একটি পূর্ণিমা রাত ও কিছু স্মৃতি
উম্মুল খাইর ফাতিমা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম এক বছর শহর থেকে ট্রেনে করে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে ক্লাস করতাম।তাই শহরের বান্ধবীদের সাথেই ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।হলের বান্ধবীদের সাথে তেমন মিশতে পারতাম না।এরপর যখন হলে চলে আসি তখন প্রথম প্রথম নিজেকে খুব একা একা লাগতো।তেমন কারো সাথে পরিচয় ছিলো না। নতুন করে কারো সাথে পরিচয় হতেও ইচ্ছে হতো না।সারাদিন একাকী বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকতাম।শাটল ট্রেনের স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াতাম।প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ট্রেনে সিট রাখার জন্য ছুটে চলা, কখনো বা ঘুম থেকে উঠতে দেরী হওয়ায় ট্রেন মিস করে আক্ষেপ করা অথবা চলন্ত ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠা, কখনো কখনো ট্রেনের জানালা দিয়ে উদাস নয়নে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া,মুগ্ধ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কল্পনায় মেঘের ভেলায় চড়ে দূর- বহুদূর পাড়ি দেওয়া, রেল লাইনের দু’পাশে অবাক বিস্ময়ে দাড়িয়ে থাকা কৌতূহলী শিশুদের হাত নেড়ে বাই বাই দেওয়া,
কখনো কখনো রেল লাইনের দু’ধারে বস্তি গুলোর নোংরা পরিবেশ দেখে বিরক্ত হওয়া অথবা ট্রেন চলতে চলতে দু’পাশের ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শির-শির বাতাসে দুলতে থাকা ধানের চারা গুলোর দিকে অবাক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকা, শাটলের বগি মেম্বারদের গান শুনে বিরক্ত হয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে রাখা অথবা তাদের সাথে সাথে সুর করে গুণগুণিয়ে গান গাওয়ার স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়তো।সবচেয়ে বেশি মনে পড়তো বান্ধবীদের কথা।তাদের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলোর কথা।পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি কিনে চারজনে ভাগাভাগি করে খাওয়া, ‘মউর দোয়ান’ এ প্রতিদিন পিয়াজুর জন্য ভীড় করা, শসা বিক্রেতা মামার ”শসা খাইলে ফর্সা হবা, গাজর খাইলে গোলাপী হবা” স্লোগান শুনে হেসে লুটোপুটি খাওয়া, ট্রেনে বসে রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করা,কখনো কখনো আমাদের অতিরিক্ত প্যানপ্যানানীতে আশপাশের মানুষকে বিরক্ত হতে দেখে আলোচনার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেওয়া।শাটল ট্রেনের সাথে জড়িত এইসব মূহুর্তগুলো খুব মিস করতাম আর শহরের বান্ধবীদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে গোমড়া মুখে বসে থাকতাম।
আরও পড়ুন–জিনের বাদশা-কাজী নজরুল ইসলাম এর চমৎকার গল্প
সময়ের বয়ে চলার সাথে সাথে মন খারাপের মাত্রা ও কমতে থাকলো।হল লাইফ ধীরে ধীরে আনন্দময় হয়ে উঠল।কারণে অকারণে হলের ছাদে গিয়ে মুগ্ধ নয়নে আল্লাহর সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতাম।চবির একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অধিকাংশ ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং এবং হলগুলো পাহাড় কেটে তৈরী করার ফলে বিল্ডিংগুলো পাহাড় আর সারি সারি বন বিথীকায় পরিবেষ্টিত থাকে।গোধূলী লগ্নে হলের ছাদ থেকে পুরো ক্যাম্পাস দেখতে ঘন বন-জঙ্গলের মত মনে হয়।যেন চারদিকে সবুজ আর সবুজের সমারোহ।পাহাড়ের বড় বড় গাছগুলোর মাথার উপর মেঘের উড়াউড়ি আর সন্ধ্যাবেলা নীড়ে ফেরা পাখিদের কিচির- মিচির শব্দ অদ্ভুত মোহাবিষ্টতা সৃষ্টি করে।অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করে।পাখিদের উড়াউড়ি দেখে নিজের ও উড়ে উড়ে দূর- দিগন্তে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।
রাতের আকাশ তো আরো বেশি সুন্দর।আমি প্রায় সময় পূর্ণিমা রাতে একা একা ছাদে যেতে খুব পছন্দ করি।কখনো কখনো পূর্ণিমা রাতে আকাশ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি টের ও পাইনা।ইচ্ছে হয় সারাটা রাত আকাশের সাথে মিতালী করে ছাদেই কাটিয়ে দেই।
এক পূর্ণিমা রাতের ঘটনা।রাত দশটার দিকে একাই ছাদে গিয়েছি আকাশ দেখার জন্য।চাঁদের আলোয় ছাদটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল।চাঁদের আলো যেন চারিদিকে ঠিকরে পড়ছিল।অপার বিস্ময়ে চারদিকে তাকাচ্ছিলাম আর স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টিতে মুগ্ধ হচ্ছিলাম।ছাদে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুণছিলাম।কখনো কখনো কল্পনাবিলাসী হয়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে পাড়ি দিচ্ছিলাম, কখনোবা বিভিন্ন গ্রহে গিয়ে এলিয়েনদের সাথে সখ্যতা করছিলাম কিংবা মহাশূণ্যে ওজনহীন হয়ে বিচরণ করছিলাম।আবার চাঁদের বুড়ির সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম, কতটুকু সুঁতা বুনেছে দেখছিলাম কিংবা চাঁদের বুড়ির সাথে অভিমান করে চরম ঝগড়া করছিলাম।
এভাবে কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে কখন যে রাত দু’টা বেজেছে টের ও পাইনি।ঘড়িতে টাইম দেখেই রুমে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লাম।হঠাৎ হলের পাশের পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখি, জমাট বাঁধা অন্ধকারে কি যেন ছোটাছুটি করছে।মনে হলো যেন,জমাট কালো কিছু একটা আমার দিকে ছুটে আসছে আর রোমা……. রোমা ……. রোমালিয়া……বলে আমাকে ডাকছে।ভূত-প্রেতে বিশ্বাস না করা অতি সাহসী আমিও চরম ভয় পেয়ে পালাতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় কানের পাশে বিকট চিৎকার শুনে পড়ে যায়।
চোখ খুলে দেখি, আমি রুমের বিছানায় শুয়ে আছি।আমাকে ঘিরে আপুরা চরম উৎকন্ঠা নিয়ে দাড়িয়ে আছে।কি হলো কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আপু ঘটনা খুলে বললেন।যা শুনলাম- এতরাতেও রুমে ফিরছিলাম না বিধায় রুমমেটরা আমাকে ডাকতে যায়।ঠিক ঐ মূহুর্তেই আমাকে ভয়ে পালাতে দেখে ওরাও চরম ভয় পেয়ে চিৎকার দেয়।আর তখনই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই।ঘটনার বিবরণ শুনে নিজের বোকামী এবং ভীরুতার জন্য খুব বিব্রত হচ্ছিলাম।কারণ,সাহসের বড়াই করা আমিই তাদের সামনে ভয়ে কুপোকাত।