অন্ত্যমিল-পর্ব-২
অন্ত্যমিলের ১ম পর্বের আলোচনায় অন্ত্যমিলের কিছু ধরণ বা প্রকৃতি তুলে ধরেছিলাম। কিভাবে অন্ত্যমিলের ধ্বনি সাদৃশ্য হতে পারে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কথা সেখানে আছে। সাধারণ অন্ত্যমিলের পাশাপাশি প্রচলিত কিছু অন্ত্যমিলের কথা আজ শুরুতেই বলে রাখি।
তুলে+ভুলে যেমন খাসা অন্ত্যমিল, অনেক কবির লেখায় এমনটি পাওয়া যাবে না। যথাযথ অন্ত্যমিলের জন্যে মূলত বর্ণ ও স্বরধ্বনির সমব্যবহার বা সাদৃশ্য প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কিছু কিছু লেখায় এর ব্যতিক্রম আমরা লক্ষ্য করি। যেখানে সম বর্ণের ব্যবহার হয় নি, কেবল সম স্বরধ্বনির প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু কানে সেটা মানিয়ে গেছে। যেমন:
“ঐ দেখা যায় তালগাছ
ঐ আমাদের গাঁ,
ঐখানেতে বাস করে
কানাবগীর ছা।”‘
কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিনের বহুল পঠিত এই কিশোর কবিতাটিতে গাঁ+ ছা অন্ত্যমিল দেয়া হয়েছে স্বরধ্বনির সমতার ভিত্তিতে। অনুরূপভাবে সমধ্বনি বিশিষ্ট অব্যয় ও সর্বনাম পদের অন্ত্যমিল আমরা পাই। যেমন:
যে+সে, কে+যে, কি+ছি প্রভৃতি।
অথবা,
“ধান ফুরালো পান ফুরালো
খাজনার উপায় কি,
আর কটাদিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।”
এই বহুল পঠিত ও পরিচিত ছড়ার অন্ত্যমিল “কি+ছি”( মধ্যখণ্ডনের পরের ছি)। এখানে সম স্বরধ্বনির প্রয়োগে (ি/ই-কার) অন্ত্যমিল হয়েছে।
মনে রাখতে হবে যে, সর্বনাম জাত বা অব্যয় জাত এবং কেবল সম স্বরধ্বনির প্রয়োগ বিশিষ্ট অন্ত্যমিলসমূহ কদাচিৎ চোখে পড়ে। এজাতীয় অন্ত্যমিল ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’র শামিল।যতদূর সম্ভব এজাতীয় অন্ত্যমিল পরিহার করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এবার বলি উচ্চমার্গীয় কবিতার অন্ত্যমিল বিষয়ে
আমরা এতোক্ষণ যে আলোচনাটা করেছি, তা ছড়া, কিশোর কবিতা, গানের ক্ষেত্রে বেশি প্রজোয্য। বড়দের কবিতা বা উচ্চমার্গীয় কবিতার ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ চোখে পড়বে। তবু বিশেষভাবে নোট দিয়ে রাখা প্রয়োজন মনে করছি আমি। বড়দের বা উচ্চমার্গীয় কবিতায় অন্ত্যমিলগুলো অনেক সময় এতোটা খাসা হয় না, দৃশ্যমান হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দূরবর্তী সমতা, স্বরের মিল দেখা যায়। তবে যারা শক্তিমান কবি তারা তাদের মাত্রা বা অক্ষরবৃত্তীয় কবিতাতেও নিটোল অন্ত্যমিলদানে সচেষ্ট থাকেন। যথাযথ অন্ত্যমিল দিতে গেলে বিপুল শব্দের সাথে লেখকের আত্মীয়তা থাকতে হবে। শব্দভাণ্ডারের যথাযথ দখল ছাড়া কবিতাসহ কোন সৃজনশীল কাজকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নেয়া কঠিন।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চোখ বুলোতে পারি:
“”হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথীবির পথে।
সিংহল সমূদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালায় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার আশোকের ধুসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক ;
চারিদিকে জিবনের সমূদ্র সফেন ; আমারে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতাসেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মূখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য , অতিদূর সমূদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়াছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর ,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে , বলেছে সে এতদিন কোথায় ছিলেন ?
পাখির নিড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
পৃথীবির সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ; সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ- জিবনের সব লেনদেন ; থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন ।””
{{জীবনানন্দ দাশ}}
এই কবিতার অন্ত্যমিল অনেকটা দূরবর্তীধর্মী। কবি জসীম উদ্দীনের নিমন্ত্রণ বা কবর কবিতার মতো প্রত্যক্ষ অন্ত্যমিল নয়।
কবি ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি কবিতার অন্ত্যমিল প্রত্যক্ষ করতে পারি:
“কতো যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হলো জানিনা তা।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা,
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা,
তবু তুমি জাগলেনা,তবু তুমি জাগলেনা।”
///আরো পড়ুন– ছন্দ শেখার পাঠশালা- পর্ব-১ ///
আমার “ছন্দ শেখার পাঠশালা” ছন্দবিষয়ক কিশোর কবিতার একটা অংশে অন্ত্যমিল প্রদানের একটা কাঠামো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি বেশ আগেই। সেখানে একটু চোখ বুলিয়ে আসা যাক।
“অন্ত্য মিলের রহস্যটা এবার দেবো খুলে
‘চরণ শেষে ধ্বনির মিলন’-কেউ যেয়ো না ভুলে।
যেমন দেখো : মনের ‘ভুলে’ গোলাপ ‘তুলেড’তুমি-
নিজের হাতে দাও পরিয়ে শ্রাবণ মেঘা ‘চুলে’।
::::
অন্ত্যমিলটা হতেই পারে বিচিত্র এক খেলা
পর চরণের প্যারায় যদি ভাসাও মনের ভেলা
প্রথম-দোসরা,তেসরা-চৌঠার মিলতে পারে ধ্বনি-
প্রথম-তেসরা,দোসরা-চৌঠারয় জমতে পারে মেলা।
::::
চার চরণেও আসতে পারে একই ররম ধ্বনি
প্রথম চৌঠা,দোসরা তেসরায় হয় যে সমাপনী,
প্রথম দোসরা চৌঠা সমিল অমিল শুধু তেসরায়-
এমন করেই মিলের তারায় সুরের আগমনী।”
এই কবিতাংশে যা বলতে চেয়েছি, তা গদ্যে একটু বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো। অন্ত্যমিল প্রসঙ্গে প্রথম পোস্টে অনেক কথাই বলেছি। প্রথম পর্বটা যারা না দেখে দ্বিতীয় পর্ব সামনে পেয়েছেন তাদের অবগতির জন্যে অন্ত্যমিল সম্পর্কে আবার একটু বাড়তি বিশ্লেষণ করতে চাই।
অন্ত্যমিল ছড়া,কবিতা ও গানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। অধিকাংশ পাঠক অন্ত্যমিলকে ছন্দজ্ঞান করে বড্ড গরমিল করে ফেলে ছড়া কবিতার আলোচনায়। ছন্দ আর অন্ত্যমিল কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো বিষয়। ছন্দ হচ্ছে লেখার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, বিন্যাস বা বাঁধন।
ছন্দ ছাড়া কোন ছড়া, কবিতা বা গান লেখা সম্ভব নয়। ছন্দ অপরিহার্য একটি বিষয়। অনেকে আধুনিক কবিতা মুক্ত ছন্দে লেখার কথা বলেন, বলেন গদ্য ছন্দ বা গদ্য কবিতার কথাও। সাধারণভাবে এজাতীয় লেখায় কোন ছন্দ নেই বলে কেউ কেউ মনে করলেও-তা কিন্তু ঠিক নয়। আধুনিক কবিতা হোক, গদ্য কবিতা হোক, মুক্ত ছন্দের কবিতা হোক- ছন্দ তাতে থাকবেই কবির হাতেই যদি তা লিখিত হয়ে থাকে। অকবিদের কষ্টকাব্যের কথা এখানে আর নাইবা বলি।
অপর দিকে অন্ত্যমিল হচ্ছে চরণের শেষ শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্য। যা কবিতার জন্য অপরিহার্য বিষয় নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অন্ত্যমিল ছাড়াও কবিতা লেখা যায়, কিন্তু ছন্দ ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি কবি জসীম উদদীনের কবর কবিতা থেকে:
এইখানে তোর/ দাদির কবর/ ডালিম গাছের/তলে
তিরিশ বছর/ ভিজায়ে রেখেছি/ দুই নয়নের / জলে।…
এইদুটো চরণের শেষ শব্দের ধ্বনি সাদৃশ্য দেখেন- তলে এবং জলে। কী সুন্দর ধ্বনিগত সাদৃশ্য।মনে রাখার মতো মিল। এই মিলটা অন্ত্য বা শেষে হবার কারণে তার নামটাও দেয়া হয়েছে-অন্ত্যমিল।
অন্যদিকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতাটি দেখুন:
এসেছে নতুন শিশু
তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ মৃত আর ধ্বংস স্তূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের;
চলে যাবো ,তবু আজ যতোক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল।
সুকান্তের এই বহুল পঠিত ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতাটিতে অন্ত্যমিল নেই, কিন্তু ছন্দ আছে।
একজন সফল ছড়াকার, কবি বা গীতিকার তার ইচ্ছে মতোন অবশ্যই অন্ত্যমিল দিতে পারবেন, যদি তিনি প্রতিটি ছন্দের অন্তর্গত প্রাণশক্তি ধারণ করতে পারেন, কানকে সজাগ রেখে চরণের গতিকে ধরে রাখতে সক্ষম হন। গানে উনিশ বিশ কী নিরানব্বিই একশত এই তারতম্য টুকুনও কেমন জানি লেখকের ব্যর্থতা ও দৈন্যকে প্রকট করে তোলে।
প্রচলিত অন্তমিলের কয়েকটি ধারণাকে (চার চরণ বিশিষ্ট স্তবকের অন্ত্যমিল) নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ
খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ
গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ
ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি)
ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ
চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি)
এর বাইরেও বিচিত্র অন্ত্যমিল দেয়া যেতে পারে। তবে একটি গানের মধ্যে এক এক প্যারায় এক এক রকম না করে প্রথম থেকে শেষ পর অবধি একই রকম অন্ত্যমিল ও মাত্রা বিন্যাসকেই আমরা আদর্শ বলতে পারি।
নিরীক্ষার নামে যাতে কোন বিশৃঙ্খলার সুযোগ তৈরি না হয়, তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। প্রচলিত কয়েকটি অন্ত্যমিলের দৃষ্টান্ত নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক) ১ম চরণ+৩য় চরণ এবং ২য় চরণ+৪র্থ চরণ :
সকল জীবের তুমি খালিক
তুমি অশেষ একক অসীম,
দোজাহানের তুমি মালিক
তুমি গাফুর মহা মহীম।।
খ) ১ম চরণ+২য় চরণ এবং ৩য় চরণ+৪র্থ চরণ):
মল বাজিয়ে মেঘের খামে
সারা দিনই বৃষ্টি নামে,
বৃষ্টি নামে ফোটায় ফোটায়
কদম কেয়া ফুলের বোটায়।
গ) ১ম চরণ+৪র্থ চরণ এবং ২য় চরণ+৩য় চরণ:
সোনার দেশে সোনার মানুষ কই
যেদিক তাকাই ডাকাত এবং চোর
গুমের ভয়ে আটকে রাখি দোর
আমরা তবু চুপটি করে রই।
ঘ) ২য় চরণ+৪র্থ চরণ (১ম চরণ এবং ৩য় চরণ ফ্রি):
অলসতা কেউ করি না
উঠি সকাল বেলা,
ভালো করে মুখ ধুয়ে নিই
কেউ করি না হেলা।
ঙ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৩য় চরণ+৪র্থ চরণ :
স্বপ্ন আমার সবুজ শীতলপাটি
জোয়ার ভাটার নিরেট পলিমাটি
স্বপ্ন বোনার স্বপ্নে বিভোর হাঁটি
স্বপ্ন তবু হয় না পরিপাটি।
চ) ১ম চরণ+২য় চরণ+৪র্থ চরণ (৩য় চরণ ফ্রি):
পায়ের নিচে সবুজ শ্যামল ভূমি
জোছনা নেমে যায় যেন তার চুমি
ফারাক্কার ঐ মরণ বাঁধের ফলে-
বাঁচা মরার সংগ্রামে আজ তুমি!
এর বাইরেও আরও বিচিত্র্য অন্ত্যমিল দেয়া যাবে। শব্দচাষীরা তাদের শব্দের আবাদ কিভাবে করবেন, কিভাবে নিজে দুলবেন, ছন্দের দোলায় পাঠককে দোলাবেন এটা তার নিজস্ব সৃজনশীলতা আর সামার্থ্যের বিষয়। অন্ত্যমিল নিয়ে আর আলোচনাকে দীর্ঘায়িত না করে আগামী কবির সৃজনশীলতা বিচিত্র মননশীলতার ওপর ছেড়ে দিলাম। কবিতা আবার ছন্দে ফিরবে, আবার অন্ত্যমিলের সুরেলা দোলায় দুলবে সেটাই আমার ঐকান্তিক প্রত্যাশা।
নরসিংদী
১জুলাই-২০১৮