ছড়া কবিতা গানে অন্ত্যমিল
অন্ত্যমিল ছড়া,গান ও কবিতার গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। অন্ত্যমিল কিন্ত ছন্দ নয়। অন্ত্যমিল হচ্ছে গান কবিতা বা ছড়ার চরণের প্রান্তমিল। ধ্বনিগত সাদৃশ্য। অনেকে না জানার কারণে অন্ত্যমিল বা প্রান্তমিলকে ছন্দ মনে করেন। শুধু তাই নয়।
অন্ত্যমিলকেই ছন্দ জ্ঞান করার কারণে প্রকৃত ছন্দ রীতি সম্পর্কে তারা জ্ঞান অর্জনের কোন আগ্রহ প্রদর্শন করেন না এবং ছন্দ সম্পর্কে অজ্ঞতা নিয়েই অন্ত্যমিল সর্বস্ব পদ রচনা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। যা সাহিত্যের জন্যে বড়ই ক্ষতিকর বিষয়।
অন্ত্যমিল বা প্রান্তমিল ছড়া, কবিতা বা গানের বহিরাঙ্গের একটি বিশেষ সৌন্দর্য। অন্ত্যমিল প্রধান গান, ছড়া বা কবিতার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। এর পাঠক শ্রোতাও বেশি। আমাদের মন মননে স্থায়ী রেখাপাতে বেশি পারঙ্গম। ছড়া, কবিতা বা গান মনে রাখার ক্ষেত্রে অন্ত্যমিল বিশেষ ভূমিকা রাখে।
আমার স্মৃতি শক্তির বিশ্লেষণে অকপটে বলতে পারি: অন্ত্যমিলে রচিত কবিতা ছড়া আমার মগজে যতটুকু গেঁথে আছে- অন্ত্যমিলহীন লেখা তার কিয়দংশই মনে নেই। অন্ত্যমিল ছাড়া লেখা কবিতাগুলো অনেকটা গদ্যের মতো। গদ্যকী সহজে মনে রাখা যায়? আমিতো মনে করি গদ্য মনে রাখা খুব কঠিন একটি সাধনা। গদ্যের ভাব বা নির্যাসটা আমরা মনে রাখি, পুরো টেক্সটা নয়। অপরদিকে অন্ত্যমিলীয় ছড়া কবিতা বা গান অামরা সহজেই মনে রাখতে পারি। অন্ত্যমিলটাই যেন আমাদের স্মৃতিকে সজীব রাখে, চাঙ্গা রাখে।
চোখ বন্ধ করে স্মৃতির পাতা একটু হাতড়ে আসুন।দেখুন- সেই জন্মদিনের পোষাক পরা বয়সে আমরা যেসব মজাদার ঘুমপাড়ানিয়া ছড়া কবিতা শুনেছিলাম, তা আমাদের আজও মনে আছে, স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। যেমন:
ক। আমপাতা জোড়া জোড়া
মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া।
খ। খোকন খোকন ডাক পাড়ি
খোকন মোদের কার বাড়ি!
গ। আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঢাক ঢোল ঝাঁজর বাজে।
ঘ। নষ্ট আশা নষ্ট স্বপন নষ্ট আমার চিত্ত
নষ্ট স্রোতে ভাসছে যেন শান্তি আনার বিত্ত।
ঙ। ভোর হল দোর খোল খুকুমনি ওঠোরে
ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুলখুকী ছোটরে।
নিশ্চয়ই এসব ছড়া কবিতার পরের চরণগুলো আপনাদের চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। সবারই মনে আছে। আরও কত্তো কত্তো ছড়া, কিশোর কবিতা আপনাদের মনে আছে তা লেখাঝোকা নেই। শুধু ছড়া বা কিশোর কবিতা কেন, অনেক অাধুনিক ভাব সমৃদ্ধ, অলঙ্কার মণ্ডিত অন্ত্যমিলের কবিতাও আমাদের মনে আছে। যেমন:
ক। এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
(জসীম উদদীন)
খ। বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল
ঝাঁউশাখে যেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল।
(বেগম সুফিয়া কামাল)
গ। গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা
কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।
( কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঘ। রাত পোহাবার কতো দেরী পাঞ্জেরি
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে
সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে
তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি
রাত পোহাবার কতো দেরী
পাঞ্জেরি!
ঙ। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলো যারা জীবনের জয়গান
অাসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দেবে কোন বলিদান?
চ। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আশাকরি অন্ত্যমিলের শক্তি ও সামর্থ্যটা এতোক্ষণে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি। এখন উদ্ধৃত চরণগুলোর শেষ শব্দ বা শেষ ধ্বনিগুলো একটু খেয়াল করা যাক। যেমন:
★প্রথম ধাপের অন্ত্যমিলসমূহ:
জোড়া + ঘোড়া,
পাড়ি + বাড়ি
সাজে + বাজে
চিত্ত + বিত্ত
ওঠোরে + ছোটরে।
★২য় ধাপে আমরা অন্ত্যমিল পেলাম:
তলে+ জলে
কোল+ দোল
বরষা+ ভরসা
দেরি+ পাঞ্জেরি+ঘেরি
মেঘে+ জেগে
জয়গান+বলিদান
বাঁকে থাকে।
দেখার ও মজার বিষয় হলো:
ক। প্রথম ধাপের প্রথম চারটা অন্ত্যমিল একেবারেই ষোলআনা। ১০০ থেকে ১০০। এজাতীয় অন্ত্যমিলকে সবল অন্ত্যমিল বলা হয়। সবল অন্ত্যমিল ধ্বনিতে ধ্বনিতে সাদৃশ্য বা সমতা থাকা।
খ। দ্বিতীয় ধাপের দুএকটি অন্ত্যমিল কিন্তু ১০০থেকে ১০০হয় নি। যেমন:
মেঘে+জেগে
জয়গান+বলিদান।
মেঘে+জেগে- অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়োগ ঘটেছে এবং জয়গান + বলিদান অন্ত্যমিলের প্রথম অংশে দুধরণের স্বরধ্বনি (জয়ো+বলি) ব্যবহার হয়েছে এবং শেষটা সমধ্বনি (আ-কার+ হসন্ত জাত) গান+দান ব্যবহৃত হয়েছে।
গ। কখনো কখনো একেবার হুবহু সমবর্ণের সমধ্বনির অন্ত্যমিল চোখে পড়ে। যেমন:
আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
এখানে “দিয়ে যা” পরপর দুচরণেই ব্যবহার হয়েছে। যা কিছুটা দুর্বলতারই নামান্তর। দিয়ে যা দুবার না লিখে নিয়ে যা+পিয়ে যা লিখলে কিন্তু আরেক রকম সৌন্দর্য পেতো।
ক) কার চিহ্ন ভিত্তিক হয়ে থাকে এবং এক অক্ষর বিশিষ্ট অন্ত্যমিল হলে শব্দের শেষ বর্ণের সমধ্বনি/একই বর্ণ এবং একই স্বরধ্বনি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন:
★গান+মান+পান+দান+তান+কান+টান
(এখানে শব্দের প্রথমাংশে ‘আ’ স্বরধ্বনি এসেছে এবং শেষ বর্ণটি সব জায়গায় ‘ন’ ব্যবহার হয়েছে।
খ) দু অক্ষর বা দু সিলেবল বিশিষ্ট অন্ত্যমিল হলে সেখানে প্রথম অক্ষরে সমস্বরধ্বনি এবং শেষ অক্ষরে সমস্বরধ্বনি ও সম বর্ণ ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন:
★বলা+কলা+চলা+গলা+তলা+খলা
★ভোলা+ পোলা+ তোলা+ নোলা+গোলা
★নানি+ জানি+ মানি+ পানি+ খানি+ আনি
★হাসি+রাশি+ নাশি+ কাশি+ খাসি+ চাষী
★জাগলো+রাগলো+ ভাগলো+মাগলো
গ) তিন অক্ষর বা তিন সিলেবল বিশিষ্ট শব্দের অন্ত্যমিল:
তিন অক্ষর বা তিন সিলেবল বিশিষ্ট শব্দের অন্ত্যমিলে মনে রাখতে হবে শেষ দুটো ধ্বনি/ বর্ণ/ অক্ষর একেবারই সম/একই হতে হবে। যেমন:
★থামানো+ ঘামানো+ নামানো
★যামিনী+কামিনী+থামিনি+গামিনী+ঘামিনী
#
ঘ) তিন বা চার অক্ষর/সিলেবল বিশিষ্টি শব্দের অন্ত্যমিলে একান্ত অপারগতায় ও অপরিহার্যতায় সমবর্ণ না পেলেও সম কার চিহ্ন সম্বলিত ধ্বনি ব্যবহার করতে হবে এবং ন্যূনতম শেষ বর্ণ/ শেষ ধ্বনিটা অবশ্যই সম(একই) হতে হবে। যেমন:
★কারাগার+জাগাবার+ হাহাকার+পারাবার
★নারায়ণ+ বাতায়ন+বনায়ন
ঙ) মাঝে মাঝে শেষ পর্বের একাধিক শব্দের সমম্বয়ে অন্ত্যমিল (ধ্বনির মিল বললে বেশি ভালো) হয়ে থাকে। যেমন:
তাল কেটে+ খাল কেটে +চাল ছেঁটে+ মাল চেটে+ডাল বেটে
চ) কখনও কখনও সমার্থক শব্দদিয়ে অন্ত্যমিল করা হয়ে থাকে। এজাতীয় অন্ত্যমিলীয় লেখা পড়ার সময় অর্থ উদ্ধারে বেগ পেতে না হলেও শ্রুতির সময় বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেকের পক্ষে অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয় না। যেমন:
★কূল+কুল, পার+পার+ বান+বাণ, বিনা+বীণা,
★নিচ+নীচ, আপন+আপণ, সবান্ধব+স্ববান্ধব
ছ)মনে রাখার বিষয় হচ্ছে: অন্ত্যমিলটা সাধারণত হয়ে থাকে প্রায় সমোচ্চারিত শব্দের /ধ্বনির প্রয়োগে।
সমোচ্চারিত শব্দের / ধ্বনির প্রয়োগে নয়। যেমন:
★অবদান+অবসান+অবধান+অপমান+বহমান+রহমান, চলোমান+কলতান+কলগান
জ) কখনও কখনও চরণে শুধু নয়, পর্বে পর্বেও মিল দিতে দেখা যায় কবি ছড়াকার ও গীতিকারদের। অর্থাৎ প্রথম পর্বের শেষ ধ্বনির সাথে দ্বিতীয় পর্বের শেষ ধ্বনির মিল। যেমন:
★আমরা চলি+দুঃখ দলি+আলোর ঠিকানায়
পাষাণ তাপে+অভিশাপে+কালোর সীমানায়।
ঝ) অন্ত্যমিল দেবার সময় সাধারণত অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনি বা বর্ণকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ অল্পপ্রাণ+ অল্পপ্রাণ এবং মহাপ্রাণ+মহাপ্রাণ দিতে হবে। যেমন:
★অল্পপ্রাণ: বুকে+ধুকে, বাঁকা+ আঁকা, নাচা+কাঁচা
★ মহাপ্রাণ: মুখে+রুখে, মাখা+রাখা,মাঝে+সাঁঝে
এভাবে ধ্বনিগত সমতার ভিত্ততে অন্ত্যমিল দিয়ে আমরা আমাদের গান কবিতা বা ছড়া লিখতে পারি।
সবল ও দুর্বল অন্ত্যমিল
এবার বলবো-সবল ও দুর্বল অন্ত্যমিল প্রসঙ্গে:
*সবল অন্তমিল বলতে ধ্বনিগত শতভাগ মিল দ্বারা গঠিত অন্ত্যমিলকে বুঝায়। যেমন:
★শুনি+গুণী+মুনি+রুনী+বুনী+খুনী+কুনি
★আসা+আশা+ভাসা+ভাষা+ নাশা+চাষা।
*অপরদিকে ধ্বনির সামান্য তারতম্য সহকারে বা অল্পপ্রাণের সাথে মহাপ্রাণ,মহাপ্রাণের সাথে অল্পপ্রাণ ধ্বনির সমন্বয়ে যে অন্তমিল, সেটাই দুর্বল অন্ত্যমিল। যেমন:
★বুকে+সুখে, নাচো+আছো, আঁকি+পাখি
★বাড়ি+সারি, কেড়ে+ ঘেরে, মান+প্রাণ/ঘ্রাণ।
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
বিশেষ সতর্কতা:
ক। আমাদের অগ্রজসহ বর্তমানের অনেক লেখকই দুর্বল অন্ত্যমিল দিয়ে ছড়া, কবিতা, গান লিখছেন। হয়তো বেখেয়ালে, অথবা অপারগতায়। সেটা দৃষ্টান্ত ধরে আমরা লেখার সময় যেন তার পুনচর্চা না করি। আমাদের চেষ্টা থাকবে- অন্ত্যমিল যেন ১০০ থেকে ১০০ হয়। ১০০ থেকে ৯৯ যেন না হয়।
খ। শব্দের অপর্যাপ্ততা ও অর্থ-ভাবের বাধ্যবাধকতায় কখনও কখনও দুর্বল অন্ত্যমিলকে মেনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটা যেন নিয়ম মাফিক হয়েছে বা একেবারেই যথার্থই হয়েছে- এই নপুংসক বোধটা যেন আমাদের বিপদগামী না করে।
“”””‘”””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
প্রচলিত কিছু অন্ত্যমিল
সাধারণ অন্ত্যমিলের পাশাপাশি প্রচলিত কিছু অন্ত্যমিলের বলে রাখি।
“তুলে+ভুলে” মতন খাসা অন্ত্যমিল, অনেক কবির লেখায় পাওয়া যাবে না। যথাযথ অন্ত্যমিলের জন্যে মূলত বর্ণ ও স্বরধ্বনির সমব্যবহার বা সাদৃশ্য প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কিছু কিছু লেখায় এর ব্যতিক্রম আমরা লক্ষ্য করি। যেখানে সমবর্ণের ব্যবহার হয় নি, কেবল সম স্বরধ্বনির প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু কানে সেটা মানিয়ে গেছে। যেমন:
“ঐ দেখা যায় তালগাছ
ঐ আমাদের গাঁ,
ঐখানেতে বাস করে
কানাবগীর ছা।”‘
কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিনের বহুল পঠিত এই কিশোর কবিতাটিতে গাঁ+ ছা অন্ত্যমিল দেয়া হয়েছে স্বরধ্বনির সমতার ভিত্তিতে।
অনুরূপভাবে সমধ্বনি বিশিষ্ট অব্যয় ও সর্বনাম পদের অন্ত্যমিল আমরা পাই। যেমন:
যে+সে, কে+যে, কি+ছি প্রভৃতি।
অথবা,
“ধান ফুরালো পান ফুরালো
খাজনার উপায় কি,
আর কটাদিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।”
এই বহুল পঠিত ও পরিচিত ছড়ার অন্ত্যমিল “কি+ছি”( মধ্যখণ্ডনের পরের ছি)। এখানে সম স্বরধ্বনির প্রয়োগে (ি/ই-কার) অন্ত্যমিল হয়েছে।
মনে রাখতে হবে যে,সর্বনাম জাত বা অব্যয় জাত এবং কেবল সম স্বরধ্বনির প্রয়োগ বিশিষ্ট অন্ত্যমিলসমূহ কদাচিৎ চোখে পড়ে। এজাতীয় অন্ত্যমিল ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’র শামিল। যতদূর সম্ভব এজাতীয় অন্ত্যমিল পরিহার করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
উচ্চমার্গীয় কবিতার অন্ত্যমিল
এবার বলি উচ্চমার্গীয় কবিতার অন্ত্যমিল বিষয়ে। আমরা এতোক্ষণ যে আলোচনাটা করেছি, তা ছড়া, কিশোর কবিতা, গানের ক্ষেত্রে বেশি প্রজোয্য। বড়দের কবিতা বা উচ্চমার্গীয় কবিতার ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ চোখে পড়বে। তবু বিশেষভাবে নোট দিয়ে রাখা প্রয়োজন মনে করছি আমি।
বড়দের বা উচ্চমার্গীয় কবিতায় অন্ত্যমিলগুলো অনেক সময় এতোটা খাসা হয় না, দৃশ্যমান হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দূরবর্তী সমতা, স্বরের মিল দেখা যায়। তবে যারা শক্তিমান কবি তারা তাদের মাত্রা বা অক্ষরবৃত্তীয় কবিতাতেও নিটোল অন্ত্যমিলদানে সচেষ্ট থাকেন। যথাযথ অন্ত্যমিল দিতে গেলে বিপুল শব্দের সাথে লেখকের আত্মীয়তা থাকতে হবে। শব্দভাণ্ডারের যথাযথ দখল ছাড়া কবিতাসহ কোন সৃজনশীল কাজকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নেয়া কঠিন।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চোখ বুলোতে পারি:
“”হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথীবির পথে।
সিংহল সমূদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালায় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার আশোকের ধুসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক ;
চারিদিকে জিবনের সমূদ্র সফেন ; আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতাসেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মূখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য , অতিদূর সমূদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়াছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর ,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে , বলেছে সে এতদিন কোথায় ছিলেন ?
পাখির নিড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
পৃথীবির সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ; সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ- জিবনের সব লেনদেন ; থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন ।””
{{জীবনানন্দ দাশ}}
এই কবিতার অন্ত্যমিল অনেকটা দূরবর্তীধর্মী। কবি জসীম উদ্দীনের নিমন্ত্রণ বা কবর কবিতার মতো প্রত্যক্ষ অন্ত্যমিল নয়।
কবি ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি কবিতার অন্ত্যমিল প্রত্যক্ষ করতে পারি:
“কতো যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হলো জানিনা তা।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা,
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা,
তবু তুমি জাগলেনা,তবু তুমি জাগলেনা।”
আমার “ছন্দ শেখার পাঠশালা” ছন্দবিষয়ক কিশোর কবিতার একটা অংশে অন্ত্যমিল প্রদানের একটা কাঠামো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি বেশ আগেই। সেখানে একটু চোখ বুলিয়ে আসা যাক।
“অন্ত্য মিলের রহস্যটা এবার দেবো খুলে
‘চরণ শেষে ধ্বনির মিলন’-কেউ যেয়ো না ভুলে।
যেমন দেখো : মনের ‘ভুলে’ গোলাপ ‘তুলে’তুমি-
নিজের হাতে দাও পরিয়ে শ্রাবণ মেঘা ‘চুলে’।
::::
অন্ত্যমিলটা হতেই পারে বিচিত্র এক খেলা
পর চরণের প্যারায় যদি ভাসাও মনের ভেলা
প্রথম-দোসরা,তেসরা-চৌঠার মিলতে পারে ধ্বনি-
প্রথম-তেসরা,দোসরা-চৌঠারয় জমতে পারে মেলা।
::::
চার চরণেও আসতে পারে একই ররম ধ্বনি
প্রথম চৌঠা,দোসরা তেসরায় হয় যে সমাপনী,
প্রথম দোসরা চৌঠা সমিল অমিল শুধু তেসরায়-
এমন করেই মিলের তারায় সুরের আগমনী।”
এই কবিতাংশে যা বলতে চেয়েছি, তা গদ্যে একটু বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।
অন্ত্যমিল ছড়া,কবিতা ও গানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। অধিকাংশ পাঠক অন্ত্যমিলকে ছন্দজ্ঞান করে বড্ড গরমিল করে ফেলে ছড়া কবিতার আলোচনায়। ছন্দ আর অন্ত্যমিল কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো বিষয়। ছন্দ হচ্ছে লেখার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, বিন্যাস বা বাঁধন।
ছন্দ ছাড়া কোন ছড়া, কবিতা বা গান লেখা সম্ভব নয়। ছন্দ অপরিহার্য একটি বিষয়। অনেকে আধুনিক কবিতা মুক্ত ছন্দে লেখার কথা বলেন, বলেন গদ্য ছন্দ বা গদ্য কবিতার কথাও। সাধারণভাবে এজাতীয় লেখায় কোন ছন্দ নেই বলে কেউ কেউ মনে করলেও-তা কিন্তু ঠিক নয়। আধুনিক কবিতা হোক, গদ্য কবিতা হোক, মুক্ত ছন্দের কবিতা হোক- ছন্দ তাতে থাকবেই কবির হাতেই যদি তা লিখিত হয়ে থাকে। অকবিদের কষ্টকাব্যের কথা এখানে আর নাইবা বলি।
অপর দিকে অন্ত্যমিল হচ্ছে চরণের শেষ শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্য। যা কবিতার জন্য অপরিহার্য বিষয় নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অন্ত্যমিল ছাড়াও কবিতা লেখা যায়, কিন্তু ছন্দ ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি কবি জসীম উদদীনের কবর কবিতা থেকে:
এইখানে তোর/ দাদির কবর/ ডালিম গাছের/তলে
তিরিশ বছর/ ভিজায়ে রেখেছি/ দুই নয়নের / জলে।…
এইদুটো চরণের শেষ শব্দের ধ্বনি সাদৃশ্য দেখেন- তলে এবং জলে। কী সুন্দর ধ্বনিগত সাদৃশ্য।মনে রাখার মতো মিল। এই মিলটা অন্ত্য বা শেষে হবার কারণে তার নামটাও দেয়া হয়েছে-অন্ত্যমিল।
★অন্যদিকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতাটি দেখুন:
এসেছে নতুন শিশু
তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ মৃত আর ধ্বংস স্তূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের;
চলে যাবো ,তবু আজ যতোক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল।
সুকান্তের এই বহুল পঠিত ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতাটিতে অন্ত্যমিল নেই, কিন্তু ছন্দ আছে।
একজন সফল ছড়াকার, কবি বা গীতিকার তার ইচ্ছে মতোন অবশ্যই অন্ত্যমিল দিতে পারবেন, যদি তিনি প্রতিটি ছন্দের অন্তর্গত প্রাণশক্তি ধারণ করতে পারেন, কানকে সজাগ রেখে চরণের গতিকে ধরে রাখতে সক্ষম হন। গানে উনিশ বিশ কী নিরানব্বিই একশত এই তারতম্য টুকুনও কেমন জানি লেখকের ব্যর্থতা ও দৈন্যকে প্রকট করে তোলে।
প্রচলিত অন্তমিলের কয়েকটি ধারণাকে (চার চরণ বিশিষ্ট স্তবকের অন্ত্যমিল) নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ
খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ
গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ
ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি)
ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ
চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি)
এর বাইরেও বিচিত্র অন্ত্যমিল দেয়া যেতে পারে। তবে একটি গানের মধ্যে এক এক প্যারায় এক এক রকম না করে প্রথম থেকে শেষ পর অবধি একই রকম অন্ত্যমিল ও মাত্রা বিন্যাসকেই আমরা আদর্শ বলতে পারি।
নিরীক্ষার নামে যাতে কোন বিশৃঙ্খলার সুযোগ তৈরি না হয়, তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। প্রচলিত কয়েকটি অন্ত্যমিলের দৃষ্টান্ত নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ :
সকল জীবের তুমি খালিক
তুমি অশেষ একক অসীম,
দোজাহানের তুমি মালিক
তুমি গাফুর মহা মহীম।।
খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ):
মল বাজিয়ে মেঘের খামে
সারা দিনই বৃষ্টি নামে,
বৃষ্টি নামে ফোটায় ফোটায়
কদম কেয়া ফুলের বোটায়।
গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ:
সোনার দেশে সোনার মানুষ কই
যেদিক তাকাই ডাকাত এবং চোর
গুমের ভয়ে আটকে রাখি দোর
আমরা তবু চুপটি করে রই।
ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি):
অলসতা কেউ করি না
উঠি সকাল বেলা,
ভালো করে মুখ ধুয়ে নিই
কেউ করি না হেলা।
ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ :
স্বপ্ন আমার সবুজ শীতলপাটি
জোয়ার ভাটার নিরেট পলিমাটি
স্বপ্ন বোনার স্বপ্নে বিভোর হাঁটি
স্বপ্ন তবু হয় না পরিপাটি।
চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি):
পায়ের নিচে সবুজ শ্যামল ভূমি
জোছনা নেমে যায় যেন তার চুমি
ফারাক্কার ঐ মরণ বাঁধের ফলে-
বাঁচা মরার সংগ্রামে আজ তুমি!
অন্ত্যমিল: ছন্দ শেখার পাঠশালা-০৭
আ বু তা হের বে লাল
সকল গানে কাব্য ছড়ায়
চেষ্টা করে যাওয়া,
একশতে আজ একশটা মিল
যায়রে যদি পাওয়া!
:::
নয়তো নিরানব্বইয়ে ভাই
রবের কথা গাওয়া,
বেলকনিতে বইছে দেখো
বইছে দখিন হাওয়া।
::::
মেলার পাড়ে ফুল ফুটেছে
হয় নি আজো যাওয়া,
ধূলোর বনে পথ হারিয়ে
বইয়ের গন্ধ পাওয়া।
::::
সাবধানী হও ভুলছো যারা
গাঁয়ের নাওয়া খাওয়া,
টিকটিকিতো পিছেই ঘোরে
দিতে পারে ধাওয়া।
ছন্দশেখার পাঠশালা
ছন্দশেখার পাঠশালার প্রিয় বন্ধুরা, কেমন আছেন আপনারা? জানি খুব ভালো থাকার কথা নয়। আমিও খুব ভালো নেই। যাক সে কথা।
গতকাল আমি নতুন একটি হামদ ( রবের স্তুতিকেই হামদ বলা হয়) পোস্ট করেছিলাম। আমার ছন্দ শেখার পাঠশালা-র সচেতন শিক্ষার্থী ছড়াকার আবুজার গিফারী নাঈম ও ছড়াকার তোরাব আল হাবিব অই হামদের প্রথম প্যারা(স্থায়ী/ অাস্থায়ী/ মুখ) ব্যবহৃত অসীম ও মহীম শব্দের অন্ত্যমিল প্রসঙ্গে অালোচনায় অংশ গ্রহণ করেছিলো। আমি আমার মতামতও সেখানে তাদের সাথে শেয়ার করেছি।
গতকালের হামদটি ছিলো ছন্দ শেখার পাঠশালা-০৫ ও ০৬ এর এক্সটেনশন বা বর্ধিতরূপ। গত দুপর্বে আমরা ছড়া কবিতা গানের অন্ত্যমিল প্রসঙ্গে কথা বলেছিলাম।
আজকের এই আলোচনা দিয়েই অন্ত্যমিলের ইতি টানতে চাই।তার আগে আমরা গতকালে পোস্টকৃত আমার লেখা হামদের মুখটা চোখ বুলিয়ে নিই:
“সকল জীবের তুমি খালিক
তুমি অশেষ একক অসীম,
দোজাহানের তুমি মালিক
তুমি গাফুর মহা মহীম।।”
এবার মতামতে দৃষ্টি দেবার পালা।
আবুজার গিফারী নাঈম:
মন ভরে গেলো।অসংখ্য ধন্যবাদ।তবে একটুখানি জানার ছিল অসীম>মহীম কি সবল অন্ত্যমিল হবে? হলে কিভাবে? বিশ্লেষণসহ জানতে চাই।
আবু তাহের বেলাল:
সংবৃত ও বিবৃত উচ্চারণ রীতির দুটো শব্দ। অসীম শব্দটা পাল্টাতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু অসীম শব্দটা ব্যাপক ভাবে প্রচলিত এবং আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে প্রচলিত।
তাছাড়া ছড়ার অন্ত্যমিলটা যেমন খুব খুব খাসা দরকার, গানে তা নয়। যেমন অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অন্ত্যমিলেও দূরতম সংস্পর্শ অনেকটা নমনীয়। আশাকরি নাঈম বুঝতে পেরেছো।
অভিনন্দন তোমাকে।
#তোরাব আল হাবিব:
গানে এরকম অন্ত্যমিল চলে ভাই।
#আবু তাহের বেলাল:
তোরাব আল হাবিব তোমাকে অভিনন্দন। তুমি গানে এজাতীয় অন্ত্যমিলকে সমর্থন করেছো। তারপরও বলি: এজাতীয় অন্ত্যমিল যতদূর সম্ভব ব্যবহার না করাই ভালো। নিরুপায় হলে গান শুধু নয়, ছড়া কবিতাতেও দেয়া যায়।
আরেকটা ব্যাখ্যা এখানে করা য়ায়- মহীম, করীম, রহীমের মতো আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে অসীম শব্দের উচ্চারণও “ওশিম ” রূপে করা যায়। সেক্ষেত্রে অসীম ও মহীম উচ্চারণ এবং অন্ত্যমিল একই হয়ে যায়।
#তোরাব আল হাবিব:
ধন্যবাদ ভাইয়া। বলছিলাম গানে এগুলো কণ্ঠশিল্পি তার কণ্ঠের যাদুকরী সুরের লহরীতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সাবলীলভাবেই। আর গানে শতভাগ অন্ত্যমিল এজন্যে না হলেও চলে। ১৯/২০অন্ত্যমিলে রচিত গান প্রায়ই গীতিকারদের গানে পরিলক্ষিত হয়। কিছুদিনতো অন্ত্যমিল ছাড়াও গান গাওয়ার চেষ্টা চলেছে বঙ্গে!
#আবু তাহের বেলাল:
ঠিক বলেছো তোরাব। তারপরও বলি: ১৯/২০/ বা ৯৯/১০০ রূপের অন্ত্যমিল কিছুটা দুর্লল বা কমভালো অন্ত্যমিল। যতোদূর সম্ভব আমরা এজাতীয় অন্ত্যমিলকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবো। তবে একান্ত অপরিহার্তায় বা অপরাগতায় আমরা মেনে নেবো। মনে রাখতে হবে: সমজাতীয় বা প্রায় সমোচ্চারিত শব্দের অন্ত্যমিল অনেক সময় লেখকের বেখেয়ালে বা অসচেতনতায় অথবা উচ্চারণগত যথাযথ ধারণার অভাবে তাৎক্ষণিকভাবে ১৯/২০ অন্ত্যমিল দিয়ে দিতে পারে, হয়তো পরে যে কোন সময় লেখক আবার নিজকে শুধরে নেবেন। তখনই ঐ পরিবর্তীত শব্দটিই হয়ে উঠবে অনিবার্য শব্দ। লেখকের দৃষ্টিতে না এলেও আমরা তার সুহৃদ বা শুভাকাঙ্ক্ষি হলে তার নজরে দিতে পারি বিষয়টি। আশা করি এতে আমাদের সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে।
বিষয়টিকে একটি ছড়ার ফ্রেমে বেঁধে ফেলতে পারি।বন্ধুরা অন্ত্যমিল শিরোণামে সেই ছড়াটিকে আজ প্রথমেই পেস্ট করা হলো।
দেখুন অন্ত্যমিলের বিচিত্র্ রূপ ছন্দমাত্রা সচেতন বিভিন্ন কবি ছড়াকারের হাতে ধরা দেয়, উপভোগ্য হয় সে নতুন ভাবনাও। ইতোমধ্যে বন্ধুবর সুপ্রিয় ছড়াকার নুরুজ্জামান ফিরোজ, অনুজ ছড়াকার আব্দুল হাকিম ও উদীয়মান নবীন ছড়াকার অানিস আরমানের ছড়া আমার নজরে পড়েছে। পাঠকের জন্যে তাদের বিচিত্র অন্ত্যমিলের ছড়া তিনটি এখানে যুক্ত করে দিলাম:
প্রথমত:
জীবনগান – ৭৩
নূরুজ্জামান ফিরোজ
সূর্যবিহীন আকাশ আমার
চন্দ্রবিহীন রাত,
সইছি প্রতিঘাত-
স্বপ্নবিহীন জীবন যেমন
ধূলোয় ধূলিস্মাৎ।
বৃক্ষবিহীন বাগান আমার
সুবাসবিহীন ফুল,
বোলতা ফুটায় হুল-
জীবন পথে একলা হাঁটি
সবকিছুতেই ভুল।
ছন্দবিহীন গানের ডালি
মন্দ ভরা তাল,
হাল জামানার হাল-
নেইতো সুরে দরাজগলা
ব্যাপ্তি সুবিশাল।
তরঙ্গহীন বুকের নদী
ভাঙা-গড়ার খেলা,
নিরাশ কাটে বেলা-
ভালোবাসা নয়তো কেবল
পাওনা অবহেলা।
এইতো আমার জীবন কথা
সুখের বদল দুখ,
বুক ফেটে যায়, বুক-
দুঃখগুলো জাপটে ধরে
তাই থাকি উন্মুখ।
#দ্বিতীয়:
পান্তা ভাতে ঘি
—আব্দুল হাকিম
”””””””””””””””””””””””””””””””””””
ঘাট চেনো না, মাঠ চেনো না
বকুলতলার হাঁট চেনো না
দিলাম যখন চিনিয়ে ;
ঘাট খেয়েছো, মাঠ খেয়েছো
আমার সকল পাঠ খেয়েছো
পান্তাভাতে ঘি দিয়ে ।
.
খিল দেখো নি, দিল দেখো নি
ভালোবাসার মিল দেখো নি
দিলাম যখন দেখিয়ে ;
খিল খেয়েছো দিল খেয়েছো
তোমার আমার মিল খেয়েছো
গোবরজলে লেপিয়ে ।
.
চর বুঝো না, ঘর বুঝো না
কালবৈশাখীর ঝড় বুঝো না
দিলাম যখন বুঝিয়ে ;
চর খেয়েছো ঘর খেয়েছো
দমকা হাওয়ার ঝড় খেয়েছো
মুখে পট্টি গুঁজিয়ে ।
.
মন বাঁধো নি, ক্ষণ বাঁধো নি
পান্না-হিরে ধন বাঁধো নি
দিলাম যখন বাঁধিয়ে ;
মন খেয়েছো, ক্ষণ খেয়েছো
উপার্জিত ধন খেয়েছো
এই আমাকে কাঁদিয়ে ।
#তৃতীয়ত:
প্রকৃতির বুলবুল
(উৎসর্গ: প্রিয়কবি আবু তাহের বেলালকে)
-আনিস আরমান
_____________
কবি তাহের
ছন্দে মাহের
কাব্যে ফোটায় ফুল
তাঁকে চিনি
যেনো তিনি
প্রকৃতির বুলবুল।
.
মনের বাঁকে
ছন্দ আঁকে
আঁকেন নদীর কূল
কথার ফাঁকে
ছন্দ মাখে
নেই এ কবির তুল।
.
কাব্যে হাসে
কাব্যে ভাসে
কাব্যতে দেয় ডুব
তাঁর গানেতে
সুর-টানেতে
মুগ্ধ হবে খুব।
.
ছন্দে নাচে
ছন্দে বাঁচে
ছন্দতে খায় দোল
ছন্দ চষে
নীরব বসে
বাংলা মায়ের কোল।
.
রঙিন ছবি
জ্যোৎস্না রবি
আঁকেন বসে চুপ
সকাল সাঁঝে
কাব্য মাঝে
আঁকেন নানান রূপ।
.
ফুলফলাদি
ঝর্ণা, নদী
পাখির কলরব
মেঘলা আকাশ
হিমেল বাতাস
আঁকেন তিনি সব।
.
মায়ের হাসি
সুরের বাঁশি
পালতোলা সব নাও
গাঁয়ের বধূ
মরু ধূধূ
আঁকেন তিনি তাও।
.
গানের কবি
প্রাণের কবি
দুখীর কথা কয়
দেশের কবি
সবার কবি
এই তাঁর পরিচয়।
.
ছন্দতানে
বাংলা গানে
ধরেন নানান সুর
প্রিয় কবি
দেশের রবি
যাক এগিয়ে দূর।
সব শেষ বলি: একজন সৃজনশীল লেখকের মননশীল মানসিকতাই,ঋদ্ধ জ্ঞান,অভিজ্ঞতা, রুচিবোধ, তীক্ষ্ণতা সাহিত্যের নানা বৈচিত্র্য সাধনে ভূমিকা রেখে থাকে। নন্দনতত্ত্বেরর শেষ সংঙ্গা, শেষ কথা, শেষ প্রকার, শেষ বৈশিষ্ট্য বলে কোন কথা নেই, কোন কথা থাকতে নেই। অন্ত্যমিলও তার বাইরের কিছু নয়। অালোচনাটি শুধু নবীনদের পথ দেখানোর জন্যে।
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
প্রথম প্রহর (রাত৩-৫)
গৃহকোণ, নরসিংদী।
এর বাইরেও আরও বিচিত্র্য অন্ত্যমিল দেয়া যাবে। শব্দচাষীরা তাদের শব্দের আবাদ কিভাবে করবেন, কিভাবে নিজে দুলবেন, ছন্দের দোলায় পাঠককে দোলাবেন এটা তার নিজস্ব সৃজনশীলতা আর সামার্থ্যের বিষয়। অন্ত্যমিল নিয়ে আর আলোচনাকে দীর্ঘায়িত না করে আগামী কবির সৃজনশীলতা বিচিত্র মননশীলতার ওপর ছেড়ে দিলাম। কবিতা আবার ছন্দে ফিরবে, আবার অন্ত্যমিলের সুরেলা দোলায় দুলবে সেটাই আমার ঐকান্তিক প্রত্যাশা।
“”অন্ত্যমিল, অন্ত্যমিল, অন্ত্যমিল, ছড়া, কবিতা, গান, ছন্দ।
নরসিংদী
১জুলাই-২০১৮