অধ্যাপক গোলাম আযম
একজন গোলাম আযম–১
আমি তেমন চিনতাম ও না। ১৯৭৫ আই এস সি পরীক্ষার পরে গ্রামের বাড়ি গেছি। হঠাৎ ই একজন আত্মীয় দাওয়াত দিলেন মেয়েদের মধ্যে কাজ করার। কি কাজ করবো নিজেইতো কিছু জানিনা। উনি ছিলেন একজন আল বদর সদদ্য।এলাকার লোকজন ওনাদের বাড়িঘর ভেংগে ওনাদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আর কিছুই আনতে পারেন নি কিন্তু নিজের লুংগি তে পেঁচিয়ে যত গুলো বই ছিল সব নিয়ে এসেছেন।সেই পোটলা র ভিতর ধেঁটে একটা বই পেলেন” মুসুলমানের অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের কর্মসূচি ” সেই সময় তার ভাবারও সময় নেই এটা আমার জন্য উপযোগী কিনা। নিয়ে এলাম বই সেদিনই পড়তে শুরু করলাম। বই টি উপমহাদেশের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদী (রহ )এর।তখন মাওলানার বই এ দেশে প্রকাশ্যে পড়া যেত না।
বইর ভূমিকায় লেখক সম্পর্কে লিখেছেন যে তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রি নেই। বইটা পড়ে কি বুঝেছিলাম জানিনা কিন্তু এই ভুমিকা আমাকে আগ্রহী করে তুললো মাওলানা র ব্যাপারে।
গ্রামের বাড়িতেই আমাদের এক লাইব্ররীরছিল। দুই আরমারী ভর্তি বই ছিল। আমার আব্বা, চাচা, বড় বোন মিলে এই লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিলেন। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস,পত্রিকা, হিন্দু মাইথোলজি,ইস্লামী বই মসলা মাসায়েল বিভিন্ন রকম তাব্লীগের বই ছিল।আমি সেই আলমারী ঘাটতে লাগলাম।পেয়ে গেলাম ” মাওলানা মওদুদীঃএকটি সংগ্রামী জীবন” লেখক – গোলাম আযম। একটা চটি বই যেমন টি প্রফেসর সাহেব সচরাচর লিখে থাকেন। সে বই পরে আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। এখন একজন নয়, দু’জন কে নিয়েই কিউরিইওসিটি। এই প্রথম আমি নামে চিনলাম অধ্যাপক গোলাম আযম কে।…..
একজন গোলাম আযম – ২
আব্বার লাইব্রেরী তে খুজতে লাগলাম আর কোন বই পাই কিনা! পেয়ে গেলাম ” আব্বাস আলী খান
সাহেবের ” মাওলানা মওদুদীঃ একটি জীবন একটি ইতিহাস।” আব্বা বললেন, ‘তুই এটা কেন পড়বি। এটা তো পড়বে যারা জামায়াত করে তারা। ভাবলাম আমি এক্তু পড়েই দেখি।
এদিকে আমার ঢাকা আসার সময় হয়ে যায় অনার্স ভর্তির জন্য। চলে আসবো আবার সেই আত্মীয়ের সাথে দেখা। আমাকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে তাগাদা দিলেন মেয়েদের মধ্যে কাজ করার।
ঢাকায় এসে ভর্তি হয়ে যাওয়ার আগেই দেখা হল সাইয়েদা মুনিরা খালাম্মার সাথে। তখন ইস্লামী মহিলা মজলিসের সহ সভানেত্রী ছিলেন। তিনিই একটি সিম্পোজিয়ামে পরিচয় করিয়ে দিলেন নিজামী আপার সাথে বায়তুল মোকাররমে
মহিলা অজ্ঞনে।
ভর্তি হয়ে গেলাম ইডেন কলেজে অনার্সে।
। কথা হোল নুরুন্নিসার সাথে।ইডেনেই ভর্তি হোল মার্জিয়া। পরিচিত হলাম আতিয়া, মনোয়ার,নাসিমাপা মতো মিতু আপা অনেকের সাথে। নিজামী ভাই আপাকে নির্দেশ দিতেন
আর নিজামী আপা আমাদের পরিচালনা করতেন। এক পর্যায় বিভিন্ন ভাই বোনদের সহায়তা আমরা সংগঠিত হই। জন্ম হয় ”একমাত্র একক ছাত্রী সংগঠন – বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার।
পথ চলার এই সময়েই অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব বাংলাদেশে এসেছেন তাঁর অসুস্থ মাকে দেখতে। এতোদিনে তার ব্যাপারে জেনে নিয়েছি অনেক কিছুই।তিনিও বাইছাস এর গঠন এর কথা শুনেছেন এবার হবে তার সাথে সরাসরি দেখা। আজকে মগবাজার কাজি অফিসে ওখানেই তার বাড়ি ছিল। বড় টিনের ঘর। দেখা করতে অনেক মানুষ এর ভীর। উনি পিছনের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন আর আমাকে ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন সংগঠনের অবস্থা বিভিন্ন দিক ছাত্রী দের সংখ্যা ইত্যাদি.
এই প্র্থম আমার সাথে তার পরিচয় দেখা আর কথা।
২য় আবার কথা হোল উনি বাংলাদেশ এসেই তার বড় ছেলের জন্য বউ খুঁজতে শুরু করলেন আর সিলেক্ট করলেন উম্মে সালমা মুন্নি কে। বাইছাসের আহবায়ক কমিটিরর সদস্য – হাফেজা আসমা খাতুন খালাম্মার মেয়ে। ইডেন কলেজে সে বছর সাংস্কৃতিক সপ্তাহে কুর আন তেলাওয়াত প্রতিযোগতায় প্র্থম হয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন গোটা কলেজে।যেমন দেখার মত ছিল তার সৌন্দর্য তেমনি অমায়িক ব্যবহার। মেয়েদের হন্দয় মুগদ হয়েছিল মুগ্ধ হয়েছিলাম আমিও। তবে এমন মেয়েকে হাত ছাড়া করতে হবে ভেবে আমাদের মন খারাপ। একদম ইউরোপ লন্ডনে। তবে ওর মাধ্যমে ই সংস্থার বিদশে কাজের সূচনা হয়েছিল বলে খুশীও হলাম আলহদুলিল্লাহ। কেমনে যেন জানতে পারলেন প্রফেসর সাহেব। বললেন, ” আমি তো শুধু একজন নিলাম। আর তো তোমাদের সব থাকলেই। আসলে কিন্তু নিয়েছিলেন তিন জন পরে তার আরো দুই ছেলের জন্য, ডালিয়া আর নাহার কে ওই লন্ডনেই।
নাগরিকত্বের জটিলতা থাকায় বাইরে কাজ করতে পারতেন না। তিনি কুরআন গবেষনার মধ্যে দিয়ে লোক তৈরীয়ে মনোযোগী হলেন। ছাত্রীদেরর ১টি, ছাত্রদে ১টি মহিলা ও পুরুষের একটি করে গ্রুপ মোট চারটি গ্রুপ তিনি স্টাডি সারকেল নিতে শুরু করলেন। এখানে মোলিক যে কাজ তিনি করেছেন ১। বিষয় ভিত্তিক আয়াত ভাগ করা। ২। কুর আনের যে সব আয়াত ক্কলা / ওয়া ক্কলু বলে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে তা আসলে কার বক্তব্য, কে কাকে বলছে কি বলছে এই বিষয়ে স্পষ্ট করা।
, ৩।আল কুরআনে বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে আল্লাহ কি প্রমান করতে চেয়েছেন। এটা নির্ধারন করা। যেমন প্রাকৃতিক বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে তৌহিদ প্রমান করতে চেয়েছেন।
আমরা খুবেই মজা পেতাম। পরবর্তী তে এই গ্রুপ গুলো নিয়ে যে ফলাফল সেটাই তার আল কুরানের সহজ অনুবাদ বের করেন আর স্টাডি সার্কেল নামে একটি বই আমরা এখন দেখি ওটাই আমাদের নিয়ে তিনি করেছিলেন। তার লেখা কুর আন বুঝা সহজ বইটির
মাধ্যমেও তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি খুব ছোট ছোট বই লিখতেন সহজ ভাষায়।তাঁর অভিমত হোল – মানুষ অনেক ব্যস্ত তাই বড় বই পড়্তে চায় ন। যতটুকু সময় পায় তা যেন কাজে লাগাতে পারে। একটি মোলিক বিষয় কম সময়েই পড়ে জেনে নিতে পারে ।’
আর একটি মজার ব্যপার ছিল মেয়েদের / মহিলাদের সাথে প্রোগ্রাম করার সময় পরদার আড়াল থেকে কথা বলাকে বলতেন ” গায়েবী বক্তৃতা ” আর শ্রোতা
না দেখে বক্তব্য দিতে কস্ট হোত বলে নিজের বোন জাহানারা আজহারী আপা ও স্ত্রী আফিফা আযম ভাবী কে সামনে রাখতেন।। এ ভাবেই আমরা তার হাতে মননে বিশ্বাসে আল্লাহর পথে চলার জন্য গড়ে উঠি।
একজন গোলাম আযম – ৩
ছাত্রী সংস্থা ১ম সম্মেলন। অনুমোদন ও বিভিন্ন পরামর্শের জন্য গেলাম মগবাজার দেখা করতে।তখন দুপুর বেলা। এই অবসরে প্রফেসর সাহেব কে পেয়ে যাব কারন এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই এসেছি ইমার্জেন্সিতে। উনি গোসল নামাজের আগে কাজ করছিলেন বাড়ির উঠানের বাগানে। একটা বরই গাছ ঘরের চাল কে অনেকটাই ঢেকে রেখেছে।আরো কিছু গাছ গোড়ার মাটি আলগা করছেন মাটি খঁরে দিচ্ছেন। স্যান্ডো গেঞ্জি লুজ্ঞি পড়া।হাতে নিড়ানি। খোলা বারান্দায় বসেই কথা বললাম। তিনি কাজ করতে করতে ই শুনলেন।
এই এক কাজে আমার মিল ছিল। আমিও গাছ লাগাই বলতে গেলে নেশা। এই গাছের বরই আমার মতো অনেকেই খেয়েছেন।বরইর দিনে যাদের সাথে তাঁর প্রোগ্রাম থাকতো তাদের জন্য ই তিনি বাটি ভরে খেতে দিতেন। /আবার মনে রাখতেন কে পেল আর কে পেল না। একবার অসুস্থ থাকার করনে আমি যেতে পারিনাই কিন্তু আমার জন্য একটি বরই ঠিকই তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রিয় মিন্টুর হাতে। শীতে বেলী, শরতে শিউলী ফুল ছোট ছোট পলি প্যাক করে দিতেন সবাইকে। আফিফা ভাবী ও আমকে পাঠিয়ে দিতেন। মিস্টি স্নিগ্ধ সে ঘ্রান তাদের স্নেহের মতই নিরবে হ্নদয় ছুঁয়ে দিত। এমন করে কে আর ভালবাসবে!
১৯৭৯ সালের এই সম্মেলন বিভিন্ন কারনেই গুরুত্বপূর্ণ। ১মতঃ এটাই প্রথম। ২য়তঃ বাইছাস তখনো বাইছাস হয়ে ওঠেনি।স্থানীয় সংগঠন হিসাবে ঢাকায় কাজ করার অনুমোদন শুধু।পুরো বাংলাদেশব্যপী কাজ করতে হলে মেয়েদের তদারকীর জন্য সফার জরুরি। আর শরীয়তী প্রশ্ন অ আচ্ছে শুধুই মেয়েদের একক সংগঠন এলাউড/ জায়েজ কিনা।
এদিকে আমরা তো মরিয়া কাজের জন্য
এই সম্মেলনে আমাদর অনেক কিছুই প্রমান করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে আমাদের সক্ষমতা। দূর করতে হব্বে শরয়ী সমস্যগুলো ও। আর এদিকে আমার বড় ছেলে সালমান হয়েছে মাত্র আঠার দিন।আমি যখন মগবাজার থেকে আসি মনে হচ্ছিল রিকশা যেন আর চলছেই না।বাচ্চার খাওয়ার সময় হয়েছে। এমন সময় আবার রাস্তার পাশে বস্তিতে কোন এক বাচ্চার কান্না আমাকে আরো উতলা করে তোলে। এখন আমি কি রিকশা থেকে নেমে দৌড় দেব না কি রিকশায় পাখা লাগাবো বুঝতে পারছিলাম না। আহ! মা। মায়ের সন্তানের প্রতি কি টান সেদিনই প্রথন বুঝলাম।আলহামদুলিল্লাহ।
মুরব্বিদের সহায়তায়,ভাইদের অকৃত্রিম সাহায্যে, বোনদের ঐকান্তিকতায় আর পরিশ্রমে সম্মেলন হয়েছিল। তারপরেও ছাত্রসংস্থা কে জাতীয় সংগঠন হিসাবে আজকের বাইছাস হয়ে ঊঠতে সময় লেগেছিল আরো এক বছর। প্রফেসর সাহেবের মত মেয়েদের কাজের ব্যাপারে এমন মুরুব্বি না থাকলে নিজামী ভাই আপার মত পৃসঠপোষক না থাকলে সম্ভব ছিলানা। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় এই সুযোগ তিনি আমদের করে দিয়ে মেহের বানী করে ঐতিহাসীক মর্যাদার সুযোগ করে দিয়েছেন।
মহিলাদের কাজের ব্যাপারে প্রফেসর সাহেব নিজে যেমন ছিলেন শ্রদ্ধাশীল, উদার আর আশাবাদী। তেমনি তিনি মাহিলাদের ও করে তুলেছিলেন আশাবাদী। সাথে সাথে ভাইদের কেও মহিলাদের কাজের পৃসঠপোষক হতে বাধ্য করেছেন অনুপ্রানিত করেছেন। তিনি হাফেজা খালাম্মাকে ঝাল্কাঠি থাকে ঢাকায় নিয়ে এসে মহলা বিভাগের দায়িত্ব দিলেন। কেন্দ্রীয় টিম গঠন করলেন। আলাদা সফর টিম বানালেন। কিভাবে সফর করা যাবে সে পরিকল্প না করলেন। সাথে ছাত্রীরাও যায়ে যেতে পারে তার জন্য নির্দেশ দিলেন। নানা পরীক্ষা নিরিক্ষার মধ দিয়ে ই আজকের এই যে রুপরেখায় আমরা লাভ করতে পেরেছি প্রফেসর সাহেবের অকৃত্তিম চেস্টা প্রচেষ্টা সাধনায় যত্নে ভালবাসায়।
আমরা যে কতটা প্রশ্রয়ে ছিলাম সেটা বুঝতে পারলাম যখন তিনি জেলে গেলেন। বিএন পি কথা রাখলনা। আল্লাহ জামায়াতকে এমন এক পজিশন দান করলেন যে জামায়াত যআকে সম্র্থম দিবে তারাই সরকার গঠন করতে পারবে। জামায়াত কোন সুযোগ সুবিধা মত্রীত্ব কোন দাবী না করেই সম্র্থন দিয়েছিল নাগরিকত্বের প্রশ্নে। কিন্তু তারা ক্ষমাতায় এসেই তাকে বন্দী করলো। আহ কী সময় তখন! কর্মীরা পালা করে করে পাহারা দিচ্ছে বাসা। পুরো এলাকাই পাহারার আওতায়।পুলিশ এলে তারা তাদের প্রিয় নেতাকে নিতে দেবেনা। পুলিশ এসে গেল।কর্মী রা শুয়ে পরেছে রাস্তায়। প্রফেসর সাহেবের ব্যাগ গুচজানোইছিল। চারিদিকে কান্নার রোল। পুলিশ কিছুই কর্তে পারছেনা। তাদের একাটাই কথা। নিতে হলে আমদেরা লাশের উপর দিয়ে নিতে হবে। তখন প্রফেসর সাহেব নিজে দাঁড়িয়ে গেলেন। বুঝালেন। দোয়া করতে বললেন যেন জয়ী হয়ে নাগরিকত্ব নিয়ে ফিরতে পারেন। কাজ হোল কর্মী রা কাঁদতে-কাঁদতে পুলিশের গাড়ি ধরে এগিয়ে যেতে থাকল।আর সত্যি ই তিনি নাগরি ত্ব নিয়েই ফিরলেন আবার তার প্রিয় কর্মী বাহিনী ও দেশবাসীর মাঝে।
এর আগে আভ্যন্তরীণ ভাবে তিনি আমীরদ জামায়াত থাকতেন কিন্তু ভারপ্রাপ্ত রাখতে হত জনাব আব্বাস আলী খান সাহেবকে। সাংবাদিক রা একবার তাকে জিজ্ঞেস করলেন “আপনি কবে ভারমুক্ত হবেন ” এ বছর সিদ্ধান্তঃ হয় সরাসরি আমীর ঘোষনা দেয়া হয়েছিল।এখন আর আইনী জটিলতা অ থাকল না
এবার শুরু হোল সফর দেশব্যাপী। মিটিং গুলোতে এতো লোক হতে থাকলো গাছে মানুষ বিল্ফিং এ মানুষ। মহিলাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ যদিও তাদের দাওয়াত দেয়া হত না।
একজন গোলাম আযম – ৪
মহিলাদের কাজে যত প্রশ্রয় পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। সারা দেশে লোক আগেই কিছু কিছু তৈরি ছিল এবার পরিবেশ পেয়ে কাজ করতে শুরু করে দিল। আলহামদুলিল্লাহ
কাজের ব্যপারে সেটা সাংগঠনিক অথবা রাজনৈতিক যে কোন ব্যাপারেই প্রফেসর সাহেব মহিলাদের সাথে পরামর্শ করতে পছন্দ করতেন। বলতেন ও আমরা আল্লাহর রাসূল সাঃ থেকে দেখতে পাই তিনি মহিলাদের সাথে পরাম্র্শ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল পার্লামেন্টে মহিলাদের যাওয়া নিয়ে। আলেমগনের সাথে ডিবেট হোল। পক্ষ বিপক্ষ করে ভাইরা কিতাব নিয়েই চলে আসলন রেফারেন্সের জন্য। শেষ পর্যন্ত” হ্যা” ই জয়যুক্ত হোল। কিন্তু কে যাবেন পার্লামেন্ট এ।কিছু গূনাবলী সাথে কিছু শর্ত যোগ হল। মহিলা ও পুরুষ উভয় পক্ষ থেকেই মতামত নেয়া হোল। বাইরের মানুষেরা তো জানেনা জামায়াতে কত উচ্চ শিক্ষিত মহিলা রয়েছে এম পি হওয়ার মত। আসলে অনেক ভাইরাও মনে হয় ভাল ভাবে জানতেন না। সৈয়দা জাকিয়া আপার পক্ষে প্রস্তাবনা আসে। কিন্তু
।গোলাম আযম সাহেবের স্ত্রীর বড়বোন একটা কলেজের প্রিঞ্চিপাল ছিলেন । তিনি বদরুন্নেসা কলেজের আরবী ডিপার্মেন্ট এর প্রধান ছিলেন। বয়সের শর্তে ও ঠিক ছিলেন কিন্তু শুধু মাত্র তিনি তার আত্মীয়া বলে এটা নাকচ করে দেন।
আর একটা ব্যাপার আমার খুবেই ভাল লেগেছে। বলেছিলাম তাঁর বাসাটা টিনের বড় একটা বাসা ছিল। পরে ওটার সামনে আর একটা সেমি পাকা ঘর তুলে তিনি থাকতেন। পরে যখন সেটা আজকের এই বিল্ডিং করেন তখন প্রফেসর সাহেব একটি লিখিত লিফ্লেট বিতরন করেন জনশক্তির মধ্যে। তাতে স্পস্ট উল্লেখ ছিল তাঁর ইনকামের সোর্স। পরিমান আর এই বাড়ী করারটাকা কোথায় পাচ্ছেন, ছেলেরা কত দিচ্ছেন সব স্পস্ট করেন। আমরা খোলাফেয়ে রাশেদার যুগে দেখেছি এই ধরনের জবাব দিহিতা। আমরা আবার দেখলাম। এই জবাব দিহিতা, স্বচ্ছতা। এমনিভাবে তিনি শুধু নিজেই নিজের স্বচ্ছতা প্রকাশ করেছেন তাই নয় তিনি দলের ও জবাব্দিহিতা নিশ্চিত করেন। মীর কাসেমের নামে খুব একটা প্রপাগান্ডা ছিল তার চাল চলন এবং জীবন যাপন নিয়ে। তিনি ডাকালেন আর অভিযোগ গুলোর জবাব চাইলেন। মীর কাসেমও তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী উত্তর দিলেন ”
‘আমার বাবার আছে একটা বাড়ি।
আমাকে অফিস দিয়েছে একটি গাড়ি।
আর আমার আছে কয়টা সাফারী।”
এই জবাব দিহিতাই ইসলামের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য । আমরা যদি দাবী করি আমরা খোলাফায়ে রাশেদারই উত্তরসূরী তবে আমাদের তাদের গুনাবলির ও প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।
প্রফেসর সাহেবের জীবন যাপনের পরিমিতি বোধ ও স্বচ্ছতা আমকে সব সময় মুগ্ধ করতো।
একবার বিশেষ প্রয়োজনেই সকাল বেলা যেতে হয়েছে তাঁর বাসায়
তখন তিনি সেমি পাকা ঘরে থাকেন। তিনি ঘুমিয়ে আছেন। ভাবী বললেন। সপ্তাহে দুদিন উনি কিয়ামুল লাইল করেন। তাই এই দুদিন সকালে ঘুমান। আর বক্তব্যেও তিনি বলতেন ক্রমান্বয়ে কিভাবে রাত জাগার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বলতেন সপ্তাহ একদিন, তারপর দুইদিন এমন করেই প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ধরনা দিতে অভ্যস্ত হতে হবে যখন পুর বিশ্বচরাচর নিস্তব্ধ – জেগে আছেন শুধুই আমাদের মহিয়ান গরিয়ান স্রস্টা তার সৃষ্টি র সান্নিধ্য পাওয়ার অপেক্ষায়।
আরো ভাল লাগতো তাঁর স্বভাবসুলভ সৌন্দর্য বোধ, পরিস্কার,পরিচ্ছন্নতা। গুছান পরিপাটি থাকা। জেলে একবার তাকে দেখতে গিয়েছিলেন একজন বিদেশী জার্নালিস্ট। তিনি তার বই ‘ Bangladesh ‘ reflect on the water,, এ অতি চমৎকার একটা বর্ননা দিন য়েছিলেন কিভাবে রুম টিকে গুছিয়ে রাখা হয়েছে তার রুচি বোধের উল্লেখ করে।
আরও পড়তে পারেন–রাজনীতি কি ? কেন আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি করতে হবে- আলানূর হোসাঈন
খাবারের ব্যপারেও তিনি পরিমিত খেতেন। দাওয়াতে বেশী আইটেম দেখলে অনেকে বিরক্ত হয়ে যেতে দেখিছি। কিন্তু তিনি বলতেন, ” সব তোমাকে খেতে হবে কেন ? যেটা ভাল লাগে সেটা খাও। ”
কার মধ্যে কোন সম্ভাবনাকে তিনি খুবেই উৎসাহিত করতেন, আগ্রহ দেখাতেন, খোঁজ খবর নিয়ে আরো উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতেন। এটা দেখেছি নয়া দিগন্ত পত্রিকা বের হওয়ার পরে। আবার দিগন্ত টিভি চালু হওয়ার সময় ও দেখেছি কত গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। কোন অসুবিধা হলে সাথে সাথে ফোন করতেন আবার কিছু ভাল লাগলেও জানাতে কার্পণ্য করতেন না। একজন হিতাকাংখী একজন অভিভাবকের মত ই। আর এই অভিভাবক্ত্ব না থাকলে আসলে সৃজনশীলতা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে এটার এতো বেশী অভাব! চাটুকারিতা যেমন দরকার নেই ক্ষতিকর কিন্তু অভিভাবক্ত্ব এবং উৎসাহিত করা খুবেই দরকার।
” জীবনে যা দেখলাম ” তাঁর লেখা কয়েক খন্ডে একমাত্র বিশাল বই।সব সময় ছোট ছোট বই যে লিখেছেন – এই বইএ তা পুরো পুরি তা উসুল করে দিয়েছেন। আমি তো বলি এটা একটা কার্য বিবরনী বই। যাতে খুটি নাটি কোন কিছুই তিনি বাদ দেননি । যখন যার কথা লিখেছেন পুরো পিরিচয় দিয়ে লিখেছেন। এই বইর অনেক পাতার অনেক প্রশংগে আছি আমি আমার পরিবার। আছে আমার ছেলে মেয়েরাও। এক জায়গায় লিখেছেন যে আমার বড় ছেলে সালমান ড্রাইভ করে নিয়ে গেছে। আসলে সালমান সেদিন শুধুই সাথে করে নিয়ে এসেছিল। ড্রাইভার সাহেব ই ড্রাইভ করেছিল কিন্তু সালমান সে সান্নিধ্য এতোটাই উপভোগ করেছিল যে মনে হয়েছিল যে ও ড্রাইভ করে এনেছিল। এই কথাট আমি বলে সংশোধ করে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তা আর হয়নি। তবে তিনি অনেক উদার মনের ছিলেন। যে কোন ত্রুটি মেনে নিতে দ্বিধা করতেন না। তার অনুবাদ কৃত ” আল কুরআনের সহজ অনুবাদে একটা খুব ছোট ভুল আমার চোখে ধরা পরলো। আমি তাঁর বোন জাহানারা আজহারী আপাকে দিয়ে জানালাম (আপা তখন মহিলা বিভাগের সেত্রেটারী) । প্রফেসর সাহেব সেটা গ্রহন তো করলেনই সাথে ধন্যবাদ ও পাঠালেন । আলহামদুলুল্লাহ। নেতা কর্মীর এই সম্পর্কের এই সহজতা ই সংঠন কে করে তোলে শিশা ঢালা প্রাচীর।
সংগঠনের বাইরের লোকেরা অনেকেই ভাবে যে আওমার তাঁকে ” প্রফেসর সাহেব ” এ জন্য বলি যে তিনি কারমাইকেল কলেজের প্রভাষক ছিলেন। তারা এটানিয়ে এভাবেও বলে যে একজন প্রভাষক কে কি প্রফেসর বলা যায়? না বলা যায় না। কিন্তু জামায়াত তাকে প্রফেসর এই সেন্সে বলে যেমন জাতীয় প্রফেসর.। অনেক কেই জাতীর প্রফেসর হিসাবে আখ্যায়িত কর হয়। মালয়েশিয়ায়ায় দাতো হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকে তেমনি তিনি জামায়াতের প্রফেসর হিসাবেই আমরা তাকে মনে করি বলেই ” প্রফেসর ” সাহেব বলে ডাকা হয়। অনেকেরি হয়তো জানা নেই৷। এটাই তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বোধ।
আমার মনে আছে একবার আমি রাস্তাদিয়ে যাচ্ছি দেখি আমার সামনেই যাচ্ছে প্রফেসর সাহেবের গাড়ি……. আমার অন্তরের অন্তঃ স্থল থেকে কিযে দোয়া আসতে লাগলো! আমি ড্রাইভার সাহেবকে একটু আসতে চালাতে বললাম। যতক্ষন না তিনি দৃস্টি সীমার বাইরে চলে গেলেন। এমন দায়ীত্বশীল থাকলেই তো কর্মিদের হ্নদয় এমন দোয়ায় আপ্লুত হতে পারে আর এমন অন্তর হতে স্বতঃস্ফূর্ত দোয়া কবুল হবেই ইনশা আল্লাহ।
তিনি ও আমাদের জন্য অনেক দোয়া করতেন। একবার আমার অপারেশন। ব্লাড দরকার । রেয়ার গ্রুপ – A গ্রুপ। প্ত্র প্ত্রিকায় দিয়ে, সব অফিস গুলোতে ঘোষনা দিয়েও ব্লাড পাওয়া গেল না। তিনি কি যে উদ্বিগ্ন ছিলেন। মীর কাসেম কে বকা দিয়ে অস্থির করে তুললেন ” তুমি কি মেয়েটাকে মেরে ফেলবে?
প্রতিটি সম্মেলন শেষে দোয়া করতেন এমন আবেগ ঘন দোয়া নিজে কাঁদতেন হ্নদয় মন উজার করে আর পুরো সম্মেলনকে কাঁদিয়ে আকুল করতেন।এমন এক রুকন সম্মেলনে স্ত্রীকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার ফায়দা বলতে গিয়ে বললেন – আপনি যখন অনেক রাতে বাসায় ফিরেন, যদি স্ত্রী আপনার সহযোগী হয় সে তখিন বুঝবে আপনার কস্ট মূল্যায়ন করবে আপনাকে তখন আপনাকে ঠান্ডা ভাত টা খেতে দিবেনা। গরম করে দিবে। এমন আবেগী ভাষায় তিনি বলেছিলেন আসলে আমাদের প্রানে ভালবাসা সঞ্চার হয়েছিল আর ভাইরা যে কত খুশী হয়েছিলেন তাত আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রতিটি সম্মেলন শেষে উদীপ্ত হতাম ভীষণ ভাবে। আর একটা দোয়া করতেন সব সময় শুধু সম্মেলনে নয় বরং শুরা শেষে বা শুরুতে, টিসি/টিএসশেষে মুনাজাতে আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন দূরারগ্য ব্যাধি থেকে আর বয়সের অনিস্ট থেকে।। আর আমার কষ্ট শেষ সময়ে বয়সের এই কস্ট ভোগ করতে আমি প্রতি নিয়ত তাকে দেখলাম।
ট্রাইবুনালের দিন গুলো কী ভয়াবহ অবস্থায় কাটিয়েছেন। ইয়া আল্লাহ তুমি সাক্ষী। একজন অশতিপর লোককে একটা মিথ্যা অভিযোগে এতোটা কস্ট দেয়া যেতে পারে চিন্তা ই করতে পারি না। প্রায় ই দেখা হোত গারদে বসে আছেন। সেই আভিজাত্যপূর্ণ লুংগি পড়া। সাদা মিশেল হাল্কা রংগের চেক , সাদা পাঞ্জবী মাথায় সাদা টুপি নেটের। লুংগিতে এমন আভিজাত্য ফুঁটে উঠতে আমি আমার আর কাউকেই দেখিনি যেমন্টা দেখেছি আমার আব্বাকে। আরো এক জায়গায় মিল ছিল। আব্বা দাবী করতেন যে তাদের পূর্ব পুরুষ তুরস্ক থেকে আগত।প্রফেসর সাহেব ও তা ই দাবী করতেন। আমি নিজেই শুনেছি আবার ” জীবনে যা দেখলাম ” বই য়ে লিখেছেন।
গারদের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে তিনি এতোই অস্থির করতেন শিক ধরে মহা বিরক্তির সাথে পুলিশ প্রহ্রীকে বলতেন, কেন এতো দেরী করছ নিতে। দেরী যদি করবে তাহলে এতো আগে কেন আনলে? ” আসলে যারা জেলে থেকে হাজিরা দিতে আসেন সবাই জানেন কতটা ঝক্কি ঝামেলা তাদের পোহাতে হত। সকাল ছয়টা থেকে তাদের খাওয়া ঘুম বিশ্রাম ছিল না। ওরা দিতনা। এরপর কখন যে মামলা উঠবে তা ও কেউ জানেনা। সকাল? দুপুর? কিংবা বিকাল? এতোক্ষন বসে থাকা এই বয়সে সম্ভব কি করে? মাঝে মাঝেই ফেইন্ট হয়ে যেতেন। কখনো রেগে যেতেন। একদম খেতে চাইতেন না। আমান আর আমানের বউ খাবার নিয়ে আসতো । আমরাও খাবার নিয়ে যেতাম খেতে সাধলেই রেগে যেতেন। আহ! কী যে কস্ট সহ্য করার মত ছিল না।
এখানেই আমাদের সাথে দেখা হত মীর কাসম এর সাথে, নিজামী ভাইর সাথে । কখনো মোল্লাভাইর সাথে। মাবরুরের সাথে দেখা হত কিন্তু মুজাহীদ ভাইকে কখনো দেখি নাই।আমান মাবরুর আরমান আহ আমাদের বাচ্চাদের চেয়ারার দিকে তাকান যেত না। ওরা দু দিকের ঝামেলা সামলাত। এক দিকে বন্দী বাবা অন্য দিকে মুক্ত হলেও আহত পাখির মত ডানা ঝাপ্টান মা, পরিবারের লোক জন।
কী হোত ওদের অন্তরে সে তো শুধু আল্লাহ ই জানেন। আযমীকে দেখতাম হুইল চেয়ারে মাকে নিয়ে পিজি হাসপাতালের করিডোরে। আর এই দেখা করার পারমিশন্ টা আনতে যেতে হোত সেই পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।। আর আমরা যেয়ে বসে থাকতাম কখন সময় হবে। আদৌ হবে কিনা।
সেই বার্ধক্য যে এভাবে কারগার বানানো হাস্পাতালে অবচেতন হয়ে কাটাতে হবে কে জানত?