You are currently viewing একটি চিঠি ও অব্যক্ত কথা । আলানূর হোসাঈন

একটি চিঠি ও অব্যক্ত কথা । আলানূর হোসাঈন

একটি চিঠি ও অব্যক্ত কথা ।

সেদিন তুমি বলেছিলে এই জগতে আমার আপন বলে রক্তের সম্পর্কের কেউ নাই। সবাই মারা গেছে অনেক আগে। তোমাকে আমার কিছু না বলা কথা বলবো। আজ রাতে আমার কাছে থাকবে, এক সাথে রাতের খাবার খাবো, গল্প করবো। আমি বললাম , ঠিক আছে দাদা আমি থাকবো আপনার অব্যক্ত কথাগুলো শুনবো।

সেদিন আমার সম্মতি পেয়ে তুমি যে কি খুশি হয়েছিলে! বুঝাতে পারবো না। বাজার থেকে মাছ,গোস্ত,দুধ,কলা এনে পাক করেছিলে। এই প্রথম তুমি দ্বিতীয় কারো জন্য পাক করেছিলে। গত ৩৫বছর যাবত শুধুমাত্র নিজের একার জন্যই খাবার রান্না করতে।

আমি তো সন্ধ্যার পরে তোমার ছোট্ট কুটিরে এসেছিলাম তোমার সাথে সারা রাত গল্প করবো বলে। কত আদর করে আমাকে খাইয়ে ছিলে, আমার খাওয়া দেখে তোমার চোখে মুখে কত সুখ দেখেছিলাম যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার চেহারায় ভর করেছিল। শুধু অপেক্ষা করছিল তোমার অব্যক্ত কথাগুলো বলার জন্য যে কথাগুলো জগতের কারো কাছে কখনো বলনি।

তুমি আমার বাবাকে বলেছিলে যে, আলানূরকে আমার কিছু কথা বলবো ও যেন আমার সাথে থাকে। আমার বড় ভাইকেও বলেছিলে।

তুমি জানতে আমি রাত পোহালেই কোটালীপাড়া চলে যাবো। আমার তো তেমন একটা সমস্যা ছিলো না তোমার সাথে রাত কাটানোর।

বাসা থেকে বড় ভাই এসে বলল , কাল কোটালীপাড়া যাবি মায় বাড়ি আসতে বলছে , খুব সকালে যেতে হবে দেরী হলে গাড়ী পাবি না। শুনে তুমি কষ্ট পেয়েছিলে তবে বুঝতে দাওনি। আমার কিছুই করার ছিল না আমি চলে এলাম এক অজানা প্রবাসে।

২০০১ সালে ছোট আলানূরের কাছে কোটালীপাড়া ছিল একটা প্রবাস। কত নতুন মানুষ , সবকিছু নতুন। কোনও বন্ধু ছিলোনা একা একা শুধু তোমার কথা ভাবতাম। কবে শুনবো তোমার অব্যক্ত কথাগুলো। একমাস পর সন্ধ্যাবেলা মামা বলল, তোর নামে একটা চিঠি এসেছে । আমি অবাক হয়ে বললাম, এমন কে আছে যে,আমার নামে চিঠি পাঠাবে ! চিঠিখানা হাতে নিয়ে দাদার ঠিকানা দেখে আনন্দ আত্মহারা হয়েছিলাম।

তুমি তো জনতে তখন কোন মোবাইল ফোন ছিল না চিঠিই ছিল একমাত্র যোগা যোগের মাধ্যম। তাও পাঠানোর ২৫দিন পর চিঠি আসতো ।

চিঠির খাম খুলে অবাক হয়ে যাই ! হায়এটা কী ! একজন বৃদ্ধ মানুষ মনে এত রং কি করে থাকে শৈল্পীক কারুকার্যে ব্লেড ভাজে চিঠিটি আটকানো আরো অবাক হয়েছিলাম প্রতিটি ভাঁজেটাকাটাকা ১০টাকার কিছু নোট দেখে বেশ সময় লেগেছিল ভাঁজগুলো খুলতে এই ভাঁজ সাবধানে না খুললে ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে চিঠি খুলেই যখন চোখ পড়লো লেখার দিকে এতটাই অবাক হলাম যে, কতক্ষণ একা একা হাসছিলাম সেকি চোখ জুড়ানো আর্ট দিয়ে চিঠিটির চার দিকে সাজানো যা তুমি নিজ হাতে এঁকেছিলে

চিঠিটি পড়ে আরো আনন্দ পেয়েছিলাম।

তুমি দারুণ একটা ছন্দও লিখেছিলে,

’’ভালো আছি ভালো খাই, মাছ না পাইলে গোস্ত চাই

রাতের মশা দিনের মাছি, তোমার দোয়ায় ভালো আছি’’

আমি চিঠিটি খুব যত্নের সাথে ডায়েরীতে ভাঁজ করে রেখেছিলাম যখন তোমার কথা মনে পড়তো চিঠিটি খুলে হাসতাম।

তুমি জানো না একদিন কে যেন চিঠিটি কোন অপ্রয়োজনীয় কাগজের সাথে ভুলক্রমে দুই ভাগ করে ফেলল, দেখি মেজের উপর দুই অংশ দুই দিকে পড়ে আছে। ঐ সময় মনে হলো আমার হৃদয়টি দুটি টুকরো হয়ে গেল। দাদা, তুমি জানো না, ঐদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে ডায়েরীতে চিঠির অংশ দুটি রেখে দিলাম। মাঝে মাঝে ডায়েরী খুলে দেখে হাসির বদলে অশ্রুহীন কান্না করেই রেখে দিতাম।

শুনেছিলাম কয়েকমাস পর আরেকটি চিঠি তুমি পাঠিয়েছিলে কিন্তু কোটালীপাড়া আসেনি, আসলে নিশ্চই পেতাম। তুমি আমাকে কতটা গভীর ভাবে ভালোবাসতে সেটা আমাকে তুমি জানাতে পেরেছিলে। শুধু আমিই না আমার বাবা, মা ,বানাতিপাড়া মাদ্রাসার অধিকাংশ সহ বাজারের অনেকেই জানতো আমার প্রাতি তোমার ভালোবাসার কথা।

কিন্তু আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসতাম সে কথা তুমি জানতে না। তুমি জানতে কিনা জানি না আমি খুব লাজুক ছিলাম, লজ্জা ছিল, সহজ কথা সহযে বলতে পারতাম না। আমার ভালোবাসা ছিল অপ্রকাশিত। কেউ জানতো না। তুমি জন না এই রোগটি আমার এখনও আছে আগের মতন। এজন্য তোমার আলানূরকে অনেকেই পাষাণ, সিমার, নোনাকাটা বলে মানে লবন পানির মানুষ বলে, মায়া মমতা বলতে আমার নাকি কিছুই নেই।

এই উপাধি সত্যি হবে আমি জানতাম না। আমি কি আসলেই হৃদয়হীন ? আমার হৃদয়ে কি আসলেই কোনও মায়া দয়া নেই? একটি চিঠি

তুমি বলতে পারো এর উত্তর কেন মিলাতে পারছি না। জানি তুমি জবাব দিবে না। তোমার কাছে জানতে চাওয়া ঠিক হবে না, আমাকেই এর জবাব মিলাতে হবে।

যাই হোক একটু ছন্দ পতন হয়েগেলো। তূমি জন না সেই চিঠিটি আমার কাছে অনেকদিন ছিল। একদিন ভাবলাম চিঠিটি দুই খন্ড থাকলে হারিয়ে যেতে পারে। আজ সাদা টেপ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে কোটালীপাড়ার ঘাঘর বাজারে গিয়ে লেমেনেটিং করে রাখবো। তুমি জান না সেদিন কী হয়েছিল! আচ্ছা, তূমি কি আমার কাছে চিঠিরুপে এসেছিলে? তা না হল ঐ দিন আমার সাথে এত নির্মম আচরণ কেন করলে। কেন কাঁদালে আমাকে ? আমার চোখ থেকে শেষ পর্যন্ত পানি বেড় করে ছাড়লে!

ডায়েরী খুলে দেখি তুমি নেই এখানে, সেখানে অনেক খুঁজলাম। চিঠিটি আর পেলাম না ! কেন এত ভালোবাসা ছিল তোমার চিঠিটির প্রতি অথচ তুমি এর কিছুই জানতে না। আমি তো তোমাকে জানাইনি। সেদিন থেকে তোমাকে কেন যেন কম কম মনে পড়তো।কারন তুমি আমাকে খুব কাঁদিয়েছিলে। তুমি দুটি চিঠি পাঠিয়ে কোনও উত্তর পাওনি অথচ প্রথম চিঠির উত্তর দুদিন পরেই প্রিয় বন্ধু আমির হোসেনের ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার চিঠি পায়নি জানিয়েছিল। একটি চিঠি

৫মাস পরে ৪দিনের জন্য বাড়িতে বেড়াতে আসলাম তোমার সাথে কেন যেন দেখা করতে পারলাম না। কোটালী পাড়া এসে আবার ৭ মাসে নানা দুঃখ কষ্ট সইতে না পেরে মামার সাথে রাগ করে স্থায়ী ভাবে বাড়িতে চলে আসলাম। আবার বানাতীপাড়া মাদ্রাসায় এক বছর লস দিয়ে নবমে ভর্তি হলাম। তুমি তো জানতে আমাদের বাসা থেকে তোমার নিবাস মাত্র ১২মিনিটের পথ , মাদ্রাসা থেকে ৩০মিনিটের পথ ।

অথচ কোটালীপাড়া থেকে এসে তোমার সাথে একদিনও দেখা করলাম না । আমার বন্ধুরা এসে আমাকে বলত বাজারের ঐ বৃদ্ধ মানুষটি তোমার সাথে দেখা করতে চায়।সে তোমার কথা অনেককে অনেকবার বলেছিলে।

একদিন বাবাও বলল লোকটা তোকে এতো ভালোবাসে অথচ কোটালীপাড়া থেকে এসে তার সাথে একবারও দেখা করনি, সে আমার কাছে খুব অনুযোগ করেছে, যা একবার হলেও দেখা করে আয়। তবুও একবারও যাইনি তোমার সাথে একটু দেখা করতে। বাজারে কতবার গিয়েছি তার হিসেব নেই অথচ যে রোডের পাশে তোমার বাসা ঐ রোডেই যেতাম না, এই ভয়ে যদি তোমার সাথে দেখা হয়! কিন্তু কেন ? কেন ? কেন ? এর উত্তর আজো খুঁজে পাই না।

এভাবে অনেকদিন চলে গেল। একদিন আমীর ভাই ও আবুবকর ভাই আমাকে বলল সেই লোকটি খুব অসুস্থ একবার গিয়ে দেখে আয় । মাদ্রাসার যার সাথেই দেখা হয় তোর কথা বলে। তখনও আমি যাইনি ওদের কথা গুরুত্ব দেইনি। তুমি কেন আমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলে? কখনও নিজেকে প্রশ্ন করিনি।

জানো তার কিছুদিন পর বন্ধুরা এসে আমাকে কী সংবাদ দিলো? …………………………তোমার মৃত্যুর ! হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার মৃত্যুর সংবাদ …………………….মৃত্যুর ! হায় ! একি করলাম ……….আমার হৃদয় তখনো টলেনি ! বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম জানাজা কথন হবে ? কোথায় হবে ? বন্ধুরা বললো সোহেল ডাক্তারের বাড়িতে হবে । একটি চিঠি

আপন বলতে তার কেউ নেই , তার জন্মস্থান ছিল গোপালগঞ্জ । সোহেল ডাক্তার তার ফামের্সির পাশে তাকে যায়গা দিয়েছিল । তার বাড়িতেই দাফন হবে।। বন্ধুরা বলল তুই যাবি না ? আমি ওদের কিছুই বললাম না । তখনও আমার হদয়ে অনুভব হয়নি সে মারা গিয়েছে । আমি তাকে শেষ দেখাও দেখতে যাইনি। এক সপ্তাহ পর থেকে হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হতে শুরু করলো । নিরবে শুধু কান্না আর কান্না——-

সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।সে আমাকে কি বলতে চেয়েছিল জগতবাসী জানতে পারলো না । চার পাশে এতো মানুষ থাকতে কেন আমাকেই ভালোবাসলেন ! যে তার বিন্দু পরিমাণ মূল্য দিলো না। কে দেবে তার জবাব ? আমার মত এমন অপাত্র এই জগতে আছে বলে জানা নেই । একটি চিঠি

আজ ১৯ বছর হয় তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন । আমার প্রতি কত আশা ছিল তার । কারো মৃত্যু ঘণিয়ে আসলে মানুষ তার কি আশা আছে জানতে চায় , পূরণ করবার জন্য অস্থির হয়ে যায় । আর আমি কি করলাম !

আজ শুধু বৃথাই কান্না করছি। হে আল্লাহ তার সাথে কি দেখা হবে আমার ? হে আল্লাহ তুমি আমার এই আশাটি পূরণ করো । পরকালে হলেও তার সাথে দেখা করবার ব্যাবস্থা করো। হে আল্লাহ তুমি তাকে জন্নাতের সর্বচ্চ মর্যাদা দান করো । আমিন।।———— ক্ষমা করে দিও দাদা———-দাদা আমাকে ক্ষমা করে দিও ———।।।। একটি চিঠি,

Leave a Reply