জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সাম্যবাদের কবি, ন্যায়ের কবি, ইনসাফের কবি। তেমনি নারী কবিতাটি তার অনন্য উদাহরণ। কবিতাটির মাধ্যমে তিনি নারীদের অধিকারের কথা, তাদের অবদানের কথা, তাদের সম্মানের কথা বলা হয়েছে। তিনি তার কবিতায় যে অমূল্য কথা বলেছেন তা হলো ‘’ বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’’ । নরিী কবিতা
নারী কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ এর অন্তর্ভুক্ত। সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে (পৌষ,১৩৩২) প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর বেশিরভাগই মানবিক ও সাম্যেরে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ১১ টি কবিতা রয়েছে । নারী কবিতা ছড়াও সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থে যে সব কবিতা রয়েছে-
১) সাম্যবাদী ২) ঈশ্বর ৩) মানুষ ৪)পাপ ৫) চোর-ডাকাত ৬) বারাঙ্গনা
৭) মিথ্যাবাদী ৮) নারী ৯) রাজা-প্রজা ১০) সাম্য ১১) কুলিমজুর।
নারী কবিতা লিরিক্স
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বলো, আদি পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছে যত ফল,
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য লক্ষ্মী নারী,
সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি’।
পুরুষ এনেছে যামিনী-শানি-, সমীরণ, বারিবাহ!
দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীতে হ’য়েছে বধূ,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে, নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হাল,
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটি মিশে
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।
স্বর্ণ-রৌপ্যভার,
নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হ’য়েছে অলঙ্কার।
নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।
নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে,
জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি’ কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।
রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী,
রাণীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।
পুরুষ হৃদয়-হীন,
আরও পড়ুন–ভালোবাসার কবিতা । বিপ্লবী চেতনা ও নারী প্রেমের আদ্যপান্ত
মানুষ করিতে নারী দিল তারে অর্ধেক হৃদয় ঋণ।
ধরায় যাঁদের যশ ধরে না’ক অমর মহামানব,
বরষে বরষে যাঁদের স্মরণে করি মোরা উৎসব,
খেয়ালের বশে তাঁদের জন্ম দিয়াছে বিলাসী পিতা,-
লব-কুশে বনে ত্যাজিয়াছে রাম, পালন ক’রেছে সীতা।
নারী সে শিখাল শিশু-পুরুষেরে স্নেহ প্রেম দয়া মায়া,
দীপ্ত নয়নে পরাল কাজল বেদনার ঘন ছায়া।
অদ্ভুতরূপে পুরুষ পুরুষে করিল সে ঋণ শোধ,
বুকে ক’রে তারে চুমিল যে, তারে করিল সে অবরোধ!
তিনি নর-অবতার-
পিতার আদেশে জননীরে যিনি কাটেন হানি কুঠার।
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর-
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
যুগের ধর্ম এই-
আরও পড়ুন–কবি আজিজ হাকিম এর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘’নাসেখ মানসুখ’’
পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই।
শোনো মর্ত্যের জীব!
অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!
স্বর্ণ-রৌপ্য অলঙ্কারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,
মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল!
যে ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু, ঊড়াও সে আবরণ,
দূর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন, যেথা যত আভরণ!
ধরার দুলালী মেয়ে,
ফির না তো আর গিরিদরীবনে পাখী-সনে গান গেয়ে।
কখন আসিল প্নুটো যমরাজা নিশীথ-পাখায় উড়ে,
ধরিয়া তোমায় পুরিল তাহার আঁধার বিবর-পুরে!
সেই সে আদিম বন্ধন তব, সেই হতে আছ মরি
মরণের পুরে; নামিল ধরায় সেইদিন বিভাবরী।
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি’!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদিন শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!
নারী কবিতা আবৃত্তি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
নারী কবিতা কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৪শে মে, ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ (১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ); বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ; এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন।
শিক্ষাজীবন প্রাথমিক শিক্ষা : গ্রামের মক্তব থেকে প্রাথমিক শিক্ষালাভ।
মাধ্যমিক : প্রথমে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, সর্বশেষ ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।
কর্মজীবন/পেশা: প্রথম জীবনে জীবিকার তাগিদে তিনি কবিদলে, রুটির দোকানে এবং সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীতে পত্রিকা সম্পাদনা, গ্রামোফোন রেকর্ডের ব্যবসায় ও সাহিত্য সাধনা করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম এর উল্লেখযেগ্য রচনাবলী:
কাজী নজরুল ইসলাম এর কাব্যগ্রন্থ :
অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙার গান, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণি-মনসা, জিঞ্জির, সন্ধ্যা, প্রলয়-শিখা, দোলন-চাঁপা, ছায়ানট, সিন্ধু-হিন্দোল, চক্রবাক।
কাজী নজরুল ইসলাম এর উপন্যাস :
বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা।
কাজী নজরুল ইসলাম এর রচিত গল্পগ্রন্থ :
ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা। নাটক : ঝিলিমিলি, আলেয়া, মধুমালা, পুতুলের বিয়ে।
কাজী নজরুল ইসলাম এর প্রবন্ধগ্রন্থ :
যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, রুদ্র মঙ্গল।
কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবনীগ্রন্থ : মরুভাস্কর [হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনীগ্রন্থ
কাজী নজরুল ইসলাম এর অনুবাদ গ্রন্থ : রুবাইয়াত-ই-হাফিজ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম।
কাজী নজরুল ইসলাম এর গানের সংকলন : বুলবুল, চোখের চাতক, চন্দ্রবিন্দু, নজরুলগীতিকা, সুরলিপি, গানের মালা।
কাজী নজরুল ইসলাম এর সম্পাদিত পত্রিকা :
ধূমকেতু, লাঙ্গল, দৈনিক নবযুগ।
কাজী নজরুল ইসলাম যেসব পুরস্কার ও সম্মাননায় ভুষিত হন:
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ এবং ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি লাভ। রবীন্দ্রভারতী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি. লিট ডিগ্রি (১৯৭৪) প্রদান করে। তাছাড়া ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার কবিকে ‘একুশে পদক’ প্রদান এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে।
জীবনাবসান মৃত্যু তারিখ : ২৯শে আগস্ট, ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ (১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ); সমাধিস্থান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণ।