মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা
কারো কারো মাথায় ভূত চেপেছে গদ্য কবিতার এবং মুক্তছন্দের । প্রকৃত কবিদের মননে মাথায় এই ভূতটা যতোটা শোভনীয়, ততোটা অকবির উপলব্ধিতে তা কিম্ভূত কিমাকার কালো দৈত্যের মতোই ভয়ঙ্কর। গদ্য কবিতা মানে ছন্দহীনতা নয়, মুক্তছন্দ মানে ছন্দের বাঁধন মুক্তি নয়। গদ্য কবিতা মানে যদি ছন্দহীনতা হতো, তবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটি উপন্যাস না থেকে আলবৎ কাব্যগ্রন্থ হয়ে উঠতো অবলীলায়। কবি গুরু নাম রাখলেন কাব্যিক, আর কামটা করলেন নিটোল গদ্যের। কারণ তিনি সচেতন ছিলেন। গদ্য কী আর কবিতা বা আধুনিক গদ্য কবিতা কি- তা তিনি ভালো করেই জানতেন।
আমাদের অনেক অগ্রজ কবি এবং বর্তমানের বা সমসাময়িক সচেতন অনেক কবি জেনে বুঝেই, সুস্থ্ ধ্যানে জ্ঞানে সমর্পিত হয়ে গদ্য কবিতা (আধুনিক কবিতার কথা বলছিনে ইচ্ছে করেই, আধুনিক কবিতা আরেক প্রেক্ষাপট) লিখছেন। তাদের লেখাগুলো কবিতা হয়ে উঠলেও অন্য অধিকাংশ গদ্য কবির লেখা কবিতা হয়ে উঠছে না। অকবিদের পণ্ডশ্রম গদ্য কবিতার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, ভুলপথে বাংলা সাহিত্যকে ঠেলে দিচ্ছে। টিনএজ প্রেমপত্র মার্কা গদ্যকে গদ্য কবিতার দর্পণে সেঁটে দেবার আয়োজন চলছে চতুর্দিকে। এই অস্থিরতা, অপরিপক্কতা, অদূরদর্শিতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার।
একজন কবিতার ছাত্রকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে:
কবিতা কী?
কোন্ বৈশিষ্ট্য কোন গদ্যকে কবিতায় উন্নিত করে?
কবিতার শরীর থাকলেও কোন্ লেখাটা প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠছে না প্রভৃতি।
আমাদের দুঃখ- এসব বিষয়গুলো সামনে না রেখেই, শিল্প প্রকরণ, অলঙ্কার তত্ত্ব, ছন্দ মাত্রা না জেনেই না বুঝেই অনেকেই কবিতায় হাত পাকানোর চেষ্টা করছেন অনেকেই। শিক্ষা জীবনের পুরোটা কাল বুয়েটে কাটিয়ে কর্মজীবনে ডাক্তারী পেশায় মনোনিবেশ করার মতো হাস্যকর বিষয় যা।
আমরা গদ্য কবিতার ছন্দ মাত্রা নিয়ে কথা বলার আগে কবিতা কাকে বলে সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করে নিই।
কবিতা কী?
চারুশিল্পের অন্যতম একটি শাখা হচ্ছে কবিতা।ইংরেজিতে যার প্রতিশব্দ দেয়া হয়েছে Poem বলে। আমি মনে করি “কবিতা অন্তর্জাত এমন একটি উপলব্ধি যা বিশিষ্ট শব্দকল্প এবং অলঙ্কারের মাধ্যমে রসাশ্রিত হয়ে মানব মনে অনির্বাণ আনন্দধারার সৃষ্টি করে থাক।” ইংরেজ কবি কোলরিজ কবিতার সংজ্ঞায় বলেছেন: Best Word In The Best Order.
কবি ড.সৈয়দ আলী আহসান যার রূপান্তর করেছেন: সুষম শব্দের সুষম বিন্যাসই কবিতা। এটাকে অন্যভাবেও বলা যায়: অনিবার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাসই কবিতা।
# কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে- রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।
# রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মতে- উপমাই কবিতা।
# মালার্মে বলেছেন- শব্দই কবিতা।
# দান্তের মতে- সুরে বসানো কথাই হল কবিতা।
# ম্যাকলিশ বলেছেন- কবিতা কিছু বোঝায় না; কবিতা হয়ে ওঠে।
# রবার্ট ফ্রস্টের মতে- সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।
# কবি শঙ্খ ঘোষের মতে- ছন্দে সমর্পিত শব্দেরই নাম কবিতা।
# সৈয়দ শামসুল হকের মতে- কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ।
# হুমায়ুন আজাদের মতে- পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।
# সিকানদার আবু জাফরের মতে- আমি কবিতা লিখি অনায়াসে। যেমন সকলেরই ক্ষেত্রে জীবনের আশে-পাশে অসংখ্য সুলভ দুর্লভ মুহূর্ত নানা রূপে অনাবৃত হয়েছে আমার সামনে। আমি কোন কোন সময় সেই সব মুহূর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করেছি সত্য-বিচ্যুতি না ঘটিয়ে। সেই আমার কবিতা।
# কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন- কবিতা সম্বন্ধে ‘বোঝা কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো‘ যাবে না ।
# কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মতে- যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সাথে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে তাকেই বোধহয় কবিতা বলা যেতে পারে।
# শক্তিমান কবি আল মাহমুদ বলেছেন- পাখির নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার
সেটাই কবিত্ব।
# এসব সংজ্ঞার মাধ্যমে কবিতার একটা চিত্র ফুটে উঠেছে সবার সামনে।যেকোন লেখা তাই কবিতা হবে না, কোন কোন লেখা হবে কবিতা। যেমন সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি। কবিরা জেনে বুঝে কবিতা লিখলে কবিতা হয়, অকবিরা লিখলে হয়তো পদ্য হয়, নয়তো গদবাঁধা গদ্যই থেকে যায়।
মনে রাখতে হবে
কবিত্ব স্রষ্টা প্রদত্ত একটি বিশেষ শক্তি, বিশেষ এক উপলব্ধির নাম। আল্লাহ যাকে এই অপার মহিমাটা দান করেছেন, তিনি অন্যদের থেকে একটু আলাদা,একটু স্বতন্ত্র,একটি ব্যতিক্রম। একজন সচেতন কবির শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, উপমা অলঙ্কারের প্রয়োগ- সব সময়ই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত।
# একজন প্রকৃত কবি যখন আধুনিক গদ্য কবিতা লিখবেন- তিনি ছন্দকে পরিহার করে কবিতা লিখবেন না, বরং ছন্দকে ধারণ করেই লিখবেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথাই প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়লো (তার কবিতার ক্লাস পড়ে মূলত ছন্দজ্ঞানটাকে পরিস্কার করে ঝালাই করে নিতে পেরেছিলাম প্রথম তারুণ্যে)। তিনি বলেন: “ছন্দ জানা ভালো কিন্তু এর দাসত্ব করা ভালো নয়”।
# একজন সচেতন কবি ছন্দকে অনুসরণ করবেন, ব্যবহার করবেন,ভাঙবেন, নতুন করে গড়বেন। তিনি কখনো একটি ছন্দের মধ্যে আবদ্ধ থাকবেন না। ছন্দের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা , নতুনত্ব আনাই হচ্ছে ছন্দের দাসত্বমুক্তি। দাসত্বমুক্তি মানে কখনো ছন্দহীনতা নয়, ছন্দহীন পথের অভিযাত্রা নয়। ছন্দের দাসত্বমুক্তির অভিপ্রায়ে কেউ কেউ ছন্দকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চান, যা খুবই অবিবেচনা প্রসূত, কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক।
# গদ্য কবিতাকে ছন্দহীন ভাবার ন্যূনতম অবকাশ নেই।মনে রাখতে হবে- আধুনিক কবিতা বা গদ্য কবিতার ভেতরেও বহমান থাকে শক্তিমান ছন্দের নির্ঝরণী। যা সাধারণ পাঠকের চোখে আবিষ্কৃত হয় না। সাহিত্য গবেষক মাহবুবুল আলম তার ‘‘বাংলা ছন্দের রূপরেখা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: “পদ্যের ছন্দ প্রস্ফুট আর গদ্যছন্দ অস্ফুট। পদ্যছন্দের যতি চরণকে কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্বে বিভক্ত করে- পর্বগুলোতেও শৃঙ্খলা থাকে। কিন্তু গদ্যছন্দে যতি থাকে না। এর পরিবর্তে আছে ছেদ। ছেদকর্তৃক বিভক্ত বাক্যে বাক্যাংশের পর্বের মতো কোনো নির্দিষ্ট মাপ নেই। ছেদকে সুনিয়ন্ত্রিত করে সামঞ্জস্যপূর্ণ বাক্যাংশের দ্বারা গদ্যে ছন্দের আভাস আনয়ন করতে হয়। গদ্যছন্দে যতি, যুগ্মচলন, মিত্রাক্ষর, অনুপ্রাস-যমক প্রভৃতি থাকবে না। গদ্যছন্দে গদ্যের বা শব্দের ক্রম অনুসরণ করতে হয়। “
# আমরা দেখতে পাই- গদ্যছন্দ বাংলা কবিতার ছন্দের শেষ পরিণতি হিসেবে সাম্প্রতিক কাব্যে প্রভূত সমাদৃত। পয়ার থেকে মুক্তক পর্যন্ত যে বন্দনমুক্তি তা শুধু যতি, মিল ও পংক্তি সীমার বন্ধনমুক্তি, কিন্তু তা মাত্রাবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্তি নয়। গদ্যছন্দে মাত্রাবিন্যাসের এই বন্ধনের অবসান ঘটেছে। গদ্যছন্দে মাত্রাবিন্যাসের স্বাধীনতা কবিপ্রাণকে ২য় বারের মতো মুক্তি দিয়েছে । প্রথম মুক্তি ঘটেছিলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দের আবিষ্কারের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে: ছন্দকে পরিহার করা নয়, ছন্দকে মাত্রাকে গভীরভাবে ধারণ করেছে আধুনিক গদ্য কবিতা।
# ছন্দবিশ্লেষক,সাহিত্য সমালোচক প্রবোধচন্দ্র সেন আধুনিক গদ্যকবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন: “মাত্রাবিন্যাসের নীতিকে লঙ্ঘন করলে পদ্য আর পদ্যই থাকে না, সে হয়ে ওঠে গদ্য। কিন্তু কবিরা অনুভব করলেন যে, বিশেষ মাত্রাবিন্যাসের ব্যবস্থার ফলে পদ্যে যে ধ্বনিগত তরঙ্গায়িত ভঙ্গি বা ধ্বনিস্পন্দন জেগে ওঠে, সেই স্পন্দন বা ধ্বনিভঙ্গিটুকুকে রক্ষা করে যদি নির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাসের বন্ধনকে এড়ানো যায় তাহলে একরকম স্পন্দনমান গদ্যের উদ্ভব হয় যাকে ক্ষেত্রবিশেষ অনায়াসেই কাব্যভাবের বাহনরূপে স্বীকার করে নেওয়া যায়।এইরূপেই আবির্ভূত হলো গদ্যকবিতা। গদ্যকবিতার এই যে ধ্বনিভঙ্গি বা স্পন্দনলীলা, তাকেই বলা হয়েছে ‘গদ্যছন্দ’।… পদ্যের রঙ লাগা গদ্যই হচ্ছে গদ্যকবিতার বাহন। গদ্যে ও পদ্যের রঙ লাগে যে কণ্ঠস্বরের প্রভাবে, সে কণ্ঠস্বর বস্তুত ভাবেরই দ্যোতক। এই ভাবাবেগের ফলেই গদ্যকবিতায় ভাষা স্পন্দিত হয়ে ওঠে পদ্যের মতো। … গদ্যকবিতার ভাষায় পদ্যের ন্যায় মাত্রাবিন্যাসের সুনির্দিষ্ট নীতি ও পরিমাণ রক্ষিত হয় না, কিন্তু তাতে কবিতার ভাবস্পন্দনটুকু রক্ষিত হয়। সাধারণ গদ্যের সঙ্গে কবিতার গদ্যের পার্থক্য এখানেই।”
# প্রবোধচন্দ্র_সেন_ও_মাহবুবুল_আলমের বক্তব্যের মাধ্যমে গদ্য ছন্দের মূল প্রকৃতিটা ফুটে উঠেছে। এই প্রকৃতিকে ধারণ না করেই নবীন প্রবীন অনেকেই গদ্যকবিতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন ইদানিং। যা খুবই বেদনাদায়ক। এতে বাংলা কাব্য সাহিত্য ক্ষতি গ্রস্থ হবে।
# প্রায় দেখি অনেকেই স্বরবৃত্ত ছন্দটার আগামাথা ঠিক রেখে দশবিশটা ছড়া কবিতা লিখতে পারছেন না, অথচ অসম্ভব দ্রুততায় কবি হয়ে ওঠার বাসনায় গদ্য কবিতা(!) লেখা শুরু করছেন। লেখা শেষ না হতেই তড়িঘড়ি করে ফেসবুকে পোস্ট করছেন, পত্রপত্রিকায় পাঠাচ্ছেন, একুশের মেলায় মুখ দেখাচ্ছেন। আহারে কবি! কবিতা আর নিজের সর্বনাশ আর কতো ভাবে করবেন! আমাদের অনেক ফেসবুক বন্ধুও আছেন- যে কোন লেখা বা পোস্ট শেষ পর্যন্ত না পড়েও অসম্ভব দায়িত্ব ও বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে যেয়ে মুগ্ধতার আবেশ ঘন কমেন্টস করেন,বিচিত্র লাইকও দেন। অকবি বন্ধুতো তো তার অখাদ্য গদ্যকেও রীতিমতো সার্থক গদ্য কবিতা ভেবে নিজে নিজে আহ্লাদিত হন, বেশ খোশ খোশ মেজাজে আবেগের ডজন খানেক ডানা লাগিয়ে কাব্যপাড়ায় ঘুরতে থাকেন।
# সহজ কথায় বললে:
এজাতীয় কবিদের(!) ধারণা- অন্ত্যমিল ছাড়া একটা লাইন বড়, আরেকটা লাইন ছোট করে বিচিত্র কাঠামোর চরণ বিন্যাস করলেই বোধ হয় তার লেখাটা হেব্বি হিটের গদ্য কবিতা হয়ে ওঠে। তাদের ধারণা – ছন্দ মাত্রার হিসেব কিতেব একবারেই ব্যাকডেটেড,মান্ধাতার আমলের। প্রাচীন মনস্কদের কাজ হচ্ছে ছন্দ মাত্রার অঙ্ক নিয়ে পড়ে থাকা। অনেকেইতো মনে করেন কিছু দুর্বোধ্য ভাবের আগমণ ঘটিয়ে প্রিয়তমার চোখ কান নাক মুখকে শ্রাবস্তীর কারুকাজের সাথে তুলনা করলেই চমৎকার গদ্য হয়ে যাচ্ছে। তাই হলে জীবনানন্দ দাশের প্রয়োজন বা অপরিহার্যতা কবেই শেষ হয়ে যেতো। সুনীল চলে যেতেন ভাঁগাড়ে। ফররুখ হয়ে পড়তেন অপ্রাসঙ্গিক।
# মনে রাখতে হবে কোন কাজই ছন্দহীন নয়। ছন্দ মূলত অদৃশ্যমান একটি জিনিস। যা প্রতিটি বিষয়ের অন্তর্নিহিত একটি Power বা শক্তি,দ্যোতনা। প্রত্যেক মানুষের জীবনেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। ছন্দ মূলত একটি পরিমিতি বোধ বা পরিমিতি জ্ঞান, একটা শৃঙ্খলা, একটা স্রোতধারা। যা আমাদেরকে গন্তব্যের শেষ প্রান্তে অবলীলালায় পৌঁছে দেয়। একজন বাস চালকের কথা ভাবুন- নরসিংদী থেকে ঢাকা পর্যন্ত যেতে তার বাসকে কতোভাবে কতো বুদ্ধিমত্তার সাথে নিয়ন্ত্রণ করেন-ঐ নিয়ন্ত্রণ কৌশলটাই তার ছন্দ। একজন বৈমানিক আকাশ পথে যানজটের ভয় না থাকলেও প্রাকৃতিক পরিবেশ বা অন্যান্য বাঁধা বিপত্তিকে মাড়িয়ে যাত্রী ও বিমানকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যে বাস চালকের মতো নয়, তার মতো করে প্রতিষ্ঠিত গাইড লাইন মাফিক বিমানকে পরিচালনা করে থাকেন। বিমান চালকের দূরদর্শিতাই তার ছন্দ।
গদ্য কবিতার ভেতরেও অনুরূপ ছন্দ থাকবে, যা অন্ত্যমিল প্রধান ছড়া কবিতার মতো অনেকের কাছেই (যাদের ছন্দ জ্ঞান নেই) ছন্দটা দৃশ্যমান হবে না, ছন্দকে তারা আবিষ্কার করতে পারবেন না। তাদের এই অক্ষমতাই ভ্রান্ত পথেই তাদের ধাবিত করছে। প্রকৃত পক্ষে ছন্দ ছাড়া কবিতার অস্তিত্ব নেই,থাকবে না। যারা বলেন: গদ্য কবিতার ছন্দ নেই, তারা মারাত্মক ভুলই বলেন। গদ্যছন্দ মানে ছন্দহীনতা নয়। ছন্দ অবশ্যই থাকবে। সেটা ধরার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে আমাদের। আমাদের অনেক অগ্রজের মানসম্পন্ন কালোর্তীর্ণ গদ্যকবিতা (ছন্দোবদ্ধ) রয়েছে, যা সাধারণ পাঠকের কাছে, নবীন অকবির কাছে ছন্দহীন মনে হতে পারে।
গদ্য কবিতায় মূলত মুক্তছন্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।আর মুক্তছন্দটা নির্ভর করে-অক্ষরবৃত্তের পরিবর্তিত রূপের ওপরই। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কাঠামোতেই গদ্যছন্দ বা মুক্তছন্দের বিস্তার বা প্রসার। যখন অন্ত্যমিলীয় রীতিতে অক্ষরবৃত্তের ব্যবহার করা হয় তখন প্রতি চরণে নির্দিষ্ট মাত্রা বসানো হয়। যার শুরুটা হয় সাধারণত ১৪ মাত্রা দিয়ে (৮+৬) । এছাড়া ১৮ মাত্রা (১০+৮), ২২ মাত্রা (১২+১০) এই মাত্রাকেন্দ্রিক পর্ব বিভাজনও একবোর আবশ্যকীয় নয়। তবে সঙ্গতিটা ধরে রাখতে পারলে চমৎকারীত্ব আসে, ভিন্ন আবেগ বা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়, কবির সৃজনশীলতা দীপ্ত হয়।
এর বাইরে চরণের মোট মাত্রা ৬,১০, ১৪, ১৮, ২২, ২৬, ৩০, ৩৪ করেও সাজানো যায়। কখনো কখনো আধুনিক কবিগণ এক চরণে ০৮ মাত্রা দিয়ে পরের চরণে ১০ মাত্রা দিয়ে মাত্রার কাঠামো ০৮+১০=১৮ ঠিক রাখেন। আবার প্রথমে ১২+পরে১০মাত্রা দিয়ে ২২মাত্রার হিসেব করেন। কখনো ১৬+১০/ ১৮+১২=৩০/ ২০+১৪=৩৪ দিয়ে মাত্রার হিসেব ঠিক রাখেন।
গদ্য কবিতায় মুক্তছন্দের নামে মূলত এই জাতীয় হিসেবকে বিবেচনা করা হয়। যেখানে মুক্তাক্ষর এক মাত্রা বিশিষ্টি হয় এবং বদ্ধাক্ষর শব্দের শেষে ব্যবহৃত হলে দুই মাত্রা বিশিষ্ট হয় (তিন জায়গায় ব্যতিক্রম হয়ে থাকে: কথ্য ক্রিয়াপদ, নির্দেশক পদ এবং সমাসবদ্ধ পদ, যেখানেই বদ্ধাক্ষর বসুক দুই মাত্রা হিসেব ধরা হবে।)। মুক্তছন্দ সাধারণত স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের বাঁধনে বাঁধা যায় না। কারণ স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের পর্ব মাত্রার চালটা একবারেই নিয়ন্ত্রিত, অংকের মতো, বিজ্ঞানের সূত্রের মতো। অক্ষরবৃত্তের উদার নীতিই তাকে গদ্য ছন্দের বাহন করেছে। আমরা জানি: সমপর্ব ও সমমাত্রার বাধ্যবাধ্যকতা নেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। যার কারণে কবি এখানে মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ভোগ করে থাকেন। তিনি কবিতার চরণকে ছোট বড় করবেন একটি ছকের মধ্যে ফেলে, ফ্রেমের মধ্যে রেখে। আর সেটা হলো: ৬,১০, ১৪, ১৮, ২২, ২৬, ৩০, ৩৪ মাত্রা বিশিষ্ট চরণ। এর বাইরেও যে মাত্রা গণনার আরেকটি কৌশল ব্যবহৃত হয়ে থাকে তারও উল্লেখ করা হয়েছে (ভিন্ন ভিন্ন চরণে: ৮+১০/ ১০+৮/ ১২+১০/১০+১২/ ১৪+৮/৮+১৪/ ১০+২০/২০+১০/ ১৬+১০/১০+১৬ প্রভৃতি)।
গদ্যছন্দে রচিত (বিবর্তিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ) দুএকটি গদ্য কবিতাকে সামনে আনলে আশাকরি গদ্য কবিতায় ছন্দের প্রয়োগ বা প্রয়োজনটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ছাড়পত্র
সুকান্তভট্টাচার্য
যে শিশু ভূমিষ্ট হল আজ রাত্রে-10
তার মুখে খবর পেলুমঃ-10
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,-10
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার-22
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।-10
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত-18
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।-18
সে ভাষা বুঝে না কেউ,কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।-22
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা-14
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-14
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ট শিশুর-14
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।-10
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;-18
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে-18
চলে যেতে হবে আমাদের।-10
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ-18
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল-14
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-18
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।-18
অবশেষে সব কাজ সেরে,-10
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে-14
করে যাব আশীর্বাদ,তারপর হব ইতিহাস।।18
কবির এই ছাড়পত্র কবিতার মধ্যে চার ধরণের চরণ পেয়েছি।10 মাত্রার চরণ,14 মাত্রার চরণ,18 মাত্রার চরণ এবং 22 মাত্রার চরণ। কী চমৎকার মুক্তছন্দের প্রয়োগ করেছেন কবি। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মুক্তক মাত্রা ব্যবহারের কথায় আমরা আগেই এমন বিন্যাসের কথা উল্লেখ করেছি। এই 6,10,14,18,22,26,30,34,38 মাত্রার চলনই মুক্ত অক্ষরবৃত্তের চাল।
আমরা কবি জীবনানন্দ দাসের ‘আকাশনীলা’ গদ্য কবিতাটি মাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি:
আকাশনীলা
জীবনানন্দদাস
সুরঞ্জনা,ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,-18
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;-14
ফিরে এসো সুরঞ্জনা; 08
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;-14
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;-10
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;-10
দূর থেকে দূরে – 06
আরো দূরে যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।-18
……. …… ……
আকাশের আড়ালে আকাশে-10
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ;-10
তার প্রেম ঘাস হয়ে সুরঞ্জনা,14
ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,-10
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;-14
ফিরে এসো সুরঞ্জনা;08
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে; 14
…… ……….
কবি জীবনানন্দ দাসের এই কবিতাতে আমরা 6,10,14,18 মাত্রার চরণ পেয়েছি। শেষের দিকে ‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা’ চরণটিতে কেবল 08 মাত্রা পেয়েছি কিন্তু পরের চরণের 14 মাত্রার সাথে যার হিসেব যুক্ত করলে মোট মাত্রা 22 দাঁড়াবে। এরদ্বারা আবারো প্রমাণ হলো-গদ্যকবিতা ছন্দহীন নয়, বরং ছন্দবদ্ধ।
# কবি_শামসুর_রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটির মাত্রা দেখে নিতে পারি:
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।-26
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়-22
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে-22
শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন-22
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,-26
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,-14
(অংশ বিশেষ)
কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতার মুক্তছন্দের মাত্রা বিন্যাস আমরা লক্ষ্য করি-14,22,26 মাত্রা সম্বলিত চরণ। এসব কবিতা কী তবে ছন্দহীন, নাকী ছন্দবদ্ধ?
এপার বাংলা ওপার বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিপ্রাণ কবি আল মাহমুদ ছন্দের দোলা ছাড়া কবিতা হয় না বলেই দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ করেছেন। ছন্দের মায়াজালে আবর্তিত হবে কবিতা। কবিতা ও ছন্দ সম্পর্কে কবি আল মাহমুদের এই দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে এখান থেকে ঠিক চার বছর আগে দেয়া তার একটি সাক্ষাৎকারে। মনে পড়ে- প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী মোহাম্মদ নূরুল হক এবং শিশুসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী আবিদ আজম ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর ছোটকাগজ অনুরণনের পক্ষ থেকে আল মাহমুদের সাহিত্য ও সমাজ বিশ্লেষণ ধর্মী দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে কবির বাক পরিবর্তনের কথা, সমসাময়িক সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ কথার ছলে তুলে ধরেন কবি। উত্তরাধুনিক কবিদের জন্যে সেই সাক্ষাৎকার থেকে কবিতার ছন্দ বিষয়ক বক্তব্যটুকু এখানে কোড করলাম:
“# হক: আপনার লোকলোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিন এর পর বিরাট পরিবর্তন আসে মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো পর্বে। এরপর দ্বিতীয় ভাঙন পর্বে। কিন্তু আপনি যতই বিষয় আর আঙ্গিকের পরিবর্তন ঘটান না কেন, সব পর্বের কবিতায়ই ছন্দযুক্ত। কোথাও আপনি ছন্দ বর্জন করেন নি। ছন্দের নিয়মকানুন মেনে চলেছেন।
# আল মাহমুদ : ছন্দ ছাড়া তো কবিতা হয় না।
# হক: এখন যারা লিখতে আসছে, তারা তো ছন্দ না মানার স্লোগান দিচ্ছে…
# আল মাহমুদ: সেটা হয়, ছন্দ ছাড়া কবিতা? হাহাহহাহাহা। ওরা কী বলতে চায়?
# হক: ওরা বলতে চায়, ওরা ছন্দ মানছে না, ছন্দ ভাঙছে…
# আল মাহমুদ : কী ভাঙছে, ‘সবাই বলে ভাঙো ভাঙো, কেউ কি কিছু ভাঙে/ ষাটের দশক বগল বাজায় বউ নিয়ে যায় লাঙে।’ আমিই তো লিখেছি। সবাই বলে ভাঙো ভাঙো, কী ভাঙে তারা? ভাঙতে পারছে কই?”
আমার বিশ্বাস এতোক্ষণে আমার কবি বন্ধুরা উপলব্ধি করেছেন:
ছন্দ ছাড়া কবিতা লেখা যাবে না, কবিতা হবে না। আধুনিক কবিতা বা গদ্য কবিতার ছন্দটা কেমন হবে, অদৃশ্যমান বিরাম বা ছেদ চিহ্ন, মাত্রা পর্বের মাধ্যমে কিভাবে কবি তার অন্তর্জাত অভিব্যক্তিকে ভাষারূপ দেবেন তা নির্ভরকরে ব্যক্তির সৃজন শীলতার ওপর।
# কবি বানানো যায় না, কবি গড়া যায় না। কবিত্ব শক্তিকে সৃষ্টি করা যায় না। কবি ও কবিত্ব মহান স্রষ্টারই অপার দান। কবিতার অনুভব একান্তই পরম করুণাময়ের প্রদত্ত অনুভূতিসিক্ত। ইচ্ছে করলেই একজন কবি কবিতা লিখতে পারেন না। কবিতা লেখার জন্যে তার বুকের ভেতর প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হতে হয়, ভাঙা গড়ার তীব্র বেদনা বা ভালোবাসা সৃষ্টি হতে হয়- যা আর্টিফিসিয়াল বা কৃত্রিম কিংবা আরোপিত নয়; একান্ত স্বাভাবিক, ঝরনাধারার মতো উৎসারিত,কলোছলো নদীর স্রোতের মতো বেগমান; যার উৎস স্রষ্টা প্রদত্ত কবি মনের স্বচ্ছ বেলাভূমি।
কবিকে, কবিত্ব শক্তিকে হয়তো শাণিত করা যায়, কবির বোধের বিষয়গুলো আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে পরিশীলিত করা যায়, কবিত্ব শক্তি প্রবাহের গতিধারাকে মরিমার্জিত করা যায়। কাল বা সময়কে চিহ্নিত করে কবিকে প্রাণিত করা যায় নতুন বিষয়ে, নতুন আঙ্গিকে তার কবিত্ব শক্তিকে প্রবাহিত করার দিকে- যা সভ্যতার বিনির্মাণের অংশ হতে পারে, সমাজ বিপ্লবের প্রেরণা হতে পারে। কালে কালে, যুগে যুগে, দেশে দেশে কবি এবং কবিতাই হয়েছে তারুণ্যের শক্তি, বিপ্লব সংগ্রামের অমীয় উদ্দীপ্ত মন্ত্র।
কবির কবিতা অন্ত্যমিল প্রধান,সমিল প্রবহমান হোক আর নাহোক ছন্দ কবিতার শরীরে থাকবেই। ছন্দের সিম্ফনিতে উচ্চকিত হবে কবিভাবনা। যারা গদ্য কবিতা লিখতে চান, অন্ত্যমিলকে মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে খড়গ মনে করেন-তাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ছন্দোবদ্ধ অন্ত্যমিল প্রধান ছড়া কবিতা সাধারণ পাঠক মনে যে টেকসই ছবি আঁকতে সক্ষম- গদ্য কবিতা তার ধারে কাছে যেতে পারে না। গদ্য কবিতার পাঠক একমাত্র কবিই বলা যায়। আধুনিক গদ্য কবিতা বলতে যখন কেউ কেউ বলেন: “যা বুঝানো যায়না, বোঝা যায় না”।
এজাতীয় কবিতার তবে কী প্রয়োজন আছে সমাজ সংসারে- তা আমারও বুঝে আসে না। কবি যদি তার নিজের লেখাকে ব্যাখ্যা করতে না পারেন, পাঠক যদি তার লেখায় রসাস্বাদন করতে না পারেন-তবে এই গদ্য কবিতার নামে কাগজ কলম বিনাশ করার আদৌ কোন প্রয়োজন দেখি না। আমি মনে করি- কবিতা লিখতে গেলে রসাস্বাদন উপযোগী ভাব ভাষা ও অলঙ্কার উপকরণের মাধ্যমে করতে হবে। গদ্য কবিতার মধ্যে যে কবিতা গুলো পাঠকের মনে কষ্ট করে হলেও টিকে গেছে বা জায়গা করে নিয়েছে- তার কোনটাই ছন্দহীন নয়(দু একটা ব্যতিক্রম ছাড়া), ভাব ভাষা অধরা নয়, বক্তব্য উদ্দেশ্যহীন খামখেয়ালি বা হেয়ালীপূর্ণ নয়, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বিশাল ক্যানভাসকে ধারণ করেই নির্মিত হয়েছে যে কবিতার শরীর, যে কবিতায় বিমূর্ত মানুষের চিরকালীন আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি।
গদ্যকবিতা একান্তই যারা লিখতে চান, তাদের নিষেধ আমি করবো না। কারণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পর্যন্ত এবং সেই ধারাবাহিকতায় আজকের টিনএজ হাইব্রিড কবিও (!) গদ্য কবিতা লিখে চলেছেন অবলীলায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে- সবার কবিতা কিন্তু কবিতা হচ্ছে না, কারো কারো কোন কোন কবিতাই কবিতা হচ্ছে। যাদের কবিতা কবিতা হচ্ছে তারা ছন্দ জেনে বুঝে, ছন্দকে নতুনত্ব দিয়ে কবিতা লিখছেন। গদ্য কবিতাতেও তারা সচেতনভাবে ছন্দের প্রয়োগ করছেন। তার বিপরীতে ছোট চরণ,বড় চরণের আইডিয়া থেকে যেসব হাইব্রিড কবি গদ্য কবিতা লিখছেন- সময়ই বলে দেবে তাদের পরিণতি কী হবে, তাদের কবিতার অবস্থান কোথায় কিভাবে নির্ণিত হবে!
আলোচনার শেষ প্রান্তে আমি দু-একটি ছন্দবদ্ধ অন্ত্যমিল প্রধান কবিতার দৃষ্টান্ত দিই।দেখুনতো এগুলো কিভাবে আপনার মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে! এগুলোকে হাতুড়ী পেটা করেও মনের ভেতর থেকে বের করে দিতে পারেন কিনা আমাকে বলুনতো! যেমন:
কুটির
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারা বেলা কথা কয়,
কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দু’পার,
রূপসীর শাড়ি যেন তৈরি রূপার।
কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
পরনে খড়কে-ডুরে,
বেণী নাচে ঘুরে ঘুরে,
পায়ে পায়ে- ‘রুনু ঝুনু’ হালকা খাড়ুর,
কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।
আকাশে গড়িয়া ওঠে মেঘের মিনার,
তারি ফাঁকে দেখা যায় চাঁদের কিনার।
গাছের পাতার ফাঁকে,
আকাশ যে চেয়ে থাকে,
গুনগুন গান গাই, চোখে নাই ঘুম।
চাঁদ যেন আমাদের নিকট কুটুম।…
নৌকারা আসে যায় পাটেতে বোঝাই,
দেখে কী যে খুশি লাগে কী করে বোঝাই।
কত দূর দেশ থেকে,
আসিয়াছে এঁকে বেঁকে,
বাদলে ‘বদর’ বলে তুলিয়া বাদাম,
হাল দিয়ে ধরে রাখে মেঘের লাগাম।…
দু কদম হেঁটে এস মোদের কুটির,
পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
চাল আছে ঢেঁকি ছাঁটা,
রয়েছে পানের বাটা,
কলাপাতা ভরে দেব ঘরে-পাতা দই,
এই দেখ আছে মোর আয়না কাঁকই।
যদি আস একবার, বলি –মিছা না,
মোদের উঠোনটুকু ঠিক বিছানা।
পিয়াল, পেয়ারা গাছে–
ছায়া করে রহিয়াছে,
ধুঁধুলের ঝাঁকা বেয়ে উঠিতেছে পুঁই,
খড়কুটো খুঁজে ফেরে দুষ্টু চড়ুই।
এস এস আমাদের সোনার কুটির,–
ঝিকিমিকি করে জল নিটোল নদীর।
ঝিঙের শাখার পরে
ফিঙে বসে খেলা করে,
বেলা যে পড়িয়া এল, গায়ে লাগে হিম,
আকাশে সাঁঝের তারা, উঠানে পিদিম।
নোট: দুএক জায়গায় অন্ত্যমিলের সামান্য সমস্যা থাকলেও অসম্ভব ভালো লাগার মতো একটি কবিতা।
কবিকে সামনে পেলে আমার ভালোবাসাময় শ্রদ্ধা জানাতাম।
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
আসমানী
জসীম উদদীন (১৯০৩-১৯৭৬)
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্নাপাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারই তলে আসমানীরাই থাকে বছর ভরে।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের কখান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে দেছে দারুণ অভাব আসি।
পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে/ নাই কৌতুক- হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।
বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হলো তাই কেঁদে,
হয়নি সুযোগ লয় যে সেসুর গানের সুরে বেঁধে।
আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্মপুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিলবিলবিল করে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে।
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয় নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকেওষুধ করে পয়সা নাহি আর।
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
আযান
কায়কোবাদ
কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর,
বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কী মধুর আযানের ধ্বনি!
আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,
কী যে এক আকর্ষণে
ছুটে যাই মুগ্ধমনে
কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।
হৃদয়ের তারে তারে,
প্রাণের শোণিত-ধারে,
কী যে এক ঢেউ ওঠে ভক্তির তুফানে-
কতো সুধা আছে সেই/ মধুর আযানে।
নদী ও পাখির গানে/ তারই প্রতিধ্বনি
ভ্রমরের গুণ-গানে
সেই সুর আসে কানে
কী এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী।
ভূধরে, সাগরে জলে
নির্ঝরণী কলকলে,
আমি যেন শুনি সেই আযানের ধ্বনি।
আহা যবে সেই সুর সুমধুর স্বরে,
ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে,
প্রাণ করে আনচান
কী মধুর সে আযান!
তারই প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে।
নীরব নিঝুম ধরা
বিশ্বে যেন সবই মরা
এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোনো স্থানে,
মুয়াজ্জিন উচ্চস্বরে
দাঁড়ায়ে মিনার ‘পরে
কী সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে!
জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।
আহা কী মধুর ওই আযানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর
বাজিল কী সমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
কান্ডারী হুঁশিয়ার
কাজী নজরুল ইসলাম
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান!
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে, নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার!!
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!
গিরি-সংকট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ
কান্ডারী! তুমি ভূলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
‘করে হানাহানি, তবু চল টানি’, নিয়াছ যে মহাভার!
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।
ফাঁসির মঞ্চে যারা গেয়ে গেল জীবনের জয়গান,
আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!
#কৃষ্ণনগর; ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
আর খুব বেশি উদাহরণ বোধহয় গদ্য কবিদের বোঝার জন্যে দরকার নেই। বেগম সুফিয়া কামালের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই! তার পল্লীস্মৃতি কবিতা কী ভুলতে পেরেছেন:
বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল
ঝাউ শাখে যেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল!
পল্লী কবি জসিম উদদীনের সেই নিমন্ত্রণ কিংবা কবর কবিতা:
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়!
(নিমন্ত্রণ)
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে…
(কবর)
কবি জিতেন্দ্রনাথ বাগচী কী চমৎকার করেই না লিখে গেলেন:
বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে অই
মাগো আমার শ্লোক বলা কাজলা দিদি কই?
সব শেষে কবি আলমাহমুদের নোলক কবিতাটি সামনে আনতে চাই।
নোলক
আল-মাহমুদ
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণ বেড়ের বাঁকে
সাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে , দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরেক ফিরতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো ভাই পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরিনাতো!
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো।
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
আলোচনার শেষপ্রান্তে বলবো- কবিতা অগ্রসর হোক ছন্দের পথে , প্রাণের স্বাভাবিক আবেদনের পথে, আধুনিকতার নামে ছন্দহীনতার উপলব্ধি ডযন আমাদের স্পর্শ না করে। কাংলা কবিতায় আনা যেতে পারে নতুনন্ত্ব, ছন্দের নতুন দোলা। গদ্য কবিতাও হবে ছন্দোবদ্ধ সুরেলা- এই প্রত্যাশায় আজকের লেখার এখানেই ইতি টানছি।
মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা ,মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা, মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা, মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা, মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা,মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা,মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা.মুক্তছন্দ এবং আধুনিক কবিতা,
২৪ অক্টোবর-২০১৭