আমরা আগেই দেখেছি,আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেইবুঝে গিয়েছিল, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে যাচ্ছে। আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টও একই ধারণা দিয়েছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচন হয় ৭ ডিসেম্বর। নির্বাচনের পুরো ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই ৮ ডিসেম্বর ১৯৭০, স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইন্টেলিজেন্স ও রিসার্চের প্রধান রে ক্লাইন কিসিঞ্জারের কাছে একটা বার্তা পাঠান।
সেখানে তিনি বলেন, পূর্বপাকিস্তানে শেখ মুজিব ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছেন ও ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠত পেতে যাচ্ছেন। এই কারণেই পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাক্ষাকে এক বিন্দুতে নিয়ে আসা এই ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট ‘তখনো সম্ভব’ মনে করছে। রে ক্লাইন মূলত ভুট্টোকে ইঙ্গিত করে বলেন, মধ্যপন্থী হিসেবে ভুট্টোর সুখ্যাতির কারণেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা সমস্যাসঙ্কুল।
আওয়ামী লীগের চাওয়া মতো সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে পর্যাপ্ত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা না গেলে বাঙালিরা বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করবে।তবে এই রিপোর্টে এক গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন আছে। যেটা ভবিষ্যতে যে কোন গবেষকের জন্য কাজে লাগতে পারে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য অথবা সমস্যা পূর্ব ও পশ্চিম দুই পাকিস্তান নিয়ে রাষ্ট্র গড়ার বিষয়ে আলোচনার সুযোগ একবারই এসেছিল বা হয়েছিল।
সেটা হলো ১৯৬৯-৭০ সালের ‘গোলটেবিল’ আলোচনায়। যার আউটকাম হলো গৃহীত দলিল ‘লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ বা এলএফও। এই দলিলের পিছনে ধরে নেয়া কী অনুমান কাজ করেছিল সে সম্পর্কে এই গোয়েন্দা রিপোর্টে এক মন্তব্য আছে। তা হলো : ‘স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে যে- কোন সিদ্ধান্তের মূল চাবি ইয়াহিয়ার হাতে। ধরে নেয়া হচ্ছে, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে কাজ করার গুরুত্বকে বুঝেছেন, কিন্তু তিনি সন্দেহাতীতভাবে এটাও বিশ্বাস করেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের এলিট শাসকেরা যথাযথভাবে মধ্যপন্থীদের (পিপিপি) দিয়ে প্রতিনিধিত্ব পাবে এবং তারাই আওয়ামীলীগের নেতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
আর এভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষিত হবে।’ এটা থেকে প্রতীয়মান, পাকিস্তানের কেউই নিশ্চিত ছিল না পূর্ব-পশ্চিম মিলে একটা রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান ইস্যু কী, যেদিকে নজর দিতে হবে। শেষ বাক্যটা লক্ষ করা যেতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানের ‘সেন্টারিস্টি’ চিন্তার রাজনীতিবিদেরা মনে করেছিল তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং এভাবেই তারা পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে।
জানুয়ারি ২৯, ১৯৭১ ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। সেই আলোচনার সারমর্মতিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠান। আলোচনাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণবিধায় পূর্ণ অনুবাদ পাঠকদের জন্য দেয়া হচ্ছে। এখানে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের সম্ভাব্য স্বাধীনতার কথা বলছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে কী কী প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। ইয়াহিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা যত নেতিবাচক হোক না কেন, এই আলোচনায় ইয়াহিয়ার আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ ও গভীর দূরদৃষ্টির পরিচয় আমাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
ফারল্যান্ড লিখছেন : ১. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপের সময় তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ভীষণ ভীতি প্রকাশ করলেন। তিনি বলেন, এই ঘটনা তার কাছে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়। বর্তমানে সংবিধান প্রণয়নের যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, সেখান থেকেই এই সমস্যা তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, তিনি কীভাবে একটি সংবিধানকে তার অফিসিয়াল অনুমোদন দেন যার মধ্যে সহজাতভাবে এমন উপাদান আছে যা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে; একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ আমাদের জাতীয় লক্ষ্য যা আমারও স্বপ্ন ছিল। তিনি আইয়ুব খানের কথাই তার ভাষ্যে বলেন, (আইয়ুব খান) বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তান ভাঙার অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করতে চান নাই।
২. আমি এটা মনে করিয়ে দিলাম, আমার প্রথম বৈঠকেই বলেছিলাম, আমেরিকার পলিসি হচ্ছে, পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির প্রশ্নে শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করা, এবং আমি এই নীতির কথা একাধিকবার নানা প্রসঙ্গে প্রকাশ্যেই বলেছি। এছাড়াও আমি বললাম, যারা এর উল্টো ধারণা পোষণ করে তারা আমেরিকার স্বার্থের বন্ধু নয়; এর উল্টো যারা বলে যে আমেরিকা পাকিস্তানের দুই অংশকে বিচ্ছিন্ন করতে মদদ দিচ্ছে তারা শুধু মিথ্যাই বলছে না, ববং এই প্রচার রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান যাদের আছে তারা বলতে পারে না। এছাড়াও, যারা এটা বিশ্বাস করে আমেরিকা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আরেকটা অনুন্নত রাষ্ট্র তৈরি হোক সেই ইচ্ছে পোষণ করে। এটা হাস্যকর কিনা তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই ধরনের বিষয়কে সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সেটা বিশ্বাসও করা হচ্ছে।
৩. ইয়াহিয়া বলেন, তিনি অবশ্যই আমেরিকার এই নীতিকে পুনর্বার ব্যক্ত করাকে সাধুবাদ জানান যেহেতু পাকিস্তান সরকার ঠিক এর উল্টো কথাই নানা রিপোর্টে শুনছে এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এই নিয়ে অস্বস্তি আছে। তিনি বলেন, তাঁর সাধ্যমতো সবকিছুই করবেন যেন পাকিস্তানের দুই অংশ একসঙ্গে থাকে। কারণ এটা থাকলে, ভারত এবং সাধারণভাবে বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পাকিস্তানকে যে বিপদ মোকাবেলা করতে হতে পারে তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
৪. তিনি কী কী বিপদ দেখছেন তা জানার জন্য, আমার অনুরোধের প্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া বলেন, যে ম্যাপ ভালো করে দেখেছে এবং মিলিটারি কৌশল সম্পর্কে অবগত আছে বা এই অঞ্চলে চীনের নেতা হওয়ার আকাক্ষার কথা জানে সে খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে, ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পূর্বপাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট হয়ে উঠবে। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা)-কে কেন্দ্র করে চীন খুব সহজেই গায়ে গায়ে লাগানো অন্যান্য ভূখণ্ডগুলো টেনে নিতে শুরু করবে; চীনের জন্য এটা খুব সহজ রাজনৈতিক চাল হবে যে আসাম, পশ্চিমবঙ্গকে একসঙ্গেটেনে নেয়া। এমনকি, তিনি বলেন, এমন একটা সুযোগের জন্য ভাসানী অনুসারীরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
৫. ইয়াহিয়া তার এই মতকে আরো গুরুত্ব দেয়ার জন্য বললেন, ‘এটা ঘটলে (বাংলাদেশ স্বাধীন হলে) জঘন্য চীনারা যা এতদিন চেয়ে আসছিল তা পেয়ে যাবে সহজেই। আর তা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে একটি বন্দর, যা দিয়ে ভারত মহাসাগরে সে ঢুকতে পারবে।’ ইয়াহিয়া বলতে থাকলেন, এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যার মধ্যে বার্মাও আছে সেই এলাকায় চীনের চোরের ওপর বাটপারি করার সুযোগ তৈরি করে দেবে; এই অঞ্চল তার জন্য হবে এক ‘পাকা আমের মতো’। এমনকি থাইল্যান্ডও এই বলয়ে আসার জন্য তখন উপায় খুঁজবে। ইয়াহিয়া এই বলে উপসংহার টানেন, যদি আপনারা মনে করে থাকেন যে আপনারা ভিয়েতনামে জগাখিচুড়ি করে ফেলেছেন, তাহলে ভাবুন এই পুরো অঞ্চল যদি চীনের প্রভাব বলয়ে আসে তাহলে কী হবে?’
৬. আমি পাকিস্তানের দুই অংশের বিচ্ছিন্নতার ফলে কী হতে পারে সে বিষয়ে ইয়াহিয়ার খোলামেলা ও অকপট বিশ্লেষণের জন্য সাধুবাদ জানালাম। আমি নিজেও একটি নতুন ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ চীনের জন্য কী সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে সেবিষয়ে জানলাম। যদিও আমি যুক্ত করলাম, পিকিং-এ কী হচ্ছে সেবিষয়ে আমি জানতাম না তাই আপনার এই আলোচনা ও পর্যবেক্ষণ আগ্রহের সঙ্গে শুনেছি।২ মূল ভাষ্যের অনুবাদ শেষ। এখানে ইয়াহিয়ার প্রথম পয়েন্ট প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা মন্তব্য করছি।
ইয়াহিয়া বলছেন, ‘তিনি বলেন, তিনি কীভাবে একটি সংবিধানকে তার অফিসিয়াল অনুমোদন দেন যার মধ্যে সহজাতভাবে এমন উপাদান আছে যা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে; একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ আমাদের জাতীয় লক্ষ্য যা আমারও স্বপ্ন ছিল।’ এ কথাগুলো পড়তে হবে ২৫ মার্চ একাত্তরে কেন তিনি ম্যাসাকার করেছিলেন এর স্বপক্ষের সাফাই হিসেবে। অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, যে কনস্টিটিউশন তৈরি করা মানে দুই পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়া; তিনি সেটা অনুমোদন দিতে পারেন না। আর এই ‘পারেন না’ বলেই ইয়াহিয়ার করণীয় হয়ে যায় বলপ্রয়োগ। গণহত্যা করে হলেও দুই পাকিস্তান ধরে রাখার পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া। এর মানে আমরা দেখছি ইয়াহিয়া আসলে ব্যস্ত, কী করলে পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়া ঠেকাবে সেটা তিনি জানেন না, বলতে পারছেন না। তিনি বরং ব্যস্ত সেপারেশনের
পরিস্থিতি হলে কিভাবে দমন করবেন সেটা আমেরিকাকে বোঝাতে। বঙ্গোপসাগরে চীনা বন্দরের বিষয়টা আমেরিকার উদ্বেগের কারণ হতে পারত কিন্তু আমেরিকা এক্ষেত্রে নিশ্চিন্ত এই কারণেই যে, তারা জানে শেখ মুজিবুর রহমান চীনবিরোধী ও আমেরিকার বন্ধু।৩
সূত্র
১. National Archives, RG59, Central Files 1970-73, POL 14
PAK. Confidential. No drafting information appears on the in-
telligence brief.
২. National Archives, RG59, Central Files 1970-73, POL PAK.
Secret; Exdis; Eyes only for Assistant Secretary Sisco. In tele-
gram 930 from Islamabad, February 1, Farland reported that he
had met with President Yahya on January 29 in Yahya’s home
to “talk about things in general.” (Ibid., POL 15-1 PAK)।
৩. National Archives, RG59, Central Files 1970-73, POL PAK-
- Confidential; Priority; Limdis. Repeated to Islamabad, Ka-
rachi, and Lahore.