আল-কুরআনে জালিমদের পরিচয় ও ভয়াবহ পরিণতি
আলহামদুলিল্লাহ, আজকে জুমআতে “আল-কুরআনে জালিমদের পরিচয় ও ভয়াবহ পরিণতি” নিয়ে আলোচনা করলাম। জালিম কারা
নিম্নে সংক্ষেপে এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার না করাঃ
وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ
আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার-ফায়সালা করে না তারাই জালিম’ (সূরা মায়িদা : ৪৫)।
সাক্ষ্য গোপন করাঃ
ؕ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ کَتَمَ شَهَادَۃً عِنۡدَهٗ مِنَ اللّٰهِ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۴۰﴾
আপনি বলে দিন, তোমরা বেশি জানো, না আল্লাহ বেশি জানেন? যে ব্যক্তি সাক্ষ্য গোপন করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে?’ (সূরা বাকারা : ১৪০)। এ ক্ষেত্রে কোনো মামলার বাদি, বিবাদি, সাক্ষী, তদন্তকারী কর্মকর্তা, বিচারক এবং সরকারপ্রধান যে কেউই বিচার-ফায়সালায় বা যেকোনো বিষয়ে প্রকৃত সত্য ও প্রত্যক্ষ বিষয়ের বিপরীতে ইস্তিকামাত হবে তারাই মূলত সাক্ষ্য গোপনকারী এবং কুরআন মাজিদে তাদেরই জালিম বলে অবিহিত করা হয়েছে।
মসজিদে ইবাদত করতে বারণ করা:
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰهِ اَنۡ یُّذۡکَرَ فِیۡهَا اسۡمُهٗ وَ سَعٰی فِیۡ خَرَابِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ مَا کَانَ لَهُمۡ اَنۡ یَّدۡخُلُوۡهَاۤ اِلَّا خَآئِفِیۡنَ ۬ؕ لَهُمۡ فِی الدُّنۡیَا خِزۡیٌ وَّ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۱۴﴾
‘সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে আল্লাহর নাম নিতে বাধা প্রদান করে এবং তাকে বিরান করার চেষ্টা করে? এরূপ লোকের তো ভীত-বিহ্বল না হয়ে তাতে প্রবেশ করাই সংগত নয়। তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহা শাস্তি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১১৪)
জাহান্নামের দিকে আহবান করাঃ
فَاَخَذۡنٰهُ وَ جُنُوۡدَهٗ فَنَبَذۡنٰهُمۡ فِی الۡیَمِّ ۚ فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۴۰﴾
وَ جَعَلۡنٰهُمۡ اَئِمَّۃً یَّدۡعُوۡنَ اِلَی النَّارِ ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ لَا یُنۡصَرُوۡنَ ﴿۴۱﴾
‘অতঃপর আমি তাকে ও তার সৈন্যবাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। দেখে নাও, জালিমদের পরিণতি কিরূপ হয়েছিল। আমি তাদেরকে নেতা বানিয়ে ছিলাম আর তারা মানুষকে ভয়াবহ ‘নারের’ পানে আহ্বান করত। কিয়ামতের দিন তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (সূরা কাসাস : ৪০—১)
আল্লাহর পথে বাধা দেয়াঃ
الَّذِیۡنَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ یَبۡغُوۡنَهَا عِوَجًا ؕ وَ هُمۡ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ کٰفِرُوۡنَ ﴿۱۹﴾ ‘যারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা দেয়, সে পথকে বাঁকা করে দিতে চায় এবং আখিরাত তথা আল্লাহর দরবারে প্রত্যাবর্তন অস্বীকার করে’ (সূরা হুদ : ১৯)।
জালেমদের সহযোগীঃ
اِنَّمَا یَنۡهٰىکُمُ اللّٰهُ عَنِ الَّذِیۡنَ قٰتَلُوۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ اَخۡرَجُوۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ وَ ظٰهَرُوۡا عَلٰۤی اِخۡرَاجِکُمۡ اَنۡ تَوَلَّوۡهُمۡ ۚ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۹﴾ ‘আল্লাহ তো তোমাদের কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন। যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেছে এবং তোমাদের বহিষ্কারে সাহায্য করেছে। এ ধরনের লোকদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই জালিম’ (সূরা মুমতাহিনা : ৯)।
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালের উদ্দেশ্যে এক কারারক্ষীর প্রশ্ন –
– ইমাম ইবনু হাম্বল! বসুন।
– ওহে কারারক্ষী! আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলে?
– আমি ইমামের নিকট রাসুলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাম- এর একটি হাদীস সম্পর্কে জানতে চাই।
– কোন হাদীসের কথা বলছো?
– জালিম ও তার সহযোগীদের সম্পর্কে যে হাদীসটি রয়েছে সেটি। সেটা কি সহীহ?
– জালেমদের সম্পর্কে হাদীস তো অগণিত। এই সম্পর্কে একটি সহীহ হাদীস হলো: (সনদের ধারা বর্ণনা) জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত: একদা নবীজি কা’ব বিন উজরাহকে বললেন, আল্লাহ তোমাকে নির্বোধদের শাসনকাল থেকে রক্ষা করুন। কা’ব বললেন, নির্বোধদের শাসনকাল কী? তিনি বললেন, এক শ্রেণীর শাসক যারা আমার পরবর্তীতে আসবে; আমার আদর্শে আদর্শবান তারা হবে না এবং আমার পথও অবলম্বন করবে না। সুতরাং যারা তাদের মিথ্যাবাদিতা সত্ত্বেও তাদেরকে সত্যবাদী মনে করবে এবং জুলমের ক্ষেত্রে তাদেরকে সহযোগিতা করবে তারা আমার দলভুক্ত নয় এবং আমিও তাদের নই। তারা আমার হাউজের পানি পান করতে পারবেনা।
– হে ইমাম! আমি কি জালিমের সহযোগী?
– না। তুমি জালিমের সহযোগী নও। জালিমের সহযোগী হলো তারা, যারা তাদের চুল আঁচড়ে দেয়, কাপড় ধুয়ে দেয়, সামনে খাবার পরিবেশন করে। জালিমের সহযোগী হলো তারা, যারা তাদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সহযোগীতা করে। হে কারারক্ষী! তুমি জালিমের সহযোগী নও। বরং তুমি নিজেই জালেমদের একজন।
– ঘটনাটি ইমাম ইবনুল জাওযী (রহঃ) তার ‘মানাকিবুল ইমাম আহমাদ (১/৪৩১)’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
মিথ্যা রচনা করাঃ
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُوَ يُدْعَى إِلَى الْإِسْلَامِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ “
“সেই ব্যক্তির চেয়ে অধিক জালিম আর কে? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে, অথচ তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা হয়। আর আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।” (সূরা সফ: ৭)
জালেমের ভয়াবহ পরিণতিঃ
وَ لَا تَرۡکَنُوۡۤا اِلَی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا فَتَمَسَّکُمُ النَّارُ ۙ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مِنۡ اَوۡلِیَآءَ ثُمَّ لَا تُنۡصَرُوۡنَ ﴿۱۱۳﴾
আর যারা যুলম করেছে তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; অন্যথায় আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক থাকবে না। অতঃপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না। সূরা হুদ।
পবিত্র কোরআনে কারিমে এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘জালেমদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে কর না। তবে তিনি তাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যেদিন চক্ষুগুলো বিস্ফোরিত হবে, তারা মাথা ঊর্ধ্বমুখী করে উঠিপড়ি করে দৌড়াতে থাকবে, তাদের চোখ তাদের নিজেদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের হৃদয়গুলো দিশেহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আজাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও, যেদিন তাদের কাছে আজাব আসবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, وَ اَنۡذِرِ النَّاسَ یَوۡمَ یَاۡتِیۡهِمُ الۡعَذَابُ فَیَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا رَبَّنَاۤ اَخِّرۡنَاۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ نُّجِبۡ دَعۡوَتَکَ وَ نَتَّبِعِ الرُّسُلَ ؕ اَوَ لَمۡ تَکُوۡنُوۡۤا اَقۡسَمۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلُ مَا لَکُمۡ مِّنۡ زَوَالٍ ﴿ۙ۴۴﴾
সেদিন জুলুমবাজরা বলবে, হে আমাদের প্রভু! অল্প সময়ের জন্য আমাদের অবকাশ দিন, তাহলে আমরা আপনার ডাকে সাড়া দেব (অন্যের ওপর জুলুম করব না) এবং রাসূলদের অনুসরণ করব। তোমরা কি এর আগে কসম খেয়ে বলতে না যে, তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বাস করছ এবং সেসব জালেমের সঙ্গে আমি কেমন আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪২-৪৫)
জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কিয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহ তাআলা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ (তিরমিজি : ২৫১১)
اتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ “তোমরা জুলুমকে ভয় করো। কেননা জুলুম কিয়ামতের দিন ভীষণ অন্ধকার রূপ ধারণ করবে।”
সেই ব্যক্তির চেয়ে অধিক জালিম আর কে? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে, অথচ তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা হয়। আর আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।” (সূরা সফ: ৭) আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَقَدْ أَهْلَكْنَا الْقُرُونَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَمَّا ظَلَمُوا “আর অবশ্যই আমি তোমাদের পূর্বে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি, যখন তারা জুলুম করেছে।” (সূরা ইউনুস: ১৩)
আল্লাহ বলেন- وَأَخَذْنَا الَّذِينَ ظَلَمُوا بِعَذَابٍ بَئِيسٍ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ “আর যারা জুলুম করেছে তাদেরকে কঠিন আজাব দ্বারা পাকড়াও করলাম। কারণ, তারা পাপাচার করত।” (সূরা আরাফ: ১৬৫)
أَنَّهُ قَالَ: يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلَا تَظَالَمُوا – হযরত আবু যর (রা) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন: আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন। হে আমার বান্দাহ! আমি আমার ওপর জুলুমকে হারাম ঘোষণা করলাম, সুতরাং তোমাদের মাঝেও জুলুমকে হারাম করে দিলাম। সুতরাং তোমরা একে অন্যের ওপর জুলুম করো না। (মুসলিম)
اتَّقُوا دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ وَإِنْ كَانَ كَافِرًا فَإِنَّهُ لَيْسَ دُونَهَا حِجَابٌ “হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মজলুমের বদ দোয়াকে ভয় কর। যদিও সে কাফের হয়, কেননা মজলুম ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।” (মুসনাদে আহমদ)
আল-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ ثَلَاثُ دَعَوَاتٍ مُسْتَجَابَاتٌ لَا شَكَّ فِيهِنَّ دَعْوَةُ الْوَالِدِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ “হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: নিঃসন্দেহে তিন প্রকারের দোয়া গৃহীত হয়। (১) পিতা-মাতার দোয়া, (২) মুসাফিরের দোয়া, (৩) মজলুম তথা নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া।” (সুনান আবু দাউদ)