You are currently viewing মল্লিকীয় গানের স্বতন্ত্র ধারা: বিপন্ন সম্ভাবনা পর্ব-০৩ (শেষ পর্ব)
কবি মতিউর রহমান মল্লিক

মল্লিকীয় গানের স্বতন্ত্র ধারা: বিপন্ন সম্ভাবনা পর্ব-০৩ (শেষ পর্ব)

(আমার কৈফিয়াত: মল্লিকীয় গানের স্বতন্ত্র ধারা:বিপন্ন সম্ভাবনার ২য় পর্বটি পোস্ট করেছিলাম বিগত ১০আগস্ট-২০১৭ তারিখে। বেশ অনেকদিন পেরিয়ে গেলো। মাঝখানে প্রলয়ঙ্কারী বন্যায় বিপন্ন করেছে আমাদের স্বপ্ন স্বদেশ। সৃজন মননে লেগেছে প্রচণ্ড ধাক্কা। এর মধ্যে বানভাসি মানুষের গান লিখেছি নিজের তাগাদায়।অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের জন্যে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি সবার কাছ থেকে এবং আজ

ধারাবাহিকভাবে আলোচনা শুরু করছি।)

মল্লিকীয় গানের শ্রোতা কারা?

মরহুম গীতিকার সুরকার শিল্পী ও কবি মতিউর রহমান মল্লিক অসংখ্য গান লিখেছেন, গান করেছেন। এসব গানের টার্গেট ছিলো কেমন শ্রোতা? কাদের প্রতি তার বিনম্র আহ্বান ছিলো-তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। সেটা যথার্থভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলে অনেক কিছুতে আমাদের তালগোল পাকিয়ে যাবে। তার উদ্দেশ্যকৃত বা টার্গেটকৃত শ্রোতা পাঠক ছিলেন তারই বিশ্বাসের সহচর, অনুগামী। একটি আধুনিক ও কল্যাণময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যারা বিভোর, অতন্ত্রপ্রহরী, সাহসী সিপাহসালার।ঘাত প্রতিঘাতে কখনও ভেঙে পড়া কাণ্ডারী, অন্যের দুঃখ বেদনায় মুষড়ে পড়া ওমরের দিল।পার্থিব কোন মোহ লালসা তাকে স্পর্শ করেনি,তার চাওয়া পাওয়া সবই ছিলো মহান রবের দরবারে।

কবি মল্লিক নিজের ঘরের মানুষকে, পথ চলার সঙ্গীকেই গান শুনিয়েছেন, সুরে সুরে সাহস যুগিয়েছেন। তিনি তার বিশ্বাসের ঘরকে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন প্রাণপণে।তার আকুতি ছিলো:

যা কিছু করতে চাও করতে পারো

অনুরোধ শুধু এই ঘর ভেঙো না।

এবুক ভাঙলে ভাঙতে পারো

অনুরোধ শুধু ওগো পর হয়ো না।…

নিজের কাছের আপন জনদেরকে মানব সম্পদে পরিণত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি সেই সকল মানুষের কাছে যেতে চেয়েছিলেন-যারা সত্যের কাফেলায় ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছেন, শপথ নিয়েছেন জীবন বিলাবার, দুর্গম পথ পাড়ি দেবার। এজাতীয় বন্ধু সুজনেরা পথ চলতে যেন থেমে না যান- গানে গানে সেই মন্ত্র দিয়েছেন মতিউর রহমান মল্লিক। সে কারণে দু.সংকটে, সম্ভাবনায় আমরা তার গানের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তার গানই আমাদের কাছে এতো প্রিয়, এতো আবেদনময়ী,এতো অল্প সময়ের মধ্যে কালজয়ী সুরের ঝরণাধারা বলে পরিগণিত হলো। তার সুর, তার কথা কোটি বিশ্বাসী মন মননে শিহরণ তুললো। মরুর বুকে যেন হঠাৎ বৃষ্টি এলো, ক্ষরার তাপে পুড়তে থাকা মনে স্নিগ্ধ জোছনার পরশ লাগলো।

এই ভালোলাগা ভালোবাসার সাথে না ছিলো শিল্পী গায়ক সাজার বাসনা, না ছিলো পেশাদারীত্বের মনোভাবে অর্থবিত্ত অর্জণের কোন মোহ।না ছিলো আম জনতার কানে কানে নতুন আবেশের ঝংকার তোলার অভীপ্সা। তিনি সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, কিন্তু সব শ্রেণি পেশার মানুষকে রাতারাতি বদলে ফেলার আকাঙ্ক্ষায় নিজের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেন নি মনের ভুলেও।

প্রাসঙ্গিক বিষয়টিকে বোধগম্যযোগ্য করার জন্যে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি মল্লিক ভায়ের লেখা গান থেকে:

ক) কথায় কাজে মিল দাও আমার রাব্বুল আলামীন

আল জিহাদ ফি সাবিল্লিাহ রাখো বিরাম হীন।…

খ) এখানে কি নেই খালিদের মতো কেউ

এখানে কি নেই সালাদ্দীন সম কেউ

এখানে কি নেই তারিকের মতো কেউ

এই দুর্দিনে অভিযান চালাবার।…..

গ) ধৈর্য ধারণ করার শক্তি

দাওগো মেহেরবান আমায়

দাওগো মেহেরবান.,

বুকের ভেতর ব্যথার নদী

বইছে অবিরাম।…

 

কবি মল্লিকের গান একাডেমিকের চেয়ে আদর্শিক গুরুত্ববহ:

তথাকথিত আধুনিক গানের শিল্পী সুরকার গীতিকারগণ মনে করেন মতিউর রহমান ক্ল্যাসিক সঙ্গীত সম্পর্কে ধারনা রাখতেন না।গানের আধুনিক ফরমেট তিনি ব্যবহার করেন নি। পান খেতে যেমন চুন লাগে, তরকারীতে নুন লাগে-তেমনই গানে বাদ্য বাজনা লাগে। বাদ্য বাজনা ছাড়া তাদের মতে গান পানসে লাগে।

এসব সুরাপ্রিয়-মদ্যপ(সবাই নন,কেউ কেউ),নারীসক্ত,উন্মাতাল,পরশ্রী কাতর, অর্থ বিত্তের ধান্ধাবাজ, ক্ষমতার সুবিধাভোগী সঙ্গীতজ্ঞদের মতো ছিলেন না মল্লিক। ‘আমি-তুমি’ কেন্দ্রিক গানের স্রষ্টা সাধকও তিনি ছিলেন না।তার জনপ্রিয়তা যাচাই এর ব্যারোমিটার এখনকার ফেসবুকীয় লাইক-কমেন্টস-শেয়ার-কপি শুধু নয়।

কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গান এ্যাকাডেমিক বিচার বিশ্লেষণে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক হচ্ছে তার আদর্শিক বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা। তথাকথিত ক্ল্যাসিক সঙ্গীতজ্ঞরা যদি মল্লিকীয় ধারাকে সাপোর্ট করবেন, তবে তাদের পেশা-নেশা্ কোথায় থাকে! তাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেইতো মল্লিকীয় ধারাকে বাঁধাগ্রস্থ করতে চাইবেন।একাজটি অনেকেই পরিকল্পিত ও সূক্ষ্মভাবেই করে যাচ্ছেন। ইসলামী ঘরানার শিল্পীরা তাদের কাছে গেলে কেউ কেউ সবক দেন- “কী গান গাও তোমরা-তাল নেই,লয় নেই। শিল্পী হতে হলে তোমাদের আগে ক্ল্যাসিক শিখতে হবে।’ সরলমনা শিল্পী তখন নিজেকে ব্যর্থ মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেন। শুধু শিল্পী নয়- ক্ল্যাসিক বিশেষজ্ঞদের শিকারে পরিণত হচ্ছে মল্লিকীয় ঘরানার কিছু কিছু সুরকার-গীতিকারও।তাতে মল্লিকীয় ধারা ক্ষতিগ্রস্থ তেমন না হলেও মল্লিক বিরোধী আদর্শিক ধারা লাভবান হচ্ছে।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক প্রচলিত ছন্দমাত্রা তাল লয়ের সব শৃঙ্খলা অনুসরণ করেন নি-তা সুস্পষ্ট। এটা আলাদা আলোচনার বিষয় বটে। তিনি তার লেখায় প্রাধান্য দিয়েছেন আদর্শিক চেতনা-বিশ্বাস-ঐতিহ্যিক বোধকে। প্রকৃতপক্ষে তিনি গান শুনাতে চান নি কখনো,আমাদেরকে ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন, প্রাণিত করতে চেয়েছেন, সাহসী ও স্বাপ্নিক হতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। প্রকৃতির পাঠে মনোনিবেশ করে ফুলের সাথে, পাখির সাথে,নদীর সাথে একাকার হয়ে তিনি আমাদের শুনাতে চেয়েছেন একত্মবাদের কোরাস। এটার গুরুত্ব উপলব্ধির জন্যে বিশ্বাসের দ্যুতিতে উদ্ভাসিত আত্মনিমগ্ন প্রেমানুভূতি প্রয়োজন। প্রয়োজন বিবেকের স্বচ্ছ দর্পণে পৃথিবীকে দেখার, মৃত্যুর পরের জীবনকে প্রত্যক্ষ করার দূরদৃষ্টি। মহান রব বোধহয় মল্লিক হৃদয়ের সুপ্ত বাসনাকে কবুল করেছেন- নয়তো পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে যেখানে বাংলা ভাষাভাষি বিশ্বাসী মানুষ আছে, সেখানে পৌঁছে যেতো না এমন চিত্রকল্প:

এই দুর্যোগে এই দুর্ভোগে আজ

জাগতেই হবে জাগতেই হবে তোমাকে

জীবনের এই মরু বিয়াবানে

প্রাণ আনতেই হবে প্রাণ আনতেই হবে তোমাকে।

::

জড়তার দেশে দাও দাও হিন্দোল

বহাও বন্যা তৌহিদী হিল্লোল

 অমারাত্রির সকল কালিমা মুছে

সূর্য উঠাতেই হবে উঠাতেই হবে তোমাকে।…

এখানেইতো মল্লিকের সার্থকতা, অপরিহার্যতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং অমরতা।

 

মল্লিকের গানের ঈর্ষণীয় প্রভাব বলয়,মিডিয়ার পরিবর্তিত অবস্থান:

এখান থেকে দশ পনেরো বছর যদি আমরা পেছন ফিরে যাই তবে দেখবো দুর্যেোগে সংকটে আপদকালীন সময়ে যেমন ঘুর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড জাতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এবং রমজান মাসসহ বিভিন্ন ইসলামী দিবসে রেডিও টেলিভিশনে বাদ্যপ্রিয় শিল্পীরা (পুরুষেরা পাঞ্জাবী পরে , মেয়েরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে) গাচ্ছেন:

: শোন শোন ইয়া ইলাহী

আমার মোনাজাত…

:ওরে পূবাল হাওয়া

তুই যাবি কিরে সোনার মদিনায়

আমার সালাম পৌঁছে দিস

নবীজীর রওজায়।…

:নবী মোর পরশ মণি

নবী মোর সোনার খনি

নবী নাম জপে যেজন

সেইতো দোজাহানের ধনী।…

এজাতীয় কিছু ইমলামী গান। যার অধিকাংশই লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, কিছু ফররুখ আমমদ, সাবির হোসেন চৌধুরী, তালিম হোসেন, ফজল-এ-খোদা, কে.জি মোস্তফা। কিছু মাজারপন্থী, মারেফতী,দেহতান্ত্রিক ভক্তিমূলক গান, নবী রাসূল ও পীর অলীদের জীবন নির্ভর গজল প্রকৃতির গানও আপদকালীন সময়ে পরিবেশিত হতো বলে আমার বিপন্ন স্মৃতি বলছে।

সময়ের বিবর্তনে দেখুন স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে, ইউটিউব –ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে এখন প্রতিনিয়ত মল্লিকীয় ধারার গানের চর্চা হচ্ছে, পরিবেশনা চলছে,

রিয়েলিটি শো চলছে। টিভি চ্যানেলগুলো বিজনেস মার্কেট হাত ছাড়া হবার ভয়ে কিছু নিজেদের ব্যবস্থাপনায়, কিছু চাং বিক্রি করে সরগরমভাবে ইসলামী গানের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এক্ষেত্রে কোন বিতর্ক বা আর্থিক ক্ষতির কারণ তারা দেখছে না। এই যে পরিবর্তন-তা কিন্তু মল্লিকীয় ধারারই সাফল্য নিঃসন্দেহে।

আমরা আরও দেখতে পাই- বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর বিশেষ করে গ্রামীণ,রবি,বাংলালিংক তাদের সংগ্রহশালায় শতশত ইসলামী গান সংরক্ষণ করছেন। প্রতিনিয়ত এখন কোটি কোটি মোবাইল ব্যবহারীকারী দ্বিধাহীন ভাবে মল্লিকীয় ধারার বাদ্যবিহীন ইসলামী বা ভক্তিমূলক সুস্থ ধারার গানের রিং টোন, ওয়েলকাম টোন ব্যবহার করছেন। ফোন কোম্পানিগুলো এসব ইসলামী গানের রয়্যেলটি প্রদান করছেন। ব্যক্তিগতভাবে শতসহস্র আইটি প্রিয় বা আইটি বিশেষজ্ঞ মানুষজন অনলাইন টিভি, চ্যানেল, ইউটিউব, ভাইবার,ইম্যু, ফেসবুকসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামী গানের প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ লাইভ অনুষ্ঠান করছেন। অসংখ্য দর্শক শ্রোতা এসব গান উপভোগ করছেন, ইমানী চেতনাকে শাণিত করছেন, মনের খোরাক পাচ্ছেন। এই সাফল্যকে আমাদের অভিনন্দিত করতে হবে।

এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় শিল্পী মোস্তাফা জামান আব্বাসী, খালিদ হোসেন, সোহরাব হোসেন, ফাতেমা তুজ জোহরা,আব্দুল মান্নান, মিল্টন খন্দকার,আবু বকর সিদ্দিক, ইয়াকুব আলী খান, হায়দার আলী,লিনা তাপসী খান এর মতো শিল্পী সুরকার সঙ্গীতবোদ্ধগণও মল্লিকীয় মঞ্চে এসে(আউটডোর, ইনডোর, স্টেইজ, টিভি)খালি গলায় গান পরিবেশন করতেও দ্বিধা করছেন না। তাদের অনেককেই এখন বলতে শুনি: ‘বিশ্বাসের চেতনায় উদ্ভাসিত এই গান,এই সুরের সাথে আমাদের আরও আগেই পরিচয় হবার দরকার ছিলো।’

#খালি গলায় মশিউর রহমানের দরাজ কণ্ঠের ভক্তিমূলক ইসলামী গান শুনে শিল্পী আব্বাসীরা বলতে দ্বিধা করছেন না: আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীমের অভাব এখন মশিউর রহমানরাই পূরণ করবে।এই অর্জন কোন অবস্থায় মামুলি বা ঠুনকো নয়, ছেলের হাতের মোয়া নয়, মেয়ের হাতের ঝুনঝুনিও নয়।

#কবি মতিউর রহমান মল্লিক,তাফাজ্জল হোসেন খান, গোলাম মোহাম্মদ, চৌধুরী আব্দুল হালিম,চৌধুরী গোলাম মাওলা, জাকির আবু জাফর, মাহফুজুর রহমান আখন্দ,মাসুদ রানা,আব্দুস সালাম,কবি মুহিব খান, মাহফুজ বিল্লাহ শাহী, আমরিুল মোমেনিন মানিক, আবুল আলা মাসুম,বিলাল হোসাইন নূরী বা আবু তাহের বেলালের নামটা এখন আর ভিন্ন গ্রহের বলে মনে হয় না সঙ্গীতাঙ্গনে।

#আমার প্রিয় গীতিকার অনুজ আবুল আলা মাসুমের কথা ও সুরে শিল্পী মশিউর রহমানের কণ্ঠে ধ্বনিত:

মালিক তুমি জান্নাতে

তোমার পাশে আমার একটি ঘর বানিয়ে দিও…

এই আকাঙ্ক্ষাতো এখন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, সিলটে থেকে পঞ্চগড় হয়ে আছড়ে পড়ছে ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বাংলা ভাষাভাষি বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে। এই গানে কোন্ ক্ল্যাসিকসূত্র আছে বলুনতো, কোন্ কোন্  বাদ্য বাজনা ব্যবহার করা হয়েছে, আধুনিক কোন্ কোন্ ইনস্টুমেন্ট প্রয়োগ করা হয়েছে? কোনটাই নয়। শুধু আল্লাহ প্রদত্ত কণ্ঠ,দরদ ও ভালোবাসার মূর্ছনা, পরম প্রিয়কে কাছে পাবার অদম্য আগ্রহ। আবুল আলা মাসুমের জন্যে বা মশিউর রহমানের জীবনে আর কোন কিছুর অপ্রাপ্তির আছে কি না- আমি তা জানি না।

আমি নগণ্য মহান রবের রহম বরকতে কোন একদিন লিখেছিলাম-

হাজার গানের মাঝে একটি গানও যদি

আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়,

সেইতো খুশির কথা

সেইতো সফলতা-

চাওয়া পাওয়া আর কিছু নয়।

আমার বাদ্যবিহীন এই গানটি শিল্পী মশিউর রহমানের কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময় (তারই সুরে)। আমার আকুতিতো একটাই। ডলার রুপি দিনার দেহরাম দিয়ে কী তার মূল্যমান নিরূপিত হবে কখনও! এই গান কী আসলে গানের কথা। আমরা পার্থিব জীবনে আল্লাহকে পাবার জন্যে যে যে কাজই করি না কেন-তারই রূপক প্রকাশ এই গানটি। এগানে বাদ্যের অভাব কেউ কী একবারও অনুভব করছেন?

আমরাতো বেড়ে উঠেছি কবি মতিউর রহমান মল্লিকেরই ছায়াই, তারই স্নেহে সিক্ত হয়ে, তারই ভালোবাসায় ঋদ্ধ হয়ে। মল্লিকীয় ধারার এই গানের সমৃদ্ধি আমাদের সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখানোর সাহস রাখে এখন। হীনমন্যতার দিন শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন সুস্থ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত হবার লগ্ন এসেছে। ব্যক্তির ইমেজ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন নয়, সামষ্টিক অভিযাত্রাকে সাফল্যমণ্ডিত করাই অভিযাত্রীদের লক্ষ্য হওয়া কর্তব্য।

 

মল্লিকীয় ধারার গান ও ক্ল্যাসিক বিতর্ক:

মল্লিকীয় সঙ্গীত ধারার বিকাশ ঘটেছে গানের কথা বা বাণীকে প্রাধান্য নিয়ে এবং আল্লাহ প্রদত্ত কণ্ঠকে নির্ভর করে। প্রচলিত সঙ্গীত শাস্ত্র বা রীতি নীতির প্রয়োগ ছাড়াই অন্তর্জাত উপলব্ধি আর পূত পবিত্র মননশীলতাকে অবলম্বন করেই এধারার যাত্রা শুরু। প্রচলিত সঙ্গীত শাস্ত্রের প্রয়োগ মল্লিকীয় ধারায় মোটেও মূখ্য বা উপজীব্য নয়। মল্লিকীয় ধারার গানের বাণী নি:সৃত হয় কোরান হাদীস এবং ইসলামী জ্ঞানের প্রত্যাদিষ্ট ঝরণা থেকে। যে গান যে সুর স্রষ্টার সাথে আমাদের আত্মিক সেতু বন্ধন, মেল বন্ধনে সহায়কের ভূমিকা রাখে।

মল্লিকীয় ধারার ক্লাসিক খুঁজতে প্রচলিত ক্লাসিক বিশেষজ্ঞদের কাছে গেলে আমাদের ভুল পথে পা বাড়ানো হবে। যা খাল কেটে কুমীর আনার নামান্তর বটে। অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হলেও বলি: মল্লিকীয় ধারার ক্লাসিক খুঁজতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খা, রবি শংকর, শেখ সাদী, মান্নাদে প্রমুখের কাছে নয়। বরং যেতে হবে পবিত্র কোরাণের সাত কেরাতে অভ্যস্থ হাফেজ ক্বারীর কাছে।কণ্ঠ সাধার পাঠ নেবার জন্যে যেতে হবে প্রিয় মোয়াজ্জিনের কাছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন হাফেজ কারী ও মোয়াজ্জীনের কণ্ঠ, কণ্ঠের কাজ-শৈলী, শ্বাসাঘাতের কী বিচিত্র প্রয়োগ-এসব কী ক্লাসিক বা শাস্ত্রীয় নয়? আমরা কেন রাধাকৃষ্ণ লীলাখেলা কেন্দ্রিক তথাকথিত ক্লাসিক বা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দিকে পা বাড়িয়ে নিজের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দেবার পথকে খুলে দেবো!

ইসলামী ভাবাপন্ন গানের শব্দ চয়ন যেমন শিরক বিদায়াত মুক্ত ইসলামী ঐতিহ্যাশ্রিত হতে হবে, তেমনই তার সুরে থাকবে পবিত্রতম আবেদন, পরিবেশনার ক্ষেত্রেও থাকবে স্বাতন্ত্র্য পরিবেশ ও পরিবেশনার কৌশল। আমাদের মনে রাখতে হবে: আমরা কী চাই, কেন চাই এবং কী ভাবে চাই- তার যথাযথ যৌক্তিক বিশ্বাসযোগ্য বোধ। কেউ যদি নিছক শিল্পী হবার বাসনা মন মননে লালন করেন, ইসলামী ঘরানার গান গেয়ে আর্থিক সুযোগ সুবিধা অর্জনে সচেষ্ট থাকেন-তার সাথে আমার অবস্থান বা কথার বিস্তর পার্থক্য থাকবেই। আমার কথা যুক্তি তাদের কাছে অযৌক্তিক বিবেচিত হবে।

              আরো পড়ুন- মল্লিকীয় গানের স্বতন্ত্র ধারা: বিপন্ন সম্ভাবনা পর্ব-০১ , মল্লিকীয় গানের স্বতন্ত্র ধারা: বিপন্ন সম্ভাবনা পর্ব-০২,

বর্তমান প্রেক্ষিত-বিপন্ন সম্ভাবনা:

আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি-সাধারণ বাদ্য বাজনা নির্ভর শিল্পীরা যখন ইসলামী ভাবাপন্ন গান পরিবেশন করছেন-তখন তারা বাদ্য ছাড়াই করছেন,ইতোমধ্যে তাদের অনেকের মনোজগতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে, অনেকে মল্লিকের গান খালি গলায় গাইছেন,এ্যালবাম করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন; তখন মল্লিকের ছায়ায় বেড়ে ওঠা, মল্লিকের গান গেয়ে গেয়ে শিল্পী হয়ে ওঠা, ইসলামী গানের শিল্পী হিসেবে পরিচিত কিছু শিল্পী ইসলামী ভাবধারার গানে বাদ্য বা মিউজিক ব্যবহার করতে অতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তারা কৌশল বা হিকমাতের কথা বলছেন। তারা সামী ইউসুফদের দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন-সাধারণ মিউজিক প্রিয় মানুষের কাছে নাকি তারা যেতে চান, সাধারণ মিউজিক নির্ভর গানের পরিবর্তে বাদ্য সহযোগে ইসলামী কথা সম্বলিত গান গেয়ে হেদায়াৎ করতে চান।আমি ফতোয়া দিচ্ছি না,ফতোয়া দেবার জন্যে আমি উপযুক্ত নই। তবে এটুকু সাধারণ বোধ থেকে বলতে পারি- এটা সুদান, তুরস্ক,লিবিয়িা, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালাএশিয়া কিংবা লন্ডন নয়।

আমার ঈমানী দুর্বলতার কারণে মনে করছি: হাতে গোনা দুএকজনের উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষার কারণে যারা এতোকাল মিউজিক ছাড়া ইসলামী গান শুনতেন তারও আস্তে আস্তে মিউজিকসহ গান শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন, একসময় ইসলামী গান ও সাধারণ গানের বাছ বিচারও ভুলে যাবেন। একজন যদি বাদ্যসহযোগে পরিবেশিত ইসলামী গান শুনে ইসলামের দিকে আসেন,অন্য দশজন সাধারণ যৌন উত্তেজক, নৈতিকতা বিধ্বংসী অসুরের জগতে প্রবেশ করতে পারেন ক্রমান্বয়ে। সাধারণ সাহিত্য সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র জগতের যারা খোঁজ খবর রাখেন-তারা বলতে পারবেন: ঐ জগতের বিচরণ ক্ষেত্র কতো সুনির্মল, কতোটা পবিত্র, কতোটা গ্রহণযোগ্য! এই বিতর্কটি বেশ লম্বা ও যুক্তি প্রমাণ নির্ভর, যা আলোচনা করে আমাদের সময় নষ্টের কোন উপযুক্ত কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। ঐ জগতের হাতছানি যদি কাউকে পেয়ে বসে, আলেয়ার সম্মোহনে যদি কেউ সিরাতুল মুস্তাকিমকে গৌন মনে করেন, তার জন্যে আমাদের দুঃখ করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

ইসলামী ভাবাপন্ন গানে মিউজিক প্রয়োগ বিষয়ে আমাদেরকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের ধর্মীয় পরিবেশ-আবহের নিরীখেই বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভী শর্তহীনভাবে মিউজিকের পক্ষে কখনও কথা বলেন নি।তার আলোচিত শর্তগুলো বিচার বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন আছে। একটি দুর্বল যুক্তির ওপর ভর করে আমাদের জন্যে যেটা প্রকান্তরে সমূহ বিপদের কারণ হতে পারে-সেদিকে কেন যাবো আমরা? বাদ্য সহকারে গান পরিবেশন করলে বা শুনলে সোয়াব না হলেও গোনাহের সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।

অপর দিকে ইসলামী ভাবাপন্ন কথা সম্বলিত গান বাদ্য বাজনা ছাড়া পরিবেশন করলে বা শুনলে সোয়াব না হোক (কথার কথা),গোনাহ হবার তো সম্ভাবনা নেই। তবে আমরা কেন এমন পথকে বেছে নেবো? উল্লেখ্য-বাদ্য ছাড়া গানেও গোনাহের উপকরণ উপাদান থাকতে পারে, যে গানের কথায় অশ্লীলতা আছে, নগ্নতা আছে,যৌন আবেদন আছে, নৈতিক চরিত্র বিধ্বংসী বক্তব্য আছে; তা বাদ্য ছাড়াও পরিবেশন করা ও শোনা নিঃসন্দেহে পাপাচার ছাড়া কিছু নয়। গানের কথাও তাই বিবেচ্য বিষয়।

আমাদের অঙ্গনের দুএকজন শিল্পী আন্তর্জাতিকমানের শিল্পী খেতাবে ভূষিত (নিজের গড়া সিন্ডিকেট ভক্তদ্বারা), কেউবা জীবন্ত কিংবদন্তী উপাধী শব্দে ভারী গদগদ- ইসলামী ভাবাপন্ন গানে বিশেষকরে মল্লিকীয় ধারার গানে মিউজিক ব্যবহারে জিহাদ ঘোষণা করেছেন।তারা চলনে বলনে বেশ আধুনিক,বুদ্ধিদীপ্ত,কুশলী,পেশাদারীত্বে অগ্রণী,ব্যবসায় বাণিজ্যে সফল,দূর গ্রহের বাসিন্দা।তাদের প্রচার প্রপাগাণ্ডা ও কৌশলের কারণে সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও এর ভক্ত অনুরক্তরা অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত, শঙ্কিত এবং চিন্তাগ্রস্থ। অগ্রজ বা নীতি নির্ধারকদের উন্নাসিকতা, নিরবতা অবলম্বন বা দেখি কী হয় মানসিকতা এই বিপদের শঙ্কাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। সব সময় হেকমত কল্যাণকর নাও হতে পারে, কৌশল বুমেরাংও হতে পারে।

# ইসলামী গানে বাদ্যপ্রিয়দের একজনের একটি জ্ঞানগর্ভ লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার আগস্ট – ২০১৭ এর গোড়ার দিকে। তার থেকে একটু উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি:

“৯/১১’র পর বিশ্বে তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম ফোবিয়া। এ ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয় আমাদের দেশের সংস্কৃতিও। জঙ্গীবাদের ভ্রান্ত মতাদর্শ এই ফোবিয়ার শেকড়ে পানি ঢালতে শুরু করে। ফলে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সংস্কৃতির সবগুলো নিয়ামক সংস্থা-সংগঠনে ইসলামকে ‘জুজু’ হিসেবে উপস্থাপন এবং এ আদর্শের স্পর্শ পাওয়া যে কাউকেই পরিহারের প্রবণতা জোরালো হয়। সংকট উপলব্ধি করে কতিপয় তরূণ বাংলা গানে মূল্যবোধকে ছড়িয়ে দিতে বিকল্প ভাবনা ভাবতে থাকেন। তারা বাদ্য ব্যবহারের সীমাবদ্ধতার দুয়ার ভেঙে অধিকতর জনস্রোতে আদর্শকে বিস্তার করতে বুদ্ধিমত্তার আশ্রয় নেন। মানবিক ও মূল্যবোধের একটি সাঙ্গীতিক ধারা তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করেন। এধারা খুব পরিপুষ্ট না হলেও ধীরে ধীরে এটি ইসলাম ফোবিয়ার বাইরে কর্ম কৌশলের ভাবনায় উপলব্ধির দুয়ারে কড়া নাড়ছে।”

তার বক্তব্য একটি আত্মঘাতী স্কোয়াডের মতো।এইকতিপয় তরুণ কারা? তারা যে আদর্শের কথা অধিকতর জনস্রোতে বিস্তারের কথা বলছেন-সেই আদর্শকে সত্যিকারার্থে তারা কতোটুকু গুরুত্ব দিচ্ছেন, আর মিডিয়ায় টিকে থাকার কৌশলকে কতো টা প্রাধান্য দিচ্ছেন; তা ভেবে দেখতে হবে। জীবন রক্ষার্থে হারাম জিনিসও কখনও কখনও হালাল হয়। মিডিয়ায় টিকে থাকার সংগ্রামটা কি জীবন রক্ষার মতো অপরিহার্য ছিলো? বৃহত্তর জনস্রোতে আদর্শকে বিস্তারের আগে নিজের ভেতর, নিজের পরিবারের সদস্যদের মাঝে ঐ আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা অপরিহা্র্য করে তুলতে হবে। সেদিকে আমার প্রিয় তরুণ চিন্ত্যকেরা কতোটা আগ্রহী-সে প্রশ্নটা থেকেই গেলো। তারা যে নতুন পথে যাত্রা শুরু করছেনে- নিজ সিদ্ধান্তেই। বেশি জ্ঞানী্গুণীদের মাঝে মাঝে এমনই পদস্খলন হয়ে থা্কে। নিজেকে কেউ যদি বেশি যোগ্য মনে করে, তখন সে অন্য কারো কথাকেেআমলে নিতে চান না। যারা ব্যক্তি ইমেজ বৃদ্ধির জন্যে, দর্শক শ্রোতার সংখ্যা বাড়িয়ে সেলিব্রেটি  বা তারকা খ্যাতি পেতে উদগ্রীব তাদেরতো কোরআন-হাদীস-নৈতিকতার কথা শোনানো-আর উলুবোনে মুক্তা ছড়ানো একই কথা। তবে তারা যে খাল কাটলেন এই খাল সমুদ্রে পরিণত হলে তার দায়ভার কে নেবে?

কী স্পর্ধিত উক্তি“বাদ্য ব্যবহারের সীমাবদ্ধতার দুয়ার ভেঙে” বাংলা গানে মানবিক ও মূল্যবোধের সাঙ্গীতিক ধারা নির্মাণ করলেন! তবে কী মতিউর রহমান মল্লিকের গানে মানবিক আবেদন অনুপস্থিত ছিলো এতোকাল, মূল্যবোধের প্রয়োগ ছিলো না আদৌ? যদি তাই হয়-তবে এই চিন্ত্যকেরা কোথা থেকে মানবিকতার মূল্যবোধর সবক পেলেন? মিউজিকের সুবাদে মিডিয়ায় টিকে থাকতে পারেন, নচিকেতার সাথে হেলে দুলে মঞ্চ কাঁপাতে পারেন, নিজের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে নতুন বেশভূষা

ধারণ করতে পারেন আর নিজের ইমেজ বাড়াতে পারেন মুক্তবুদ্ধির প্রগতিবাদীদের জলসায়- এর দ্বারা ব্যক্তি জীবনে অর্থবিত্ত যশ খ্যাতি অর্জনের পথ সুগম হলেও হতে পারে; এর দ্বারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই আদর্শিক বোধটা কতোটুকু তীব্র হয়েছে বা হবে তা বিবেচনার বিষয়। বাদ্যসহকারে ইসলামী গান পরিবেশনার উন্মাদনা বা কৌশল কবি মতিউর রহমান মল্লিকের স্বতন্ত্র ধারাকে শুধু শঙ্কিত করে তুলছে না, বরং বিনাশ করার আয়োজনই সম্পন্ন করছে। সুস্থ সংস্কৃতির কফিনে পেরেক ঠোকার এই অপতৎরতা থেকে বিরত থাকার জন্যে আমি বিনয়ের সাথে অনুরোধ করছি। শিল্পী হবার বাসনা তীব্র হলে, গান গেয়ে পয়সা উপার্জনের বিষয়টি মুখ্য হলে এসব ঘোমটা দিয়ে লাভ কী? টোটাল লেবাস আর খোলশটা পাল্টে বাদ্য নির্ভর ‘তুমি-আমি’-র গান গাইতে কেউতো বারণ করছে না। শুধু শুধু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পবিত্র অঙ্গনকে বিতর্কিত করে লাভ কী তাদের ভেবে পাই না!

মনে রাখতে হবে: কোরআন হাদীস পাঠ করার সময় আমরা মিউজিক ব্যবহার করি না, তবে কোরআন ও হাদিস নির্ভর কথা সম্বলিত গানে আমরা কিভাবে মিউজিক ব্যবহার করবো ? মসজিদে মক্তবে, মাদ্রাসায়,ওয়াজ মাহফিলে, জানাযায়, ঈদগাহে আমরা একটি পবিত্রতম আবহ-পরিবেশ সৃষ্টির গুরুত্ব দিয়ে থাকি। মিউজিকসহ এসব জায়গায় কী আমাদের কথাগুলো পরিবেশন করতে পারবো? এসব জায়গায় যদি বাদ্যসহ সঙ্গীত পরিবেশন সম্ভব না হয়- তবে কোথায় যেয়ে করবো? এজাতীয় সঙ্গীতায়োজনের আমাদের প্রয়োজনইবা কী? সুস্থ সংস্কৃতি ও আদর্শের প্রচার প্রসারের মাধ্যমে যদি আল্লাহর রেজামন্দী হাসিল আমাদের উদ্দেশ্য হয়- তবে সে অনুযায়ী কর্মপন্থা অবলম্বন করাও অপরিহার্য। সেলিব্রেটি শিল্পীর চেয়ে ভাঙাগলার শিল্পীর কদর আমার কাছে বেশি- যার আদর্শিক চেতনা প্রখর, বিশ্বাসের পারদ যার প্রগাঢ়, জান্নাত যার চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দু।

 

আমার গানে মিউজিক ও প্রাসঙ্গিক কথা:

আমি অনেক পরে ফেসবুকে মিউজিক বিতর্কে অংশ গ্রহণ করি। ইসলামী গানে মিউজিক ভাইরাস অনুপ্রবেশের পর হতে এর পক্ষে বিপক্ষে অনেকেই ঝড় তোলার চেষ্টা করেছেন। নিজ নিজ মতের পক্ষে ফতোয়া উদ্ধার ও প্রকাশের চেষ্টাও লক্ষ্য করেছি। অনেক দিন চুপ থাকার পর মল্লিকীয় ধারা বিপন্ন বা ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা আমার কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় আমি লিখতে বাধ্য হয়েছি। আমি সুস্পষ্টভাবে ইসলামী ভাবাপন্ন গানে মিউজিক ব্যবহারের (দফ ছাড়া) বিপক্ষে। সাধারণ গান নিয়ে আমার কোন কথা নেই, দায়বদ্ধতাও নেই। আমি যখনই এবিষয়ে কথা বলি তখনই আমার বাদ্যপ্রিয় বন্ধুরা আমার কিছু গানকে দৃষ্টান্ত দেবার চেষ্টা করেন।

আমি স্পষ্টতই বলছি: আমি যখন বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হয়েছি, তখন বাদ্যপ্রিয় অনেকের জন্মও হয় নি। আমি কোন শিল্পীকে বাদ্য সহকারে গান গাবার জন্যে কোন গান দিইনি কখনও। আমার লেখা গান কবিতা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত, ফেসবুকে প্রচারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসমস্ত মাধ্যম থেকে কেউ সংগ্রহ করে যদি বাদ্য সহকারে পরিবেশন করেন তবে দায়িত্ব তার। আমার কোন গানের কোন কথায় নগ্নতা, অশ্লিলতা নেই। যে যেভাবে গ্রহণ করবে আমার তাতে খড়গ হস্থ হবারও কারণ নেই।কা্রণ আমি গানের বিনিময়ে, কবিতার বিনিময়ে কোনদিন টাকা পয়সা উপার্জনের চিন্তা করি নি।বাংলাদেশ বেতারে প্রায় দুইযুগ ধরে আমার গান পরিবেশিত হচ্ছে, সেখান থেকে একটা টাকাও আজ পর্যন্ত আমি গ্রহণ করি নি।আমার প্রত্যাশা-আমার গান বাদ্যবাজনা ছাড়াই মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হবে, মল্লিকীয় ধারায় অবদান রাখবে।

শেষ কথা: ইসলামী ভাবধারার গানে বাদ্য ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি বা কোরআন হাদীসের দৃষ্টান্ত প্রয়োজন হবে, বিপদগামীতার সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে- অপর পক্ষে বাদ্য ছাড়া গাওয়ার পক্ষে কোরআন হাদীসের কোন দলিল প্রয়োজন হচ্ছে না, আলেম ওলামাদের নিয়ে বহাসের দরকার হচ্ছে না। মল্লিকীয় ধারার যেভাবে বিকাশ লাভ করেছে, যেভাবেই থাকলে কারো লাভ না হলেও ক্ষতির আশঙ্কা বিন্দুমাত্র নেই। তাই তর্ক বিতর্ক মান অভিমান ভুলে কবি মতিউর রহমান মল্লিক যে সুস্থ ধারার সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখেছিলেন-আমরা তার সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাবো আগামী দিনগুলোতে সেই প্রত্যাশা রাখি। যারা এই ধারার সাথে একাত্ম থাকতে পারবে না বা চাইবে না তাদের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাই ফয়সালা করবেন।

(দ্রষ্টব্য: আমার আলোচনায় কেউ কষ্ট পেলে. ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি আমার ব্যক্তি স্বার্থে কোন কথা বলিনি। সুস্থধারার জীবন বোধ ও সংস্কৃতির প্রয়োজনে যা বলার বলেছি। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন, হেফাজত করুন।) কবি মতিউর রহমান মল্লিক । কবি মতিউর রহমান মল্লিক । কবি মতিউর রহমান মল্লিক । কবি মতিউর রহমান মল্লিক। কবি মতিউর রহমান মল্লিক। কবি মতিউর রহমান মল্লিক ।

 

Leave a Reply