You are currently viewing ইসলামি গান : সমস্যা ও সম্ভাবনা-কবি আবু তাহের বেলাল

ইসলামি গান : সমস্যা ও সম্ভাবনা-কবি আবু তাহের বেলাল

(আরও অধিক মতামতের জন্য)

প্রাথমিক কথা:

সুর সহযোগে কোন অভিব্যক্তির কাব্যিক প্রকাশ, যা মানুষের মনকে দোলা দেয়, চেতনাকে শাণিত করে, প্রশান্ত করে;মূলত তাই গান বা সংগীত। মানুষের বিশ্বাস ও বোধের সাথে এই গান বা সংগীত নিবিড়ভাবে জড়িত। কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও প্রকাশ্যভাবে। প্রায় প্রতিটি মানুষই গান গেয়ে থাকেন- গুনগুন করে অথবা দরাজ গলায়। কাউকে শোনাবার চেয়ে নিজের মনের ক্লান্তি,অবসাদ দূর করার জন্যে, দুঃখ বেদনাকে দূরে ঠেলে দেবার জন্যে, প্রেম মমতা ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে, নিজের মন ও অনুভবকে অন্যের মাঝে সঞ্চারিত করার জন্যে আমাদের ঠোঁটে তুলে নিই গানের কলি। কখনও সম্পূর্ণ, কখনও খুব প্রিয়,খুব পছন্দের কোন চরণমালা। সুরহীন, দোলাহীন,ছন্দহীন প্রকৃতি যেমন অর্থহীন, মানুষের মনও তেমন যেন সুরের আবেশ ছাড়া মরুময় খা খা শুষ্ক প্রান্তর।

শুধু সংগীত নয়- পার্থিব জীবনের প্রতিটি কাজকে টানা মোটা দাগে চিহ্নিত করলে দুভাগে বিভক্ত করা যাবে:

ক। তাওহীদ বা মহান রবের একত্ববাদী কার্যক্রম

খ। তাগুত বা মহান রবের বিরুদ্ধবাদী কার্যক্রম।

একজন মানুষের অন্তর্গত বিশ্বাস বা চেতনাবোধের সাথে তার কার্যক্রমের যোগসূত্র জড়িত থাকে সব সময়। একজন বিশ্বাসী (ঈমানদার) মানুষ তার প্রতিটি কাজে আখিরাতের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে সামনে রেখে কাজকর্ম পরিচালনায় প্রাণিত হন। অপরদিকে একজন অমুসলিম বা অবিশ্বাসী মানুষ পার্থিব সাফল্য ও ব্যর্থতার গণ্ডীতে আবদ্ধ থেকে তার যাবতীয় কাজ, কাজের পরিকল্পনা করে থাকেন। সংগীত রচনা, পরিবেশনা, সুরারোপ সবটার পেছনে এই দুধনের অভিব্যক্তি ও মন সংযোগের বিষয়টি জড়িয়ে আছে।

এপর্যায়ে প্রশ্ন জাগতে পারে ইসলামী গান বা সংগীত কী? কী তার বৈশিষ্ট্য?এই প্রশ্নের জবাবের জন্যে বেশি গভীরে না যেয়ে,দলিল প্রমাণের বহর হাজির না করে বলা যায়-

“যে গান বা সংগীত ইসলাম বিরোধী নয়,তাই ইসলামী গান বা সংগীত।”

ইসলামী গান বা সংগীতের পরিভাষাটি বাংলা ভাষায় যুক্ত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের সময় থেকে এবং তা সুস্পষ্ট হয়েছে মরহুম কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

কিছুদিন আগেও যা গজলের মোড়কে আচ্ছন্ন ছিলো। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও ধারাবাহিকতা খেয়াল করলে আমরা মধ্যযুগের বিরাট একটি অংশ জুড়ে আল্লাহ ও নবী-রাসুলের স্তুতিবাচক অনেক লেখাই দেখতে পাবো। যাতে মানুষের জীবন ও কর্মের সংযোগ ঘটেছে কম। ইসলামের পরিপূর্ণ আদর্শ ধারণ করার পরিকল্পিত প্রয়াস তার মধ্যে অনুপস্থিত ছিলো। তাৎক্ষণিকের কোন উপলব্ধি বা যাপিত যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্যে একটি আশ্রয় বা ভরসার কেন্দ্র হিসেবে আল্লাহ ও রাসুলকেই আকড়ে ধরার বা তাতে সমর্পিত হবার বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

আমরা হযরত মুহাম্মদ স. এর জীবদ্দশায় লক্ষ্য করি- তিনি যুদ্ধ বিগ্রহের সময় সাহাবায়ে কেরামের মনোবল বৃদ্ধির জন্যে কবি হাসান বিন সাবিতসহ অন্যান্য মুসলিম কবিদেরকে কবিতা পাঠ করার জন্যে,গান গাওয়ার জন্যে উৎসাহ দিয়েছেন। প্রতিপক্ষের জবাব দেবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেদিক থেকে মূল্যায়ন করলে ইসলামী গানের ধারাটি বেশ পুরাতন এবং এর শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।

ইসলামী গান বা সংগীতের সমস্যা ও সম্ভাবনা প্রসঙ্গে আলোকপাতের পূর্বে ইসলামী সংগীতের বৈশিষ্ট্য কি হতে পারে সে বিষয়ে দু একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন।

নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

 

ইসলামী গানের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য:

ক. ইসলামী গান বা সংগীত হবে ইসলামের সৌন্দর্যমণ্ডিত। ইসলামের চিরন্তন ও শাশ্বত বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেই গড়ে উঠবে ইসলামী গানের ক্যানভাস।

খ. ইসলামী গান হবে শিরক ও বিদায়াত মুক্ত। ইসলাম যেমন একত্ববাদের আদর্শ,তেমনই ইসলামী গানের বিষয়বস্তু ও শব্দচয়ন হবে শিরক ও বিদায়াত মুক্ত। ইসলামী গানের স্রষ্টার সামনে শিরক বিদায়াত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

গ. ইসলামী গানের শব্দচয়ন হবে ইসলামের ঐতিহ্য আশ্রিত। আল্লাহ রাসুলের পাশাপাশি ইসলামের নানা অনুষঙ্গ তুলে আনতে হবে নিবিড় মমতায়।

ঘ. ইসলামী গান হবে ঈমানের দ্যোতক। ইসলামী গান শুনলে যেন আমাদের ঈমানের শক্তি বেড়ে যায়, আল্লাহর রাহে জানমাল কোরবান করার উদ্দীপনা জাগ্রত হয়-সেদিকে গীতিকারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

ঙ. ইসলামী গান হবে যৌন আবেগ ও উত্তেজনার পরিপন্থী। সাধারণ গানের মৌলিক বিষয় যখন হালকা ঠুনকো এবং সস্তা প্রেমানুভূতি,যৌনাবেগ ও অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা- তখন ইসলামী গান”তুমি-আমি”-এর বিপরীতে গড়ে তুলবে অনন্ত অসীম প্রেমময় মহান রাব্বুল আলামীনের সাথে একাত্ম হবার দুর্নিবার অনুষঙ্গ।

চ. ইসলামের মৌলিক সীমারেখাই হবে ইসলামী গানের মানদণ্ড। ইসলাম আমাদেরকে হালাল হারামের যে নির্দেশনা দিয়েছে, অর্জনীয় এবং বর্জনীয় বিষয়ের ভেদরেখা স্পষ্ট করে দিয়েছে- ইসলামী গানের সব

লেখককে তা সুস্পষ্ট মেনে চলতে হবে গান লেখার ক্ষেত্রে। ব্যক্তি জীবনেও তাকে হতে হবে ইসলামী আদর্শের পরিপূর্ণ তাবেদার।

ছ. ইসলামী গানের মূল থিম থাকবে দুনিয়ার কল্যাণ এবং আখিরাতের নাযাত লাভের অভিপ্রায়যুক্ত। মহান রব আমাদেরকে পৃথিবী বাদ দিয়ে শুধু আখিরাতের ভাবনা ভাবতে বলেন নি। পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তোলার দায়িত্বটা আমাদেরই। পৃথিবীর যাবতীয় কল্যাণলাভের আকাঙ্ক্ষাই (ইসলামের সীমারেখার মধ্যে থেকে) ঈমানের পরিচায়ক।সাথে সাথে আমাদের আখিরাত যেন কোন অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়-সেদিকেও দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে।

জ. ইসলামী গানের পরিবেশন কৌশলও হবে ইসলাম অনুমোদিত পন্থায়। পাশ্চাত্য বা ভিন্ন সংস্কৃতির কলাকৌশল রীতিনীতিকে কোন অবস্থায় গ্রহণ করা যাবে না। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে- ইসলামী গানে বাদ্য বাজনা সীমাতিরিক্ত প্রয়োগ করা যাবে না। বাদ্য বা যন্ত্রসংগীতের যতোটুকু বৈধতা আছে, সর্বোচ্চ ততোটুকুর মধ্যে আমাদের বিচরণকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

দর্শকপ্রিয়তার কথা বলে, সাধারণ মানুষের উপযোগিতার কথা বলে- ঢালাও ভাবে বাদ্যবাজনা প্রয়োগের ন্যূনতম সুযোগ নেই। বিয়ে শাদীর আসরে অনুষ্ঠানকে আনন্দময় করতে দফ বাজানোর অনুমোদনের দৃষ্টান্ত হযরত মোহাম্মদ স. এর জীবন থেকে পাওয়া যায়।এমনকি বরযাত্রীর সাথে গায়িকা নেবার কথাও রাসূল স. বলেছেন। কিন্তু এটার ওপর নির্ভর করে আধুনিক কালের ডিজিটাল ইনস্টুমেন্ট ব্যবহার করে ইসলামী গানে ঢালাওভাবে বাদ্য বাজনা ব্যবহারের সুযোগ নেই।

গানের বাণীর চেয়ে বাদ্যবাজনার উন্মাদনা বেশি থাকলে তা অবশ্যই পরিহারযোগ্য। ইসলামি গানের সাথে যারা জড়িত আছেন বা হবেন তাদেরকে এই বেসিক মানদণ্ডটা অনুসরণ করতে হবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য: সীমিত পরিসরে যে বাদ্য বাজনা বৈধতার পর্যায়ে পড়ে বলে প্রতীয়মান হয়,সেখানে কোরআন হাদীস এবং মাসনুন দোয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে বাদ্যবাজনা পরিহার করে চলতে হবে। নতুবা এর নেতিবাচক প্রভাব মুসলিম সমাজে পড়বে।

গান বাজনা প্রসঙ্গে আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভীর শর্তযুক্ত মতামতকে নতুনভাবে প্রয়োজনে মূল্যায়ন করতে হবে। যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে আমাদের

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতকে সামনে রাখতে হবে।

এসব বৈশিষ্ট্যের বাইরেও অনেক কথা রয়ে গেলো, যা ইসলামী গান বা সংগীতের বৈশিষ্ট্য বলে প্রতীয়মান হয়। সময় এবং পরিসরের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রসঙ্গটি আর প্রলম্বিত করলাম না।

ইসলামী গানের বিষয়বস্তু ও পরিধি:

“””””””””””””””””””””””””””””””””‘””””””””””””””””””””””””

আলোচনার এপর্যায় ইসলামী গানের বিষয়বস্তু ও পরিধি নিয়ে কথা বলতে চাই। গোড়াতেই বলেছি: যেটা কোন অবস্থায় ইসলাম বিরোধী নয়, সেটাই ইসলামী। সে প্রেক্ষিতে-ইসলামী গানের বিষয়বস্তু ও পরিধি হতে পারে:

ক. আল্লাহর রহম করম,শক্তি,প্রতিপত্তি,তার শ্রেষ্টত্বের পরিচায়ক যে কোন বিষয়

খ. আসমানী গ্রন্থ বিশেষ করে কুরআনুল কারীম,প্রিয় নবী হযরত স. এর জীবনাদর্শ, ত্যাগ কুরবানী

গ. সাহাবায়ে কেরামের ব্যক্তিত্ব-মাহাত্ম্য

ঘ. মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ

ঙ. আখিরাতের সাফল্য ও ব্যর্থতা,পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তোলার অভিপ্রায়

চ. দৈনন্দিন যাপিত সংসার জীবন

ছ. পৃথিবীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নির্দোষ বিভিন্ন পালা পার্বণ,উৎসব

জ. পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধা,সন্তান বাৎসল্য

ঝ. ব্যক্তিগত জীবনের সুখ স্বপ্ন,বিরহ বোধ

ঞ.সামাজিক অবক্ষয়,জুলুম,বঞ্চনা,আর্তনাদ হাহাকার

ট. পারস্পারিক অবিশ্বাস অনাস্থা

ঠ. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন, মুসলিম নিধন প্রক্রিয়া প্রভৃতি।

 

ইসলামী গানের সমস্যা:

 

মৌলিকভাবে চিন্তা করলে ইসলামী আদর্শের যে যে সমস্যা, ইসলামী গানেরও সেই সেই সমস্যা। আর সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলেই সম্ভাবনার পথও সহজেই উন্মুক্ত হবে। সমস্যাগুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি তাই আমরা সম্ভাবনার চিত্রটিই দেখতে পাবো। এখানে একটু সহজ করে ইসলামী গানের মৌলিক কিছু সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করছি:

 দৃষ্টিভঙ্গীগত সমস্যা:

আগেই বলা হয়েছে: ইসলামী গানের নামে আমাদের সমাজে বহু ধরনের গান,গজল প্রচলিত আছে। এর মধ্যে অনেক গানে শিরক,বিদায়াত,কুফুরীর মতো চিন্তা চেতনা ও দর্শনের অস্তিত্ব রয়েছে। মারেফতী, সুফীবাদী ও মাজারকেন্দ্রীক গান গুলোতে এসব প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। নবী রাসুলের জীবন ও তাদের বিশিষ্ট কর্মকাণ্ডকে রসাত্মকভাবে কল্পনার আশ্রয়ে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনার প্রবণতা দেখা যায়।

এসব গান, গজল, কাওয়ালী পথে ঘাটে যত্র তত্র নির্বিঘ্নে পরিবেশিত হচ্ছে। পরিবেশ ও পরিবেশনার মান যাই হোক- এসব গানের শ্রোতা দর্শক নেহায়েত কম নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব গানে সরকারি বেসরকারি নানা ধরণের পৃষ্টপোষকতারও নজির রয়েছে। নারীপুরুষ একই সাথে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী সহযোগে এজাতীয় গান পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতার সস্তা মনোরঞ্জনের চেষ্টা চালাতে দেখা যায়।

আমাদের ঈমান ও আকীদা বিধ্বংসী এসব গানের বিপরীতে ইসলামের প্রকৃত আদর্শপুষ্ট গানের অবস্থান সত্যিকারর্থে খুব কাঙ্ক্ষিত নয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তো নয়ই, বরং কখনো কখনো নানা ধরনের বিপত্তির মুখে পড়তে হয়। ইসলামী আদর্শাশ্রিত গান তাই সবার কাছে পৌঁছতে পারছে না।

 

ইসলামী গানের জন্যে সুনির্দিষ্ট প্লাট ফরম এদেশে গড়ে ওঠেনি:

যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ইসলামী গানের সাথে  জড়িত রয়েছেন-তাদের প্রায় একই কথা: আমাদের টিকে থাকার মতো কোন প্লাটফরম নেই। নেই তেমন কোন পৃষ্ঠপোষকতা। পেশা হিসেবে তাই ইসলামী সংগীত চর্চাকে বেছে নিতে কেউ সাহসী হয় না। এমন কি ছাত্র জীবনে অনেক সক্রীয় ভূমিকা রাখার পরও কর্ম জীবনে প্রবেশ করে অনেকেই সংগীত জীবন থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হচ্ছেন। সংগীত সত্ত্বার অকাল মৃত্যু ঘটিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অন্য পেশাকে অবলম্বন করছেন জীবন জীবিকার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে। তাই সুনির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক প্লাট ফরম গড়ে তোলা দরকার। যেন শিল্পীলেখকরা কাজের ক্ষেত্র পায়। তার যেন হতাশাগ্রস্থ না হয়ে পড়ে।

 

 ইসলামীসংগীত চর্চার কোন ইনস্টিটিউট আমাদের নেই:

কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া আধুনিক ও প্রযুক্তির যুগে বসবাস যেমন কঠিন, তারচে বেশি কঠিন কোন সৃজনশীল কার্যক্রম পরিচালনা করা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্যে দরকার প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউট। ইসলামী গান নিয়ে যেখানে গবেষণা হবে,নিয়মিত প্রশিক্ষণ হবে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদেরকে পরিকল্পিতভাবে কর্মসংস্থানের জন্যে সুযোগ করে দিতে হবে। কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা রাখতে হবে পরিকল্পিত ভাবে।

আমরা দেখি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোটা নির্ধারিত থাকে। খেলোয়াড় কোটা, শিল্পী কোটা, উপজাতি কোটা, পোষ্য কোটা প্রভৃতি। সরকারি চাকরীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কোটাও আমরা লক্ষ্য করি। সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। বেসরকারি, প্রাইভেট বা আদর্শিক সমমনাদের পরিরচালিত স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়,হাসপাতাল,সামাজিক সংস্থা,অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে এসব শিল্পী বা সাংস্কৃতিক কর্মীদের অগ্রাধিকারের ব্যবস্থা রাখা সময়ের দাবী।

তাদের ন্যূনতম একাডেমিক সনদ থাকলে-শিল্পী সত্ত্বার বিবেচনায় শিল্পীদেরকে আমরা যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি, তবে অনেকটা সহজ হবে আমাদের প্রিয় সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা।

 

মানসম্পন্ন স্টুডিও বা নির্মাণ হাউজ নেই:

ইসলামী গানের ক্ষেত্রে বিরাট একটা সমস্যা হচ্ছে- মানসম্পন্ন নিজস্ব স্টুডিও বা নির্মাণ হাউজ এখনও আমাদের নেই। ব্যক্তি মালিকানায় আমাদের অনেকেই স্টুডিও নির্মাণ করলেও সেখানে মূলধন সমস্যার কারণে প্রডাকসনের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রযুক্তি এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা পড়ে আছি অনেক পেছনে। শুধু ব্যবসায়ীক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, আদর্শিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের নিজস্ব মানসম্পন্ন স্টুডিও (অডিও, ভিডিও) গড়ে তোলা খুব জরুরী। যেখানে পেশাদারমূলক কাজ হবে। পেশাদারীত্বের সাথে যারা কাজ করতে প্রস্তুত, তাদেরকে এই স্টুডিও পরিচালনায় সংযুক্ত করা যেতে পারে।

 

প্রশিক্ষণের সুযোগ সুবিধা খুব কম আমাদের:

ইসলামী গানকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা সৃষ্টি খুব প্রয়োজন। সেজন্যে পূর্বের পয়েন্টে ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার কথা বলেছিলাম। সব পর্যায় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। গান যিনি লিখছেন- গানের লেখার ক্ষেত্রে তার প্রশিক্ষণ দরকার। যিনি সুরের কাজে মগ্ন- তাকে সুরের ওপর প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যারা কণ্ঠ শিল্পী- তাদের বাচনিক উৎকর্ষ সাধনের জন্যে প্রশিক্ষণ আবশ্যক। শুদ্ধ উচ্চারণ, যথাযথ কণ্ঠশীলনের নিশ্চয়তা বিধান জরুরী।

অনুরূপভাবে এডিটিং বা সম্পাদনার কাজে যারা জড়িত, যারা সংগীত পরিচালনা করেন; সবারই বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। একসাথে সারাদেশকে প্রশিক্ষিত করার কথা বলছি না। ক্ষেত্র ধরে ধরে কিছু মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তুললেই আপাতত কাজ চালানো যেতে পারে। মনে রাখতে হবে পেশাগত দক্ষতা ছাড়া কোন কাজে কোন সাফল্য আশা করা যায় না।

 

সেন্সর বোর্ড বা মাননিয়ন্ত্রক বোর্ড না থাকা:

তাদের কন্ট্রোল করার অনেক উপায় থাকলেও তাদের সৃজনশীল কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদের কাজের মানকে নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করা, প্রয়োজনীয় সংশোধনী প্রদান করা সেই ভাবে হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। সসাস যে মনিটরিংটা করছে তাও খুব নিবিড় নয়। সিনিয়রদের কোন প্যানেল সসাসের গান সংক্রান্ত কাজের সাথে প্রকৃতপক্ষে কতোটা কিভাবে জড়িত থাকে বা আছে (লিরিক পরিমার্জন, সুর পরিমার্জন, গায়কী ঢং বা স্টাইল পর্যবেক্ষণ, উচ্চারণ নীরিক্ষণ, পোষাক আশাক মূল্যায়ন প্রভৃতি) তা আমার বোধগম্য নয়।

বাংলাদেশে ইসলামী গানের ধারায় উৎকর্ষ বা অবনমন উভয়ের জন্যেই সসাসের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাবার মতো নয়। কারণ সসাসের অধীনে শতাধিক শিল্পীগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ইসলামী গানের ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে ব্যাপক ও বিস্তৃত। সসাসের মৌলিক চিন্তার প্রভাব নবীন শিল্পীদের ওপর প্রত্যক্ষভাবেই পড়বে। সসাস প্রয়োজন বোধ করলে বাংলাদেশ সংগীত কেন্দ্রের পরামর্শ ও সহযোগিতাও নিতে পারে।

যিনি যখন সসাসের সংগীত বিভাগের পরিচালক থাকেন,তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ অনেক ক্ষেত্রে বেশিমাত্রায় ক্রিয়াশীল থাকে বলেও প্রতীয়মান হয়। বিষয়টি এমন হলে গানের মান, পরিবেশনার মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

ইসলামী গানের মানকে সমুন্নত করতে হলে নিরপেক্ষ মানসম্পন্ন শক্তিশালী একটি সেন্সরবোর্ড থাকা অত্যাবশ্যক। যে বোর্ড আগে গানের লিরিক চূড়ান্ত করবে, তারপর সুরকারের দেয়া সুর পর্যালোচনা করবে। কথা ও সুর চূড়ান্ত হবার পরই কেবল গান প্র্যাকটিস করার জন্যে শিল্পী গোষ্ঠীর কাছে দিতে হবে। শিল্পী বা গোষ্ঠীসমূহ চূড়ান্ত রেকর্ডিং এর আগে আবারও সেন্সরবোর্ডের কাছে হাজির হবে। এভাবেই মাজাঘঁষা করতে পারলে ভালো গান বের করে আনা সম্ভব।

 

গান লেখা ও সুর করার প্রকরণ সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের অভাব:

ইসলামী গানের ক্ষেত্রে আরেকটি মৌলিক সমস্যা হচ্ছে গান লেখার কলাকৌশল ও সুরারোপের প্রকরণ সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা খুবই কম। আমরা যাদের প্রেরণায় গান লিখি বা সুর করি তাদের অনেকের সীমাবদ্ধতা ছিলো গানের প্রকরণগত। যারা গীতিকার তারা অনেকেই ছন্দ মাত্রার হিসেব না জেনেই অনুমান ভিত্তিক চরণ সাজিয়ে গান লিখে ফেলছেন।

পাশাপাশি অনেক সুরকারও আছেন যারা গানের কবিতার ছন্দ মাত্রা না জেনে না বুঝে সুরারোপ করছেন। এসব গান আমাদের কানে ও মনে ভালো লাগায় নিয়ম কানুন ছন্দ মাত্রা জানা-বোঝা বা অনুসরণ করার তাগিদ অনেকেই বোধ করেন না। আমি নিজেও একই ধারণা থেকে গান লেখা শুরু করেছিলাম। আমার প্রথম দিকের গানে ছন্দমাত্রার এলোমেলো প্রয়োগের বেশ কিছু চিত্রও রয়েছে। পরবর্তীতে আমি এসব বিষয়ে সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি।

নতুন প্রজন্মকে এবিষয়ে বিনয়ের সাথে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ছন্দ মাত্রা অন্ত্যমিলের দুর্বলতাসহ কোন গানের সুরারোপ করা হয়ে গেলে এবং তা একবার শিল্পীর কণ্ঠে উঠে গেলে- তাকে আর শুদ্ধতার পথে ফেরানো যায় না। এপ্রসঙ্গে আগ্রহী বন্ধুদেরকে আমি বিশিষ্ট কবি ও সংগীতজ্ঞ অগ্রজ মোহাম্মদ রফিকউজজামানের “বাংলা গান রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা” বইটি মন দিয়ে পড়ে নেবার অনুরোধ করছি। ছন্দ মাত্রার বিষয়ে আমার কথা অনেকের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু নিজের অবস্থানকে বোঝার জন্যে ““বাংলা গান রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা” বইটি সহায়ক হতে পারে।

 

গীতিকার সুরকারের সম্মানী প্রদানের মানদণ্ড না থাকা:

একটি গান একদিনের জন্যে করা হয় না। এর স্থায়ীত্ব প্রত্যাশা করা উচিৎ সভ্যতা যতোদিন টিকে থাকবে, টেকসই হবে- এমন প্রত্যাশার জায়গা থেকে গান করা উচিৎ। সেজন্যে গীতিকারের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও মেধার প্রয়োগ যেমন প্রয়োজন; তেমনই সুরকারও সুর করার সময় সর্বোচ্চ নিরীক্ষা করবেন, ভাবের সাথে একাত্ম হবেন। কণ্ঠ শিল্পীও দীর্ঘদিন অণুশীলন করে গানটিকে তার কণ্ঠে তুলবেন,দরদ দিয়ে পরিবেশন করবেন। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় সবারই পরিশ্রম আছে।যদিও ইসলামী সংগীতের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট,তারা অর্থের বিনিময়ে কিছু করবেন- তা যেমন প্রত্যাশিত নয়, তেমনই তাদের থেকে আমরা বিনা পারিশ্রমিকে সব গ্রহণ করবো এই মানসিকতাও নিন্দনীয় এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাফল্যের অন্তরায়ও।

পারিশ্রমিক শুরু হবে গীতিকার থেকে,তারপর পাবে সুরকার। সবশেষে শিল্পী। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে উল্টো। কণ্ঠশিল্পী তার এক গানের পারিশ্রমিক কিন্তু বহুবার পাচ্ছেন (যতবার মঞ্চে পরিবেশন করছেন,এলবাম করছেন, মোইইল রিং টোনে ব্যবহার করছেন),অথচ গীতিকার ও সুরকারের সম্মানীটার কথা কেউ ভাবছেনই না। আর ভাবলেও তার পরিমাণটা বলার মতো নয়(ব্যক্তিগতভাবে আমি গান লেখার বিনিময়ে কোন কিছু প্রত্যাশা না করলেও,বাস্তব কথাটি আমার বলতেই হচ্ছে)।

যারা গান নির্মাণে সময়, শ্রম ও অর্থ লগ্নি করে থাকেন-তাদেরকে বাইরের জগতের গান নির্মাণের বাজেটের বিষয়ে একটু খোঁজ খবর নিতে হবে। একজন গীতিকারকে শ্রেণিভেদে কতো সম্মানী দেয়া হয়, সুরকারের পারিশ্রমিকের মাত্রাটা কেমন, সংগীত পরিচালক কত টাকা পান, শিল্পীর জন্যেই বা বাজেট কতো- এসব খোঁজ খবর রাখা দরকার। আমরা সব যদি ফি সাবিলিল্লাহর কথা বলে অর্জন করতে চাই, তা কিন্তু যথাযথ হবে না। সর্বোতভাবে কপিরাইট বিধিবিধানের অজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রে ভুল বুঝাবুঝির জন্ম দিচ্ছে। এসম্পর্কেও আমাদের সুস্পষ্ট ধারনা রাখতে হবে।

 

সাংস্কৃতিক কর্মীদের সার্বিক বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান না করা:

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব সম্যক অনুধাবন করে সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রেষণা, প্রণোদনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা অতি জরুরী। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য-এই ক্ষেত্রে আমরা সবাই চরমভাবে অবহেলা ও উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করে চলেছি আজ অবধি। কোন ভালো উৎসাহবাচক নজির আমরা আজো সৃষ্টি করতে পারি নি, যা দেখে মূলত সাংস্কৃতিক কর্মীরা উৎসাহ ও গর্ববোধ করবে,নির্ভরতা পাবে, কাজের উদ্যম পাবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে যে ভাবে মূল্যায়ন করা হয়, সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীদেরকে সেভাবে করা হয় না।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক এর উৎকৃষ্টতম প্রমাণ। যে মল্লিকের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এতো অবদান- তার শেষ জীবনটা কীভাবে কেটেছে, তার চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়ে কতো কিছু করা হলো। আমাদের প্রথম সচেতন সাংস্কৃতিক সংগঠক অগ্রজ সিদ্দিক জামাল ভাই মৃত্যু বরণ করেছেন রোগে শোকে। তার পরিবারের খোঁজ খবরটাও আমরা রাখি না।

শক্তিমান কবি ও গীতিকার গোলাম মোহাম্মদ- তাকে নিয়ে আমাদের অবস্থান কী? আমাদের উদীয়মান কবি রফিকুল ইসলাম ফারুকী সড়ক দুর্ঘনায় মারা গেলেন। তার কোন নাম নিশানাও নেই আমাদের মাঝে। সম্প্রতি গীতিকার আজিজুর রহমান ভাই হাসপাতালের বেডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার পরিবার অনেকটাই বিপন্ন। সেদিকে আমাদের কারও কোন খেয়ালই নেই।

এসব দেখে-শুনে মনের বল হারিয়ে ফেলে অনেকেই। গান কবিতা তো লাঠি মেরে বের করা যাবে না। মনের স্বাভাবিক উত্থিত ভাবনারই নির্যাস এগুলো। আমাদের কর্মপন্থায়-পরিকল্পনায় এসব বিষয়গুলো স্থান দিতে হবে।

দাওয়াতের মানসিকতা থেকে দূরে থাকা ওবং লক্ষ্য স্থির না থাকা:

এখনো অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন : আগের গানের মতো বর্তমানের গানে আর প্রাণ নেই। নতুন গান যে সবই প্রাণহীন তা কিন্তু নয়। তবে নতুন গানের সংখ্যার তুলনায় প্রাণযুক্ত গানের সংখ্যা নিতান্তই কম। সাইমুম,পাঞ্জেরি,টাইফুনসহ পুরাতন শিল্পীগোষ্ঠীসমূহের পুরাতন গানগুলো এখনো কেউ গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলে মনপ্রাণ মুহূর্তের মধ্যে পুলকিত হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি তারই একটা দৃষ্টান্ত পেলাম প্রত্যাশা প্রাঙ্গনে। সেদিনের কবি গীতিকার সুরকার ও শিল্পীদের মিলন মেলায় পাঞ্জেরির অগ্রজ শিল্পী আহসান হাবীব ভাই যখন গেয়ে উঠলেন:

“ও দুনিয়ার পরশ পাথর

ঘুমিয়ে আছো এই মাটিতে ।”…

আহা কী যে মোহাচ্ছন্নতা, কী যে সম্মোহন, কী যে শিহরণ ছড়িয়ে গেলো আকাশে বাতাসে- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রিয় গানের অদেখা প্রিয় শিল্পীকে দেখে আবেগাপ্লুত না হয়ে পারে নি সেদিন। আগের গানে প্রাণ ছিলো, এখন শব্দের ঝংকার অধিকাংশই। কবি ও গীতিকার শ্রদ্ধাভাজান মোহাম্মদ রফিক উজজামানের কথায় “শব্দে শব্দে বিয়ে পড়ানো”র প্রসঙ্গটা মনে পড়ে গেলো। গানের জন্যে যে মন সংযোগ,যে একনিষ্ঠতা,যে একাগ্রতা প্রয়োজন- বর্তমানে তার উপস্থিতি খুবই নগণ্য।

আগে গান লিখতেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, গীতিকার আজিজুর রহমান, ওস্তাদ তাফাজ্জল হোসেন খান। বিশেষ করে মল্লিক ভাইয়ের কথা বলবো- তিনি নিজেই তার শিল্পী সত্ত্বার ছবি এঁকে দিয়েছেন গানে গানে,টার্গেটের কথা বলেছেন সুরে সুরে। যেমন:

১। শিল্পী গায়ক নয়তো মোদের আসল পরিচয়

২। চলো চলো মুজাহিদ পথ যে এখনো বাকি

৩। এ আকাশ মেঘে ঢাকা রবে না…

প্রথমদিকের গানগুলো লেখা হতো দাওয়াতের মানসিকতা নিয়ে, ঈমানী অনুভূতিতে প্রগাঢ় হয়ে। শিল্পী গীতিকার হবার তাগিদ তারা অনুভব করতেন না। এখন আমরা মহৎ উদ্দেশ্য থেকে অনেকটাই বিচ্যুত।

 

একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার অভাব, প্রকরণ সম্পর্কে অজ্ঞতা:

ইসলামী সংগীতের সমস্যার কথা বলতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে গীতিকার, সুরকার, শিল্পীর একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতার অভাবই প্রকট বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। কোন রকমে দায়সারা ধরণের কাজের সাথে আমরা যেন জড়িয়ে পড়ছি। অনেক গীতিকার গানের কথা সাজাচ্ছেন ছন্দ,মাত্রা,প্রকরণ,অলঙ্কার, অন্ত্যমিল প্রভৃতি না জেনেই,নিজের কাছে যেমনটি ভালো লাগছে-তেমন ভাবেই । সেই কথার ওপর আবার কোন কোন আবেগী সুরকার সুর বসিয়ে দিচ্ছেন অবলীলায়।কন্ঠ শিল্পী ও যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া রেকর্ড পর্যন্ত করে ফেলছেন। এই যে তাড়াহুড়ো ও অস্থিরতা- গানের মানকে নিম্নমুখী করছে।

 

অল রাউন্ডার হবার প্রতিযোগিতা:

মহান রব সব যোগ্যতা সবার মধ্যে দেন না- ভারসাম্য বিধানের জন্যে। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য। একই ব্যক্তি গান লিখতে পারেন,সুরারোপ করতে পারেন আবার গান গাইতেও পারেন: এটা আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ ও বিরল ঘটনাই বলতে হবে। এখন অনেকের মধ্যে সবকিছু একাই করার প্রবণতা আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। দেখা যায়- কোন শিল্পীগোষ্ঠির কেউ পরিচালক নির্বার্চিত হয়েছেন, অমনি তার প্রতিভার বিষ্ফোরণ ঘটে যাচ্ছে।

একহাতে লিখছেন, আরেক হাতে সুর করছেন, আবার গানে লিডও দিচ্ছেন। ইউটিউব বা চ্যানেল গুলোতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সিনিয়রদের থেকে গান নেয়া, সুর করানোর কথা ভুলে যাচ্ছেন। এর দ্বারা প্রবীণ ও নবীনের সেতুবন্ধনটা ঢিলেঢালা হয়ে পড়ছে, গানের মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

আমি অবাক হই- ছন্দ মাত্রার হিসেব ছাড়া জীবনে লেখা প্রথম গানটিও (!) যখন কেউ রেকর্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়, গানের কথাটা ঠিক আছে কিনা, সুরটা যথাযথ হলো কিনা- তা কারো কাছে শুনতেও প্রয়োজন বোধ করে না। নন্দনশিল্প কিন্তু ছেলের হাতের মোয়া নয়, মেয়ের হাতের ললিপপও নয়। রাতারাতি খ্যাতিমান হবার স্বপ্ন দেখা খুবই দুঃখ জনক।

 

গানের ভাব, বিষয়,অর্থ না বুঝে সুরের কাজ করা:

তাড়াহুড়ো করে সুরারোপ করার কথা আগের পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও আরও একটু বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার মনে করছি। কথার মেজাজ, গানের বিষয়বস্তু, শব্দের গাঁথুনি দেখে শুনে হৃদয়াঙ্গম করেই গানে সুরারোপ করা দরকার।

#আমাদের অনেক সুরকার আছেন- কথার গভীরে, বাণীর গভীরে প্রবেশ না করেই এমনকি গানের কথা শেষ পর্যন্ত না পড়েই মুখ দেখেই সুর দেয়া শুরু করেন। এরদ্বারা গান শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না-গানকে রীতিমত হত্যা করা হচ্ছে।

#কোন কোন সুরকারের মধ্যে আরেকটি ভয়াবহ প্রবণতা বিরাজ করে: গানের পর্ব বিন্যাসকে যথাযথ ধরতে না পেরে, তাল লয় বুঝে সুর করতে না পেরে- লেখকের অনুমতি ছাড়াই স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজে নিজে শব্দ পরিবর্তন করে গান এডিট করে নেন, তার সুর যেদিকে যেভাবে খেলছে- সেভাবে ইচ্ছে মতো কথা বদলে নেন। সুর অনুযায়ী কথা নয়, কথা অনুযায়ীই সুরারোপ করতে হবে।

#কোন সচেতন গীতিকার তার গানের লিরিককে যদি পরিকল্পিত ভাবে বিন্যাস করেন- সেখানে সুরকারের কাছে কোন বিকল্প থাকার কথা নয়। তারপরও যদি সুন্দরতর করার কোন তাগিদ সুরকার উপলব্ধি করেন, তবে তা লেখকের দৃষ্টিতে আনতে পারেন।

#আমি যদি সুরকারদের কাছে প্রশ্ন করি: গানের কবিতার ছন্দ কী, ছন্দ কতপ্রকার, কোন ছন্দের মাত্রা বিশ্লেষণ কেমন? তার সদুত্তর অধিকাংশ সুরকারই দিতে পারবেন না। অথচ তাকে কতোভাবে আমরা বিশেষায়িত করে আসমানে তুলতে দ্বিধান্বিত হই না। মনে রাখতে হবে গীতিকারের জন্যে সুরের রাগ লয় জানা যতোটা অপরিহার্য তার চেয়ে সুরকারের জন্যে শতগুণে অপরিহার্য গানের কবিতার ছন্দমাত্রার জ্ঞান অর্জন করা।

 

উচ্চারণ বিকৃতি,অশুদ্ধ উচ্চারণ ও মৌলিক সুরের অভাব:

আমরা অনেকেই শুদ্ধ উচ্চারণ চর্চায় আগ্রহী নই। অনেক শিল্পী আছেন যারা শুদ্ধ উচ্চারণের প্রয়োজনও বোধ করেন না। বিকৃত বা অশুদ্ধ উচ্চারণে অসংখ্য গান আমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। এরদ্বারা এই গানের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রকারন্তরে শিল্পী ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছেন। ভালো কথা বা বাণী সমৃদ্ধ কোন গান একই কারণে ধুলোয় মলিন হয়ে যাচ্ছে।

এর পাশাপাশি মৌলিক সুরের অভাব আমাদের ইসলামী গানের জগতে বিষফোঁড়ার মতো। সুরের বেসিক জানা না থাকার কারণে আমাদের অনেকেই সরাসরি প্যারোডি করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ এদিক সেদিক হাত বাড়িয়ে ভেজাল সুরের ব্যঞ্জন করছেন। কেউ অবচেতন মনে পুরনো কোন গানের সুরে ভাসিয়ে দিচ্ছেন নতুন গানের কথা। এ ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ না করলে আমরা কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারবো না।

 

মানসম্মত ভিজ্যুয়াল সম্পাদনায় অদক্ষতার ছাপ:

বর্তমানে অডিও গানের জগৎ সীমিত হয়ে আসছে, ফিতার যুগ ও প্রয়োজনতো শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন ভিডিও বা ভিজ্যুয়ালের যুগ পড়েছে। সবাই প্রতিদিন শত সহস্র ভিডিও দেখছে, আইডিয়া আহরণ করছে। আমরা তাদের তুলনায় বাস্তব কারণেই পিছিয়ে আছি। আমাদের মধ্যে বেশ কিছু ভালো কাজ হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু অপরিণত ও মানহীন কাজের তালিকাটাও দীর্ঘতর। একবার দেখার পর, ২য় বার দেখার আগ্রহ সৃষ্টিতে সক্ষম হচ্ছে খুব কম গানই।

আমাদের মাঝে যথাযথ চিত্র ধারণ ও চিত্র সম্পাদনায় দক্ষ মানুষের অভাব রয়েছে। ভালো কিছু করতে আগ্রহী হলে এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।

 

শিল্পীদের ড্রেসআপ সমস্যা:

আমাদের দেশে ইসলামী সংগীত ত্রি বা চতুর্ধারায় বিভাজিত। যেমন:

১। মাজার কেন্দ্রিক ওরশমুখি ধারা

২। পীরপন্থী ধারা

৩। সাধারণ ইসলামী কেচ্ছা কাহিনীভিত্তিক ধারা

৪। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিফলনের অভিপ্রায়ে নিবেদিত ইসলামী ধারা।

প্রথম দুধারার উপস্থাপন কলাকৌশল,পোশাক পরিচ্ছদ তাদের পরিচয়কে ফুটিয়ে তোলার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু পরের দুধারার পোশাকী পরিচয়টা সুস্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের ইসলামী ধ্যান ধারণা, আবেগ আর অনুভূতির সাথে মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপিয়ান ধ্যান ধারণার পার্থক্য রয়েছে।

বাংলাদেশে যারাই ইসলামী আদর্শের প্রচার প্রসারে ব্রতী হবে, তাদেরকে এদেশীয় মুসলীম সংস্কৃতি,ঐতিহ্য এবং কৃষ্টিকে লালন করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে বলি: ইসলাম প্রচারক জাকির নায়েক যতোই যৌক্তিক কথা বলুন না কেন- তার পাশ্চাত্যানুসারী ড্রেসআপ মানুষের মনে প্রথমেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়। ইসলাম প্রচারক হিসেবে জাকির নায়েকের প্রতি প্রথম দর্শনে যে ভক্তিটা জন্ম নেবার কথা, অনেকের মনে তা নেয় না। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করা দরকার।

আমাদের বিভিন্ন শিল্পী গোষ্ঠীর স্টেইজ পারফরমেন্স বা ভিজ্যুয়াল কার্যক্রম এখানেই প্রশ্ন বিদ্ধ থেকে যাচ্ছে। আমাদের মনে মডার্ন চিন্তা বেশি ভর করায়, অন্য জগতের সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে অসম অযৌক্তিক প্রতিযোগিতায় নামার মানসিকতায় আমাদের শেকড় কিন্তু মাটি থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে। ইসলামী সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসেবে সাধারণ ইসলামী ভাবাপন্ন মানুষের কাছে আমাদের বাণী পৌঁছাচ্ছে না। অথচ এই ব্যর্থতাকে আমরা ব্যাখ্যা করছি অন্যভাবে। আমাদের অনেকেই বলছেন: বাদ্যবাজনা ছাড়া আমাদের পরিবেশনা হওয়ায় সবার কাছে আমরা যেতে পারছি না।

উল্লেখ্য- ইসলামী কালজয়ী শাশ্বত আদর্শ হলেও তার বিপরীতে প্রবল স্রোত যেমন থাকবেই, তেমন ইসলামী সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করার মতো শত সহস্র মানুষ থাকবেই। সচেতন বিরুদ্ধবাদীদের মনতুষ্টির আদৌ প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বরং যারা ইসলামকে পছন্দ করেন, ইসলামী সংস্কৃতিকে লালন করেন, তাদের হৃদয়ের খোরাক কীভাবে যোগান দেয়া যাবে- সে চিন্তাটাই আমাদের করতে হবে বেশি করে।

আমাদের গান,কবিতা, নাটক এমন ভাব ভাষা পরিবেশের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে যাতে মানুষের ঈমান মজবুত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। পোশাকের ব্যাপারটিও সে দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতেই হবে।

 

 প্রয়াত গীতিকার শিল্পীদের গানগুলো না গাওয়া:

আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে একটি নেতিবাচক চর্চা বেশ জোরেশোরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তা হলো অগ্রজদের গান না গাওয়ার মানসিকতা। ইসলামী সংস্কৃতির অংগনে যারা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে গেছেন- তাদের অনেক ভালো ভালো গান থাকা সত্বেও এখনকার শিল্পীরা তা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশন না করে নিজেদের একান্ত পছন্দের গান পরিবেশন করছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মিডিয়ায়। এর দ্বারা আমরা শেকড়ের সন্ধান পাচ্ছি না,শেকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্বের প্রয়োজনে নবীনের পাশাপাশি অগ্রজদের গান পরিবেশনে সব সময় আন্তরিক থাকা দরকার।

 

শিল্পীদেরকে ভিন্ন গ্রহের মানুষ ভাবা ও কাছে না টেনে নেওয়া:

শিল্প সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত, তারা একটু হলেও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। তাদের মধ্যে ভিন্ন একটু মেধার স্ফূরণ আছে, তারা একটু অন্যভাবে সমাজ ও প্রতিবেশকে ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একটু স্বাধীনভাবে ভালোলাগা ভালোবাসার কথাগুলো তারা প্রকাশ করতে চান। তাদের ইচ্ছে ও আকাঙ্ক্ষার পয়ার একটু আলাদা। ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধে আর দশজন থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন। মোসাহেবী, তোষামোদী তারা অধিকাংশই পছন্দ করেন না, অন্ধ আনুগত্যেও তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্বাসী নন। তারা অনেকেই প্রখর চিন্তা ও বিচক্ষণতার অধিকারী।

সে কারণে তাদের সাথে আমাদের আচরণ ভিন্ন প্রেক্ষিৎ দাবী করে। তারা আপনার আমার আদর স্নেহ ও ভালোবাসা একটু বেশিই প্রত্যাশা করেন। বিষয়টি কিন্তু আমরা বেমালুম ভুলে থাকি। সাধারণ আর দশজন জনশক্তিকে যেভাবে আমরা মনিটরিং করি, শিল্পী কবি সাহিত্যিককেও যদি হুবহু সেভাবে করতে যাই; তা কখনও ফলপ্রসূ হবার নয়।

ইসলামী বেসিক আইডিয়ার মধ্যে রেখে যতদূর সম্ভব তাদের থেকে কাজ তুলে নেবার পরিকল্পনা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। বামধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকেও ডানপন্থীদের দীক্ষা নেবার অনেক কিছুই আছে।

শিল্পী কবি সাহিত্যিকরা তাদের স্বাতন্ত্র্যের কারণে যখন সাধারণের মতো আচরণ নের্তৃত্বের সাথে করতে ব্যর্থ হন, তখই নের্তৃত্বের দেখাদেখি সাধারণ জনশক্তিও তাদেরকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে বাঁকা চোখেও দেখেন। এই সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার বেরিকেড ভাঙতে হবে। সময় উপযোগী পদক্ষেপ নিতে আমরা ব্যর্থ হলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে কখনই বেগবান করা যাবে না। তাদের যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।

 

সাংস্কৃতিক কর্মীদের সুনির্দিষ্ট সিলেবাস না থাকা

ক্ষুদ্রার্থে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্যে পৃথক কোন সিলেবাস, তাদের নার্সিং পদ্ধতি আজ অবধি প্রণয়ণ করা হয় নি পরিকল্পিত ভাবে। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই কিছু বইপত্র প্রণয়ন করেছেন, কিন্তু গুলোকে কাঠামোবদ্ধ করা হয় নি। একজন সাধারণ জনশক্তি যা যা প্রাত্যহিক পড়াশোনা করছেন, সাংস্কৃতিক কর্মীকেও তাই অপরিহার্য ভাবে পড়াশোনা করতে হচ্ছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রপ্ত করতে হলে তাকে আলাদাভাবে সময় বের করতে হচ্ছে,যা কষ্ট কর।সংগীতের সাথে যারা যুক্ত তাদেরকে সংগীত বিষয়ক উচ্চতর ধারণা দেবার জন্যে যদি পরিকল্পিত গাইড লাইন দেয়া যেতো, যিনি সাহিত্য বা ছড়া, কবিতা, গল্প উপন্যাসে কাজ করতে আগ্রহী- তাকে যদি বিশ্ব সাহিত্যের নানা নান্দনিক কর্মকে আবশ্যকীয় পাঠ্য হিসেবে দেয়া যেত, যিনি নাটক সিনেমা নিয়ে কাজ করতে চান-যদি বিশ্বনাট্য আন্দোলন ও সিনেমা নির্মাণ কলা কৌশলের পাঠ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা তার থাকতো; তবে আজকের প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন রকম হতে পারতো।

একজন সাংস্কৃতিক কর্মীর মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে যদি অন্যান্য শর্তের পাশাপাশি তার নিজের সৃজনশীলতার বিষয়ে একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা যেতো (যিনি কবি-তাকে কমপক্ষে ২০/২৫ টা কবিতা জাতীয় পত্রপত্রিকায় ছাপাতে হবে, যিনি সুরকার- তাকে কমপক্ষে ২৫ টি গানের সুর জমা দিতে হবে, যিনি নাট্যকার- তাকে কমপক্ষে ১০টি নাটকের পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হবে, যিনি নির্মাতা তাকে কমপক্ষে পাঁচটি মানসম্পন্ন ডকুমেন্টরি জমা দিতে হবে, যিনি কারুশিল্পী তাকে দেশীয় প্রাকৃতিক বা ঐতিহ্যিক ১০টি শিল্পকর্ম জমা দিতে হবে, যিনি সংবাদ কর্মী তাকে অনুসন্ধানী বা গবেষণাধর্মী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট জমা দিতে হবে।),তবে তাদের নিজস্ব ক্ষেত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী হতো এবং নিজে অগ্রসর হবার আগ্রহ বোধ করতো। বাস্তবে কিন্তু এটার ছিটেফোটাও নেই।

শুধু তাই নয়- ব্যাংক বীমা,এনজিও প্রভৃতির মতো যদি সাংস্কৃতিক কর্মীদের স্ব স্ব বিষয়ের মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক, বার্ষিক টার্গেট নির্ধারণ পূর্বক তার মনিটরিং ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যেতো- তবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনেক বেগবান হতো।

সাংস্কৃতিক কর্মীদের দৈননন্দিন পাঠ্য তালিকায় ইসলামী সাহিত্যের পাশাপাশি তার মূল ক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পড়াশোনা বা সাহিত্য পাঠ বিবেচনার মধ্যে আনার বিষয়টিও খোলাসা করে দেয়া দরকার। কারণ সাংস্কৃতিক কর্মীর জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্যে তাকে বিবিধ সেক্টরেই পড়াশোনা করা আবশ্যক এবং সেই পড়াশোনার মূল্যায়ন করাও আমাদের কর্তব্য বটে।

 

সাংস্কৃতিক কর্মীদের সময়দান জটিলতা:

আমি খুব পরিস্কার করে বলতে চাই- যারা আদর্শিক সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত, তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয়িত সময়কে ব্যক্তিগত সময়দান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী যতোক্ষণ তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যাপৃত থাকবেন, ততোক্ষণই তার সময়দান ধরে নিতে হবে।

একজন সাধারণ মানুষ যদি রাজপথে মিছিল শ্লোগানে মুখর থাকার সময়টাকে সময় দান ধরতে পারেন, তবে একজন প্রাবন্ধিক ঘরে বসে বিভিন্ন গবেষণা তথ্য- উপাত্তের সমন্বয়ে প্রবন্ধ লিখবেন, একজন কবি আদর্শিক চেতনাকে শাণিত করার জন্যে কবিতা লিখবেন, একজন গীতিকার জনশক্তির ধূসর মনের পাতাকে সজীব করে তোলার জন্যে গান রচনা করবেন, একজন সুরকার- নতুন একটি গানে সুরারোপ করবেন, একজন শিল্পী দীর্ঘ অনুশীলন ও পরিচর্যার মাধ্যমে গানকে পরিবেশনের উপযোগী করবেন; এভাবে প্রত্যেকেই তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে মননশীল ও সৃজনশীল কাজে যে সময়টুকু ব্যয় করবেন- তা তাদের সময়দান হিসেবে বিবেচিত হওয়া আবশ্যক।

এতে তারা কাজে আগ্রহ পাবে, নের্তৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আনুগত্যশীল হবে। এক্ষেত্রে দায়িত্বশীলের উদারতা, সহনশীলতা খুবই অপরিহার্য বিষয়। রেগুলার টাইট সিডুইলের মধ্যে তাদেরকে না বেঁধে, কাজের টার্গেট দিয়ে ময়দানে ছেড়ে দিতে হবে হিরা মাণিক কুড়িয়ে আনার জন্যে। তাদের স্বতস্ফূর্ত কর্মকাণ্ডই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে শাণিত করবে।

প। আমাদের নিজস্ব কোন কমিউনিটি সেন্টার বা হলরুম না থাকা:

দেশ জুড়ে নামে বেনামে আমাদের হাসপাতাল আছে, ব্যাংক বীমা আছে, এনজিও আছে, ট্রাস্ট আছে, ফাউন্ডেশন আছে, প্রতিজেলায় অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কিন্ডার গার্টেন আছে, বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান আছে। নেই কেবল একটি কমিউনিটি সেন্টার বা অডিটোরিয়াম। শুধু পরিকল্পনার অভাবেই এটি এতোদিন হয় নি বলেই আমার বিশ্বাস। অথচ এর গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। নিজস্ব অর্থায়নে একটি মানসম্পন্ন অডিটোরিয়াম বা কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করে প্রয়োজনে বাণিজ্যিকভাবেও তাকে ব্যবহার করা যেত। আয় থেকে ব্যয় নির্বাহ পলিসি মোটেও খারাপ ছিলো না। যতোদিন নিজস্ব হলরুম বা অডিটোরিয়াম গড়ে তোলা সম্ভব না হবে, ততোদিন আমাদেরেকে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, হাপিত্যেস করতে হবে। পরিবেশনার ক্ষেত্রে অনেক বাছ বিচার করে চলতে হবে।

 

বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ টিম না থাকা:

ইসলামী সংগীত শুধু নয় ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে অর্থবহ ও বেগমান করতে হলে প্রত্যেক বিভাগের জন্যে বিশেষজ্ঞ টিম থাকা প্রয়োজন। যারা জাতীয়ভাবে পরিচিত এবং কর্মক্ষম। উদারভাবে এই টিম গঠন করতে হবে। যারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও ইসলামী ঐতিহ্য সচেতন। আমাদের নের্তৃত্ব এক্ষেত্রে অন্তরালে থেকে বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে বিভিন্ন সময় সম্মানিত করা, তাদেরকে সংবর্ধনা দেয়া, উৎসব পার্বণ ভিত্তিক উপহার উপঢৌকন প্রদান করা,পারিবারিক খোঁজ খবর নেয়া,পারবিারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে মজবুত করা অপরিহার্য।

বিশেষজ্ঞ টিমের বাইরেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যারা বিশেষ অবদান রাখছেন, সময় সুযোগ মতো প্রতিবছর যে কোন একটি সংস্থার মাধ্যমে তাদেরকে ২/৪জন ব্যক্তিত্বকে সংবর্ধনা প্রদান করা, প্রয়োজনে আর্থিক সাপোর্ট প্রদান করা, চিকিৎসা সেবা প্রদান করা। তাদের বই পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করা। জাতীয় দিবস সমূহে তাদেরকে সভাপতি বা প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠানাদি করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা। এদিকগেুলোতে আমাদের এ যাবৎকালের ভূমিকা বা অবস্থান খুব স্পষ্ট নয়। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে উদারভাবে দ্রুত আমাদের এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর্থিক দায়ভারের সমস্যা:

সাংস্কৃতিক কর্মীরা তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় এখন পর্যন্ত কোন সাহস বা ভরসা পান না। কোন একটি কর্মসূচী হাতে নিতে যেয়ে সাতবার দ্বিধাগ্রস্থ হন। আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে যেয়ে তাদেরকে গলদঘর্ম হতে দেখা যায়। অনেক অতৃপ্তি আর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে কোন একটি অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক কর্মীদেরকে আর্থিক বিষয়ে সম্পূর্ণ চাপ ও দায়মুক্ত রাখতে হবে। বছরের শুরুতেই পরিচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে- এক বছরে মূল সাংস্কৃতিক ফোরামের মাধ্যমে আপনারা কী কী কাজ সম্পন্ন করতে আগ্রহী- তা সুনির্দিষ্ট করা।

কাজের পরিধি অনুযায়ী বাজেট অনুমোদন,বাজেট বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। আর্থিক বিষয় মাথায় নিয়ে কখনও মানসম্পন্ন কাজ উপহার দেয়া সম্ভব নয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের দ্বারা। সাংস্কৃতিক কর্মীরা থাকবে আর্থিক চাপ মুক্ত। তারা স্বাধীনভাবে লিখবে,সুর করবে, গান গাইবে, নাটক করবে,ছবি আঁকবে। এসব সৃজনশীল কাজ প্রচার ও প্রকাশের ব্যয়ভার কেন্দ্রকেই বহন করতে হবে। শুধু অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের অর্থ নয়,বরং এসব কবি,গীতিকার, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সুরকার, শিল্পী,কার্টুনিস্ট,নাট্যকার, কম্পোজার , সিনেমা নির্মাতাদেরকে সুনির্ধারিত হারে সম্মানী প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিৎ করতে হবে। এসব বিষয়ে যদি অনীহা থাকে বা সংকীর্ণতা থাকে,তবে খুব সাকসেস আমরা কখনই দেখাতে পারবো না। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম একটা মানদণ্ড থাকা জরুরী। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে গীতিকার,সুরকার,শিল্পী, নাট্যকার বা অন্যান্য আর্টিস্ট বিভিন্ন গ্রেডে বিন্যস্ত আছেন এবং তারা সেভাবেই সম্মানী পেয়ে থাকেন। এসব বিষয় জরুরীভাবে পর্যালোচনায় নেয়া দরকার।

ইসলামী গান ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড প্রচার প্রসারের ক্ষেত্র কম:

নানা কারণে এবং যৌক্তিকতায় আমাদের ইসলামী গান, ইসলামী ভাবাপন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রচারের সুযোগ সুবিধা পায় খুবই সীমিত পর্যায়ে।বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকে। পরিকল্পিতভাবে এই ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন পত্রিকা,নতুন টিভি চ্যানেল, প্রাইভেট অনলাইন রেডিও চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। সমন্বিত ভাবে উইটিউব চ্যানেল পরিচালনা করতে হবে। ফেসবুক, ভাইভার, ইমু, টুইটারসহ যাবতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিকল্পিত ভাবে কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়িার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে হবে বিশেষ ব্যক্তিদের মাধ্যমে। তাদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের পরিবেশনা প্রচারের পদক্ষেপ ও পরিবেশ নিশ্চিৎ করতে হবে।আরও উল্লেখ্য-বামধারার শ্রমিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে বিশেষ পরিকল্পনায় যোগাযোগ নিবিড় করতে হবে। তাদের চিন্তারাজ্যে প্রভাব বিস্তারী পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

সার্বক্ষণিক সাংস্কৃতিক কর্মীর অনুপস্থিতি :

কোন মিশন ভিশনকে সাফল্যের মুখ দেখাতে হলে, সেই মিশন ভিশনে বিশ্বাসী বা একাত্ম কিছু প্রাণের সার্বক্ষণিক তৎপরতা প্রয়োজন। পার্ট টাইম বা খণ্ডকালীন সেবক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজের আঞ্জাম দেয়া যায় না। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। ফুলটাইম সাংস্কৃতিক কর্মী ছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা যাবে না। কোন আদর্শিক বিপ্লবের আগে সেই আদর্শজাত সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান করা আবশ্যক, নতুবা আদর্শিক বিপ্লব মোটেই টেকসই হতে পারে না। যারা সুস্থ সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখি বা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা কল্পনা করি তাদের মধ্য থেকে সার্বক্ষণিক সময় দেবার মতো কর্মী খুঁজে বের করার উদ্যোগ এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়ছে না।

সব পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন সার্ভিসে আছি আমরা। অনেকেই আছেন ছাত্রজীবনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, কিন্তু ছাত্রজীবন শেষ হবার সাথে সাথে তার সাংস্কৃতিক জীবনও শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ আছেন একেবারেই অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক তৎপরতায় সীমাবদ্ধ। হাতে গোনা দুএকজন আছেন-নিজের আর্থিক বা ব্যবসায়ীক দৃষ্টিভঙ্গী বা সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে সাংকৃতিক কাজ বিশেষ করে সংগীতের প্র্যাকটিসটা ধরে রেখেছেন। কারণ কেবল সংগীতেই নগদ ইনামটা দ্রুত পাওয়া যায়। টোটাল বিষয়টা আমাদের জন্যে হতাশার ও নেতিবাচক বলে মনে হয় আমার কাছে।

অনেক ভালো মেধাসম্পন্ন সাংস্কৃতিক কর্মী আছেন, যাদের একাডেমিক কেরিয়ার অনুয়ায়ী হয়তো সুবিধা মতো চাকরি জুটাতে পারছেন না, কোন রকমে নাম মাত্র সম্মানীতে লেগে আছেন কোথাও। তাদের মধ্য থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে যোগ্যদের নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে ফুলটাইম একটা সাংস্কৃতিক টিম গড়ে তোলা খুব জরুরী। এটা সংগীতের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পূর্ণ। যারা একেবারই ফি সাবিলিল্লাহ কাজ করেন (গীতিকার,সুরকার,শিল্পী,সখের নির্মাতা) তাদের কথা বাদ দিয়ে যদি সাধারণভাবে ভেবে দেখি,তবে বলা যায়: একটা গান লেখা থেকে শুধু অডিও রেকর্ডিং ও এডিটিং পর্যন্ত মহড়ার খরচ সহ কমপক্ষে হাজার পনেরো টাকা অবশ্যই খরচ হবে। আলাদা আলাদা ভাবে গীতিকার,সুরকার ও শিল্পী সম্মানী দিতে হচ্ছে। এর সাথে যদি ভিজুয়্যাল এবং ইউটিউবের বিষয়টি যুক্ত করা হয় কাজ ভেদে তা লক্ষটাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এক বছরে মানসম্প্ন্ন করে যদি আমরা মাত্র ১২টি গানও করি (মাসে ১টি হিসেবে, যা দ্বারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চিন্তা করাও বোকামো ছাড়া কিছুই না), তবু অন্তত পনেরো লক্ষ টাকা ব্যয় হবে।

এখন গানের জন্যে যদি ন্যূনতম আটজনের একটি ফুলটাইম টিম গঠন করি (গীতিকার ২জন, সুরকার ২জন, কণ্ঠ শিল্পী ৪জন, এই ৮জনের মধ্যে ১জন আইটি সেক্টরেও দক্ষ হবেন। আমাদের গীতিকার ও সুরকাররাও কিন্তু ভোকাল দিতে পারে। সে হিসেবে ৮জন ভোকালিস্ট ভালো আউটপুট দিতে পারবে ইনশায়াল্লাহ।), যাদের মাসিক সম্মানী জনপ্রতি ও যোগ্যতার বিবেচনায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা যদি গড়ে দেয়া হয় (সর্ব সাকুল্যে ১০০০০০/ টাকা মাসিক সম্মানী ধরে বছরে ১২০০০০০/-) এবং তাদের কে যদি ন্যূনতম ৩০টি গানের টার্গেট দেয়া হয়,তবে আন্দোলন কতোটা বেগবান হবে এবং আর্থিক দিক থেকে কতোটা সাশ্রয়ী হবে- তা ভেবে দেখার বিষয়। উল্লেখ্য- কিছু টাকা খরচ করে আমাদের পুরাতন অথবা নতুন কোন প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ ভাবে মিডিয়া বা নির্মাণ হাউজ হিসেবে গড়ে তুলে সেখানে এইগুলো রেকর্ড ও এডিটের কাজটাও ন্যূনতম খরচে সম্পন্ন করা যাবে।

ফুলটাইম নিযুক্তি কোন চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। যদি কারো পারফরমেন্স মানসম্পন্ন না হয় বা কোন কারণে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তার ব্যাপারে পর্যালোচনার সুযোগ থাকবে, তার স্থলে নতুন লোক নিযুক্ত হবে। এই টিম কেন্দ্রের মূল কাজ পরিচালনা সহ সারা দেশের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমেও পরিকল্পিতভাবে অংশ নিতে পারবেন। তারা নিয়মিত অফিস করবেন। অফিসই তাদের সৃজনশীল কাজের কেন্দ্র থাকবে। একজন অবশ্যই টিম প্রধান থাকবেন। তিনি মূল সংগঠন ও মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমে সমন্বয়কের ভূমিকায় থাকবেন। কেন্দ্রীয় টিমের পাশাপাশি জেলা পর্যায়েও পরিবেশ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে ক্ষুদ্র পরিসরে সার্বক্ষণিক সাংস্কৃতিক কর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে।

কেন্দ্রীয়ভাবে সংগীতের পাশাপাশি অন্তত ০১জন আবৃত্তিকার, ০১জন চারুশিল্পী, ০১জন নাট্য নির্মাতাকেও ফুলটাইম করা যেতে পারে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে বিভিন্ন স্তরে ফুলটাইম লোক নিযুক্ত হলে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে কেন হবে না? বিষয়টা ভাবনার জন্যে উন্মুক্ত করে দিলাম।

 

ইসলামী গানে মিউজিক ও নারী মডেল ব্যবহারের বিতর্ক:

বেশ কিছুদিন ধরে ইসলামী গানে মিউজিকের ব্যবহার নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। কেউ নিরীক্ষার নামে, কেউ হিকমাতের নামে , কেউবা জীবনমুখী গানের নামে সব মানুষের কাছে ইসলামী গানকে পৌঁছে দেবার মানসিকতা নিয়ে ইসলামী গানে মিউজিক ব্যবহারের চেষ্টা করছেন, যা সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা নবীন শিল্পীদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে। কেউবা ক্ল্যাসিক সঙ্গীত শেখার কথা বলে নিজেদের ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিতে চলেছেন। অনেকের মনের মধ্যে দর্শক নন্দিত হবার বাসনাটাও প্রবল। যারা ইসলামী গানে মিউজিক ব্যবহার করতে আগ্রহী, কোরান হাদীসের আরবী তেলাওয়াতেও তারা মিউজিক ব্যবহারে দ্বিধা করছে না।

তাদের মধ্যে আবার মহিলা,এলোকেশী তরুণী দিয়ে ইসলামী গানের মডেলিং করানো শুরু করেছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশের ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ও পরিবেশের সাথে যা মোটেও সঙ্গতীপূর্ণ নয়। এই ধারা অচিরেই থামানো না হলে- ভবিষ্যৎ অন্ধকারই হবে। ইসলামী গানে ব্যতিক্রম ধারাটি একবারেই বিপন্ন হবে। যারা মিউজিক সহকারে গান করে জনপ্রিয় শিল্পী হতে চান, ব্যবসায় সফল শিল্পী হতে চান- তারা কেন ইসলামী গানটাকে মিউজিক প্রয়োগের জন্যে বেছে নিলেন আমার তা বোধগম্য হয় না। তারা এসব ভণিতা বাদ দিয়ে সরাসরি বাদ্যবাজনা নির্ভর সাধারণ গানতো করতে পারেন।

আমাদের অগ্রজদের এবিষয়ে নিরবতা এক সময় বুমেরাং হতে পারে। অবশ্য ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে যারা অতি মডারেট চিন্তায় বিশ্বাসী,যারা বাংলাদেশে মিশর-তুরস্কের জল্পনা করেন,বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার বাইরে অবস্থান করে রাতারাতি নিকট ভবিষ্যতে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন-তাদের কাছে ইসলামী গানের স্বাতন্ত্র্যধারা বিপন্ন হলেও কিছু যাবে আসবে না।

আমাদের অনেকেই কেন বুঝি না: বিপদ-আপদ এবং মুসিবতের কালে বেতার টিভির প্রখ্যাত শিল্পীরাও বাদ্যবাজনা ছাড়াই গান পরিবেশন করে থাকেন, নারীশিল্পীরা মাথায় কাপড় দিয়েই গান পরিবেশন করেন। তারা মনে করেন- এটার বিকল্প নেই। আর আমরা হাঁটছি তার উল্টোপথে। আমরা যদি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের দিকে তাকাই- অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারবো আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার শিল্পীদের মৃত্যুটা কতো অযত্ন অবহেলায় হয়েছে! চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থা ছিলো না অনেকের। যারা দলকানা সাংস্কৃতিক কর্মী,তাদের বিষয়টা সব সময় আলাদা। ভিন্ন জগতের শিল্পীরা যখন খালি গলায় মশিউর রহমানের ইসলামী গান শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়, শ্রদ্ধায় নত হয়; তখন মিউজিক দিয়ে গান করার স্বপ্ন আমাদের ছেলেরা কেন দেখে তা বোঝা কষ্টকর। অগ্রজ সাইফুল্লাহ মানসুর, মশিউর রহমানের ধারে কাছে কী আছে আমাদের কোন মিউজিক প্রিয় শিল্পী?

যাহোক, মিউজিক বৈধ, নাকি অবৈধ, বৈধ হলে তার সীমারেখা কতোটুকু, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে মিউজিক বৈধ, কী কী ইনস্টুমেন্ট বৈধ এ নিয়ে অনেক গবেষণা, মাসয়ালার বিষয় রয়েছে। সেটা চূড়ান্ত না হবার আগ পর্যন্ত বিতর্কিত বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়াই কল্যাণকর। আর এবিষয়টির দ্রুত ফয়সালাও হওয়া দরকার। সুষ্পষ্ট নীতি ঘোষণা না করলে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ঘাটতি, দূরত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ ফোরাম থেকে ইসলামী স্কলারদের মাধ্যমে যদি নির্দেশনা দেয়া হয়- ইসলামী গানে বাদ্য বাজনা প্রয়োগ বৈধ, সবাই আমরা যার যার অবস্থানে থেকে সেটাই প্রতিপালন করবো, আর যদি বলা হয় অবৈধ; তবে যে যে মিউজিক থেকে বিরত থেকে ইসলামী গান করতে চায় করবে। যে অন্য দিকে পাড়ি দিতে চায় দেবে।

সবাইকে ধরে রাখার হিকমত যদি মূল আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, সেই হিকমত পরিহারযোগ্য। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই শুধু সবাইকে জোড়াতালি দিয়ে ধরে রাখার উদারতা দেখাবো কোন্ ভয়ে বা কোন্ যুক্তিতে? পৃথিবীতে কোন মানুষ কোন কাজের জন্যে একেবার অপরিহার্য নয়। অনেক মেধাবী,চৌকস,যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ হারিয়ে গেছে,বিরোধীদের রোষানলে পড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে অনেক অনেক যোগ্য নের্তৃত্ব। তাই সব কী থেমে যাবে বা থেমে গেছে? কোন না কোন ভাবেই আমরা গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকবো। কখনও বন্ধুর হবে পথ, কখনও হবে দুর্গম, কখনও হবে মসৃণ। সাংস্কৃতিক অঙ্গনও এর বাইরে নয়। তাই সিদ্ধান্ত যা নেবার তাড়াতাড়ি নিতে হবে- মস্তিষ্কে পঁচন ধরার আগেই গন্তব্যকে স্থির করে নিতে হবে।সিদ্ধান্তহীনতায় যতোটুকু সময় আমরা পার করবো,ততোটুকুই সমস্যার মধ্যে আবর্তিত হবে ইসলামী সংগীত।

/// আরো পড়ুন–অন্ত্যমিল কি? ছড়া কবিতা গানে অন্ত্যমিল কেন প্রয়োজন? ///

 

সাংস্কৃতিক কর্মীদের নৈতিক প্রশিক্ষণের অভাব:

কবি শিল্পীদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারীমে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। সুরা আশশুয়ারায় বলা হয়েছে: আল্লাহর একত্মবাদে বিশ্বাসী কবিরা ছাড়া অন্য কবিরা উদভ্রান্ত,তারা কল্পনার রাজ্যে উদাসীন ভাবে বিচরণ করেন।সাংস্কৃতিক কর্মীদের সুরা আশশুয়ারা খুব ভালোভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।সাথে সাথে সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিচরণ ক্ষেত্র যেহেতু একটু ভিন্নতর, তাদের নৈতিক মান ধরে রাখার জন্যে বা উৎকর্ষ সাধন করার জন্যে বিশেষ কর্মশালা পরিচালনা করা দরকার,বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। তাদের ব্যক্তিগত মান উন্নয়ন ও ক্যারিয়ারের সমৃদ্ধির বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। যা বর্তমানে হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।

 

ইসলামী গানের আর্কাইভসের অভাব:

বাংলাদেশে ইসলামী গানের একটি বড় সমস্যা- অদ্যাবধি ইসলামী গানের কোন আর্কাইভস না থাকা। বিশেষ করে মরহুম কবি মতিউর রহমান মল্লিকভাই থেকে শুরু করে তার সাথে এবং তার পরবর্তীতে যারা যারা ইসলামী গান লিখেছেন, সুর করেছেন, কণ্ঠ দিয়েছেন তার সুস্পষ্ট দালিলিক ভিত্তি বিপন্নের পথে। কোন গানের গীতিকার কে, কে সুর করেছেন এবং কোন গানের মৌলিক শিল্পী কে- তা অধিকাংশই আমাদের কাছে অজ্ঞাত।একজনের গান আরেক জনের নামে চলছে। রীতিমতো এক অরাজকতা। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ইসলামী গানের ধারাকে বেগবান করার ক্ষেত্রে বিরাট এক প্রতিবন্ধকতা। আর্কাইভস দূরে থাক মল্লিকের গীতি সমগ্রটা পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। এই অবস্থার পরিত্রাণ প্রয়োজন। যতদ্রুত সম্ভব বিজ্ঞান সম্মত ডিজিটাল পদ্ধতিতে আমাদেরকে ইসলামী গানের আর্কাইভস গড়ে তুলতে হবে। শুধু আমাদের অঙ্গনের নয়, দেশ বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী গানের সংকলন, রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিজস্ব সমস্যা:

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অল্প দিনের বিচরণের অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতায় বলছি: সমস্যা শুধু সামষ্টিক নয় বা নীতি পদ্ধতির নয়। ব্যক্তির সমস্যাও ইসলামী গানের বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির জন্যে বিরাট এক প্রতিবন্ধতার দেয়াল স্বরূপ। আমিসহ আমাদের অধিকাংশ গীতিকার,সুরকার,শিল্পী,নাট্যকর্মী,আবৃত্তিকার, উপস্থাপক ভীষণ ভীষণভাবে আত্মকেন্দ্রিক, কম পরিশ্রমী, পাঠ বিমুখ, ক্ষেত্র বিশেষে অহংকারী, ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি সম্পন্ন, আত্মপ্রচারে অগ্রসর, দাম্ভিকতায় আচ্ছন্ন, নিজেকে সবচে যোগ্যতাসম্পন্ন জ্ঞান করার প্রবণতায় মশগুল,সমাজের আর দশজনের চাইতে নিজের মূল্যায়ন ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি ভাবতে পছন্দ করার মানসিকতা,অগ্রজ বা নের্তৃস্থানীয়দের সমালোচনায় সিদ্ধবাগ্মী, বুদ্ধিবৃত্তির প্রচ্ছন্নতায় মৌলিক আদর্শ থেকে নিজকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারঙ্গম; এসব বহুবিধ মানবীয় দুর্বলতা ইসলামী গান তথা ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশের পথে অন্তরায় স্বরূপ।

আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে- আমরা অধিকাংশই নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের উত্তরসূরী গড়ে তোলার ব্যাপারে কারো কোন আন্তরিকতা দেখি না। আমরা যেটা জানি,সেটা নবীন বা অনুজদের শেখাতে বেশ কুণ্ঠাবোধ করি।পাই পাই করে নিজের

সময়ের হিসেব করি। আর্থিক সুবিধা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে পা বাড়াতে চাই না। যে লিখতে পারি- সে অন্যকে লেখা শিকাই না, যে সুর পারি- সেলামী ছাড়া অন্যকে সেটা শেখাতে চাই না। মনের উদারতা বড্ড কম আমাদের। গীকত পরচর্চাতেও আমাদের জুড়ি মেলা ভার। সংকীর্ণ কোটরীগত চিন্তাতেও আমরা অনেকেই আচ্ছন্ন।

আরও আরেকটি সত্যি কথা হলো- আমরা অধিকাংশই অন্য কাউকে উপরে টেনে তুলতে চাই না। আঞ্চলিকতাও আমাদের কখনও কখনও আচ্ছন্ন করছে। আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দের লোককে কাছে টানতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করি। গান কবিতার শিল্পমান বাছবিচার না করে ব্যক্তিগত তুষ্টি-অতুষ্টি প্রাধান্য দিয়ে আমরা কেউ কেউ গানে সুর বাঁধি, মঞ্চে সরব হই,কবিতা আবৃত্তি করি। আরেকটি সমস্যার কথা না বললেই নয়- আমরা অধিকাংশ আত্মতুষ্টিতে ভুগি, করতালি পছন্দ করি। নিজের ভুলটি কেউ ধরে দিলে তার ওপর অসন্তুষ্ট হই। নিজের সৃজনশীলতার উৎকর্ষ সাধনে পরিশ্রমী হতে চাই না। নেতিবাচক সমালোচনায় আমরা সময় দিতে কুণ্ঠিত হই না। আর্থিক লেনদেনেও আমাদের অনেকের সমস্যা রয়েছে।

ইসলামী সংস্কৃতিকে যারা ভালোবাসে, তাদের আবেগ ও ভালোবাসাকে পূঁজি করে দেশ বিদেশ থেকে আমরা অনেকেই আর্থিক ফায়দা লোটার চেষ্টায় বেশ অগ্রসর। গান করার নামে স্পন্সর খোঁজা,স্টুডিও করার নামে অনুদান খোঁজা,পার্টনার তালাশ করা, এমনকি জমি জমার দালালী ও ভূয়া নেটওয়ার্ক বিজনেসের সাথেও আমরা জড়িত। অনেকের মধ্যে আছে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাউসার বানানোর প্রবণতাও। এসব দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম না হলে, সাংস্কৃতিক অঙ্গন বা আন্দোলনকেও বেগবান করা যাবে না। লেখালেখির ক্ষেত্রে, গানে সুরারোপের ক্ষেত্রে নকল প্রবণতা, চালিয়াতীর মানসিকতা, সম্পাদনার সুযোগে পাণ্ডুলিপি গায়েব করার ঝোঁক,অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার ফন্দিফিকির ডান বামে একাকার করে ফেলেছে আমাদের অনেকের । সৃজনশীল লেখার পরিবর্তে অন্যের লেখা দেখে বা ভাব সম্পদ চুরি করে তা থেকে স্বস্তা লেখা নির্মাণ করা, মৌলিক সুর সৃষ্টি না করে দেশি বিদেশি গানের সুর মেরে দেওয়া প্রভৃতি আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বিঘ্নিত করছে।

ইসলামী গানের সম্ভাবনা এবং প্রান্তিক কথা:

ইতমধ্যে ইসলামী গানের সমস্যা নিয়ে মোটামুটি দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। যার ইতিবাচক পর্যালোচনা ও ইঙ্গিতপূর্ণ পথ নির্দেশনা মনে প্রাণে প্রতিপালনের মাধ্যমে সমাধান সূত্রও বেরিয়ে আসবে। শুধু তাই নয়- ইসলামী সঙ্গীত তথা ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার দিকটাও আমরা উপলব্ধি করতে পারবো। ইসলামী গান বাংলাদেশে শুধু নয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এখন বিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বললে: এখন সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় গানের ধারা হচ্ছে ইসলামী গানের ধারা। হোক সেটা বাদ্য ছাড়া বা হোক বাদ্য নির্ভর। মরমী,ভক্তিমূলক,জারী-সারী,মারেফতী, বাউল, দেহতাত্মিক, কা্ওয়ালী,গজল, ফোঁক- সবই ইসলামী ঘরানার গান। শিল্পী আব্বাস উদ্দীন থেকে শুরু করে আমাদের শিল্পী মশিউর রহমান পর্যন্ত বিশাল ও দীর্ঘতর সেতু বন্ধন তৈরি হয়েছে ইসলামী গানের। আধুনিক গানের যতো বড় শিল্পীই হোন না কেন,রোজা, ঈদ, কুরবানী, কারবালা, হজ্জ,যাকাত তথা মানবীয় মূল্যবোধ জাত ইসলামী গান প্রত্যেকেই কমবেশি করছেন।পবিত্র কোরআন নিয়ে নকুল কুমারের লেখা চমৎকার গানটিকে আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে আনতে পারি।

ইসলামী গানের লাখোকোটি শ্রোতা এখন। গ্রামীন ফোন, বাংলা লিংক, রবি, টেলিটক প্রভৃতি মোবাইল অপারেটরা এখন বাণিজ্যিকভাবে ইসলামীগানের রিং টোন, ওয়েলকাম টোন ছাড়াও শ্রোতাদের মন আকর্ষণের জন্যে বিভিন্ন ইভেন্ট উন্মুক্ত করছে। অধিকাংশ টিভি চ্যানেলে এখন নিয়মিত ইসলামী গানের অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে প্রতিটি টিভি চ্যানেলে ইসলামীরিয়ারিটি শো, সাহরী কালীন অনুষ্ঠান ও ইফতার পূর্ব অনুষ্ঠানে অবধারিত ভাবে ইসলামী গানের পরিবেশনা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরাট একটা অংশ জুড়ে চলছে ইসলামী গানের পরিবেশনা। প্রতিদিন নতুন নতুন গান সামাজিক মাধ্যম সমূহে আপলোড হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে, ভাইরাল হচ্ছে।

আরেকটি সম্ভাবনার দিক হচ্ছে: সারা দেশে শতাধিক ইসলামী সঙ্গীতের শিল্পী গোষ্ঠী ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে। এক ঝাঁক নবীন লেখক এখন নিয়মিত হামদ নাত, ইসলামী গান কবিতা লিখছেন, অসংখ্য গানে অন্তপ্রাণ সুরকার ভালোভালো সুরারোপ করছেন ইসলামী গানে, শিল্পী গোলাম মাওলা,লিটন হাফিজ, হাসনাত আব্দুল কাদের, মশিউর রহমান, রোকনুজ্জামান, হাসিনুর রব মানু, আব্দুল্লাহ আল কাফি, নওশাদ মাহফুজ, আমিরুল মোমিন মানিক, মতিউর রহমান খালেদ, সোহাইল, রবিউল ফয়সাল, শরিফ, দিদারুল, ওবায়দুল্লাহ তারেক, মাহফুজ মামুন ,শাহাবুদ্দিন,মিরাদুল,তাওহিদ,রেজওয়ানুল হক লেলিনের মতো শিল্পীরা ময়দানে সক্রীয় আছে।

কলম যুদ্ধে নবীনদের মধ্যে ভালো লিখছে আব্দুস শাকুর তুহিন, আব্দুস সালাম,মাসুদ রানা, আবুল আলা মাসুম, মাহফুজ বিল্লাহ শাহী, বিলাল হোসাইন নূরী, মনির হোসাইন, আতিফ আবু বকর, জাহিদ মেহবুর,আব্দুল হাকিম, তোরাব আল হাবীব, ইসলাম তরিক,মাসুদ,জুবায়ের বিন ইয়াছিন, মল্লিক মাহমুদ, আবু সাদাদ লুলু, শাহনুর নূর, নূরুজ্জামান নূর, মোস্তাফিজুর রহমান, নূরুজ্জামান শাহ, ওমর আল ফারুক প্রমুখ। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক দুর্বলতাগুলো একে একে কাটিয়ে উঠতে পারলেই নবীনদের উচ্চকিত পদচারণায় ইসলামী গান তথা ইসলামী সংস্কৃতি অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে অপ্রতিরোধ্য দুর্বার হয়ে উঠবে ইনশায়ল্লাহ। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি।

:::::::::::::::::::::::::::::

আবু তাহের বেলাল

কবি, গীতিকার, উপস্থাপক ও বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক।

 

Leave a Reply