যেশ্যে ভুলে অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বেপরোয়া জীবন-যাপনে ঝাপিয়ে পরে, সেই সাথে বাস্তবতা, মৃতু, কবর, হাশর, কিয়ামত, শেষ বিচারের ভয়াবহতা ভুলে নীতিহীনতার দিকে প্রতিযোগীতার পাল্লায় এগিয়ে যাচ্ছে।

এইসব মানুষের অন্তর্দৃষ্টিতে ঘা মেরে বাস্তবতা প্রমান করে গেলো আমার বন্ধুর বন্ধু তাহমিদা জান্নাত। ঘটনাটি এতই মর্মান্তিক, কষ্টদায়ক, লোমহর্ষক যা মানুষের হৃদয়কে ছুয়ে যায়। আর তার শেষ ও চিরন্তন বিদায়ে যে, অনুভুতি প্রকাশ করেছে তা নিঃসন্দেহে এক শিক্ষনীয় বিষয়। তাহমিদা জান্নাতের কষ্টের অনুভুতি আমার সমস্ত স্বত্বা, অনুভুতিতে আঘাত হানে এবং আমি নির্বাক ও স্তম্ভিত হয়ে পরি, তাহমিদাকে আমি কখনো দেখিনি, সে পৃথিবীতে বেঁচেও নেই, আর কোনদিন তার সাথে দেখাও হবেনা, শেষ যবনিতার পুর্বে তার আন্তরিক প্রত্যাশা, প্রাপ্তি আর না পাওয়ার বেদনা যে ভাবে এঁকে গেছে সে কারণে আমার মানসপটে অ………..নে……….ক দিন জাগ্রত থাকবে। কষ্ট পাবো, হয়ত বা সকলের অজান্তে অব্যক্ত বেদনায় চোখে অশ্রু ঝরবে। কেন জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি যে তাহমিদা বাস্তবতা বুঝতে পেরেছিল। আমার তনুমনে অনুভব করি চরম শীতলতা। অবশ হয়ে আসে আমার দেহ। দু’চোখে ভেসে ওঠে অন্ধকারাচ্ছন্ন গোটা জীবনের ব্যর্থতা। ধ্বংস ও ক্ষয়প্রাপ্ত দুনিয়ার নির্বোধ চিন্তা চেতনা থেকে ফেরানো ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেকে ফিরিয়ে সুšদর করে কোরআন-সুন্নাহর ালোকে জীবন সাজাতে পারি, এই ইচ্ছায় তাহমিদার ডায়রী থেকে সংরক্ষিত উদ্বৃতিগুলো হুবুহু তুলে দিলাম। আশা করি যা আমাদের অন্তর্চোখের পর্দা উন্মোচন করবে।

.৭-৩-২০১৩……… মৃত্যু

আজ আমার ক্যান্সার জীবনের সপ্তম দিন । খবরটা আব্বু আম্মু আমাকে দেয়ার সাহস করে নাই । সারিন আমাকে জানায় আমার লিউকেমিয়া । কিভাবে নিব ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না । আমিতো ক্যানসারকে চাই নাই । তাহলে সে কেন আসলো আমার কাছে । আমিতো অন্য কাউকে চেয়েছিলাম… যাহা পাই তাহা চাইনা ।

১৩-৭-২০১৩……… মৃত্যু

শেষ পর্যন্ত স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হল আমার । ব্লিডিং বেড়ে যাচ্ছে । কি অদ্ভুত ! একসময় জ্বরের ভান করে পড়ে থাকতাম । আর এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য সুস্থ থাকার অভিনয় করতে হয় । পোয়েটিক জাস্টিস । ক্যান্সার মনে হয় একটা মানুষের অতীতের সব খোজ খবর নিয়ে আসে । এই যে একসময় বৃষ্টি ভালো লাগত না । কিন্তু এখন যেন বৃষ্টিকেই আপন মনে হয় । রোদ অসহ্য লাগে । রোদ আমাকে আমার অক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয় ।

২২-৯-২০১৩……… মৃত্যু

আজ আমার বন্ধুরা আমাকে দেখতে এসেছিল । ঐশি, মৌমিতা,সানি, রিয়ান । অনেকদিন পর একটা ভালো সময় কাটালাম । কিন্তু কোথায় যেন সুরটা কেটে গেছে । আমি জানি ওরা আমায় প্রচন্ড ভালোবাসে । সানি আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছিল না। লজ্জায় বোধ হয় । সম্পর্কটা শেষ হয়েছে প্রায় তিনমাস । আমার ক্যান্সারের কথা শুনে সানিই আস্তে আস্তে দূরে সরে যায় । আমি জানি ও আর মৌমিতা প্রেম করা শুরু করেছে । খারাপ লেগেছে ওরা আমাকে খোলা মনে ব্যাপারটা জানালেই পারত। সত্যি কথা শোনার অধিকার কি থাকেনা একজন ক্যন্সার রোগীর । সবাই এমন অভিনয় করে কেন ?

১৬-১-২০১৪………

অনেক দিন লিখিনি । অনেক দেরি হয়ে গেছে । রোগটা আমাকে গ্রাস করে ফেলছে । ইদানিং সানিকে খুব মনে পরে । ওকে ফোন দেই ধরেনা । ক্যান্সার তো ছোঁয়াচে না । তবে কেন এত অবহেলা । আজকাল রিসানের সাথে কথা বলে সময় কাটে আমার। ছেলেটার সাথে আমার ফোনে পরিচয় । কোন শর্ত ছাড়াই ভালোবাসে আমায় । কিন্তু আমার কিছু করার নেই । একজন ক্যান্সার রোগীর

কাউকে ভালোবাসার কিংবা কারো ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই ।

আরও পড়তে পারেন–৬৪ জেলার ট্যুরিস্ট স্পট । tourist spot in bangladesh

২৬-১-২০১৪……… মৃত্যু

দ্বিতীয় কেমো দিতে বাসায় আসলাম । চুলের ব্যপারে সবসময় একটু বেশি খুত খুতে ছিলাম আমি । নতুন নতুন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু কন্ডিশনার কিনতাম । এখন আর ওসবের প্রয়োজন হয়না । চুলই নেই, শ্যাম্পু দিয়ে কি করব । কাজের বুয়াকে বলে ড্রেসিং টেবিলটাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি । আয়নায় তাকাতে ভালো লাগেনা । এদিকে আব্বু আম্মুর মধ্যে ঝগড়া বেড়েই চলেছে দিন দিন

। এই সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না আমি জানি । ওইদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আব্বু আমার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে । ভালোবাসার বিযয়ের এ কি পরিণতি ! ভালোবাসার থেকে বোধহয় ক্যান্সারও ভালো…

২-২-২০১৪………

২৬ ঘন্টা পর আমার জ্ঞ্যান ফিরল । রিসানের সাথে ঝগড়া করলাম অনেকক্ষন । ওর সাথে ঝগড়া করতে আমার ভালো লাগে । ঝগড়া করার কেউ থাকা লাগে জীবনে । না হলে বেঁচে থাকাটাই বৃথা…

১৩-৩-২০১৪……… মৃত্যু

গত ৪৮ ঘন্টায় আমায় নিয়ে যমে ডাক্তারে টানাটানি হয়েছে । আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছি ডাক্তাররা যাতে জিতে । কিন্তু জানি শেষ পর্যন্ত জয়টা ক্যান্সারের হবে । লিখার শক্তি পাচ্ছিনা… সানিকে অনেক মিস করছি । যদিও মিস করাটা উচিত না । ক্যান্সার রোগীদের কাউকে মিস করার অধিকার নেই…

২৫-৫-২০১৪………

এই লিখাটাই বোধহয় আমার শেষ লেখা হতে যাচ্ছে । শেষ শক্তিটুকু জমিয়ে লিখাটা লিখছি । আমার রেখে যাওয়া জিনিসের মধ্যে ডায়রিটা রিসানের ভাগে পড়েছে । ছেলেটার মধ্যে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা আছে । ও অনেক ভালো থাকুক । লিখতে লিখতে চোখের কোণে জল জমে একফোটা । এই জলটা কার জন্য । জানিনা । খুব মিস করব । বাবা মাকে, আমার ছোট্ট বোনটাকে । বন্ধুদের মিস তো করবই । সানি ভালো থাকুক । স্কুলের সামনে যে মামাটা আচার বিক্রি করত, তাকেও মিস করব অনেক । আচ্ছা, স্বর্গে কি আঁচার বিক্রি হয় ? মনে হয়, না। আরেকটা দিন বেঁচে থাকার শখ ছিল । আফসোস ! যাহা চাই তাহা পাইনা………………………

অবশেষে তাহমিদা জান্নাত তার দুইদিন পরে মে মাসের ২৭ তারিখে তার বেচে থাকার যুদ্ধটা শেষ হয়। কিন্তু ! চেতনার সাথে নয়, অচেতন, নির্জীব, নিথর, জড় পদার্থের মত। কোন সাড়া ছিলনা, শব্দ ছিল না। নড়া-চড়া ছিলনা। তার জন্মগত সুত্রে পাওয়ার সবই যেমন, শরীর, অঙ্গ-প্রতঙ্গ, দেহ,মন, আত্না পুর্ববৎ ছিল কিন্তু; আল্লাহ তার হুকুমে অকেজো করে দিয়েছেন তাই সে আর কিছু লিখতে পারে নাই, বলতে পারে নাই, কষ্ট বুঝাতে পারে নাই, একটা দিন বাচার সখ আল্লাহ পুরন করেছেন তবে সে বেচে থাকার কোন স্বার্থকতা পেয়ে নয় অথর্ব মুল্যহীন জীবন নিয়ে।

তাকে ভালবাসার মানুষের অভাব ছিলনা, সবার কথা ছেড়ে দিলেও বাবা, মা’কেতো আর বাদ দেয়ো যায় না। অকুত্রিম বন্ধু, প্রাণের বান্ধবী, ডাক্তার তার পাশে ছিল, কিন্তু পৃথিবীর চিরন্তন নিয়মের হাতছানি নির্মম যমকে কেউ রুখতে পারেনি। কারণ এই ক্ষমতা তার হাতেই নিয়ন্ত্রিত যিনি সকল জীবকে সৃষ্টি করেছেন। হে, পৃথিবীবাসী আমাদের সব কিছু যার হাতে বন্দি ! তাকে উপেক্ষা করে জীবন-যাপন করা বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। তারপরও আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তাহমিদার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে দাখিল করেন। কারণ পৃথিবীর বুকে প্রাপ্ত কষ্টের শেষ আছে, কিন্তু ! আখেরাতের কষ্টের সীমাহীন…………………………………

সিরাজগঞ্জ

২২-০৮-১৫ ইং