You are currently viewing চলচ্চিত্রে মরুর দুলাল-আজিজ হাকিম
চলচ্চিত্রে মরুর দুলাল-আজিজ হাকিম

চলচ্চিত্রে মরুর দুলাল-আজিজ হাকিম

প্রত্যেক বছর সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রর সিরাত স্মারকের জন্য অপেক্ষা করি। কেন্দ্রের এই কাজটি ইউনিক একটি কাজ। দীর্ঘদিন যাবত তারা সিরাত স্মারক প্রকাশ করে আসছে। এই বছরের স্বারকে চলচ্চিত্রের উপর আমার বড় একটি লেখা স্থান পেয়েছে। Afsar Nizam ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন একটি লেখা লিখিয়ে নেওয়ার জন্য। আসলে সম্পাদকদের দায়িত্ব এমনই হয়।

আরেক ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে কেন্দ্র এবার লেখার সম্মানি দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। স্মারকের সম্পাদকসহ কেন্দ্রের সবার প্রতি অনেক অনেক শুভকামনা। আপনিও পড়তে পারেন।

চলচ্চিত্রে মরুর দুলাল xx চলচ্চিত্র

মরুপ্রান্তর। দূরে তিনজন ঘোড় সওয়ারীকে দ্রুতবেগে আসতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পরিষ্কার না। লাল সূর্যটা অস্তগামী না উদিয়মান বোঝা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে সওয়ারী দলের দুচোখে স্পষ্টতার ছায়া ফেলছে। মরুর ধুলো থেকে বাঁচতে তাদের আবৃত মুখোত্রয় দেখা যাচ্ছে না। তবে এতোটুকু বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা। হঠাতই তারা পাহাড়ের একটি উপত্যকায় এসে পৃথক হয়ে গেল। ইতোমধ্যেই ঘটনার সংমিশ্রণে যুক্ত আরবীয় আবহ সংগীত হৃদয়ে ঝড় তুলেছে। আরব উপকূল থেকে মিশরের পিরামিট আর ধূসর মরুভূমির ফাঁকে দৃশ্যমান হলো বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবার। সাদা বসনে আবৃত এক মধ্য বয়সী যুবক কোনরকম তোয়াজ না করেই চামড়ায় মোড়ানো একটি চিঠি বের করে বাদশার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন- “নিজের পরিত্রাণের জন্য ইসলাম গ্রহণ করুন”। রাজসভার সভাসদগণ যেন নড়েচড়ে উঠল। হিরাক্লিয়াসের প্রাসাদের মানুষেরা এক নতুন দু:সাহসী বক্তব্যের সাথে পরিচিত হলো। রাজার বজ্রকণ্ঠে ভেসে এলো- “ব্যাপারটা কি এমন নয় যে, মরু থেকে উঠে আসা এক যুবক যে কিনা বাইজেন্টাইন সম্রাটকে বলছে কী করে পরিত্রাণ পেতে হবে? তাকে এ দায়িত্ব কে দিয়েছে?” পত্রবাহক বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন- “আল্লাহ মুহাম্মদকে করুণারূপে পাঠিয়েছেন”।

এতক্ষণ বলছিলাম রাসূল সা. কে নিয়ে নির্মিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র দ্যা ম্যাসেজ’র কিছু দৃশ্যপটের কথা। কীভাবে মূলচরিত্রকে না দেখিয়েও গল্পকে জীবন্ত করে তুলেছেন পরিচালক, এই চলচ্চিত্র না দেখলে বোঝার উপায় নাই। আর এই অসাধ্যকেই সাধন করেছেন সিরিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা আক্কাদ। ইসলামি ইতিহাস এবং রাসূল সা. কে নিয়ে সারা বিশ্বে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে দ্যা ম্যাসেজ, মুহাম্মদ ম্যাসেঞ্জার অব গড (মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ), মুহাম্মদ লিগেসি অব এ প্রফেট (ডকুমেণ্ডারী) অন্যতম। চলচ্চিত্র জগতে ইসলাম এবং রাসূল সা. কে নিয়ে নির্মিত শিল্পকর্মগুলোর দিকে হালকা আলো ফেলার চেষ্টা করব এই লেখায়।

১.

১৯৭৪ সাল। জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন নতুন এক পরিচালক। তাও যেন তেন নয়, বায়োপিক বানাবেন। এমন কাউকে নিয়ে বায়োপিক বানাবেন যার ছায়াও এক পলকের জন্য দেখানো যাবে না। এও কি সম্ভব? শুধু চেহারা না; তার মুখের কথাও শোনা যাবে না। এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন সিরিয়া বংশদ্ভুত অ্যামেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা আক্কাদ। হ্যাঁ সেই বিখ্যাত চলচ্চিত্রটির নাম- দ্যা ম্যাসেজ। রাসূল সা.কে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে চরম এক বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। যদিও দ্যা ম্যাসেজ’র চিত্রনাট্য মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিমকে দিয়ে অনুমোদন নিয়ে নেন। তারা চিত্রনাট্যটি ভালোভাবে দেখে এতে ইতিহাস এবং ধর্মীয় ব্যাপারে তেমন কোনো সমস্যা না থাকায় এর অনুমোদন দিয়ে দেয়। কিন্তু মুসলিম ওয়ার্ল্ড এবং সৌদি আরব এটি নির্মাণের বিরোধীতা করে। বাদশা ফয়সাল বরাবরই এটি নির্মাণে বাধা দিয়েছেন। মোস্তফা আক্কাদের ইচ্ছে ছিল মক্কা মদিনার কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে এটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করবেন। কিন্তু সৌদি সরকারের বিরোধীতার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। কুয়েত এবং মরক্কো সরকারের আর্থিক সহযোগীতায় এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় মরক্কোর মারাকাশে।

প্রায় চার মাসের মত সময় লাগে সপ্তম শতাব্দীর মক্কা ও মদিনা শহর নির্মাণে। টানা ছয় মাস শ্যুটিং চলার পর তাকে আবারও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সৌদি সরকারের চাপে কুয়েত এবং মরক্কো সরকার তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেন। প্রথমে মোস্তফা আক্কাদকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে মরক্কো থেকে বহিষ্কার করা হয়। পুরো টিম বিপদে পরে যায়। পরিচালক আবারও লিবিয়া সরকারের কাছে যায়, যদিও ইতোপূর্বে একই কাজের জন্য লিবিয়াতে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, মোস্তফা আক্কাদকে বিমানবন্দর থেকেই অ্যামেরিকায় ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার তিনি লিবিয়া পৌঁছাতে সক্ষম হন এবং গাদ্দাফীকে ছয়মাস ব্যাপী চলা শ্যুটিংয়ের ভিডিওগুলো দেখান। কথিত আছে যে, গাদ্দাফী নাকি সেই ফুটেজগুলো দেখে আবেগ তাড়িত হয়ে যান এবং কেঁদে ফেলেন। এরপর ঘটনা পাল্টে যায়। গাদ্দাফী লিবিয়াতে এটি নির্মাণের অনুমতি দিয়ে দেন এবং অর্থ-জনশক্তি দিয়ে সহযোগিতা করেন। লিবিয়া সেনাবাহিনীর ৩০০০ সৈন্য সেখানে দৈনিক কাজ করে, যারা সেট নির্মাণেও সহযোগিতা করে এবং প্রয়োজনে শ্যুটিং ইউনিটেও থেকেছে। লিবিয়ার সাবহা শহরে আরও ছয় মাস শুটিংয়ের পর দ্যা ম্যাসেজ নির্মাণের কাজ শেষ হয়।

এটি ইংরেজি এবং আরবি দুই ফরমেটে দুইসেট অভিনেতা অভিনেত্রী দিয়ে তৈরী করা হয়। সিনেমাটির দৈর্ঘ্য (ইংরেজি)- ১৭৮ মিনিট এবং ২০৭ মিনিট (আরবি)। নির্মাণ ব্যয় ১০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আয় ১৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আইএমডিবি রেটিং- ৮.১/১০ এবং ৮.৯/১০ । সিনেমাটির পরিবেশক ছিল- তারিক ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাকশন লিমিটেড। এতে অভিনয় করেছেন- অ্যান্থনি কুইন, আইরিন পাপেস, মাইকেল অ্যানসারা, জনি সেকা প্রমুখ।

দ্যা ম্যাসেজের গল্প শুরু হয়েছে রাসূল সা. এর নবুওয়ত প্রাপ্তির সময়কাল থেকে। প্রথম ওহী নাযিল, মক্কায় দাওয়াতি কাজের শুরু, বিরোধী শক্তির তৎপরতা, মদিনায় হিজরত, রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বদর এবং ওহুদ যুদ্ধ, পরিশেষে মক্কা বিজয় এবং বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের মাধ্যমে সিনেমার গল্প শেষ করা হয়েছে। সিনেমার শুরুতে দেখানো হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে রাসূল সা. এর পত্র মারফত দাওয়াত প্রধান এবং তাদের প্রতিক্রিয়া। এরপরেই বানিজ্যিক শহর মক্কা নগরীকে দেখানো হয় এবং মক্কার ওকাজ মেলাকে ঘিরে কর্মব্যস্ত মক্কাবাসীর কর্মকাণ্ড ফুটিয়ে তোলা হয়। হিন্দার দুই ভাইয়ের মধ্যে হুজাইফার ইসলাম গ্রহণ। পিতার তেজ্যপুত্র করে দেওয়া। ইসলামের প্রথম শহীদ সুমাইয়ার আত্মত্যাগ, তার সন্তান আম্মারের উপর নির্যাতন। উমাইয়ার বিলালের উপর পাথরচাপা ইত্যাদির মাধ্যমে মক্কার নির্যাতন যখন দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল, তখন তায়েফবাসীর ব্যবহার যেন সবার হৃদয় ভেঙে দেয়। এরই আগে আবু তালিব এবং খাদিজা রা. এর মৃত্যুতে রাসূল সা. মানসিকভাবে খুবই কষ্টে ছিলেন। এরপরই আসে হিজরত। কিছু সংখ্যক অনুসারী আগেই জাফর রা. এর নেতৃত্বে আবিসিনিয়ায় রাজা নাজ্যাসীর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করেছিল মক্কার কুরায়েশেরা। কিন্তু তাতে তারা ব্যর্থ হয়। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত জোট সরকার দেখে এবং বানিজ্যিক কাফেলা রক্ষার ঘটনার একপর্যায়ে বদর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মাত্র তিনশো তেরোজন নিয়ে যুদ্ধেজয়ী হন মুসলমানেরা। সেই যুদ্ধে মক্কার বড় বড় নেতা নিহত হন। এর মধ্যে উমাইয়া, আবু জেহেল অন্যতম। আবু সুফিয়ান কাফেলাসহ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং বদর থেকে আরো দূরে সরে যায়। যে কারণে তিনি এ যাত্রায় বেঁচে যান। সেই বিজয়ের রেশ ধরেই উহুদ যুদ্ধ পরবর্তী হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং দশহাজার সৈন্য নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয়। আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ। কাবার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা এবং বিদায় হজ্জ্বেও ভাষণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের সমাপ্তি টানা হয়েছে। এই সিনেমা দেখে একজন দর্শক যেমন রোমাঞ্চিত হবেন, একই সাথে আবেগ তাড়িতও হবেন। কিছু মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে কী করে ইসলাম বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল।

আরও দেখতে পারেন মাসুম আজিজ অভিনীত টেলি ছবি ম্লান জোছনা

সিনেমায় রাসূল সা. পরবর্তী চার খলিফার চরিত্ররূপায়ন করা হয়নি। হামজার পাশাপাশি আলীর উপস্থিতি বুঝালেও তার অবায়ব দেখানো হয়নি। রূপায়িত প্রধান চরিত্রগুলো ছিল- হামজা, রাসূলের পালকপুত্র জায়েদ, বিলাল, আবু তালিব এবং জাফর। যখন যাকে দিয়ে সম্ভব তাকে দিয়েই রাসূল সা. এর উক্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও খালিদ বিন ওয়ালিদ, আম্মার, হুজাইফা চরিত্রগুলোও ছিল প্রাণবন্ত।

সিনেমা মুক্তির পরে অনেক মুসলিম দেশ এটার বিরোধীতা করে এবং প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারী করে। কারণ ইতোপূর্বে ইসলামি ইতিহাস তথা রাসূল সা.কে নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মিত হয়নি। এমন কী একপর্যায়ে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় রাসূল সা. এর চাচা হামজার চরিত্র রূপায়নের কারণে তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে সিনেমাটি গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং দেশগুলো থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সিনেমাটি ব্যবসা সফল না হলেও সারা বিশ্বেই সমাদৃত হয় এবং ১৯৭৭ সালে এটি সেরা আবহসঙ্গীত বিভাগে অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল।

২.

২০১৫ সালের ২১ জুলাই। ভারতের ডিজিটাল প্লাটফর্মে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তির আগেই কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে মুক্তির নিষেধাজ্ঞা চেয়ে চিঠি লেখেন মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি অনিল দেশমুখ। তিনি লেখেন- “এই ছবি যদি ভারতে মুক্তি দেওয়া হয় তাহলে একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং ভাবাবেগে আঘাত হানতে পারে। যার কারণে আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে”। তিনি অনুরোধ জানান “এটি যেন ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের মত ডিজিটাল প্লাটফর্মে মুক্তির নিষেধাজ্ঞা জারি করে নির্দেশনা দেওয়া হয়”। মুহাম্মদ: দ্যা ম্যাসেঞ্জার অব গড (মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ) চলচ্চিত্রটি নির্মাণের শুরু থেকেই বিতর্কিত। চিল্ড্রেন অব হ্যাভেন খ্যাত ইরানের পরিচালক মাজিজ মাজিদি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এটিকে ইরানের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র হিসেবে অবহিত করা হয়। রাসূল সা. কে নিয়ে তিন পর্বের প্রথম পর্ব এটি।

২০০৭ সাল থেকে এই চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেন মাজিদি। নানান প্রতিকূলতা পেড়িয়ে ২০১৫ সালে এটি মুক্তির মুখ দেখে। এটিতে রাসূল সা. এর শৈশব এবং শৈশবের পূর্ববর্তী কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রের আবহসঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ভারতের এ. আর. রহমান এবং চিত্রগ্রহণের কাজ করেছেন তিনবারের অস্কারজয়ী ভিত্তোরিও স্টোরারো। শ্রেষ্ঠাংশে- মাহদি পাকদেল, সারেহ বায়্যেত, মিনা সাদাতি, মোহসেন তানাবান্দে, রানা আজাদিভার প্রমুখ। ১৭৮ মিনিট দৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে- ৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আইএমডিবি রেটিং ৭.৩/১০।

রাসূল সা. এর শারীরিক চিত্রায়ন নিষিদ্ধ। যদিও সেই নিয়ম মেনেই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন পরিচালক মাজিদি। কিন্তু দ্যা ম্যাসেজের মত অতোটা পরিশুদ্ধ বলা যায় না এই চলচ্চিত্রকে। এখানে মা আমিনার কোলে শিশু মুহম্মদ, তাঁর ছুটে চলার দৃশ্য, পিছন থেকে প্রতিকী অবস্থানের দৃশ্যগুলোর কারণে পরিচালক বেশ সমালোচনার সম্মুখীন হন। একই সাথে রজা একাডেমির বিরোধের জেরেই ২০১৫ সালে চলচ্চিত্রের থিয়েট্রিক্যাল মুক্তির নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। এমন কি ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তির ব্যাপারেও আপত্তি জানায় এই সংগঠন। কিন্তু ২০১৮ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সেখানে স্বয়ং পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।

চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখানো হয় একজন ঘোড়সওয়ারীকে। দ্রুতবেগে কোথাও যাচ্ছেন। একপর্যায়ে মক্কা শহরকে দেখানো হয়। যেখানে একজন বন্দিকে হত্যার নির্দেশ পালন করা হচ্ছে। যে কিনা আবু তালিবকে সহযোগিতার দোষে দুষ্ট। আবু তালিবসহ রাসূল সা. এর সাথীগণকে একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে কোনোরূপ সহযোগিতা করা রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল। তাই আজকের এই আয়োজন। আগুন্তুক ঘোড়া থামিয়ে এমন হত্যাকাণ্ডের বিরোধীতা করেন। কিন্তু কে এই আগুন্তুক! যে কিনা আরব শাসকদের হুকুমের বিরুদ্ধে কথা বলে! সবাই অবাক হয়। “কে কথা বলে! আমার তো মনে হয়- হামজা! তোমার মুখ দেখাও তো হামজা?” ভারি কণ্ঠে এই কথাগুলো বলতে বলতে আবু সুফিয়ান প্রবেশ করে। এক পর্যায়ে তারা বন্দীকে ছেড়ে দেয় এবং হামজা শিয়াবে আবু তালিবে প্রবেশ করে। ক্ষুধার্থ শিশুদের দেখে। যেখানে কোনো খাবার এবং পানির ব্যবস্থা নেই। নিদারুণ কষ্টে জীবনযান করছে মুসলিমরা। এ এলাকাটিকে সমগ্র আরব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এটি একটি পাহাড়ের গিরি সংকট, যেখানে সবাই আশ্রয় নিয়েছে।

ঘটনার এক পর্যায়ে আবু তালিব সুরা ফিল নাযিলের সময়ে সুরার তেলাওয়াত শোনে এবং হস্তিওয়ালাদের বাস্তব ঘটনা মনে পড়ে যায়। কারণ আবু তালিব সেই ঘটনার বাস্তব সাক্ষী। এরপর সিনেমার গল্প চলে যায় অতীত স্মৃতিতে। সেখানে দেখানো হয় বাদশাহ আব্রাহা বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে আসছেন। আব্দুল মুত্তালিব তাদের বাধা দিতে ব্যর্থ হয়ে কাবা ঘরের দরজার কাছে আসেন এবং আল্লাহ কাছে সাহায্য চান, যেন তিনি তাঁর কাবাঘর রক্ষা করেন। এসময় ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট ছোট পাখি এসে আব্রাহার বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়। এরপর দৃশ্য চলে যায় দশ বছর পরে রাসূল সা. জন্মের সময়কালে। নবীজির (সা.) জন্মের সময় কাবাঘরের মূর্তিগুলো ভেঙে যাওয়া, শামদেশ পর্যন্ত আলোকিত হওয়ার ঘটনাগুলোকেও তুলে ধরা হয়েছে। ঝমকালো আয়োজনের মাধ্যমে আকিকা অনুষ্ঠানে আব্দুল মুত্তালিব নবীজির নাম রাখেন মুহাম্মদ। তারপর নবী সা. কে মা হালিমার ঘরে লালনপালনের জন্য দেওয়া হয়। মক্কায় হালিমার আগমণ এবং রাসূল সা.কে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলোকে অত্যান্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। হালিমার কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, উঠ হারিয়ে যাওয়া এবং খুঁজে পাওয়ার দৃশ্যগুলো বেশ নাটকীয়তা পেয়েছে। মা হালিমার এলাকাটি ছিল অনুর্বর। সেখানে বৃষ্টি হয় না। উঠের পিঠে শিশু মুহাম্মদ সওয়ার হওয়া কারণে দুর্বল উঠনীর দ্রুতগামী হওয়া এবং রাসূলের আগমণে রহমের বৃষ্টির দৃশ্যগুলো হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। এখানে চলচ্চিত্রকার অত্যান্ত মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। যেন চিত্রগ্রাহক প্রতিটি ফ্রেমকে জীবন্ত করে তুলেছেন। পর্ববর্তীতে রাসূলুল্লা সা. এর ধারাবহিক জীবনের অংশগুলোও উঠে এসেছে। মা আমিনা এবং দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ইন্তেকাল, চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বের হওয়া। সেখানকার পাদ্রী নবীর নিদর্শনসমূহ দেখে তাকে সনাক্ত করেন এবং আবু তালিবকে নবী সা. এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সতর্ক করেন।

সিনেমার শেষে ঘটনা আবার বাস্তবে চলে আসে, যেখানে কাবার কাছে আবু তালিব বক্তব্য রাখছিল। হঠাৎ সেখানে আবু সুফিয়ান ও তার সাথীরা চলে আসে এবং আবু তালিবের বিরোধীতা করে। তারা একটি নিদর্শন চায় যেটি দেখাতে পারলে তাদের একঘরে অবস্থান থেকেও মুক্তি মেলতে পারে। তখন আবু তালিব একটি চুক্তিপত্রের কথা বলে যেটি কিনা পোকায় খেয়ে ফেলেছে। এক পর্যায়ে চুক্তি পত্র বের করে দেখা গেলো সত্যি সত্যিই সেটি পোকায় খেয়ে ফেলেছে, সেখাসে শুধু কাগজটিই অবশিষ্ট আছে, কোনো লেখা নেই। আবু সুফিয়ানের শেষ উক্তি ছিল যতদিন তাঁর চাচা আবু তালিব আছে ততদিন আমরা তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারব না।

৩.

কী করে একজনের মুখের কথায় সন্তান তার ছেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পিতা তার সন্তানকে ভুলে যায়। কেমন মানুষ তিনি? যার কথা সারা জাহানে এখনও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। মুহাম্মদ: লিগেসি অব এ প্রফেট ডকুমেণ্ডারী চলচ্চিত্রটি এমন একজন মানুষের গল্প যিনি ১৪০০ বছর আগে সারা দুনিয়া পরিবর্তন করে ফেলেন। এই সময়েও অ্যামেরিকার মিলিয়ন জনগোষ্ঠী ইসলামকে মানে এবং রাসূল সা. কে অনুসরণ করে। এই চলচ্চিত্রটি শুধুমাত্র আরব অঞ্চলের মানুষদের জন্য নয়। বরং এটি নির্মাণ করা হয়েছে যারা পাশ্চাত্যে বসবাস করেন। ইসলাম এবং রাসূল সা. সম্পর্কে যাদের কোন জানা শোনা নেই।

মুহাম্মদ: লিগেসি অব এ প্রফেট সিনেমাটি ঠিক তখন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যখন সারা অ্যামেরিকায় ইসলাম সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে গেছে। আর সেটা ২০০১ সালের ৯/১০ এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের মাধ্যমে। তখন কিছু ঐতিহাসিক এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারা এটিতে রাসূল সা. এর জীবনকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। চলচ্চিত্রটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন- মাইকেল ওয়ার্জ এবং ওমর আল কাত্তান। শ্রেষ্ঠাংশে- কারেন আর্মস্ট্রং, হুসাইন নাসের, ডেইজি খান, মুহাম্মদ জাকারিয়া, এম. চেরিফ বাস্যিউনি প্রমুখ। প্রায় ১৫জন আলোচক এটিতে রাসূল সা. সম্পর্কে কথা বলেন। যাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আইনবিদ, সামাজ সচেতন ব্যক্তি, নবমুসলিম, বিভিন্ন সাহিত্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি, মসজিদের খতিব, ইসলামী স্কলারগণও ছিলেন। এটি নির্মাণ করেছে পিবিএস (দ্যা পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস)। অ্যামেরিকার একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। চলচ্চিত্রটি ইংরেজি ভাষায় নির্মিত এবং আইএমডিবি রেটিং- ৮/১০। ২০০২ সালে ১৮ ডিসেম্বর এটি মুক্তি পায় এবং পিবিএসের প্রায় ৬০০টি আলাদা আলাদা স্টেশনে প্রদর্শন করা হয়। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি চ্যানেলেও এটি প্রদর্শিত হয়। এটি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রদর্শন করা হয়। প্রায় ২০ হাজারের মত সংলাপ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি যেন একটি জীবন্ত সিরাত।

চলচ্চিত্রের শুরুতে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে দেখানো হয়, যারা কিনা কাবা জিয়ারতের জন্য যাচ্ছে। তাদের চোখের দৃষ্টির স্বাভাবিকতা বুঝানো হয়। একজন মানুষ বিপদজনক কিনা তা তার চোখ দেখলে অনুমান করা যায়। যেহেতু এটি একটি ডকুমেণ্ডারী ফিল্ম সেহেতু এখানে বক্তার আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বিষয়াদির একটি দৃশ্যমান কল্পনাও পর্দায় দেখানো হয়। ভূমিকাতেই রাসূল সা.কে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তিনি কেমন মানুষ। মুহাম্মদ সা. শুধুমাত্র একজন নবীই নন, তিনি একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন যোদ্ধা, একজন রাজনৈতিক নেতা এবং সমাজসংস্কারক। ইসলাম শুধু মসজিদকেন্দ্রীক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ কোনো ধর্ম নয়, এটি শেখায় কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে সামাজিকতা বজায় রাখতে হয়, একজন শিশুর সাথে কেমন আচরণ করব, জ্ঞান অর্জন কেমন হওয়া উচিৎ, আইন ও শাসনব্যবসস্থার ধরণ প্রকৃতিসহ এমন প্রয়োজনীয় সব কিছু ইসলামে পাওয়া যাবে। কুরআন বলে- উত্তম চরিত্র দেখতে চাইলে রাসূল সা. এর জীবন হচ্ছে সর্বোত্তম উদাহরণ। এমন দারুণ সব বাস্তবতার আলোকে মানুষের প্রয়োজনীয় আলোচনাগুলো স্থান পেয়েছে পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে।

গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে ৯/১১ এর কথা। যখন মুসলিম সমাজ একটি বিপদজনক অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। একই সাথে কাবার পূর্বের এবং ইসলাম পরবর্তী অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে কিনা যুদ্ধ আগে থেকেই নিষিদ্ধ ছিল। ২৫ বছর বয়সে রাসূল সা. এর খাদিজার সাথে কীভাবে বিয়ে হয়েছে, কীভাবে একটি আন্দোলনের জন্য খাদিজার এতো ধন সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন তার বিস্তারিত উঠে এসেছে। জাবালে নূরে নবুওয়াত প্রাপ্তি এবং খাদিজা রা. এর চাচাতো ভাই ওরাকার কাছে গমনের বিষয়গুলো তুলে আনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রের আলোচনার ব্যাপ্তি পরিস্ফুটিত হয়। মাঝে মাঝে নবমুসলিমদের আলোচনাগুলো যেন গল্পের বিষয়গুলোর সাথে নতুন প্রাণের সৃষ্টি করেছে। যখন রাসূল সা. এর যেই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তখন সেই বিষয়ের সৌন্দর্য দেখে যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন তার ভাষ্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। একজন বললেন- “রাসূল সা. বলেছেন তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে তার সৃষ্টিকে ভালোবাসো তাদের সেবা করো। তাদেরকে ভালোবাসার অর্থই আল্লাহর ভালোবাসা”। চলচ্চিত্রে মদিনায় সামাজিক সহবস্থানের বর্ণনাও এসেছে। মদিনার ঘটনাবহুল জীবনের উদাহরণ টেনে বুঝানো হয়েছে ইসলামে যুদ্ধের নীতিমালা কেমন? রাসূল সা. এর ওফাত লাভ এবং ওমর রা. এর মানসিক অবস্থাও আলোচনায় এসেছে। চলচ্চিত্রে প্রায় ৮৮টি বিষয়ভিত্তিক পয়েন্টে আলোচনা উঠে এসেছে।

মুহাম্মদ: লিগেসি অব এ প্রফেট সিনেমার নির্মাণ, সংলাপ, আবহসঙ্গীত সব কিছু মিলিয়ে চমৎকার একটি পরিবেশনা। যেটি পাশ্চাত্যসহ সারা বিশ্বে মানুষদের জন্য অনন্য একটি নির্মাণ। যেখানে একজন দ্বীনের দায়ী পৌঁছাতে পারবেন না, সেখানে এই চলচ্চিত্রটি ইসলাম এবং মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে জানার অনেক বড় একটি ক্ষেত্র। এমন নির্মাণ বিশ্বে সকল ভাষায় সব মানুষের জন্য নির্মিত হোক। ইসলামের আলো প্রতিফলিত হোক সবার মনের আয়নায়।

আজিজ হাকিম

সংস্কৃতিকর্মী

সোনারগাঁও

এক্সএক্সএক্স: রিটার্ন অফ জান্ডার কেজ ২০১৭ সালের চলচ্চিত্র

চলচ্চিত্র । চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন । বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি । 

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি তালিকা । বাংলা চলচ্চিত্র

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন ফলাফল

Leave a Reply