নীল পাঞ্জাবী | ঈদ গল্প
ঈদের আর তেমন একটা দেরি নেই। হাতেগোনে আর মাত্র ১০ দিন। যে যার মতো করে প্রস্তুত হচ্ছে ঈদের জন্য।
তিন বন্ধু আরাবী, মাহি ও নাঈম হাটঁছে গাঁয়ের পার্শ্ববর্তী সুরমার পাড়ে। নদীর পাড়ে দৃষ্টিনন্দন সবুজ ঘাসের গালিচার উপর বসে পড়লো তিন বন্ধু। কথার ফাঁকে উঠলো ঈদ প্রসংগ। এবারের ঈদকে কে কীভাবে উদযাপন করবে, কীরকম কাপড় পরবে, কোথায় ঘুরতে যাবে এ নিয়ে আলোচনা সবার মুখে।
কিন্তু কথা নেই আরাবীর মুখে। বুকটা কেমন তার দুরুদুরু করছে। ছোটভাই ফারাবীর বায়না, পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ ইত্যাদি কেমনে সামান্য বেতন দিয়ে সামাল দেবে ইত্যাদি ভাবছে সে। এবারের ঈদে ফারাবী বায়না ধরেছে একটা “নীল পাঞ্জাবী”র জন্য। পরিবারের বড় ছেলে আরাবী এবং পরিবারের মূল চালিকাশক্তিও সে। তাই ছোটভাইয়ের বায়নাটা পূরণ করতে হবে তাকেই। গল্প শেষে উঠলো তিন বন্ধু। মাহিন ও নাঈম আরাবীর খুব কাছের বন্ধু।সেই ছোটবেলা থেকেই ওদের সাথে বন্ধুত্ব আরাবীর।
নাঈম ও মাহিন দশম শ্রেণিতে পড়লেও আরাবীর ৮ম শ্রেণিতেই থেমে যায় ক্যারিয়ার। ৮ম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার কিছুদিন পর মারা যান আরাবীর বাবা আ:জলিল। পরিবারের বড় ছেলে বলে পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে আরাবীর উপর। ছোটভাই ফারাবী ও মা সালেহা বেগমকে নিয়েই ওদের পরিবার। পরিবার পরিচালনার জন্য বাবা হয়েই কাজে নামতে হয় আরাবীকে। প্রথমে একটি শপিং মলে কাজ করলেও বর্তমানে একটি রেষ্টুরেন্টে কাজ করে সামান্য বেতনের কর্মচারী হিসেবে। এই সামান্য বেতন দিয়েই কোন রকমে চালিয়ে নেয় পরিবার। মা সালেহা বেগম কাজ করতে চাইলেও সে সুযোগ দেয়নি আরাবী।
ছোটভাই ফারাবীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আরাবী। ফারাবীর সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করে সে। বাবার অভাব কোনদিন বুঝতে দেয়নি ওকে। আর’ক দিন পরেইতো ঈদ। দিন যত এগোচ্ছে চিন্তাটাও ওর ততো বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবারের খরচ পুশিয়ে কেমনে ছোটভাইয়ের বায়নাটা মিটাবে এবং তার প্রবল ইচ্ছে তার আম্মুকেও একটা শাড়ি দেবে। কারণ গত ঈদেও আম্মুকে কিছু দিতে না পেরে মনেমনে বলছিল এই ঈদে দেবে। গত মাসে রেষ্টুরেন্ট চুরি হওয়ায় এবারের ঈদে বাড়তি কোন বোনাস ও নেই। তাই কেমনে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা আরাবী। ঈদের দু’দিন আগে বেতন পেল আরাবী। রাতেই চলল ঈদের কেনাকাটায়। পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটার শেষে কাপড় কেনার অবশিষ্ট টাকা থাকেনি হাতে। এতদিন ফারাবীকে বেতনের অজুহাত দেখিয়ে দমিয়ে রাখলেও আজ ফারাবীকে কি জবাব দেনে ভাবছে আরাবী। ঘরে ঢুকতেই দৌড়ে আসে ফারাবী।
আরও পড়ুন–রাজবন্দীর চিঠি – রাজবন্দীর জবানবন্দী – কাজী নজরুল ইসলাম
ঃ ভাইয়া, দেখিতো আমার পাঞ্জাবী।
ঃ অহ ভুলে গেছি ভাইয়া। কাল ইনশা-আল্লাহ নিয়ে আসবো মিস হবেনা।
এভাবে ফারাবীকে শান্তনা দেয় আরাবী। রাত্রে শুয়ে ভাবতে থাকে কেমনে কাল পাঞ্জাবী কেনা যায়। সিদ্ধান্ত নেয় সে , তার মোবাইল ফোনটা বিক্রি করে দেবে। কিন্তু ক্রেতা পাবে কই? হঠাৎ মনে পড়লো ওর সহকর্মী ফরহাদের কথা। সে বলছিল এবার বেতন পেলে একটি ফোন কিনবে। তাই সিদ্ধান্ত নেয় ওর সাথে কথা বলবে কাল। পরদিন রেষ্টুরেন্টে ফরহাদের সাথে কথা বলে আরাবী।
ঃ তুই তো বলছিলি এ মাসের বেতন দিয়ে একটা ফোন কিনবি?
ঃ বলছিলাম ঠিক, তবে নতুন ফোন কেনা সম্ভব না কারণ আম্মাকে কিছু টাকা পাঠাতে হবে দেশের বাড়িতে।
ঃ যদি পুরাতন কিনিস তাহলে আমারটা দেখতে পারিস।
ঃ তুই কি বিক্রি করবে?
ঃ হ্যা যদি কিনিস তাইলে নিয়ে নেয় আমার টা।
ঃ দিয়ে দিস।
আরও পড়ুন–শেফালীর ঈদ – রাবেয়া বেগম লাকী
ফরহাদের কাছে মোবাইল বিক্রি করে টাকা নিয়ে রওয়ানা দেয় মার্কেটে। ফারাবীর জন্য কিনে একটি নীল পাঞ্জাবী। মায়ের জন্য একটি শাড়ি এবং টাকা কম থাকায় নিজের একটি টুপি কিনে পথ ধরে বাড়ির। আজ কেমন যেনো শান্তি লাগছে আরাবীর নিজেকে কেমন যেনো তৃপ্ত মনে হচ্ছে। কাপড় নিয়ে প্রবেশ করতেই দৌড়ে আসে ফারাবী ভাইয়ার হাতে কাপড় দেখে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় ভাইয়ের দু গালে। মা সালেহা বেগম প্রশ্ন করেন ছেলেকে
ঃ বাবা টাকা পেলি কই?
ঃ মা, মোবাইল বিক্রি করে দিয়েছি।
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন ছালেহা বেগম। ছেলের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করেন তিনি। এমন ছেলে জন্ম দেয়া যেন তার সার্থক হয়েছে।