প্রাসঙ্গিক কথা
গান হৃদয় মননের গীতল অনুষঙ্গ, বিরহ বেদনার নিষিক্ত কাব্য, আত্ম জাগরণ ও আত্ম প্রকাশের দূরন্ত সহচর। অব্যক্ত অনুভূতির আচানক রিনি ঝিনি ঝংকার। নিজের মনকে অন্যের মনে আর অন্যের মনকে নিজের মনে সম্মোহনের সবচে শক্তিশালী ভাবাস্ত্র।
গান কখনও দেহতে লীন, কখনো অধ্যাত্ম চেতনায় উজ্জ্বল। কখনো যুদ্ধের প্রণোদনা, আবার শান্তির শীতল পেলব। গানে উঠে আসে জীবনের অনিবার্য প্রেম বিরহ ,প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির রোদন হাহাকার, আগামীর স্বপ্ন ও কল্পনা। গান অতি দ্রুততার সাথে চেতনাকে সঞ্চালিত- সঞ্চারিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন। কবিতা যেমন মনের ভাষা, সঙ্গীতও তেমনি ভাবের ভাষা। প্রকাশের তারতম্যে একটি কবিতা অন্যটি গান।
বাংলা গানের কথা বলতে গেলে প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য ভাবে রবীন্দ্র-পূর্ব বেশ কজন গীতিকবির নাম উচ্চারণ করতেই হয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক গীতি-কবিতার প্রবর্তক কবি বিহারীলাল, রাজনারায়ণ বসু, দার্শনিক অক্ষয় কুমার চৌধুরী, কবি দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যিক স্বর্ণ কুমারী দেবী প্রমুখ বাংলা গানের পথিকৃৎ।
তাছাড়া রবীন্দ্র পরবর্তী গীতিকবি ও গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। বাংলা গানের ভুবনে তাদের অবদান চিরস্মরণীয় থাকবে। বিশেষত পঞ্চগীতিকবি হিসেবে খ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও কাজী নজরুল ইসলাম।
কবি ফররুখ আহমদও অনেক বিখ্যাত কালজয়ী গান লিখে আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন। কাজী নজরুল ইসলামের কথা তার গানের কথা আলাদা করেই বলার দাবী রাখে। তিনি বাংলা গানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। নজরুলে যতোটুকু শিল্পবোধ, যতোটুকু সৌন্দর্য কিংবা আবেদন তা বোধহয় তার সঙ্গীতেই ঢেলে দেয়া।
এরপর পল্লীকবি জসীম উদদীন, ফজল-এ- খোদা, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, মাজহারুল আনোয়ার, কবির বকুল, আব্দুল লতিফ, সাবির হোসেন চৌধুরী, কে.জি মোস্তফা অনেকের নামই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যায়। যারা নিজেদের যোগ্যতা ও মননশীলতা দিয়ে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন।
ইসলামী বা ভক্তিমূলক গানের জন্যে আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীম, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ইয়াকুব আলী খান, আবু বকর সিদ্দিক, খালিদ হোসেন, সোহরাব হোসেন প্রমুখ বিশেষভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছেন আমাদের স্মৃতিতে। কবি আল মাহমুদের কিছু ছড়াগান আমাদের মন মননেও দাগ কেটে দিয়েছে।
আমরা সাধারণ আধুনিক গানের ধারার পাশাপাশি সত্তুর -আশির দশক থেকে সচেতন প্রয়াশে বাংলা কবিতা ও গানের ভূবনে নতুন একটি ভাব বলয় নির্মিত হতে দেখি। বিশেষ করে স্বদেশ, স্বজাতি, স্বধর্মের নির্যাস আশ্রিত গান।
অগ্রজ কবি গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক সামনে থেকে এগিয়ে নিয়েছেন এই ধারাকে।
তার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন গীতিকার শিল্পী সুরকার তাফাজ্জল হোসেন খানসহ অনেকেই। পরবর্তীতে কবি আসাদ বিন হাফিজ, আ.জ.ম ওবায়দুল্লাহ, আব্দুল হালিম চৌধুরী, মহিউদ্দীন আবু তাহের, আজিজুর রহমান, সুমন আজিজ, কবি গোলাম মোহাম্মদ, হাসান আখতার, খন্দকার রাশিদুল হাসান, কামরুল ইসলাম হুমায়ুন, গীতিকার আমিনুল ইসলাম, চৌধুরী গোলাম মাওলা, কবি মোশাররফ হোসেন খান, শিল্পী- গীতিকার আবুল কাশেম, শিল্পী ও গীতিকার তারেক মনোয়ার প্রমুখের ঝলোকিত গানে আমরা ঋদ্ধ হয়েছি।
গীতিকার হিসেবে আমাদের কালটা শুরু হয় আশির শেষপাদে এবং নব্বই দশকে এধারায় অনেকগুলো নাম যুক্ত হয়ে যায়। শাহ আলম বাদশা, সালেহ মাহমুদ, নাসির মাহমুদ, জাকির আবু জাফর, নুরুজ্জামান ফিরোজ, মঈনুদ্দিন জাহেদ, সাইফুল আরেফিন, সিরাজ উদ্দীন, রফিকুল ইসলাম ফারুকী, আলতাফ হোসেন রানা, সাইদ আবু বকর, মাহফুজুর রহমান আখন্দ, নাইম আল ইসলাম মাহিন, আবু তাহের বেলাল প্রমুখ ইসলামী গান কবিতার ধারাকে বেগবান করেছেন এবং তাদের কেউ কেউ এখনো সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিচ্ছেন সাহসিকতার সাথে।
সুরকার শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠকদের মাঝে অগ্রজ সাইফুল্লাহ মানসুর, বাহলুল করীম, গোলাম মাওলা, আহসান হাবীব, হাসান মোরতাজা, শরিফ আব্দুল গোফরান, আবুল হোসাইন মাহমুদ, হাসানাত আব্দুল কাদের, দুররুল হক বাবুল, শহিদুল্লাহ মাসুদ, মশিউর রহমান, লিটন হাফিজ, হাসিনুর রব মানু, মেহরাজ মিঠু, জাফর সাদেক, নওশাদ মাহফুজ, আল্ মিজান, শামসুল ইসলাম, ইকবাল হোসেন, হাফেজ বেলাল হোসাইন প্রমুখের অবদানও অনস্বীকার্য।
ইতোমধ্যে বাংলা গানের ইসলামী ধারায় মল্লিকীয় ধারা দৃশ্যত স্পষ্ট হয়েছে। এ ধারায় এযাবৎ কালের শিল্পী সুরকারদের মাঝে শিল্পী সুরকার মশিউর রহমান অতুলনীয় অসাধারণ। মহান রবের পক্ষ থেকে পাওয়া তার গায়কী কণ্ঠ এবং মন ঘেঁষা প্রাকৃতজ সুরের শিহরণ ইসলামী ধারার সঙ্গীত পিপাসুদের মনে প্রশান্তি আর প্রাপ্তির পালক যোগ করেছে। তার কণ্ঠের নিয়মিত পরিচর্যা আব্দুল আলীম, আব্বাস উদ্দীনদের অভাবকে কাটিয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।
ইসলামী ভাবাদর্শকে উপজীব্য করে সঙ্গীত চর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছেন মরহুম আইনুদ্দিন আল আজাদ, শিল্পী গীতিকার আবুল কালাম আজাদ, কবি মুহিব খান প্রমুখ। আমরা তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই পেয়েছি। তাদের প্রতি আমার সালাম ও কৃতজ্ঞতা।
আনন্দের সাথে উচ্চারণ করতে চাই বর্তমানে গীতিকার-সুরকার -শিল্পী হিসেবে আমিনুল ইসলাম আব্দুল্লাহ আল কাফি, মালিক আব্দুল লতিফ, আব্দুস শাকুর তুহিন , কে,এম, মুনির হোসাইন, বিলাল হোসাইন নূরী, মাহফুজ বিল্লাহ শাহী, মাসুদ রানা, আব্দুস সালাম, আমিরুল মোমিন মানিক, আবুল আলা মাসুম, জাফর ফিরোজ, আল মিজান, মতিউর রহমান খালেদ, ইউসুফ বকুল, আবু সায়াদাত দুলু,
শিল্পী আমিনুল ইসলাম, মারুফ আল্লাম, সুরকার ও শিল্পী মাহফুজ মামুন, শাহাবুদ্দীন, রবিউল ইসলাম ফয়সাল, সোহাইল আহমদ, রোকনুজ্জামান, মিরাদুল মুনীম, তাওহীদুল ইসলাম, ওবায়দুল্রাহ তারেক, আব্দুল গাফফার প্রমুখ নিজস্ব ভূবনে স্বাতন্ত্রের ছাপ এঁকে চলেছেন। তাদের দ্বারা ইসলামী গান বিচিত্র ধারায় বিকশিত হচ্ছে।
স্মৃতি থেকে লেখা বলে অনেকের নাম আলোচনা থেকে বাদ পড়েছে এবং ক্রম বিন্যাসটাও এদিক ওদিক হয়েছে। যাদের নাম এখানে লিখতে পারলাম না-তাদের অবদানও আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে অকপটে
(পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য কারো নাম স্মরণে এলে এই লেখাটি সংস্কার করে নেবার আশা থাকলো)।
গান বা সঙ্গীত প্রসঙ্গে খুব এ্যাকাডেমিক আলোচনা এখানে আমার মূখ্য নয়। নবীন যারা গান লিখতে চান , তাদের জন্যে একেবারই প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য দু একটি কথা বলবো। মূলত গান রচনার কলা কৌশল নিয়ে আজকের লেখাটাকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
গান লেখার নিয়ম
প্রথমত:
গানের কাঠামো নিয়ে কথা:
গানের পরিভাষায় গানের অংশ বা বিভাগকে অবয়ব বলা হয়। গানের ভুবনে অবয়ব তুক্ বা কলি নামেও পরিচিত। গানের অবয়ব চার প্রকার যথা:
(ক) আস্থায়ী বা স্থায়ী বা মুখ
(খ) অন্তরা
(গ)সঞ্চারী
(ঘ)আভোগ।
আস্থায়ী বা স্থায়ী : স্থিতি অর্থে আস্থায়ী উদ্ভব হয়েছে। গান, আলাপ, গৎ প্রভৃতির শুরু ও স্থিতি আস্থায়ীতে। আস্থায়ীর স্বরবিন্যাস মূলত উদারা ও মুদারা সপ্তকের স্বরে হয়। গানের প্রথম কলি বা তুক্কে ‘আস্থায়ী বা স্থায়ী’ বলা হয়।
অন্তরা : আস্থায়ী থেকে অন্তরে অবস্থিত বলে অন্তরা নাম দেয়া হয়েছে। গানের দ্বিতীয় কলি বা তুক্কে ‘অন্তরা’ বলা হয়।
সঞ্চারী : আস্থায়ী ও অন্তরা স্বরের মধ্যে সঞ্চারণ বলে সঞ্চারী নাম দেয়া হয়েছে। গানের তৃতীয় কলি বা তুক্কে ‘সঞ্চারী’ বলা হয়।
আভোগ : গানের যে স্থানে পরিপূর্ণরূপে ভোগ হয়, তাকে ‘আভোগ’ বলা হয়। গানের চতুর্থ কলিকে আভোগ বলে। আভোগ গানের শেষ কলি। আভোগের স্বরবিন্যাস অনেকটা অন্তরার মতো। তারা সপ্তকেই আভোগের কাজ বেশি। কণ্ঠে ও বাদ্যযন্ত্রে উভয় ক্ষেত্রেই আভোগের ব্যবহার রয়েছে।
গানের বর্তমান কাঠামো
মিউজিক বা বাদ্য প্রধান গানের সূচনার পূর্বকাল পর্যন্ত বাংলা গানের এই কাঠামো (আস্থায়ী বা স্থায়ী বা মুখ, অন্তরা,সঞ্চারী ও আভোগ) বহাল ছিলো। তখন গানের বাণীই ছিলো প্রধান বা মুখ্য বিষয়। পরবর্তীতে জ্যাকসনীয় যুগে মিউজিক, শারীরিক কসরত প্রধান হয়ে উঠলে গানের অঙ্গচ্ছেদ শুরু হয়। সঞ্চারী বাদ পড়ে যায় গানের কাঠামো থেকে। মিউজিকে অধিকাংশ অন্তপ্রাণ হওয়ায় গানও প্রাণহীন হতে থাকে দিন দিন।
সেক্ষেত্রে বর্তমানে মুখের সাথে দুটো অন্তরা দিয়েই শেষ নামানো হচ্ছে গান। কারণ বাণী বা কথা শোনার ধৈর্য কোথায় আধুনিক শ্রোতার। কিন্তু মনে রাখতে হবে বাণী ও ম্যাসেজ ছাড়া শুধু গান লেখার, গাওয়ার কষ্ট করার দরকার নেই। যারা শিল্পের জন্যেই শিল্প করেন তাদের কথা বলছি নে। যারা জীবনের জন্যে শিল্প করেন আমি তাদের বিষয়টি বলছি এখানে।
গানে যদি জীবন বোধের কথা, সৃষ্টির সৌন্দর্যের কথা বলতে হয়, তবে অবশ্যই গানের বাণীর দিকে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। তখন কিন্তু গানে সঞ্চারীর প্রসঙ্গটিও সামনে এসে যাবে।
প্রত্যেক গানের একটি মূল অংশ থাকে। অর্থাৎ সূচনা প্যারা বা স্তবক। যাকে স্থায়ী, আস্থায়ী বা মুখ বলেই নামকরণ করা হয়ে থাকে। আমরা গানের প্রথম প্যারাকে ‘মুখ’ বলেই ধরে নিলাম। এই মুখই কিন্তু গানের প্রাণ।
পৃথিবীতে যতো গান লেখা হয়েছে- সকল গানের মুখই আসল, মুখই সবচে আবেদনময়ী, অর্থময় ও হৃদয় সঞ্চারী।
গানের মুখটা সাধারণত ৪ (চার) চরণের হয়ে থাকে। চরণ বিন্যাসটি গীতিকারের সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা ও মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। সুরকে কীভাবে তিনি খেলাতে চান, দোলাতে চান তার ওপর নির্ভর করে। গানের মুখ ছাড়া বাকিটার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। মুখটা আগেই লেখকের মনে অনুভূতিতে জাগ্রত হয়। সেটাকে অবলম্বন করেই নিজের সৃষ্টিশীলতা ও দক্ষতা দিয়েই বাকি লাইন কটা আমরা লিখে থাকি।
আলোচনার সুবিধার্থে আমার লেখা একটি হামদ-এ- বারি তায়ালাকে নিম্নে উল্লেখ করলাম:
“ততোবার ক্ষমা করে দাও
যতোবার করি আমি ভুল,
আলো দাও দাও বাতাস পানি
তোমার দয়ার নেই কোন তুল।।
::::
যতোবার দূরে যাই যাই আঁধারে
ভেসে যাই বেদনার নীল পাথারে,
ততোবার করুনার বৃষ্টি ধারায়-
ঝরে যেন নূরানী ফুল।।
::::
ভুল করে ভুল স্বরে জপি প্রিয় নাম
বেঘোরে যায় ঝরে শত সুবহি শাম,
ভুল পথে ভুল মতে ছুটি অবিরাম-
দায় সারা যাই করে সালাত ও সিয়াম।…
::::
ঈমানের দাবি যে আরো বহু
দিতে হয় জান ও মাল বুকের লহু,
নেইতো কোন কাজে খুলুসিয়াত-
বাড়ে শুধু জীবনের ভুল।।
(সুর: মশিউর রহমান
কণ্ঠ: হাসানুল বান্না ও মোবারক)
এই গানটি আমরা লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবো প্রথম চারটি চরণের গুরুত্ব ও আবেদন কতোটুকু।
কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত ইসলামী গানের মুখটা আমরা শুনে নিতে পারি:
আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান/
কোথা সে মুসলমান।
কিংবা,
ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ
এলোরে দুনিয়ায়,
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস
দেখবি যদি আয়।
আামাদের অগ্রজ কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইয়ের প্রসিদ্ধ একটি গানের মুখটা এমন:
টিকটিক টিকটিক যেই ঘড়িটা
বাজে ঠিক ঠিক বাজে,
কেউ জানে না সেই ঘড়িটা
লাগবে কয়দিন কাজে।
এবার শিল্পী সুরকার গীতিকার অগ্রজ তোফাজ্জল হোসেন খানের পরিচিত একটি মুখ দেখি:
আল্লাহ আমার রব
এই রবই আমার সব,
দমে দমে তনুমনে
তারই অনুভব।
শ্রদ্ধাভাজন শক্তিমান গীতিকার কবি মরহুম গোলাম মোহাম্মদের একটি গানের মুখটা এমন:
হলদে ডানার সেই পাখিটি
এখন তো আর ডাকে না
মনের কোণে রঙিন ছবি
এখন সে আর আঁকে না।
এভাবে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। যেখানে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে – একটি গানের মুখই যে তার প্রাণ, মূল চেতনার উৎসভূমি। তাই গানের মুখের ভাষা, ছন্দ, অন্ত্যমিল পরম গীতল ও সুচিন্তিত, সুআরোপিত, সুবিন্যস্ত এবং সুপরিকল্পিত হওয়া আবশ্যক।
নবীন বন্ধুদের জন্যে বলছি,
আমার হামদের দিকে আবারও চোখ রাখো। দেখো সেখানে (মুখে) চারটি চরণ আছে। গান কবিতার প্যারা বা স্তবকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: সুনির্দিষ্টি একটি ভাব ও বিষয়বস্তুকে ধারণ ও প্রলম্বিত করে প্যারার শেষ পর্যন্ত টেনে নেয়া বা বিন্যস্ত করা। এখানেই একজন লেখক বা গীতিকারের স্বাতন্ত্র্য বা মৌলিকত্ব নির্ভর করে। আমরা অনেক সময় কিন্তু মনের অজান্তে ভাব ও বিষয়কে গুলিয়ে ফেলি। তখন সুরকার বিরক্ত হন, শ্রোতাবৃন্দও অস্বস্তি অনুভব করেন।
লক্ষ্য করো:
“ততোবার ক্ষমা করে দাও
যতোবার করি আমি ভুল,
আলো দাও দাও বাতাস পানি
তোমার দয়ার নেই কোন তুল।”
এই মুখের প্রথম দুটো চরণকে আমি যদি ঘুরিয়ে দিতাম এভাবে:
যতোবার করি আমি ভুল
ততোবার ক্ষমা করে দাও..
কোন শব্দতো পরিবর্তন করিনি, শুধু ১ম চরণকে ২য়তে আর ২য়কে ১ম চরণ হিসেবে প্রতিস্থাপন করেছি। এখানে আগের সেই দোলা বা রিদমকে কী খুঁজে পাচ্ছি! নিশ্চয়ই না। অথবা যদি লিখতাম:
ক্ষমা করে দাও ততোবার
ভুল করি আমি যতোবার..
এখানেও কি পাচ্ছি ঠিক দোলার জায়গাটা খুঁজে? এই বোধটুকুন আমাদের খুব খুব জরুরী।
ভাব ও বিষয়ের সাথে একাত্ম হয়ে অনিবার্য শব্দের গাঁথুনিতে মুখকে নির্মাণ করাই একজন সফল গীতিকারের প্রধান কাজ।
গানের অন্ত্যমিল বা চরণের বিন্যাস নিয়ে পরে কথা বলবো আশা করি। আগে কাঠমোটার বাকি কথা সেরে নিই।
গানের মুখের পর আমাদের অগ্রজেরা গানকে আরও তিনটি ভাগে বিভক্ত করে গান রচনা করতেন। তার কথা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি।
বর্তমানে দুটো অন্তরা থাকছে অধিকাংশ গানেই। মুখের চরণ বিন্যাস, মাত্রা বিন্যাসের বাইরে যেয়ে নতুন আরেকটি বিন্যাস, নতুন আরেকটি চমকের সৃষ্টি করাই গীতিকারের কাজ। যেখানে সুরেরও আসবে রূপান্তর ও বৈচিত্র্য।
আমার লেখা উপরের হামদের মুখটার সাথে অন্তরার পার্থক্যটা খেয়াল করে দেখো:
যতোবার/ দূরে যাই/ যাই আঁধারে
ভেসে যাই/ বেদনার / নীল পাথারে,
ততোবার /করুণার /বৃষ্টি ধারায়-
ঝরে যেন/ নূরানী ফুল।।
মুখের মাত্রা বিন্যাস ছিলো ০৮ (আট) করে। অন্তরার প্রথম তিন চরণে তার ব্যতিক্রম করে ১০ (দশ) মাত্রার প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। আবার ৪র্থ চরণে অন্ত্যমিল সহ মুখের মাত্রা বিন্যাসে (০৮ মাত্রা) ফিরে গেছি। প্রথম অন্তরার মতো মাত্রা ও অন্ত্যমিলের বিন্যাস রাখতে হবে শেষ বা ২য় অন্তরাতেও।
উদাহরণতো দেয়াই আছে:
ঈমানের / দাবি যে/ আরো বহু
দিতে হয় / জান ও মাল/ বুকের লহু,
নেইতো কোন কাজে/ খুলুসিয়াত-
বাড়ে শুধু / জীবনের ভুল।।
অন্তরার অন্ত্যমিল দেয়া হয়েছে ১ম ও ২য় চরণের (আঁধারে+ পাথারে, বহু+ লহু) , ৩য় চরণ স্বাধীন রেখে ৪র্থ চরণের মিলটা দেয়া হয়েছে মুখের অন্ত্যমিলের সাথে সমন্বয় রেখে।
সঞ্চারী
এবার সঞ্চারীর দিকে চোখ ফেরানো যাক। সঞ্চারী কথাটাই তো প্রলম্বিত করা, দ্যোতনা সৃষ্টি করা। ভাবকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দেয় সঞ্চারী। আবেগকে আরও প্রগাঢ়, আরও ঘনীভূত, আরও বেগবান ও যথার্থ করে তোলে সঞ্চারী। সেখানে সঞ্চারীর আবেগকে ধারণ করার উপযোগী শব্দের ব্যবহার অপরিহার্য । মাত্রা ও অন্ত্যমিল প্রয়োগেও বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন।
যেমন দেখো হামদের সঞ্চারীটা:
“ভুল করে/ ভুল স্বরে/ জপি প্রিয় নাম
বেঘোরে /যায় ঝরে/ শত সুবহি শাম,
ভুল পথে / ভুল মতে/ ছুটি অবিরাম-
দায় সারা/ যাই করে / সালাত ও সিয়াম।”…
আশাকরি সঞ্চারীর শব্দের বাঁধন, মাত্রার গাঁথুনি ও অন্ত্যমিলের স্বাতন্ত্র্যটা চোখে পড়েছে, কান ও মনেও অনুরণিত হচ্ছে নতুন দ্যোতনায়।
মনে রাখবে এখন নিয়ম কানুনের কথা কেবল তাদের জন্যেই প্রযোজ্য যারা ছন্দ মাত্রার হিসেব কিতেব করে গান কবিতা লিখতে চায়। আর যারা ছন্দ মাত্রার হিসেব ছাড়া আ্ধুনিক গান-কবিতার নামে গা ভাসিয়ে দিতে চায়- তারা সব সময় স্বাধীন, বেপরোয়া, লাগামহীন।
তাদের নিয়ে আমার কোন কথা, কোন বক্তব্য আগেও ছিলো না, এখনও নেই। শুধু বলি : ছন্দ মাত্রার হিসেব কষে লেখার অক্ষমতা থেকেই তাদের আধুনিকতার অভিলাষ, অন্য কিছু নয়। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নামান্তর মাত্র।
দ্বিতীয়ত:
গানের শব্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগ প্রসঙ্গ:
নবীন বন্ধুরা অনেকেই প্রশ্ন করেন গানের ভাষা বা শব্দ কেমন হবে, কিংবা অলঙ্কারের প্রয়োগটা কিভাবে হবে? সোজা সাফটা জবাব আমার:
গানের ভাষা তথা শব্দ হতে হবে গীতল সুরেলা এবং কোমল। যতোদূর সম্ভব সংযুক্ত ব্যঞ্জন/ বর্ণ পরিহার করাই ভালো। তবে সংযুক্ত ব্যঞ্জন একবারেই ব্যবহার করা যাবে না তা নয়। গান কবিতায় শব্দ প্রয়োগ লেখকের সৃজনশীল সংবেদনশীল মন মননের ওপরই নির্ভর করে। কাউকে বলে দিয়ে হবার বিষয় নয় এটা।
গান লেখার সময় গীতিকার বা লেখককে অবশ্যই একটি ফাউন্ডেশন সুরের ওপর ভর করতে হবে। গুনগুন করে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গাইতে হবে এবং লিখতে হবে। আগে গেয়ে চলা, পরেই লেখা। যেখানে যে শব্দে খটকা লাগবে, নিজের কাছেই বাধাগ্রস্ত মনে হবে-সেখানেই কলম চালাতে হবে।
মনে রাখতে হবে: এই জায়গাতেই সুরকার হোঁচট খাবেন, শিল্পী দ্বিধান্বিত হবেন, শ্রোতা বিরক্ত হবেন।
গানের অলঙ্কার
অলঙ্কারের কথায় আসি এবার। সাহিত্যে মূলত দুধরনের অলঙ্কারের প্রয়োগ হয়ে থাকে। শব্দালকঙ্কার ও অর্থালঙ্কার। যথাযথ অলঙ্কার ছাড়া গান কবিতা স্থায়ী হবে না। শুধু কঠিন জটিল শব্দ দিয়েই অলঙ্কার হয় না। কখনও ঘাস ফুল, ভাট ফুল দিয়ে জ্বল জ্বল করে ওঠে কারো মুখ।
সহজ শব্দের মধ্যে আমরা চমৎকার অলঙ্কার ছড়িয়ে দিতে পারি (অলঙ্কার বিষয়ে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পাঠটা শেষ করার আহ্বান থাকলো)। এসব বিষয় একদিনেই আয়ত্ব করার জিনিস নয়। প্রতিনিয়ত আমাদের শেখার মধ্যে থাকতে হবে, অর্জনের মধ্যে কাটাতে হবে, নতুন উদ্ভাবনী দৃষ্টি ও মনন থাকতে হবে। তার সাথে যোগ করতে হবে একাগ্রতা, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা এবং কঠোর নিয়মতান্ত্রিক পরিশ্রম ও অনুশীলন।
রেডিমেট বা মেসৈুমী লেখক কবি গীতিকার বানের পানির মতো। ভেসে যাওয়ার জন্যে মাথা তুললে হবে না। শেকড় গাড়তে হবে মাটির সুগহীনে।
শব্দ প্রয়োগ ও অলঙ্কারের দৃষ্টান্ত এক ফ্রেমেই বেঁধে দিতে চাই। এসময়ের সম্ভাবনাময়ী প্রতিশ্রুতিশীল আমার অনুজ প্রিয় গীতিকার ও কবি বিলাল হোসাইন নূরীর একটি গানের মুখটা লক্ষ্য কর:
“মনের ভূবন ধুসর হলে কোরান পড়ো
তখন তোমার হৃদয় হবে সবুজ পাতা,
পাতার ফাঁকে ফুটবে নতুন গোলাপ কুঁড়ি
রঙিন হবে আমল নামার মলিন খাতা।”
কী মায়াময় ভাষাশৈলী, কী কোমল অনিন্দ্য অলঙ্কারের প্রয়োগ! সত্যি বিমোহিত হই বার বার।
তৃতীয়ত:
গানের অন্ত্যমিল
একজন সফল গীতিকার তার ইচ্ছে মতোন অবশ্যই অন্ত্যমিল দিতে পারবেন, যদি তিনি প্রতিটি ছন্দের অন্তর্গত প্রাণশক্তি ধারণ করতে পারেন, কানকে সজাগ রেখে চরণের গতিকে ধরে রাখতে সক্ষম হন। গানে উনিশ বিশ কী নিরানব্বই একশত এই তারতম্য টুকুনও কেমন জানি লেখকের ব্যর্থতা ও দৈন্যকে প্রকট করে তোলে।
প্রচলিত অন্তমিলের কয়েকটি ধারণাকে (চার চরণ বিশিষ্ট স্তবকের অন্ত্যমিল) নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ
খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ
গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ
ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি)
ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ
চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি)
এর বাইরেও বিচিত্র অন্ত্যমিল দেয়া যেতে পারে। তবে একটি গানের মধ্যে এক এক প্যারায় এক এক রকম না করে প্রথম থেকে শেষ পর অবধি একই রকম অন্ত্যমিল ও মাত্রা বিন্যাসকেই আমরা আদর্শ বলতে পারি।
নিরীক্ষার নামে যাতে কোন বিশৃঙ্খলার সুযোগ তৈরি না হয়, তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
প্রচলিত কয়েকটি অন্ত্যমিলের দৃষ্টান্ত নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ :
সকল জীবের তুমি খালিক
তুমি অশেষ একক অসীম,
দোজাহানের তুমি মালিক
তুমি গাফুর মহা মহীম।।
খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ):
মল বাজিয়ে মেঘের খামে
সারা দিনই বৃষ্টি নামে,
বৃষ্টি নামে ফোটায় ফোটায়
কদম কেয়া ফুলের বোটায়।
গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ
সোনার দেশে সোনার মানুষ কই
যেদিক তাকাই ডাকাত এবং চোর
গুমের ভয়ে আটকে রাখি দোর
আমরা তবু চুপটি করে রই।
ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি)
অলসতা কেউ করি না
উঠি সকাল বেলা,
ভালো করে মুখ ধুয়ে নিই
কেউ করি না হেলা।
ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ
স্বপ্ন আমার সবুজ শীতলপাটি
জোয়ার ভাটার নিরেট পলিমাটি
স্বপ্ন বোনার স্বপ্নে বিভোর হাঁটি
স্বপ্ন তবু হয় না পরিপাটি।
চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি)
পায়ের নিচে সবুজ শ্যামল ভূমি
জোছনা নেমে যায় যেন তার চুমি
ফারাক্কার ঐ মরণ বাঁধের ফলে-
বাঁচা মরার সংগ্রামে আজ তুমি!
চতুর্থত:
গান রচনায় ছন্দের প্রয়োগ
বাংলা ভাষায় সাধারণত তিন প্রকার ছন্দ রয়েছে। যেমন:
ক) অক্ষরবৃত্ত খ) মাত্রাবৃত্ত এবং গ) স্বরবৃত্ত।
গান রচনার ক্ষেত্রে সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দকেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্বরবৃত্ত ছন্দকে ছড়ার ছন্দ ও গানের ছন্দ বলে থাকেন অনেকেই। স্বরবৃত্ত ছন্দটি দ্রুতলয়ের, সহজবোধ্য, সাবলীল।
সবরবৃত্ত ছন্দ ছাড়াও অক্ষরবৃত্ত, বিশেষ করে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে অসংখ্য সফল গান রচিত হয়েছে। বিষয়টি নির্ভর করে গীতিকারের সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর। তার দখলে কী পরিমাণ শব্দ ভাণ্ডার আছে কিংবা শব্দ ব্যবহারে কতোটা কারিশমা আছে তার ওপরই নির্ভর করে। ছন্দকে তিনি কীভাবে প্রয়োগ করবেন সেটি তার সাধারণ বোধ ও বিবেচনার বিষয়।
স্বরবৃত্তে লিখলেই যে গান ঝলমল করে উঠবে আর মাত্রাবৃত্তে বা অক্ষরবৃত্তে লিখলে যে গান ঝুলে যাবে এমনটি ঠিক নয়।
-//আরো পড়ুন // ছন্দ শেখার পাঠশালা //-
স্ববরবৃত্ত ছন্দে লেখা আমার একটি গানের (নাত) উদাহরণ দিই এখানে:
দূর আরবের মরুর বুকে
একটি ফোটা ফুল,
দীন দুঃখীদের বন্ধু সে যে
মোহাম্মাদ রাসূল।
::
সুনীল নভে চাঁদ সেতারা
যার নামেতে মাতোয়ারা,
যার আগমন খবর পেয়ে
হাসে আলম কুল।।
::
বর্বরতার পাষাণ বুকে
মরতো মানুষ ধুকে ধুকে
তাদের দিলো পথের দিশা
ভাঙলো হাজার ভুল।।
:::
পাপী তাপীর সহায় যে জন
সেই তো আমার বন্ধু স্বজন,
সর্বকালের সেরা মানুষ
নেই যে তাহার তুল।।
(সুর ও কণ্ঠ: মশিউর রহমান)
এবার অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একটা গান দেখাচ্ছি।
কলুষিত আঁধারের ঘন ঐ চাদরে
পড়েছিলো ঢাকা যত সুরভী বকুল,
পথ হারা মানুষেরে জোছনার আদরে-
বুকে তুলে নিয়েছিলো আখেরী রসূল (স.)।।
::::
হেরার গুহাতে তার কেটেছিলো ক্ষণ
বিনিদ্র রজনী ছিলো ব্যথাভরা মন।
মুক্তির ঠিকানা পাবে কিভাবে ধরণী-
সেই ধ্যানে প্রিয় নবী ছিলো যে আকুল।।
::;:
জিবরাইল এসেছিলো ঐশী বাণী নিয়ে
তোমার রবের নামে পড়ো মোহাম্মদ,
থরো থরো কেঁপেছিলো নীরব পাহাড়
শিহরিত হয়েছিলো প্রিয় প্রেমাষ্পদ।…
:::::::
ঢেকে দাও ঢেকে দাও ত্বরা করে প্রিয়
খাদিজাও পেয়েছিলো ইশারা স্বর্গীয়।
মুক্তি পেলো মানবতা সুখ এলো ফিরে-
স্বস্তি এলো লোকালয়ে অশেষ অতুল।।
সবশেষে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত আমার একটি গানের দৃষ্টান্ত দেখি:
তোমার দুয়ারে অবনত শিরে
ফেলি আঁখি ধারা
তুমি যে আমার বড় প্রিয়তম
দাও দাও সাড়া।।
:::
তোমার অপার অতুল রহমে
তোমার মোহন অশেষ করমে
সবুজ পৃথিবী এতো মনোময়
এতো মাতোয়ারা।।
:::
তোমার আদেশে বাতাসের পালে
দোলা দিয়ে যায় কদমের ডালে
মিনারের সুরে রূপোলি দুপুরে
প্রেমে হই সারা।।
গান মূলত স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা ভালো। বিশেষ করে নবীন গীতিকারের জন্যে। স্বরবৃত্ত ছন্দে সাধারণত চার মাত্রা করে পর্ব বিন্যাস করা হয়ে থাকে। মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর সবই একমাত্রা করে হয়ে থাকে।
মুক্তাক্ষর বলতে যে অক্ষর উচ্চারণে বাতাস কোথাও বাঁধা প্রাপ্ত হয় না, ইচ্ছে মতো শ্বাসের প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন: বলাকা (ব/ লা/ কা) । এখানে তিনটি মুক্তাক্ষর, তিনটি মাত্রা গুনবো আমরা। আবার যে অক্ষর উচ্চারণে বাতাস বাঁধা প্রাপ্ত হয়, সেটা বদ্ধাক্ষর। যেমন: বালক (বা/লক্), এখানে ‘বা’ মুক্তাক্ষর এবং ‘লক্’ বদ্ধাক্ষর। গান কবিতা লিখতে গেলে এবিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
শেষকথা:
ক্ষুদ্র পরিসরে গান রচনার কলা কৌশল নিয়ে আলোকপাত করলাম। এখানে বিবেচনার মৌলিক বিষয় হচ্ছে: ছড়া গান কবিতাসহ সাহিত্য সংস্কৃতির কোন শাখা প্রশাখার সুনির্দিষ্ট সংঙ্গা, প্রকৃতি , ধরণ, বৈশিষ্ট্য এবং রচনাকৌশল বেঁধে দেয়া সম্ভব নয়।
যুগে যুগে এসবের ধারণা পাল্টায়। শক্তিমান লেখকেরা অন্যের দেখানো পথে না হেঁটে নিজেই স্বাতন্ত্র্য পথ বা ধারা নির্মাণ করেন। নতুন পথ দেখান পাঠক শ্রোতা শুভাকাঙ্ক্ষীদের। গান রচনায় নবীন গীতিকার একটি নির্দিষ্ট ফরমেট ব্যবহার করে লিখবেন সেটাই প্রত্যাশা।
তেমনি যোগ্যতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখে ধূমকেতুর মতো কেউ কেউ বেরিয়ে আসবেন নতুন মুখরতায়, নতুন পথের পথনির্দেশক হিসেবে, শোনাবেন আলোকদীপ্ত ভোরের আজান; আমি সে প্রত্যাশায় কান পেতে আছি। গান লেখার নিয়ম , গান লেখার নিয়ম , গান লেখার নিয়ম , গান লেখার নিয়ম , গান লেখার নিয়ম , গান লেখার নিয়ম , গান লেখার নিয়ম , গান লেখার নিয়ম, গান লেখার নিয়ম ,
নরসিংদী# ০৯ জুন,২০১৭